কোনও ডুবন্ত জোতদারের থেকে কেনা, সাবেকি মেহগনি পালঙ্কে শুয়ে, কলকাতা থেকে তিরিশ বছর আগে ভবেশকা আর খুশিদির আচমকা হারিয়ে-যাওয়া আর আজকে তেমনিই হঠাৎ খুঁজে পাওয়ায়, যিশুর ভাবনায় অনির্বাণ আহ্লাদ খেলছিল । ব্যাটমে তোলা নেটের মশারি । শিমুলের ধবধবে বালিশ । এমব্রয়ডারি নেই । ছোট্ট মোটা কোলবালিশ, পা রাখার জন্যে । বারান্দায় টালির চাল । শালি-শুনা জমি ইঁটভাটার জন্যে ব্যবহার বারণ বলে টালির খোলা তো উঠেই গেছে বলতে গেলে । দেয়ালে পুরোনো আমলের লম্বাটে আয়না । পেরেকে চাবির গোছা ঝোলানো । সঙ্গেকার তাকে কাঁকুই । দেয়ালে ঝাঁকড়া হাসছে সত্য সাঁইবাবা । ভবেশকা বোধয় এ-ঘরেই শোয় । খুলনার বাড়িতে হুবহু এরকুম ঘরই ছিল হয়তো । গ্রামে লোকেরাও আজকাল এভাবে থাকে না । শহর তার রঙিন উস্হিতি জানাবেই । শহর মানেই তো দাপটের কেন্দ্র । খুশিদির ঘরটা কেমন কে জানে । ঘর তো বেশ কয়েকখানা । দুজন মোটে লোক ।
দেয়ালে-বসানো আলকাৎরা রঙের লোহার সিন্দুক, দিশি । কিছুক্ষূণ দ্বিধাগ্রস্ত থাকার পর আলতো পায়ে বিছানা থেকে নেবে, চাবির গোছাটা নিয়ে বারকয়েক কৌতুহলী চেষ্টা করতে খুলে যায় সিন্দুক । আলুর বণ্ডের বই, পাকিস্তানের পুরোনো একশো টাকার নোটের একটা বাণ্ডিল, উনিশশো পঞ্চাশ সালের হলদে খড়খড়ে পাকিস্তান অবজার্ভার আর দৈনিক আজাদ, দুটো একই মাসের । একটা ছবিসুদ্দু বিঞ্জাপন লাল কালিতে ঘেরা । লাল শালুর পাক খুলে শতচ্ছিন্ন বইটা, গীতা নয়, লুপ্ত সোভিয়েত দেসে ছাপানো ‘দাস কভাপিটাল’, এত বছর পরও মোষের খুরের শিরীষ -আঠার ভকভকে স্তালিনি গন্ধ । সংগ্রাহকের জন্যে গর্বাচভের সৌজন্যে বইটার সোভিয়েত সংস্করণ এখন দুষ্প্রাপ্য । সিন্দুক বন্ধ করে পালঙ্কে ফেরে যিশু ।
পাড়সুতোর নকশিকাঁথা চাপা দিয়ে, ভাতঘুমের অলস তন্দ্রায়, অতীতে ভাসছিল ও, যিশু । ষোলো বছর বয়সে কুড়ি বছরের খুশিদিকে ছোঁয়া, বাহু ধরা, চুলে নারকোল তেলের গন্ধ । স্মৃতির আলতো জলপোকা ।
কোথাও দুপুর-কোকিলের চোরা-কুহু । পশ্চিমের জানলায় থোকা-থোকা ফিকে হলুদ নোড়ফল ঝোলানো গাছটার পেছনে মঞ্চস্হ হচ্ছিল সূর্যাস্তের দ্বিপ্রাহরিক মহড়া ।
কাজের সময় কোকিল ডাকে, ভাল্লাগে না বাপু । কপালে খুশিদির স্পর্শ আর কন্ঠস্বরে অস্বস্তিকর অস্হিরতা । যিশুর তন্দ্রায় ঝনৎকার ঘটে । যিশুর শিরা-উপশিরা যা টানটান বাঁধা, ছিঁড়ে গেল, আর শ্বাসনালিকায় মোচড় দিয়ে ওঠে অদম্য বিষাদ ।
তোমার বরের কী হল খুশিদি ?
কেঁপে উঠেছে খুশিদির চোখের পাতা, মুখমণ্ডলে অবিশ্রান্ত ক্লান্তি , হৃৎপিণ্ডে অশ্রুপতনের টুপটাপ । বিয়ে আর হল কই ! চারটে মোটে শব্দ, অথচ, অথচ জ্যোৎস্নায় ডোবা ভুতুড়ে ঝিলের মতন নিষ্পন্দ । বর্ধমান জেলার ছুতোর গাঁ’র সহদেব মণ্ডলের বড়ো ছেলে এখানের উপসাসথো কেন্দ্রে কাজ করতো, আমাকে দেখতে পেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল একাত্তর সালে । দশঘরার পোড়ামাটির পরি বলেছিল আমাকে দেখে । পালটি ঘর ছিল, কাসসপ গোত্তর । খুন হয়ে গেল । ধড় পাওয়া গেসলো, মাথা পাওয়া যায়নি । সবাই বললে, নকশাল ছিল, তা-ই । দাদাও সে কথাই বলেছিল । দাদা কী করে জানবে বল ? নকশাল তো ছিল ছোটো ভাইটা । নকশাল করলে বিয়ে করতে চাইবে কেন, বল ? গোপের হাটের আড়তদার রামরতন মণ্ডলও বিয়ে করতে চেয়েছিল । পনেরো বছর আগের কতা । দোকানে আগুন লেগে জ্যান্ত পুড়ে মারা গেল সে । আমি খুব অপয়া । খুশিদির চোখের নাব্যতা হয়ে ওঠে অতল । তুই কেমন আচিস যিশকা । কতো বড়ো হয়ে গেচিস, লোক অ্যাগবারে ।
দশঘরা অঞ্চলের টেরাকোটা, মাটির তলায় পুঁতে, তার ওপর মাস ছয়েক জলছড়া দিয়ে, কয়েকশো বছরের প্রাচীন আর দুর্মূল্য করে তোলার খবর জানে যিশু । দেখেছে । সন্তর্পণে ও বলল, অজানা ইনোসেন্ট নারীজীবনে প্রবেশ করে নিজেকে পুনরুদ্ধারের অভিপ্রায়ে, আমার সঙ্গে যাবে খুশিদি ? আমার কাছে ? পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু । ওর কথার ঈষদুষ্ণ ভাপে, সালোকসংশ্লেষে অক্ষম স্বর্ণলতার মতন খুশিদি যখুন যিশুর কাঁধে মাথা রেখে, হ্যাঁ জানায়, রেশমগুটির মধ্যে তুঁতপোকার মতন ভাবাবেগের আরাধ্য পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছে ও, যিশু ।
আমার শরীর কেমন-কেমন করচে । বুক ধড়ফড় করচে । কিছু আবার হবে না তো । বলেছিল সন্ত্রস্ত খুশিদি, আর যিশু উত্তর দিয়েছে, হোক, হওয়া দরকার, এরপর আর সময় নেই ।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেচিস । ঠিক সময়ে পাকা ফসল তুলে না নিলে শুকনো সরষেও তো খেতে ঝরে যায়, বল ? তোর কিচু হবে না তো ? কাঁধ থেকে মাথা তুলে, চুলে নারকোল তেলের পরিচিত গন্ধ, যিশুর মুখের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চেয়েছে খুশিদি, আর তারপর বলেছে, আমার কাচে তুষলাব্রতর সরষে আর মুলোফুল আচে । তোর বাকসোয় রেকে নিস ।
তুমি ব্রত করো ? কী-কী ব্রত করো ? যিশু কাঁধ নাচিয়ে হেসেছিল, শব্দহীন, যাতে রাহু কেতু অশ্লেষা মঘা বসতে না পারে ওর গায়ে । ইউরোপ আমেরিকা এশিয়া আফরিকার বহু নারীর হার্দ্র সঙ্গ কাটিয়েছে ও, যিশু । কিন্তু এই প্রথম একজনকে মনে হল আধুনিকতার স্পর্শদোষ থেকে মুক্ত ; সমূল নিসর্গপ্রকৃতির অন্তর্গত ।
হাসচিস কি ! ব্রতর অনেক গুণ । এই তো শাবনমাসে মনসার ব্রত করেছিলুম । পান্তাভাত আর সজনে শাগের পেসাদ খেতে হয় তখুন । তারপর ভাদ্দরে চরাচরি ব্রত করি । চরাচরি পুজোয় সব রকুমের পিঠে ভাজা হয় । আশিন সংক্রান্তিতে পিঠে-পুলি খেয়ে খেতে নল দিতে হয় । ভাদ্দরে জল, আশিনে নল, ধান ফলে গলগল, শুনিসনি ? পোস মাসে পোসতলা ব্রত করি । শাঁক বাজিয়ে চাল দুধ ফল ফুল গোড়ায় দিয়ে পাঁচ গাচা ধান তুলতে হয় পোসতলায় । যখুন নতুন-নতুন এসছিলুম শেষপুকুরে, গাছতলায় বিলরান্না করতুম । আজগাল আর হয় না খ বডডো ঝগড়াঝাঁটি হয় গাঁয়ে । ঘেঁটুব্রতর গান জানতুম আগে । সবায়ের বে-থা ছেলেপুলে হয়ে গেল । কথা বলার সময়ে খুশিদির হাত নাড়া দেখে মনে হচ্ছিল বাতাসের তোশক সেলাই করছে ।
চাষবাস, গ্রামজীবন থেকে বঙ্গসংস্কৃতি এখুন গিয়ে পৌঁছেচে কলকাতা শহরের শেকড়হীন নাচাকোদা, বাজনা-থিয়েটারে । পশ্চিমবাংলার ভূজমিন থেকে আর সংস্কৃতির সত্য অঙ্কুরিত হয় না । তা নকল কায়দায় পয়দা হয় অকাদেমি, অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, পার্টি অফিসে । খুশিদিই হয়তো শেষ বাঙালিনি ।
একবার ভবেশকার সঙ্গে মিছিলে হাঁটার সময়ে গলা ঢেলে গান গেয়েছিলুম তোমায় শুনিয়ে, মনে আছে ?
মনে নেই আবার ? বাঙালদের মিছিলে গিসলি বলে পিটুনি খেয়েছিলি । খুশিদির চোখের কোলের অনিশ্চয়তার কালি কিছুটা কমে । চোখের কোলের কালির জন্যেও নারীকে ভালো দেখায়, আশ্চর্য । নৈকট্যার ঝাপটায় গড়ে ওঠে অজ্ঞাতসার । যিশু দুহাতে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে শেষতম বাঙালিনিকে । অ্যাই, কী হচ্ছে কী, পাগল নাকি, ভালোবাসা এমনি করেই জানাতে হয় বুঝি ? ছাড়াবার চেষ্টা না করে, গলা নাবিয়ে বলল খুশিদি । প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলোয়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত । সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে, মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে । খুশিদির জৈব প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয় । থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি ; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা ।
যিশকা নামে ডাকার আর কেউ বেঁচে নেই । ডাক-নামের মৃত্যু মানুষের জীবনে জলবিভাজক । তার অস্তিত্বে যে যিশকা নামের কেউ একজন কখনও ছিল তা টের পেল যিশু, এতদিন পর । বহুকাল, বহুকাল, বহুকাল পর ।
খুশিদির কোমরলগ্ন যিশু, খুশিদির ঘরে, সেগুনকাঠের নিচু খাটের ওপর, খুশিদিকে আবরণমুক্তির সময়ে, খুশিদি বলল, পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, কেউ কখনও আদর করেনি আমায়, আদর করার মতন কিচু আচে কিনা তা-ও জানি না, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেএএএউ নয় । আমি খুবই অপয়া ।
উদোম স্বাস্হ্যবতী চাষি-প্রৌঢ়ার প্রগাঢ় চাউনির দিকে তাকিয়ে, ফুঁ দেবার মতন আলতো কন্ঠস্বরে যিশু বলেছে, ওসব বোলো না । জানি, পনেরই আগস্ট তোমার জন্মদিন করত ভবেশকা । তোমাদের কলোনিতে তা দেখে গালমন্দ করত অনেকে, আর ভবেশকা তাতে কান দিত না । এসো, আমি চোখ না বুজে তোমায় তিরিশ বছর পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি । শরীর জুড়ে ঠোঁট বোলায় যিশু আর প্রতিবার বলে তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা । যিশু অস্ফুট বলতে থাকে, তোমার মুখের ভেতর থেকে রক্তচন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমার ঠোঁটে মধুপর্কের স্বাদগন্ধ, আম্রপল্লবের গন্ধ তোমার চোখের পাতায়, কানের লতিতে রক্তপদ্মের পাপড়ি, তোমার চুলে দুর্বাঘাসের সুবাস, তোমার এই হাতে কাঁচা ধানের সুগন্ধ । বেলপাতার সবুজ গন্ধ তোমার পায়ে, তোমার বুক থেকে ডাবের জলের গন্ধ পাচ্ছি । আআআআআআআঃ । কী মাখো তুমি ? অ্যাঁ ? কী মাখো ? কী মাখো ? কী মাখো ? আলো ? জল ? বাতাস ? সময় ? কী মাখো ?
চুপ করিসনি, তুই বলতে থাক রে, তুই বল । কিচ্ছু বুঝিনে তুই কী কইছিস, তবু তুই বল, বলতে থাক । আমু মুকখু । নাকতলায় তো তখুনই ইশকুল হয় । লেকাপড়া শেখায়নিকো । মুকখু, জানি আমি মুকখু । ঠোঁট দিয়ে খুশিদির চোখের কোল থেকে , অশ্রু পুঁছেছে যিশু । খুশিদির নাভি ঘিরে জেগে ওঠে নরম পরাগ-রোঁয়ার দল ।
বাইরের আমবাগানে চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেছে বাতাস । ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে রোদ্দুরের । চাপা উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে টুপ শব্দে মাটিতে পড়ল একাকী শিমুল । মাঝবয়েসি রোদের শেষ ফালিটুকু এসে পড়ে আছে বিছানার একপাশে । জানলার জংধরা শিকের বাইরে, নারকোল গাছের পাতায় বয়োবৃদ্ধ চিলকে ঘিরে গুটিকয় যুবা পাতিকাকের হাওয়া-সাঁতার হুড়দং । দক্ষিণের জানলায় পুরুষালী চেহারার ঝাঁকড়ামাথা খেজুরগাছ । তারপর থেকে, খুশিদির কাঁধের ওপর দিয়ে যতটা দেখা যায়, আলু খেতের সবুজ, খুপরি হাতে ময়লাটে রঙিন শাড়িতে আবছা কামিনেরা । ফড়িঙের ইচ্ছানুকূল স্পন্দন ছেয়ে ফেলছে চরাচর ।
মুখচোরা স্পর্শের আতিশয্যে খুশিদি এখুন প্রাণবন্ত পাথরে রূপান্তরিত , অন্তঃপুর নির্বাক, চোখের জলে গড়া মানবী । যিশু ওর দাঁত ঠোঁট মুখ দিয়ে খুশিদির চরণবন্দনা করে, জানুবন্দনা করে, স্তনবন্দনা করে, বাহুমূলবন্দনা করে, চোখবন্দনা করে । খুশিদি ফিরে যেতে থাকে তিরিশ বছর অতীতে প্রতিবেশী তরুণের শ্রেণি-নিষিদ্ধ সম্পর্কে, অপ্রত্যাবর্তনীয় সময়ে । অস্তিত্বের শীতাতপ আনাচকানাচ ভেসে যায় অবিরাম স্নিগ্ধতায় । জানা ছিল না এতকাল যে ওর নিজের শরীর এরকুম, যাকে এখুন দেহের আর মুখের ভাষায় যিশু করে তুলেছে পূজনীয়, অর্চনীয়, বন্দনীয়, আরাধনীয়, সাধনীয়, অহর্নীয়, উপাসনীয়, টের পায় যিশু । নিজের অর্চক, উপাসক, যাজক, জাপক, পূজক, সেবাইত, সাধক, আরাধককে সারা জীবনে প্রথমবার, পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম, সাহায্য করে খুশিদি নিজেকে অবাধ করে তুলতে । অস্ফূট উঃ, খুশিদির চোখবোজা, ক্রমাগত বলে চলেছে, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেউ চায় না আমায়, আমি মুকখু, আমি অপয়া । অবারিত যিশু, গড়ে তোলে স্বপ্নের দ্রুতশ্বাস সম্পখফ । তিরিশ বছর আগের না-মেটা আশ পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে । সুখানুভূতির অঢেল বখরায় মরা গাঙ প্লাবিত হয় ।
বাঁশের বেড়া খোলার ক্যাঁচোর শুনে উৎকর্ণ শঙ্কিত খুশিদি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত, পাক খেয়ে আনারদানা জামদানি জড়ায়, চোখের জল মোছে, হাত-খোঁপা বাঁধে, আর চাপা গলায়, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, বাইরে যা, বাইরে যা, এখুন তো দাদার আসার সময় হয়নি । ব্লাউজের হাতায় বাহু ঢোকায় । টেপা-বোতামের পট-পট শব্দ ।
ভীতির গভীরতায় অবাক যিশু বাইরে দাওয়ায় বেরিয়ে খুশিদি আর আগন্তুকের উদ্দেশে গলা চড়ায় , জাবেদালি এসেছে গো খুশিদি । বিশ্বাসবাবুর জন্যে খাসি কাটালে ভবঠাকুর, তাই পাটিয়ে দিয়েচে, আর এই হরিপালের দই, জানায় জাবেদালি ঘরামি, হিমঘরে নজরদার, থলথলে কালচে চাহারা, গোঁফ নেই, দাড়ি আছে, কুচকুচে । হিমঘরের নাটবল্টু পেরেক আলপিন ওর মুখস্হ । অনেক বন্ড কিনেছে নিজের নামে, নাবালক ছেলের নামে । পদবির বিশ্বাস শব্দটাকে কারা বিকৃত করবে তা মুখের দিকে তাকিয়ে টের পাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে যিশু ।
যিশকা এখেনে কদিন থেকে যাক না দাদা, কদ্দিন বাদে দেকা, ওর তো মা-বাপ কেউ নেই এসংসারে, আমরা ওকে পুষ্যি নিতে পারিনে ? ভবেশকা ফিরলে অবাস্তব প্রস্তাব করেছিল খুশিদি ।
কিইইইই যে আবোল-তাবোল বলিস ; বিলেত-ঘোরা লোক ও, আপিসের কাজে এয়েচে । তা থাকতে চায় থাকুক না কদিন, কিন্তু ব্যাবসা আর গাঁয়ের গপ্পো করিসনি ওর সঙ্গে ।
রাত্তিরে, মাংস খাওয়ার সময়ে, এই অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে যিশুর, আবার মনে হল, অন্ত্যজ বাঙালি পরিবার মোগলাই রান্না রাঁধতে পারে না, অথচ সবর্ণদের তুলনায় নবাব-সুলতানদের কত কাছে ছিল । যে হিন্দুর বাড়িতে এককালে ছাগলের মাংস আর মুরগি নিষিদ্ধ ছিল, তারা কিন্তু আজকাল নানা মোগলাই পদ দিব্বি রাঁধতে পারে । অরিন্দমের ছোটো ভাইয়ের বউ কত ভালো মাংস-পরোটা খাইয়েছিল অরিন্দমের জন্মদিনে । অরিন্দমের ছোটো ভাইটা তো সব রকমের মাংসই খায় ।
কে কোন তপশীলিকে সরকারি ব্রাহ্মণ বলেছিল বলে অরিন্দমের অফিসে ইউনিয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে কত চেঁচামেচি করেছিল গৌরাঙ্গ নাগুরি, রমাপদ বাইন, জগৎ মান্না, সদানন্দ সাঁই, আর ঝাড়পিট ঘিরে নাট্যমোদীর কেরানিমঙ্গল । চাকরি-বাকরির চেয়ে নিজের বুদ্ধি বিক্রির ব্যবসা বরং ভালো, এর রাজনীতিতে তেমন হ্যাঙ্গাম নেই । খুশিদির সেগুনকাঠের পেল্লাই খাটে, রং-ওঠা নীল নেটের মশারির মধ্যে শুয়ে ভাবছিল যিশু ।
খুশিদির ঘরটা প্রায় ফাঁকা । একটা ড্রেসিং টেবিল অন্তত কিনে দিতে পারত ভবেশকা, একটা ট্রানজিস্টর বা টু ইন ওয়ান । নিদেনপক্ষে ছবি দেখার জন্যে সিনেমার ম্যাগাজিন । গ্রামপঞ্চায়ের এখানে কেবল টিভি নিষিদ্ধ করলেও, একটা টিভি তো রাখতে পারত সরকারি চ্যানেল দেখার জন্যে । খুশিদিকে ঠিক কোন শতকে আগলে রেখেছে ভবেশকা কে জানে । তালা-দেওয়া ঘরগুনোয় কী আছে জানতে অহেতুক আগ্রহ হয় ওর, যিশুর ।
ভেতরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরে খাটে কটনের মশারি টাঙিয়ে খুশিদি বাতি নেভাবার পর, যিশু আলতো পায়ে ওর পাশে গিয়ে শুলে, কন্ঠস্বর উদারায় তুলে খুশিদি বলল, সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়, কাল তো আবার আপিসের খাটনি আচে । আর গলা নাবিয়ে বলল, দুপুরে যা সব বলছিলি, সেগুনো আবার বল । পারবি ? ওমা তোর বুকে তো চুল নেই রে ।
যিশু প্রণয়ের প্রণয়ন করে ।
তোমাকে অনেক বলার আছে খুশিদি ; একই কথা বারবার কেন বলব ?
না, না, দুপুরেরটাই বল, তখুন যেমন-যেমন করেছিলি । নিজের অস্তিত্বে উত্তেজনার ভণিতা চেয়েছে খুশিদি ।
তোমাদের খুলনার ভাষা তোমরা দুজনেই ভুলে গেছ ?
তিরিশ বছরের ওপর রইচি এই গাঁয়ে । এই গাঁয়েরই হয়ে গেচি । আমি তো ছোটো ছিলুম, কিছুই মনে নেই । দাদা গপ্পো করে কখুনো-কখুনো ।
আমি তোমায় দেখে ভেবেছিলুম, বিধবা হয়ে ফিরে এসেছ । ভবেশকা যে কেন বিয়ে না দিয়ে আইবুড়ো করে রেখে দিয়েছে । অনেক ভালো পাত্র পেত তোমার জন্যে । নিজেও করেনি ।
দাদার তো চোপরদিন হিমঘর আর পারটি আর চাষবাস আর সভা । তুই করিসনি কেন ?
আমি ? পড়াশোনো আর পড়াশুনো । তারপর রোজগার আর রোজগার । উন্নতি আর উন্নতি । ব্যাস, বিয়ের বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল । আর তারপর বাবা-মা মারা গেল ।
তুই তো বেমমো, না রে ?
যিশুর বেশ ভাল্লাগে খুশিদির অকৃত্রিম মর্মসত্তা । বলল, না, আমরা খ্রিস্টান, ফ্রানসিসকান খ্রিস্টান । আমাদের জাতের বাঙালি খ্রিস্টান কলকাতায় আর নেই । কলকাতায় জেসুইট,কারমেলাইট, ডোমিনিকান, অগাস্টানিয়ান জাতের বাঙালি খ্রিস্টানও আর নেই । কলকাতা এখুন নানা ধর্মের ট্যাঁসদের শহর, বুঝলে । হিন্দু ট্যাঁস, মুসুলমান ট্যাঁস, খ্রিস্টান ট্যাঁস । কিন্তু ছোটোবেলায় কতদিন বড়োদিনের কেক খাইয়েছিলুম, ভুলে গেলে ? অবশ্য তিরিশ বছর আগের মতন কেক আর হয় না । কেকের ময়দা তো এখুন দুপা দিয়ে মাড়িয়ে-মাড়িয়ে মাখে কলকাতায় ।
অতশত বুঝিনে, মোচরমান না হলেই হল । খিশিদির অজ্ঞানতার আহ্লাদ, আরো গভীরে, জানায়, তা বেমমোও যা খ্রিস্টানও তাই । আমিও তাই, বল ? কিন্তু দুপুরবেলা তুই আমার জন্যে হিন্দুর মন্তর পড়লি যে বড়ো । শুয়ে শুয়েই, যিশু কাঁধ নাচিয়ে আহ্লাদিত ।
জানলায় ফিকে শীতের শ্রবণসুভগ শুক্লপক্ষের স্তব্ধতা । ভুলো মনের বাতাসে আওয়াজ নেই । যিশু ফিসফিসিয়ে, তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব আমি । আমার কাছে ক্যামেরা আছে , কাল ফোটো তুলব তোমার ।
খুশিদির বিষণ্ণ উক্তি, আমার কোনো ছবি নেই, কেউ তোলেনি আজ ওব্দি । ভোটের ছবি তুলেচে যেন শাঁকচুন্নি । তারপর বহুক্ষুণ নিরুত্তর থেকে, কিন্তু কী করে যাব, দাদা এক পা-ও যেতে দেবে না । চাদ্দিকে দাদার পঞ্চায়েত, কিসক সভা, হ্যানোত্যানো কমিটি, হিমঘর, সমবায়ের লোকে গিজগিজ করচে । কী করে এড়াব ? সবাই চেনে আমাকে ।
বৈশাখী পূর্ণিমার মেলা আসছে তো । গাঁয়ের মুখে তো বিরাট মেলা বসে শুনেছি । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কেউ খেয়াল করবে না । আমি কলকাতা থেকে টানা গাড়ি আনব ।
শরীর কেঁপে ওঠে খুশিদির । যিশুর মাথাকে চেপে ধরে উন্মুক্ত বুকে । যা ভালো বুঝিস, কর । কিচ্ছু ভাল্লাগে না আর । রাত্তিরেও চুল আঁচড়ে শুস ? এক লহমায় যিশু ফিরে গেছে মায়ের কোলে । চাঁদের আলোর ক্ষীণ স্বাদ ওর জিভে । রোমকূপের গোড়ায়-গোড়ায় পড়ে গেছে সাজো-সাজো রব । একত্রে অনোন্যোপায় হয়ে ওঠে দুজনে, অভিভূত, দিশেহারা, বিভোর, আচ্ছন্ন । অন্ধকারে তিরতির করে কাঁপতে থাকে অন্ধকার । চোরাবালির কেন্দ্র থেকে প্রসারিত হাতের অনুনয়ের মতন খুশিদির নিঃশ্বাস । একে আরেকের ব্রাহ্মমুহূর্ত গড়ে তোলে আর প্রশমিত করে পারস্পরিক স্পন্দন ।
প্রাকভোরে, শুক্লপক্ষ তখুনও কৃষ্ণপক্ষে ঢলে পড়ার জন্যে তৈরি হয়নি, ঘুম ভেঙে গেলে খুশিদি যিশুকে ঝাঁকায় । এখুনো ঘুমোসনি, নিজের বিছানায় যা, বিপদ হবে শেষকালে । যিশু যখুন মশারি তুলে বেরোতে যাচ্ছে, ওর বাঁ হাত ধরে, না যাসনে, আমার কাছে থাক । যৌবন ফুরোতে থাকা নারী-পুরুষ চুপচাপ পাশাপাশি শুয়ে নৈশব্দ্যের খাঁই মেটায় । চরাচরের অপার্থিব উম কনশিকাঁথার রূপ নিয়ে ঢেকে রেখেছে ওদের দুজনকে । বহুদূরে, কোনো পথকুকুরের খেদোক্তি শোনা যায় । এই এভাবে পরস্পর, একেই বোধয় শুশ্রুষা বলে, প্রাণ জুড়োনো বলে, মনে হচ্ছিল যিশুর ।
অ্যাতো জমিজিরেত প্রতিপত্তি কী করে করলে গো তোমরা ?
বিনময় করে । জানিস তো, বিনময় ? ওখেনে আমাদের খেতখামার ঘরদোরের বদলে এখেনে কে একজন ফরোজন্দো মোমেনিন ছিল, তার সঙ্গে অদল-বদল । তক্কে-তক্কে ছিল দাদা ।
ওঃ বিনিময় ! কখুনো তো টের পাইনি ?
তুই আবার কী টের পাবি ? তখুন কতই বা বয়েস তোর ।
গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে পেছনের ওসারায় এসে দাঁড়ায় যিশু । সকাল হয়ে এল । স্পষ্টবাক বিবাহযোগ্য কোকিল ডাকছে । সঙ্গে ফস্টিনষ্টি আরম্ভ করেছে ফাল্গুনের প্রেমানুভূতিময় কচি-কচি বাতাস । বেশ ভালো বাগান করেছে ভবেশকা । ঘষাকাঁচ কুয়াশা দেখা যাচ্ছে দূরের ঠান্ডা দোচালাগুলোকে ঘিরে । সজনেফুল আঁকড়ে সদ্যোজাত লিকলিকে সজনে ডাঁটারা বেরিয়ে এসেছে রোদ্দুরের উড়ন্ত উনকির সঙ্গে খেলবে বলে । কাঁটাকাঁটা সবুজ ছুনিফলের মুকুটে তালঢ্যাঙা রেড়িগাছ । পুকুরের পাড়ে মুখ তুলে পাতাহীন গাছে আমড়ার ফিকে সবুজ বউল । ছোটো-ছোটো প্রায়ান্ধকারে দোফলা গাছে পুরুষ্টু সফেদা । পাকা আর ডাঁসা অজস্র টোপাকুল, আলতো নাড়ালেই ঝরে পড়বে গোঁসা করে । গা ভরতি নানা মাপের সবুজ আঁচিল নিয়ে কাঁঠাল গাছ । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে মুখে পাউডার মেখে নার্সারি স্কুলের খোকাখুকুর মতন জামরুল ফুলের দলবদ্ধ কুঁড়ি । লালচে-সবুজ ছাই মেখে কচি খসখসে ফলসা পাতা । নরম তুলতুলে গুটিপোকাকে আলগোছে খেয়ে ফেলল ময়নাপাখি । কত রকুমের পাখির ডাক । বেলা হলে আর শোনা যায় না তো ! গলায় কোরালের মালা ঝুলিয়ে মোচা ফেলছে সুপুরিগাছের সারি । জীবনমুখী গায়কের দ্রুতলয় গিটারের মতন বাঁশের শুকনো ফ্যাকাশে গাঁটে কাঠঠোকরা ।
খালি গায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাতাস । বাতাসে ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । দানদিকের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নিচে খেলা করার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলটলে পুকুর । আঁশটে গন্ধের ঐতিহ্যলালিত কুচোপোনার ঝাঁক ভেসে আছে আলতো রোদে ভেজা প্ল্যাঙ্কটন-পোকা খাবে বলে । ঘাটের জলে কাঁসার এঁটো বাসন । স্হানীয় চোরেরা ভবেশকাকে বেশ ভয় পায় বোধয় ।
কত জল পুকুরটায় । কত্তো । কলকাতায় হরদম ফেরুল নোংরা, জলের পাইপ পাম্প করার ঝঞ্ঝাট, স্টপকক চুরি, ফি-দিন মেরামত । জলের জন্যে টেনশানের চূড়ান্ত । অথচ এই অজ পাড়াগাঁয় অগুনতি পুকুর । ভবেশকার পুকুর তিনটের মধ্যে এটা সবচে ছোটো । পুকুরের উত্তরে গোয়ালঘর । সঙ্কর গাই রয়েছে দুটো, জার্সি ।
কত কি করে ফেলেছে ভবেশকা । দেশভাগের দরুন তাহলে জোতদার বিনিময়ও হয়েছিল । এগাঁয়ের লিগি মুসুলমান গিয়ে ইস্তাহারি রাজনীতিতে দড় হিন্দু জোতদার এল। মূল্যবোধ যে কে সেই । খুঁটিগুনোর তেমন তফাত হয়নি । তিরিশ বছর আগের ভবেশকার স্লোগান লাঙল যার জমি তার আজ ফলে গেছে । হালবলদ, জোয়াল-লাঙল ভবেশকার, জমিও ভবেশকার । সমন্বিত গ্রামীণ বিকাশ, প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প, ডোকরা, সাক্ষরতা অভিযান, রক্তদান শিবির, মৎস্য উন্নয়ন, পঞ্চায়েতের বরাত, তাঁতিদের সুতো, ত্রাণ প্রকল্প, তপশিলি কল্যাণ, হ্যান-ত্যান কমিটি, সমবায় তাপবিদ্যুৎ, স্বাস্হ্যকেন্দ্র, লোন-দাদন, আলুর বন্ড, ক্লাব, পুজো, নাটকদল, মেলা, বায়োগ্যাস, ধোঁয়াহীন চুলো, প্রশিক্ষণ, মডেল শৌচাগার, সব ভবেশকার, ভবেশকাদের, সব, সব, সঅঅঅঅব ।