১২

ছাদের ঘরের দিকে ছাইরঙের দরোজা ঠেলে অরিন্দম দেখল, কুচোকাঁচা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাশেষ ছেলেমেয়ের দল, যে যার মতন নেচে যাচ্ছে, হাত তুলে কোমর বেঁকিয়ে । একজন ফ্রক উড়িয়ে শাস্ত্রীয় নাচের অঙ্গভঙ্গী করছে ইউরোপীয় বাজনার তালেতালে, বোধয় শাস্ত্রীয় ভারতীয় নাচ শেখে, কুচিপুড়ি ভারতনাট্যম কোনো-একটা হবে । ঘরে ঢুকতেই অরিন্দমকে ঘিরে ধরে সবাই । বড়দা-মেজদার মেয়ে দুটো অরিন্দমের হাত ধরে অরিকাকু অরিকাকু বলে হাঁক পাড়ে । এদের দুজনকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না অরিন্দম । কেউ গিয়ে বাজনা বন্ধ করে । জামায় তীব্র হুইস্কির গন্ধ আর প্যান্টময় খাপচা লাল রং যে এরা কেউই অনুমোদন করছে না, ভুরু কোঁচকানো অনুসন্ধিৎসা দেখে আঁচ করে অরিন্দম । বলল, খাইনি আমি, বমি পায়, ওদের গেলাস থেকে চলকে পড়েছে । এই কচিকাঁচাদের কাছে নিজের দুর্বলতা মেলে ধরে কিছুটা ভারমুক্ত বোধ করল অরিন্দম । বয়সের সাহায্যে নিচের তলায় আর ওপর তলায় আনন্দের মুহূর্ত গড়ে নিয়েছে এই বাড়ির সদস্যেরা । ওই বা কেন যে বঞ্চিত হয় আনন্দের পরিসর থেকে !  কেন যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা !

বালক-বালিকাদের মাঝে ভালো লাগে ওর, অরিন্দমের । আশ্বস্ত বোধ করে । পাটনায়, অফিসের লাঞ্চটাইমে পাশের নার্সারি স্কুলের ছুটি হত । ছোটো-ছোটো খোকা-খুকুর ছুটির হইচইয়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত অরিন্দম, দাঁড়িয়ে থাকত বেশ কিছুক্ষণ । চারিদিকে অজস্র কচি ছেলেমেয়ের ছোটাছুটি আর কোলাহলের মাঝখানে চুলচাপ দাঁড়িয়ে থাকত ও । পুজো আর গ্রষ্মে যখুন ইশকুলটা বন্ধ থাকত তখুন মন খারাপ লাগত অরিন্দমের । এখানে, কলকাতায় বি-বা-দী বাগে ওর অফিসের কাছে ইশকুল নেই । এই অফিস পাড়াটায় বালক-বালিকাদের প্রবেশাধিকার নেই । আজ পর্যন্ত কোনও ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের এই এলাকায় দেখতে পায়নি  ও, অরিন্দম ।

ওর সামনে হিচইরত ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে বুঝতে পারছিল অরিন্দম, ওকে বিশ্বাস করছে না এরা । শিশু কিশোর তরুণদের চেখে এখুন আগের প্রজন্ম সন্দেহজনক । জনকেরা সন্দেহজনক । মেজদার বড়ো মেয়ে এই ফাঁকে বাবার জামা-প্যান্ট এনে দিয়েছে । যাও, নিচে বাথরুমে চান করে পাউডার মেখে পালটে এসো, গিজার আছে ।

চান করে, জামা-প্যান্ট পালটে এসে বসলে, কাছে এসে মুখ থেকে গন্ধ শুঁকে আশ্বস্ত করে নিজেদের , শাড়ি-পরা উচ্চ-মাধ্যমিক, চুড়িদার মাধ্যমিক । এদের মধ্যে সবচে ছোটোটা, তুলতুলে বছর তিনেকের, পায়ে রুপোর মল, বিস্ফারিত তাকায় । কোলে চাপতে চাইছে । তুলে নিলে, কাঁধে মাথা রাখে । ঘুমের গন্ধ আসছে শিশুটির মুখ থেকে । কত ভালো লাগে এই গন্ধ ।

তোদের খাওয়া হয়েছে তো ?

সমস্বরে, হ্যা আ্য আ্য আ্য আ্য আ্য, সন্ধেতেই । আজ তো ভুরিভোজ ছিল ।

জানলা দিয়ে দেখা যায়, বাতিস্তম্ভের আলোয় , বাড়ির পেছনের থমথমে পানাপুকুর । একগাল হাসিমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে ঝাঁকড়া স্হলপদ্ম । পুকুরের দক্ষিণে বৈদগ্ধ্যে ভারাক্রান্ত আমগাছ , স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে থাকবে, ফলহীন । পুকুরের এদিকে জানলার তলায়, গোলাপ ঝাড় দুহাত তুলে খরচ করছে মোলায়েম সুগন্ধ । গাছগুনোর পাতাকে ফুঁ দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে অন্ধকার । লাস্যময়ী বাদলাপোকারা ঘরে ঢুকেই, ডানার ওড়না ফেলে দিচ্ছে পার্ক হোটেলের ক্যাটওয়াকে মডেলখুকিদের ঢঙে । অন্ধকারে তিরতির কাঁপা কৃষ্ণপক্ষের কনকনে আকাশে ভিজেভিজে বিদ্যুতের শব্দহীন আলো । কোনও প্রতিবেশির বাড়িতে উদাত্তকন্ঠ অ্যালসেশিয়ানের রোমশ ডাকের তরঙ্গ ।

পাঁচ-সাত বছরের গালে-টোল ফরসা দুঝুঁটি এগিয়ে আসে । তুমি কে গো ও ও ও ?

আমি ? আমি হ্যামেলিনের কেটলিওলা । অরিন্দম কথাটা বলেই থ । এখনও তো কেটলিউলি অদেখা । তবে ?

তুমি বাঁশি বাজাতে জানো ?

বাঁশি ? উঁহু, জানি না ।

তবে কেটলড্রাম বাজাও ?

না, তাও জানি না ।

লিটলুটা ঘুমিয়ে পড়েছে কেটলিকাকুর কোলে ; টুম্পা ওকে শুইয়ে দিয়ায় । আলো জ্বেলে মশারি টাঙিয়ে দিস । পিগটেল ফ্রকপরার হুকুম মান্য করে ববছাঁট ফ্রকপরা ।

কেটলিকাকু, তুমি গান জানো ? জানতে চায় ক্লস নাইনের পরীক্ষামুক্ত কিশোর ।

গান । মমমমমমম, ভেবে দেখি । গানের কিছুই জানে না অরিন্দম । কী করে লোকে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্র নজরুলের গানের সুরের তফাত বোঝে, ঠাহর করতে পারে না ও, পারেনি। গানের আলোচনায় কুন্ঠিত বোধ করে । ওর সামনের ফ্ল্যাটে লরেটোতে পাঠরতা কিশোরী তিনচারটে গান কতকাল যাবৎ সেধে যাচ্ছে, সকালের আলো ফুটলেই, অবিরাম । শুনে-শুনে সুর আবছা মুখস্হ হয়ে গেছে অরিন্দমের । খোকাখুকু শ্রোতার মাঝে চেষ্টা করা যেতে পারে । শ্রোতাদের সামনে নিজেকে গান শোনানোর ভালই সুযোগ । শ্রোতারা যখুন অত্যুৎসাহী ।

কই গাও । গাইছি ।

মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কল্লে না যে । ঠাকুর পাপ দেবে । গাইবার আগে, নাচবার আগে, পড়তে বসে, মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কত্তে হয় । বিদেশী বাজনার তালে স্বদেশী নাচছিল যে কিশোরী, তার উপদেশ ।

অরিন্দম চোখ বুজে হাতজোড় করেছে । মগজের মধ্যে একাগ্র ভগবদভক্তি কী করে জোটায় কেউ-কেউ ? ব্যাপারটা ঠিক কী ? কোন উপায়ে অমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘটে ! আমি কেন ওই বোধ থেকে বঞ্চিত ?

জীবনে প্রথমবার ও, অরিন্দম, সিরিয়াসলি গান ধরে :

II { স..সপা…T পা…পধা…ধপহ্ম-T হ্ম…হ্মা…গসাঃ… I সগঃ…সপা…TI

সাঁ….ঝে০….রপা….খি….রা০০…০…ফি…রি…ল০….০কু…লা০…য়

I গহ্ম…ক্ষণা…নর্সা…ধনা…পাঃ I পহ্মগঃ…হ্মপা-T – T গমাগমা…গরসা }I

তু০…মি০…ফি০…রি০…লে০…না ০০০ ঘরে ০  ০ ০০০০  ০০০

I প…পনা—TI  না….সর্ণা….র্সর্সনধা I ধনা…পধর্নারা…র্সনধা I ধনা…ধপা–TI

আঁ….ধা০….র…ভ…ব০….০০০ন…জ্ব০…লে০০০…নি০০…প্র০…দী০…প

I  সা….রা….রা….I  রা…গহ্মপধা….গহ্ম I  – T হ্মপা- TI  গমা…গগা…রসা I

ম…ন…যে…কে…ম০০০…০ন….০করে…০….০০…০০…০০

ভুল ভুল ভুল ভুল, জানোওওওওনা, হলোওওওনা । হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শাড়িপরা উচ্চমাধ্যমিক ।

অরিন্দম স্তম্ভিত । ঠাহর করতে পারে না গানের হওয়া না হওয়া । অথচ গাইতে-গাইতে বিভোর আত্ম্রীতিতে আক্রান্ত হয়েছিল । কোকিল যেভাবে কাককে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, ও-ও নিজেকে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল অচেনা আনন্দের পরিসরে ।

হ্যাঁ, তুই বড়ো কুমার শানুর মা এসচিস । মাধ্যমিক অরিন্দমের পক্ষে ।

তুমি তো মিশ্র ইমনে গাইছিলে । গানটা তো নজরুলের, মিশ্র মল্লারে হবে । তুই গেয়ে শোনা দেখি । মাধ্যমিক চ্যালেঞ্জ জানায় ।

উচ্চমাধ্যমিক বসে পড়ে মেঝেতে । চোখ বোজে । কোলে হাত । প্রথমে গুনগুন । তারপর গান ধরে ।

II { সা   মরা   মা I পা  ধা ণা I ণা  ধপা  মপধাঃ I পঃ মজ্ঞা    রসা I

সাঁ    ঝে০    রা   পা  খি   রা    ফি রি০ ল০০০ কু  লা০       ০য়

I স   সরজ্ঞা   রা  I সা    ণা ধ পা I  পনা    না   সা  I   সা   সা   র্সা }

তু    মি০০   ফি   রি   লে   না      ঘ   ০   ০              রে   ০   ০

I মা    মরা     মা  I   মপা   পাধ    মপাঃ I    মঃ    পা সর্ণা  I  ধা   পা  পা I

আঁ     ধা০    র      ভ    ব    ন                জ্ব   লে  নি          প্র   দী   প

I পধা    পধা   পমা I   গা   মগা    রসাণ  I  না   সা   গা I   রগা   মা  মা I

মা০     ০ন    যে      কে   ম০     ০ন        ক     রে০        ০০   ০    ০

কেটলিকাকু, আমিও গান জানি । নাদুস কিশোরের প্রস্তাব ।

গাও তাহলে, শুনি ।

আমমি চিন্নিগো চিন্নি তোমাআআড়ে ওগ্গো বিদেশিন্নি, তুমি থাআআআকো শিনধু পাআআআড়ে….

অরিন্দমের হাসি পেয়ে যেয় । দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকাদের কী সর্বব্যাপী প্রভাব । অত্যন্ত জোরে হেসে ফ্যালে ও কিশোরটিকে জড়িয়ে ধরে । অট্টহাস্য । দিলখোলা হাসি । হাসতেই থাকে । এভাবে খোলামেলা হাসেনি বহুকাল । হাসতে-হাসতে ভালো লাগে ওর । ওর দেখাদেখি সবাই হাসতে থাকে । সব্বাই ।

অতর্কিতে, বাইরে থেকে, বাঁদিকের বন্ধ জানলার ফুলকারি ঘষাকাচের শার্শির ওপর ভারি একটা ঢিল পড়তে, থমকে থেমে যায় হাসি । সবায়ের মুখমণ্ডলে আতঙ্কিত অনুসন্ধিৎসা । শার্শির ঠিক মাঝখানে, যেখানে ইঁটটা পড়ল, সেখানে ঘাপটি-মারা ছোট্টো মাকড়সাটা সেই মুহূর্তে, তক্ষুনি, কাচের বুক জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের আলোকিত তন্তুজাল, শার্শির ফ্রেমের কোণে-কোণে ।

কেভ রে হারামজাদার বাচ্চা । গালাগালটা অরিন্দমের নিজেরই ভয় কাটাবার উপায় হিসাবে আরেকটু হলেই , এতগুলো কচিকাঁচা কিশোর-কিশোরীর সামনে বেরিয়ে যেত । ঠিক তখুনই, খোলা জানলাটা দিয়ে, ওরা দেখতে পেল, হ্যালোজেনের আলোয়, মাছরাঙার ঢঙে ছোঁ মেরে, ছোটো-ছোটো অগুনতি সাদা বরফের ছররা, ঝেঁপে নাবছে পানা-পুকুরের দাম সরিয়ে , মটকা-মেরে ঘুমোবার ভানরত কালবোস-কাতলার ওপর । জলতলের ওপরে লাফিয়ে উঠল কয়েকটা সোমথ্থ রুই ।

সাদা বরফ টুকরোর টিমটিমে প্রভায় উদ্ভাসিত হয় খোকাখুকুদের কচি-তুলতুলে মুখগুলো । পৃথিবীর মাটিতে নাবার আহ্লাদ-মাখানো শিলাবৃষ্টির খই খাবার নেমন্তন্নে, ছাদের দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে আগত টুকরো মুখে পোরে মিনি টিঙ্কু টুম্পা তাতাই বুবুন খোকন বাবাই টুঙ্কা হাবলু গাবলু ।

অরিন্দম জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । ফুঁ-এর মতন মুখময় বিচরণকারী আরামপ্রদ হাওয়ার আদর ।  গাছের পাতাদের গা শিরশির করছে ঠাণ্ডায় । বরফ-পাথরের টুকরো মেরে-মেরে ভ্যাপসা গরমকে তাড়িয়েছে বৃষ্টি । শিলাদের নাচের তাল ক্রমশ বিলম্বিত হয়ে থেমে যায় । বিদ্যুচ্চমকে, পুকুরের জলকে সর্পিল করল হেলে সাপ ।

দুকানে দুহাত চাপা দিয়ে তাতাই বলে ওঠে, যাআআআআআ ।

কেন ? কী হল ?

এবার আর হিমসাগর খাওয়া হবে না । সঅঅঅঅঅব ঝরে গেল ।

1 thought on “১২

  1. মলয়বাবু,
    আগে আমাদের পরিচয়টা দিই। তার পরে অন্য কথা।
    আমরা কলাবতী মুদ্রা, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের সদস্য। আমাদের কয়েকটি ওয়েবসাইট রয়েছে তার মধ্যে lokfolk.blogspot.com, একটি। আমরা, বাংলার পারম্পরিক শিল্পীরা একত্রিত হয়েছি। বিশ্বায়নের চাপে ভাঙতে থাকা ভারতের পারম্পরিক পরিকাঠামো, সম্পদ রক্ষায় নিজেদের ব্রতী করেছি। পূর্বজদের তৈরি পুরনো ইতিহাস, প্রযুক্তি, কিছুটা হলেও নথি করছি। পশ্চিমীরা নিজেদের সভ্যতা বাঁচাতে, ভারতেতিহাসের যে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছে, তাকে ধ্রুব সত্য বলে মানতে রাজি নই। প্রশ্ন করছি নিজেদের। উত্তরও খুঁজছি আমাদের পূর্বজদের কাজে, ভাবনায়, মাটিতে দাঁড়িয়ে। এটি শিল্পীদের জন্য সংগঠন নয়, শিল্পীদের সংগঠন।
    আমরা ভাজপা বা হিন্দু রাজনীতির মানুষ নই। এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা – এই স্লোগান ইওরোপের। অকেন্দ্রিত গ্রামীণ ভারত, বহুধরমী, বহু জাতিক, বহু আচারিত, বহু ভাষার ভারতের স্বপ্ন দেখি। ভারত যদি ইয়োরোপ-আমেরিকা না বনতে চায়, তাহলে ভারতকে গ্রামে ফিরতে হবে, শহরভিত্তিক সংসদীয়, বিচার, আমলাতান্ত্রিকতা ছেড়ে পুরনো পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় ফিরতে হবে। ভাজপারা ইয়োরোপের আদলে আসলে জাতি রাষ্ট্র চাইছে। আমরা এর সম্পূর্ণ বিরোধী।
    প্রথমেই কবুল করেনেওয়া ভাল,এ ধরণের উপন্যাস আগে পড়িনি। বহিরঙ্গে পাশ্চাত্যধর্মী খুনি স্বভাবের (ভারতপথিক ধরমাপালজি বলেছিলেন ইওরপিয়ানরা স্বভাবতঃই খুনি), অন্তরে বাংলা মায়ের মত কোমল। আমরা যদিও খুব কম পড়েছি, তবুও খুব নম্রভাবে বলি, আগে এত বিস্তৃতভাবে, এই সময়ের রাঢ বাংলার কৃষি এবং কৃষি পরিকাঠামো নিয়ে কোনও আলোচনা, গল্প পড়িনি। শহুরে বাংলায় জাতপাত নিয়েও হা হুতাশ দেখেছি, বাংলার সমাজ কেন পশ্চিমেরমত হলনা। হাহুতাশ দেখেছি, কেন ব্রিটিশ বাংলার বিকাশ শিল্পবিপ্লবীয় ঢঙে হলনা। সেই ভাবনায় আপনি কিছুটা সামিল হয়েও কাঁদুনি গাননি। বলেছেন লৌকিক বাঙ্গালিয়ানা মানেই যে ব্রিটিশপূর্ব সময়ে যে মানুষেরা বাংলা গড়েছিলেন (সেই গ্রামীণ শিল্পী, কারিগরেরা – যারা বাংলার বিশ্বজয়ী, অকেন্দ্রিভূত, ছড়ানো, অনিয়ন্ত্রিত কিন্তু অসম্ভব কুশলী শিল্প, কৃষি, বণ্টন, ব্যবসা, শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন), তাদের যাপনকথা, তাদের ভাবনার জরুরিভাবটি আপনি এই উপন্যাসের অন্তরে এঁকেছেন।
    আদতে এই মানুষেরা দারশনিকভাবে যে গ্রাম্যতার(শহুরে সভ্যতা আদতে নিরবিচ্ছিন্ন খুনের ইতিহাস) পরিকাঠামো তৈরি করেছিলেন সচেতনভাবে, তাকে শহুরে বাঙ্গালিরা ব্রিটিশ পদানুজায়ি, পথানুজায়ি হতে গিয়ে ধংস করে দেয়। সেই ধংসস্তুপের ওপর আজ আমরা দাঁড়িয়ে আপনাকে এই চিঠিটা লিখছি।
    কয়েকটা বিনম্র ফরিয়াদ।
    ১) খুব সচেতনভাবে কর্পোরেট-রাষ্ট্রের আঁতাতের কথা আসেনি। আমরা মনেকরি কৃষি শিল্প-সংস্কৃতি, তাকে কারখানা বানানো মানে অন্ততঃ বাংলার সংস্কৃতি ধ্বংস করা। আপনি মাটির জলের দূষণের কথা ছুঁয়ে গেছেন। কিন্তু গবেষণাগারে তৈরি হানি-কুরগের জীবন গাথা গেয়েছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেখানো পথে আজ সংসদ-দল-কর্পোরেট একাকার। তাই কৃষির করপরেটাইজেসন চলছে। তার হাত থেকে কৃষিকে, কৃষি সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। কৃষকরাইতো হাজার হাজার বছর ধরে মানুষদের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করছ্রন। একে তাদের সাফল্য বলছে সব সরকার।
    ২) যিশু আসলে সচেতনভাবে কর্পোরেট প্রতিনিধি(দালাল বললাম না), গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে তাদের কথা জাপানের এক কর্পোরেট দপ্তরে পৌঁছে দেয়। লেখকের সমস্ত সহানুভূতিই সে টেনে নেয় নিজের করে। ঘাটে মাঠে আমরা যারা দৈনন্দিনভাবে অমিত সম্পদ, ক্ষমতাধারী এই কোম্পানিগুলোর ভাবনা, পণ্য, বাজার লুঠের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তাদের কাছে কি উল্টো ভাবনা পৌঁছায় না! গ্রামে ঘুরে কৃষকের কারু শিল্পীর, তাঁতির নাড়ি জানতে কর্পোরেট প্রতিনিধি হতেই হবে? এবং সে এই কাজ নিজে বেছে নিয়েছে। অথচ অন্য কাজ সে করতেই পারত। আপনার সহানুভুতি, লেখার জাদুতেও মাঝে মাঝে মনেহয় সে আসলে বাংলার সামাজিক ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের লেখকের ভাবনা জানাচ্ছে, সেই অনুভুতি মধ্যবিত্ত পাঠকের মনে চারিয়ে যায়। মেহনতিদের প্রতি তার সহানুভুতি থাকতেই পারে। কিন্তু একজন চিহ্নিত কর্পোরেট প্রতিনিধির মুখে সামাজিক দায়ের তত্ব, নাক উঁচু বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্তের পাতে ভাল ভাবে পরিবেশিত হয়। ঠিক যেভাবে কোটি টাকা ব্যয়ে কাঙ্গাল মালসাট মাল্টিপ্লেক্সে জিন্স পরিহিত পপকর্ণ আর পিতজা-হ্যাম্বারগার চেবানো, কোকএর গ্লাস হাতে মাসে লাখ টাকা মাইনে পাওয়া, বাঙালি চাকুরের মনে বিপ্লবএর বীজ পুতছে। মালসাট না দেখলে নাকি পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই লাইন লাগছে।
    কিন্তু এই দায় লেখক, আপনি কেন ঘাড়ে তুলে নেবেন? কতদিন আর ইওরোপিয় বামপন্থার দায়, দালাল বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্ত ঢাক পিটিয়ে সারা বিশ্বকে জানাবে? নেপালে ক্ষমতা পেয়ে প্রচন্ড, গাজুরেল, বাবুরামেরা আদতে কর্পোরেটদেরই ডেকে আনছে। ভারতের জঙ্গলে লড়াই করা বন্ধুদের প্রতি সহানুভুতি রয়েছে আমাদের সকলের, তারা আজ অনেক সম্পদ রক্ষা করছেন(যারা ইংরেজিতে রেড বুক পড়িয়ে আদিবাসীদের বিয়ে দ্যায় – আদিবাসীর সংস্কৃতি না মান্য করে), কিন্তু তারা ক্ষমতায় এলে নেপালের নীতি অনুসরন করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়! তখন খোলা অর্থনীতির যায়গায় নেহেরুরমত রাষ্ট্র-কর্পোরেট অর্থনীতির রমরমা হবে, মধ্যবিত্ত চক্রবর্তী, মুখারজি, ভট্টাচার্য, রেড্ডিরা মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, আমলা হবে। গ্রামীণদের কি এল গেল? পঞ্চায়েত কোথায়? তারা ক্ষমতার বাইরে থেকেই ভারতকে গড়েছিল। এতোই বুকের পাটা ছিল তাদের। বামপন্থা বরাবরই কেন্দ্রিকৃত দর্শনের কথা বলেছে। ১৯৫৭য় সিপিআই, সুশোভন সরকার বাংলার রেনেসাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন। আজও কি মধ্যবিত্তের ইতিহাস ভাবনা পাল্টেছে?
    খুব বড় লেখা হয়ে যাচ্ছে, থামতে হবে অথচ অনেক কিছু বলার ছিল। কেননা আপনার কলম থেকে এধরনের একটা লেখা বেরিয়েছে বলেই আপনাকে এত কথা বললাম। আরও কিছুটা হয়ত অন্য কোনও দিন।
    আপনাকে বাংলার শিল্পীদের বিনম্র প্রনাম জানালাম।

Leave a comment