কোনও ডুবন্ত জোতদারের থেকে কেনা, সাবেকি মেহগনি পালঙ্কে শুয়ে, কলকাতা থেকে তিরিশ বছর আগে ভবেশকা আর খুশিদির আচমকা হারিয়ে-যাওয়া আর আজকে তেমনিই হঠাৎ খুঁজে পাওয়ায়, যিশুর ভাবনায় অনির্বাণ আহ্লাদ খেলছিল । ব্যাটমে তোলা নেটের মশারি । শিমুলের ধবধবে বালিশ । এমব্রয়ডারি নেই । ছোট্ট মোটা কোলবালিশ, পা রাখার জন্যে । বারান্দায় টালির চাল । শালি-শুনা জমি ইঁটভাটার জন্যে ব্যবহার বারণ বলে টালির খোলা তো উঠেই গেছে বলতে গেলে । দেয়ালে পুরোনো আমলের লম্বাটে আয়না । পেরেকে চাবির গোছা ঝোলানো । সঙ্গেকার তাকে কাঁকুই । দেয়ালে ঝাঁকড়া হাসছে সত্য সাঁইবাবা । ভবেশকা বোধয় এ-ঘরেই শোয় । খুলনার বাড়িতে হুবহু এরকুম ঘরই ছিল হয়তো । গ্রামে লোকেরাও আজকাল এভাবে থাকে না । শহর তার রঙিন উস্হিতি জানাবেই । শহর মানেই তো দাপটের কেন্দ্র । খুশিদির ঘরটা কেমন কে জানে । ঘর তো বেশ কয়েকখানা । দুজন মোটে লোক ।

দেয়ালে-বসানো আলকাৎরা রঙের লোহার সিন্দুক, দিশি । কিছুক্ষূণ দ্বিধাগ্রস্ত থাকার পর আলতো পায়ে বিছানা থেকে নেবে, চাবির গোছাটা নিয়ে বারকয়েক কৌতুহলী চেষ্টা করতে খুলে যায় সিন্দুক । আলুর বণ্ডের বই, পাকিস্তানের পুরোনো একশো টাকার নোটের একটা বাণ্ডিল, উনিশশো পঞ্চাশ সালের হলদে খড়খড়ে পাকিস্তান অবজার্ভার আর দৈনিক আজাদ, দুটো একই মাসের । একটা ছবিসুদ্দু বিঞ্জাপন লাল কালিতে ঘেরা । লাল শালুর পাক খুলে শতচ্ছিন্ন বইটা, গীতা নয়, লুপ্ত সোভিয়েত দেসে ছাপানো ‘দাস কভাপিটাল’, এত বছর পরও মোষের খুরের শিরীষ -আঠার ভকভকে স্তালিনি গন্ধ । সংগ্রাহকের জন্যে গর্বাচভের সৌজন্যে বইটার সোভিয়েত সংস্করণ এখন দুষ্প্রাপ্য । সিন্দুক বন্ধ করে পালঙ্কে ফেরে যিশু ।

পাড়সুতোর নকশিকাঁথা চাপা দিয়ে, ভাতঘুমের অলস তন্দ্রায়, অতীতে ভাসছিল ও, যিশু । ষোলো বছর বয়সে কুড়ি বছরের খুশিদিকে ছোঁয়া, বাহু ধরা, চুলে নারকোল তেলের গন্ধ । স্মৃতির আলতো জলপোকা ।

কোথাও দুপুর-কোকিলের চোরা-কুহু । পশ্চিমের জানলায় থোকা-থোকা ফিকে হলুদ নোড়ফল ঝোলানো গাছটার পেছনে মঞ্চস্হ হচ্ছিল সূর্যাস্তের দ্বিপ্রাহরিক মহড়া ।

কাজের সময় কোকিল ডাকে, ভাল্লাগে না বাপু । কপালে খুশিদির স্পর্শ আর কন্ঠস্বরে অস্বস্তিকর অস্হিরতা । যিশুর তন্দ্রায় ঝনৎকার ঘটে । যিশুর শিরা-উপশিরা যা টানটান বাঁধা, ছিঁড়ে গেল, আর শ্বাসনালিকায় মোচড় দিয়ে ওঠে অদম্য বিষাদ ।

তোমার বরের কী হল খুশিদি ?

কেঁপে উঠেছে খুশিদির চোখের পাতা, মুখমণ্ডলে অবিশ্রান্ত ক্লান্তি , হৃৎপিণ্ডে অশ্রুপতনের টুপটাপ । বিয়ে আর হল কই ! চারটে মোটে শব্দ, অথচ, অথচ জ্যোৎস্নায় ডোবা ভুতুড়ে ঝিলের মতন নিষ্পন্দ । বর্ধমান জেলার ছুতোর গাঁ’র সহদেব মণ্ডলের বড়ো ছেলে এখানের উপসাসথো কেন্দ্রে কাজ করতো, আমাকে দেখতে পেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল একাত্তর সালে । দশঘরার পোড়ামাটির পরি বলেছিল আমাকে দেখে । পালটি ঘর ছিল, কাসসপ গোত্তর । খুন হয়ে গেল । ধড় পাওয়া গেসলো, মাথা পাওয়া যায়নি । সবাই বললে, নকশাল ছিল, তা-ই । দাদাও সে কথাই বলেছিল । দাদা কী করে জানবে বল ? নকশাল তো ছিল ছোটো ভাইটা । নকশাল করলে বিয়ে করতে চাইবে কেন, বল ? গোপের হাটের আড়তদার রামরতন মণ্ডলও বিয়ে করতে চেয়েছিল । পনেরো বছর আগের কতা । দোকানে আগুন লেগে জ্যান্ত পুড়ে মারা গেল সে । আমি খুব অপয়া । খুশিদির চোখের নাব্যতা হয়ে ওঠে অতল । তুই কেমন আচিস যিশকা । কতো বড়ো হয়ে গেচিস, লোক অ্যাগবারে ।

দশঘরা অঞ্চলের টেরাকোটা, মাটির তলায় পুঁতে, তার ওপর মাস ছয়েক জলছড়া দিয়ে, কয়েকশো বছরের প্রাচীন আর দুর্মূল্য করে তোলার খবর জানে যিশু । দেখেছে । সন্তর্পণে ও বলল, অজানা ইনোসেন্ট নারীজীবনে প্রবেশ করে নিজেকে পুনরুদ্ধারের অভিপ্রায়ে, আমার সঙ্গে যাবে খুশিদি ? আমার কাছে ? পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু । ওর কথার ঈষদুষ্ণ ভাপে, সালোকসংশ্লেষে অক্ষম স্বর্ণলতার মতন খুশিদি যখুন যিশুর কাঁধে মাথা রেখে, হ্যাঁ জানায়, রেশমগুটির মধ্যে তুঁতপোকার মতন ভাবাবেগের আরাধ্য পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছে ও, যিশু ।

আমার শরীর কেমন-কেমন করচে । বুক ধড়ফড় করচে । কিছু আবার হবে না তো । বলেছিল সন্ত্রস্ত খুশিদি, আর যিশু উত্তর দিয়েছে, হোক, হওয়া দরকার, এরপর আর সময় নেই ।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেচিস । ঠিক সময়ে পাকা ফসল তুলে না নিলে শুকনো সরষেও তো খেতে ঝরে যায়, বল ? তোর কিচু হবে না তো ? কাঁধ থেকে মাথা তুলে, চুলে নারকোল তেলের পরিচিত গন্ধ, যিশুর মুখের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চেয়েছে খুশিদি, আর তারপর বলেছে, আমার কাচে তুষলাব্রতর সরষে আর মুলোফুল আচে । তোর বাকসোয় রেকে নিস ।

তুমি ব্রত করো ? কী-কী ব্রত করো ? যিশু কাঁধ নাচিয়ে হেসেছিল, শব্দহীন, যাতে রাহু কেতু অশ্লেষা মঘা বসতে না পারে ওর গায়ে । ইউরোপ আমেরিকা এশিয়া আফরিকার বহু নারীর হার্দ্র সঙ্গ কাটিয়েছে ও, যিশু । কিন্তু এই প্রথম একজনকে মনে হল আধুনিকতার স্পর্শদোষ থেকে মুক্ত ; সমূল নিসর্গপ্রকৃতির অন্তর্গত ।

হাসচিস কি ! ব্রতর অনেক গুণ । এই তো শাবনমাসে মনসার ব্রত করেছিলুম । পান্তাভাত আর সজনে শাগের পেসাদ খেতে হয় তখুন । তারপর ভাদ্দরে চরাচরি ব্রত করি । চরাচরি পুজোয় সব রকুমের পিঠে ভাজা হয় । আশিন সংক্রান্তিতে পিঠে-পুলি খেয়ে খেতে নল দিতে হয় । ভাদ্দরে জল, আশিনে নল, ধান ফলে গলগল, শুনিসনি ? পোস মাসে পোসতলা ব্রত করি । শাঁক বাজিয়ে চাল দুধ ফল ফুল গোড়ায় দিয়ে পাঁচ গাচা ধান তুলতে হয় পোসতলায় । যখুন নতুন-নতুন এসছিলুম শেষপুকুরে, গাছতলায় বিলরান্না করতুম । আজগাল আর হয় না খ বডডো ঝগড়াঝাঁটি হয় গাঁয়ে । ঘেঁটুব্রতর গান জানতুম আগে । সবায়ের বে-থা ছেলেপুলে হয়ে গেল । কথা বলার সময়ে খুশিদির হাত নাড়া দেখে মনে হচ্ছিল বাতাসের তোশক সেলাই করছে ।

চাষবাস, গ্রামজীবন থেকে বঙ্গসংস্কৃতি এখুন গিয়ে পৌঁছেচে কলকাতা শহরের শেকড়হীন নাচাকোদা, বাজনা-থিয়েটারে । পশ্চিমবাংলার ভূজমিন থেকে আর সংস্কৃতির সত্য অঙ্কুরিত হয় না । তা নকল কায়দায় পয়দা হয় অকাদেমি, অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, পার্টি অফিসে । খুশিদিই হয়তো শেষ বাঙালিনি ।

একবার ভবেশকার সঙ্গে মিছিলে হাঁটার সময়ে গলা ঢেলে গান গেয়েছিলুম তোমায় শুনিয়ে, মনে আছে ?

মনে নেই আবার ? বাঙালদের মিছিলে গিসলি বলে পিটুনি খেয়েছিলি । খুশিদির চোখের কোলের অনিশ্চয়তার কালি কিছুটা কমে । চোখের কোলের কালির জন্যেও নারীকে ভালো দেখায়, আশ্চর্য । নৈকট্যার ঝাপটায় গড়ে ওঠে অজ্ঞাতসার । যিশু দুহাতে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে শেষতম বাঙালিনিকে । অ্যাই, কী হচ্ছে কী, পাগল নাকি, ভালোবাসা এমনি করেই জানাতে হয় বুঝি ?  ছাড়াবার চেষ্টা না করে, গলা নাবিয়ে বলল খুশিদি । প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলোয়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত । সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে, মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে । খুশিদির জৈব প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয় । থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি ; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা ।

যিশকা নামে ডাকার আর কেউ বেঁচে নেই । ডাক-নামের মৃত্যু মানুষের জীবনে জলবিভাজক । তার অস্তিত্বে যে যিশকা নামের কেউ একজন কখনও ছিল তা টের পেল যিশু, এতদিন পর । বহুকাল, বহুকাল, বহুকাল পর ।

খুশিদির কোমরলগ্ন যিশু, খুশিদির ঘরে, সেগুনকাঠের নিচু খাটের ওপর, খুশিদিকে আবরণমুক্তির সময়ে, খুশিদি বলল, পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, কেউ কখনও আদর করেনি আমায়, আদর করার মতন কিচু আচে কিনা তা-ও জানি না, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেএএএউ নয় । আমি খুবই অপয়া ।

উদোম স্বাস্হ্যবতী চাষি-প্রৌঢ়ার প্রগাঢ় চাউনির দিকে তাকিয়ে, ফুঁ দেবার মতন আলতো কন্ঠস্বরে যিশু বলেছে, ওসব বোলো না । জানি, পনেরই আগস্ট তোমার জন্মদিন করত ভবেশকা । তোমাদের কলোনিতে তা দেখে গালমন্দ করত অনেকে, আর ভবেশকা তাতে কান দিত না । এসো, আমি চোখ না বুজে তোমায় তিরিশ বছর পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি । শরীর জুড়ে ঠোঁট বোলায় যিশু আর প্রতিবার বলে তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা । যিশু অস্ফুট বলতে থাকে, তোমার মুখের ভেতর থেকে রক্তচন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমার ঠোঁটে মধুপর্কের স্বাদগন্ধ, আম্রপল্লবের গন্ধ তোমার চোখের পাতায়, কানের লতিতে রক্তপদ্মের পাপড়ি, তোমার চুলে দুর্বাঘাসের সুবাস, তোমার এই হাতে কাঁচা ধানের সুগন্ধ । বেলপাতার সবুজ গন্ধ তোমার পায়ে, তোমার বুক থেকে ডাবের জলের গন্ধ পাচ্ছি । আআআআআআআঃ । কী মাখো তুমি ? অ্যাঁ ? কী মাখো ? কী মাখো ? কী মাখো ? আলো ? জল ? বাতাস ? সময় ? কী মাখো ?

চুপ করিসনি, তুই বলতে থাক রে, তুই বল । কিচ্ছু বুঝিনে তুই কী কইছিস, তবু তুই বল, বলতে থাক । আমু মুকখু । নাকতলায় তো তখুনই ইশকুল হয় । লেকাপড়া শেখায়নিকো । মুকখু, জানি আমি মুকখু । ঠোঁট দিয়ে খুশিদির চোখের কোল থেকে , অশ্রু পুঁছেছে যিশু । খুশিদির নাভি ঘিরে জেগে ওঠে নরম পরাগ-রোঁয়ার দল ।

বাইরের আমবাগানে চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেছে বাতাস । ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে রোদ্দুরের । চাপা উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে টুপ শব্দে মাটিতে পড়ল একাকী শিমুল । মাঝবয়েসি রোদের শেষ ফালিটুকু এসে পড়ে আছে বিছানার একপাশে । জানলার জংধরা শিকের বাইরে, নারকোল গাছের পাতায় বয়োবৃদ্ধ চিলকে ঘিরে গুটিকয় যুবা পাতিকাকের হাওয়া-সাঁতার হুড়দং । দক্ষিণের জানলায় পুরুষালী চেহারার ঝাঁকড়ামাথা খেজুরগাছ । তারপর থেকে, খুশিদির কাঁধের ওপর দিয়ে যতটা দেখা যায়, আলু খেতের সবুজ, খুপরি হাতে ময়লাটে রঙিন শাড়িতে আবছা কামিনেরা । ফড়িঙের ইচ্ছানুকূল স্পন্দন ছেয়ে ফেলছে চরাচর ।

মুখচোরা স্পর্শের আতিশয্যে খুশিদি এখুন প্রাণবন্ত পাথরে রূপান্তরিত , অন্তঃপুর নির্বাক, চোখের জলে গড়া মানবী । যিশু ওর দাঁত ঠোঁট মুখ দিয়ে খুশিদির চরণবন্দনা করে, জানুবন্দনা করে, স্তনবন্দনা করে, বাহুমূলবন্দনা করে, চোখবন্দনা করে । খুশিদি ফিরে যেতে থাকে তিরিশ বছর অতীতে প্রতিবেশী তরুণের শ্রেণি-নিষিদ্ধ সম্পর্কে, অপ্রত্যাবর্তনীয় সময়ে । অস্তিত্বের শীতাতপ আনাচকানাচ ভেসে যায় অবিরাম স্নিগ্ধতায় । জানা ছিল না এতকাল যে ওর নিজের শরীর এরকুম, যাকে এখুন দেহের আর মুখের ভাষায় যিশু করে তুলেছে পূজনীয়, অর্চনীয়, বন্দনীয়, আরাধনীয়, সাধনীয়, অহর্নীয়, উপাসনীয়, টের পায় যিশু । নিজের অর্চক, উপাসক, যাজক, জাপক, পূজক, সেবাইত, সাধক, আরাধককে সারা জীবনে প্রথমবার, পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম, সাহায্য করে খুশিদি নিজেকে অবাধ করে তুলতে । অস্ফূট উঃ, খুশিদির চোখবোজা, ক্রমাগত বলে চলেছে, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেউ চায় না আমায়, আমি মুকখু, আমি অপয়া । অবারিত যিশু, গড়ে তোলে স্বপ্নের দ্রুতশ্বাস সম্পখফ । তিরিশ বছর আগের না-মেটা আশ পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে । সুখানুভূতির অঢেল বখরায় মরা গাঙ প্লাবিত হয় ।

বাঁশের বেড়া খোলার ক্যাঁচোর শুনে উৎকর্ণ শঙ্কিত খুশিদি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত, পাক খেয়ে আনারদানা জামদানি জড়ায়, চোখের জল মোছে, হাত-খোঁপা বাঁধে, আর চাপা গলায়, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, বাইরে যা, বাইরে যা, এখুন তো দাদার আসার সময় হয়নি । ব্লাউজের হাতায় বাহু ঢোকায় । টেপা-বোতামের পট-পট শব্দ ।

ভীতির গভীরতায় অবাক যিশু বাইরে দাওয়ায় বেরিয়ে খুশিদি আর আগন্তুকের উদ্দেশে গলা চড়ায় , জাবেদালি এসেছে গো খুশিদি । বিশ্বাসবাবুর জন্যে খাসি কাটালে ভবঠাকুর, তাই পাটিয়ে দিয়েচে, আর এই হরিপালের দই, জানায় জাবেদালি ঘরামি, হিমঘরে নজরদার, থলথলে কালচে চাহারা, গোঁফ নেই, দাড়ি আছে, কুচকুচে । হিমঘরের নাটবল্টু পেরেক আলপিন ওর মুখস্হ । অনেক বন্ড কিনেছে নিজের নামে, নাবালক ছেলের নামে । পদবির বিশ্বাস শব্দটাকে কারা বিকৃত করবে তা মুখের দিকে তাকিয়ে টের পাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে যিশু ।

যিশকা এখেনে কদিন থেকে যাক না দাদা, কদ্দিন বাদে দেকা, ওর তো মা-বাপ কেউ নেই এসংসারে, আমরা ওকে পুষ্যি নিতে পারিনে ? ভবেশকা ফিরলে অবাস্তব প্রস্তাব করেছিল খুশিদি ।

কিইইইই যে আবোল-তাবোল বলিস ; বিলেত-ঘোরা লোক ও, আপিসের কাজে এয়েচে । তা থাকতে চায় থাকুক না কদিন, কিন্তু ব্যাবসা আর গাঁয়ের গপ্পো করিসনি ওর সঙ্গে ।

রাত্তিরে, মাংস খাওয়ার সময়ে, এই অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে যিশুর, আবার মনে হল, অন্ত্যজ বাঙালি পরিবার মোগলাই রান্না রাঁধতে পারে না, অথচ সবর্ণদের তুলনায় নবাব-সুলতানদের কত কাছে ছিল । যে হিন্দুর বাড়িতে এককালে ছাগলের মাংস আর মুরগি নিষিদ্ধ ছিল, তারা কিন্তু আজকাল নানা মোগলাই পদ দিব্বি রাঁধতে পারে । অরিন্দমের ছোটো ভাইয়ের বউ কত ভালো মাংস-পরোটা খাইয়েছিল অরিন্দমের জন্মদিনে । অরিন্দমের ছোটো ভাইটা তো সব রকমের মাংসই খায় ।

কে কোন তপশীলিকে সরকারি ব্রাহ্মণ বলেছিল বলে অরিন্দমের অফিসে ইউনিয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে কত চেঁচামেচি করেছিল গৌরাঙ্গ নাগুরি, রমাপদ বাইন, জগৎ মান্না, সদানন্দ সাঁই, আর ঝাড়পিট ঘিরে নাট্যমোদীর কেরানিমঙ্গল । চাকরি-বাকরির চেয়ে নিজের বুদ্ধি বিক্রির ব্যবসা বরং ভালো, এর রাজনীতিতে তেমন হ্যাঙ্গাম নেই । খুশিদির সেগুনকাঠের পেল্লাই খাটে, রং-ওঠা নীল নেটের মশারির মধ্যে শুয়ে ভাবছিল যিশু ।

খুশিদির ঘরটা প্রায় ফাঁকা । একটা ড্রেসিং টেবিল অন্তত কিনে দিতে পারত ভবেশকা, একটা ট্রানজিস্টর বা টু ইন ওয়ান । নিদেনপক্ষে ছবি দেখার জন্যে সিনেমার ম্যাগাজিন । গ্রামপঞ্চায়ের এখানে কেবল টিভি নিষিদ্ধ করলেও, একটা টিভি তো রাখতে পারত সরকারি চ্যানেল দেখার জন্যে । খুশিদিকে ঠিক কোন শতকে আগলে রেখেছে ভবেশকা কে জানে । তালা-দেওয়া ঘরগুনোয় কী আছে জানতে অহেতুক আগ্রহ হয় ওর, যিশুর ।

ভেতরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরে খাটে কটনের মশারি টাঙিয়ে খুশিদি বাতি নেভাবার পর, যিশু আলতো পায়ে ওর পাশে গিয়ে শুলে, কন্ঠস্বর উদারায় তুলে খুশিদি বলল, সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়, কাল তো আবার আপিসের খাটনি আচে । আর গলা নাবিয়ে বলল, দুপুরে যা সব বলছিলি, সেগুনো আবার বল । পারবি ? ওমা তোর বুকে তো চুল নেই রে ।

যিশু প্রণয়ের প্রণয়ন করে ।

তোমাকে অনেক বলার আছে খুশিদি ; একই কথা বারবার কেন বলব ?

না, না, দুপুরেরটাই বল, তখুন যেমন-যেমন করেছিলি । নিজের অস্তিত্বে উত্তেজনার ভণিতা চেয়েছে খুশিদি ।

তোমাদের খুলনার ভাষা তোমরা দুজনেই ভুলে গেছ ?

তিরিশ বছরের ওপর রইচি এই গাঁয়ে । এই গাঁয়েরই হয়ে গেচি । আমি তো ছোটো ছিলুম, কিছুই মনে নেই । দাদা গপ্পো করে কখুনো-কখুনো ।

আমি তোমায় দেখে ভেবেছিলুম, বিধবা হয়ে ফিরে এসেছ । ভবেশকা যে কেন বিয়ে না দিয়ে আইবুড়ো করে রেখে দিয়েছে । অনেক ভালো পাত্র পেত তোমার জন্যে । নিজেও করেনি ।

দাদার তো চোপরদিন হিমঘর আর পারটি আর চাষবাস আর সভা । তুই করিসনি কেন ?

আমি ? পড়াশোনো আর পড়াশুনো । তারপর রোজগার আর রোজগার । উন্নতি আর উন্নতি । ব্যাস, বিয়ের বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল । আর তারপর বাবা-মা মারা গেল ।

তুই তো বেমমো, না রে ?

যিশুর বেশ ভাল্লাগে খুশিদির অকৃত্রিম মর্মসত্তা । বলল, না, আমরা খ্রিস্টান, ফ্রানসিসকান খ্রিস্টান । আমাদের জাতের বাঙালি খ্রিস্টান কলকাতায় আর নেই । কলকাতায় জেসুইট,কারমেলাইট, ডোমিনিকান, অগাস্টানিয়ান জাতের বাঙালি খ্রিস্টানও আর নেই । কলকাতা এখুন নানা ধর্মের ট্যাঁসদের শহর, বুঝলে । হিন্দু ট্যাঁস, মুসুলমান ট্যাঁস, খ্রিস্টান ট্যাঁস । কিন্তু ছোটোবেলায় কতদিন বড়োদিনের কেক খাইয়েছিলুম, ভুলে গেলে ? অবশ্য তিরিশ বছর আগের মতন কেক আর হয় না । কেকের ময়দা তো এখুন দুপা দিয়ে মাড়িয়ে-মাড়িয়ে মাখে কলকাতায় ।

অতশত বুঝিনে, মোচরমান না হলেই হল । খিশিদির অজ্ঞানতার আহ্লাদ, আরো গভীরে, জানায়, তা বেমমোও যা খ্রিস্টানও তাই । আমিও তাই, বল ? কিন্তু দুপুরবেলা তুই আমার জন্যে হিন্দুর মন্তর পড়লি যে বড়ো । শুয়ে শুয়েই, যিশু কাঁধ নাচিয়ে আহ্লাদিত ।

জানলায় ফিকে শীতের শ্রবণসুভগ শুক্লপক্ষের স্তব্ধতা । ভুলো মনের বাতাসে আওয়াজ নেই । যিশু ফিসফিসিয়ে, তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব আমি । আমার কাছে ক্যামেরা আছে , কাল ফোটো তুলব তোমার ।

খুশিদির বিষণ্ণ উক্তি, আমার কোনো ছবি নেই, কেউ তোলেনি আজ ওব্দি । ভোটের ছবি তুলেচে যেন শাঁকচুন্নি । তারপর বহুক্ষুণ নিরুত্তর থেকে, কিন্তু কী করে যাব, দাদা এক পা-ও যেতে দেবে না । চাদ্দিকে দাদার পঞ্চায়েত, কিসক সভা, হ্যানোত্যানো কমিটি, হিমঘর, সমবায়ের লোকে গিজগিজ করচে । কী করে এড়াব ? সবাই চেনে আমাকে ।

বৈশাখী পূর্ণিমার মেলা আসছে তো । গাঁয়ের মুখে তো বিরাট মেলা বসে শুনেছি । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কেউ খেয়াল করবে না । আমি কলকাতা থেকে টানা গাড়ি আনব ।

শরীর কেঁপে ওঠে খুশিদির । যিশুর মাথাকে চেপে ধরে উন্মুক্ত বুকে । যা ভালো বুঝিস, কর । কিচ্ছু ভাল্লাগে না আর । রাত্তিরেও চুল আঁচড়ে শুস ? এক লহমায় যিশু ফিরে গেছে মায়ের কোলে । চাঁদের আলোর ক্ষীণ স্বাদ ওর জিভে । রোমকূপের গোড়ায়-গোড়ায় পড়ে গেছে সাজো-সাজো রব । একত্রে অনোন্যোপায় হয়ে ওঠে দুজনে, অভিভূত, দিশেহারা, বিভোর, আচ্ছন্ন । অন্ধকারে তিরতির করে কাঁপতে থাকে অন্ধকার । চোরাবালির কেন্দ্র থেকে প্রসারিত হাতের অনুনয়ের মতন খুশিদির নিঃশ্বাস । একে আরেকের ব্রাহ্মমুহূর্ত গড়ে তোলে আর প্রশমিত করে পারস্পরিক স্পন্দন ।

প্রাকভোরে, শুক্লপক্ষ তখুনও কৃষ্ণপক্ষে ঢলে পড়ার জন্যে তৈরি হয়নি, ঘুম ভেঙে গেলে খুশিদি যিশুকে ঝাঁকায় । এখুনো ঘুমোসনি, নিজের বিছানায় যা, বিপদ হবে শেষকালে । যিশু যখুন মশারি তুলে বেরোতে যাচ্ছে, ওর বাঁ হাত ধরে, না যাসনে, আমার কাছে থাক । যৌবন ফুরোতে থাকা নারী-পুরুষ চুপচাপ পাশাপাশি শুয়ে নৈশব্দ্যের খাঁই মেটায় । চরাচরের অপার্থিব উম কনশিকাঁথার রূপ নিয়ে ঢেকে রেখেছে ওদের দুজনকে । বহুদূরে, কোনো পথকুকুরের খেদোক্তি শোনা যায় । এই এভাবে পরস্পর, একেই বোধয় শুশ্রুষা বলে, প্রাণ জুড়োনো বলে, মনে হচ্ছিল যিশুর ।

অ্যাতো জমিজিরেত প্রতিপত্তি কী করে করলে গো তোমরা ?

বিনময় করে । জানিস তো, বিনময় ? ওখেনে আমাদের খেতখামার ঘরদোরের বদলে এখেনে কে একজন ফরোজন্দো মোমেনিন ছিল, তার সঙ্গে অদল-বদল । তক্কে-তক্কে ছিল দাদা ।

ওঃ বিনিময় ! কখুনো তো টের পাইনি ?

তুই আবার কী টের পাবি ? তখুন কতই বা বয়েস তোর ।

গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে পেছনের ওসারায় এসে দাঁড়ায় যিশু । সকাল হয়ে এল । স্পষ্টবাক বিবাহযোগ্য কোকিল ডাকছে । সঙ্গে ফস্টিনষ্টি আরম্ভ করেছে ফাল্গুনের প্রেমানুভূতিময় কচি-কচি বাতাস । বেশ ভালো বাগান করেছে ভবেশকা । ঘষাকাঁচ কুয়াশা দেখা যাচ্ছে দূরের ঠান্ডা দোচালাগুলোকে ঘিরে । সজনেফুল আঁকড়ে সদ্যোজাত লিকলিকে সজনে ডাঁটারা বেরিয়ে এসেছে রোদ্দুরের উড়ন্ত উনকির সঙ্গে খেলবে বলে । কাঁটাকাঁটা সবুজ ছুনিফলের মুকুটে তালঢ্যাঙা রেড়িগাছ । পুকুরের পাড়ে মুখ তুলে পাতাহীন গাছে আমড়ার ফিকে সবুজ বউল । ছোটো-ছোটো প্রায়ান্ধকারে দোফলা গাছে পুরুষ্টু সফেদা । পাকা আর ডাঁসা অজস্র টোপাকুল, আলতো নাড়ালেই ঝরে পড়বে গোঁসা করে । গা ভরতি নানা মাপের সবুজ আঁচিল নিয়ে কাঁঠাল গাছ । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে মুখে পাউডার মেখে নার্সারি স্কুলের খোকাখুকুর মতন জামরুল ফুলের দলবদ্ধ কুঁড়ি । লালচে-সবুজ ছাই মেখে কচি খসখসে ফলসা পাতা । নরম তুলতুলে গুটিপোকাকে আলগোছে খেয়ে ফেলল ময়নাপাখি । কত রকুমের পাখির ডাক । বেলা হলে আর শোনা যায় না তো ! গলায় কোরালের মালা ঝুলিয়ে মোচা ফেলছে সুপুরিগাছের সারি । জীবনমুখী গায়কের দ্রুতলয় গিটারের মতন বাঁশের শুকনো ফ্যাকাশে গাঁটে কাঠঠোকরা ।

খালি গায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাতাস । বাতাসে ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । দানদিকের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নিচে খেলা করার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলটলে পুকুর । আঁশটে গন্ধের ঐতিহ্যলালিত কুচোপোনার ঝাঁক ভেসে আছে আলতো রোদে ভেজা প্ল্যাঙ্কটন-পোকা খাবে বলে । ঘাটের জলে কাঁসার এঁটো বাসন । স্হানীয় চোরেরা ভবেশকাকে বেশ ভয় পায় বোধয় ।

কত জল পুকুরটায় । কত্তো । কলকাতায় হরদম ফেরুল নোংরা, জলের পাইপ পাম্প করার ঝঞ্ঝাট, স্টপকক চুরি, ফি-দিন মেরামত । জলের জন্যে টেনশানের চূড়ান্ত । অথচ এই অজ পাড়াগাঁয় অগুনতি পুকুর । ভবেশকার পুকুর তিনটের মধ্যে এটা সবচে ছোটো । পুকুরের উত্তরে গোয়ালঘর । সঙ্কর গাই রয়েছে দুটো, জার্সি ।

কত কি করে ফেলেছে ভবেশকা । দেশভাগের দরুন তাহলে জোতদার বিনিময়ও হয়েছিল । এগাঁয়ের লিগি মুসুলমান গিয়ে ইস্তাহারি রাজনীতিতে দড় হিন্দু জোতদার এল। মূল্যবোধ যে কে সেই । খুঁটিগুনোর তেমন তফাত হয়নি । তিরিশ বছর আগের ভবেশকার স্লোগান লাঙল যার জমি তার আজ ফলে গেছে । হালবলদ, জোয়াল-লাঙল ভবেশকার, জমিও ভবেশকার । সমন্বিত গ্রামীণ বিকাশ, প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প, ডোকরা, সাক্ষরতা অভিযান, রক্তদান শিবির, মৎস্য উন্নয়ন, পঞ্চায়েতের বরাত, তাঁতিদের সুতো, ত্রাণ প্রকল্প, তপশিলি কল্যাণ, হ্যান-ত্যান কমিটি, সমবায় তাপবিদ্যুৎ, স্বাস্হ্যকেন্দ্র, লোন-দাদন, আলুর বন্ড, ক্লাব, পুজো, নাটকদল, মেলা, বায়োগ্যাস, ধোঁয়াহীন চুলো, প্রশিক্ষণ, মডেল শৌচাগার, সব ভবেশকার, ভবেশকাদের, সব, সব, সঅঅঅঅব ।

পাতালের আলু, মর্ত্যের গতিপ্রকৃতি আর স্বর্গের খুশিদি, সমস্তকিছু ভবেশকার কবজায় । শাসনে এত আলু যদি সংরক্ষণ করা না-ই যাবে, পড়ে-পড়ে নষ্ট হবে, হিমঘরে গিয়ে পচবে, যাহোক-তাহোক দামে বেচে দিতে হবে চাষিকে, তাহলে বিঘের পর বিঘে পরিশ্রম, টাকা আর সময়ের অপচয় কেন ? ব্লকের আর জেলার আধিকারিকরা করছিলটা কী ? কী করছিল ? অ্যাঁ ?

কোনো একটা অচেনা পাখির ডাকে চমকে উঠেছে যিশু । স্পষ্ট শুনেছিল পাখিটার গান । পরপর তিনবার পাখিটা বলল, ‘বাল ছিঁড়ছিল’।

তিন সত্যিই করেছিল পাখিটা । পরের বছর নিশ্চয় প্রচণ্ড দাম বাড়বে । তখুনও কৃষি আধিকারিকরা একই কাজ করবে । ওঃ । চার বছর আগে আলু হয়েছিল একান্ন লক্ষ টন, যখুন কিনা সারা পশ্চিমবঙ্গের হিমঘরে রাখার জায়গা ছিল বাইশ লাখ টন । এবছর হয়েছে সত্তর লাখ টন । রাখার জায়গা আটাশ লাখ ।

যিশু ভেবেছিল বুঝি কাঁচা ফাল্গুনের ঘাসে শিশির মাখতে বেরিয়েছে একজোড়া বেঁজি, তার আওয়াজ । পেছন ফিরে দেখল ভবেশকা, নিমডাল পাড়ছে নাবালক গাছ থেকে । বলল, এ নাও যিশু, নিমের দাঁতন করো । খ্রিশ্চানরা কি দাঁতন করে ? টুথব্রাস বেরোবার আগে কী করত সিরিল র‌্যাডক্লিফ ? আর কঘর বাঙালি খ্রিশ্চান রইল হে এদেশে ? চার্চ-টার্চ যাও ? নাকি সেসবও বাইরের লোকেরা হাতিয়ে নিয়েছে ? নাকতলায় ডালগিশ সায়েবের বাড়িটা আছে ? ডালগিশ তো তোমাদের জ্ঞাতি, না ? তারপর ডালগিশের বাটলার, আরদালি, বাবুর্চি, খাদিম অনেকঘর খ্রিশ্চান তো ছিল নাকতলা-বাঁশদ্রোণিতে ?

প্রশ্নাবলীর দাঁতন-বুলেটে যিশুর একাগ্রতা ছত্রভঙ্গ । অপ্রস্তুত, ও বলল, হ্যাঁ, ডালগিশ পরিবারে বাবার মাসির বিয়ে হয়েছিল । বাঙালি খ্রিস্টান বলতে গেলে আর নেই কলকাতায় । বাবা তো ওদিকের বাড়ি বেচে সেই আপনারা কলোনি ছাড়ার বছর দুয়েক পরেই পার্ক স্ট্রিটে ফ্ল্যাট কিনেছিল । সারা পশ্চিম বাংলায় আমিই শেষ বিশুদ্ধ বাঙালি খ্রিস্টান ।

হ্যাঁ, বলছিলে বটে । অত বড় বাগানবাড়ি ছেড়ে শেষে সেই ফ্ল্যাটে ! তা বেশ, বেশ । নাটকের চরিত্রের চিৎপুরি সংলাপের মহড়ার ঢঙে ভবেশকা । হিমঘরের লাইসেন্সটা আমরা শিগগিরই রিনিউ করিয়ে নেব । কোথায় আটকে আছে জানোই তো, অ্যাতো হিমঘর দেখেছো ঘুরে-ঘুরে । ড্রাই অ্যান্ড ওয়েট বাল্ব-থার্মোমিটারের অর্ডার দিয়ে রেখেছি ঠিকমতন তাপ মাপার জন্যে । পরিচালন সমিতির কার্যবিবরণীও এবার থেকে রেজিস্টারে লিখে রাখার ব্যবস্হা থাকবে, পরিচালকরা সই করবে তাতে । ডিফিউজানের বদলে বাঙ্কার পদ্ধতিতে পালটালে খর্চাখরচ কেমন পড়বে তার একটা তলবি-সভা হবে দিন-সাতেকের মধ্যে । বিজলির চেয়ে ডিজেলের খরচটা হয়তো কম, তাই আরকী । তারপর বিদ্যুৎ তো আজ আছে কাল নেই । দাঁতনের সঙ্গে চিবিয়ে-চিবিয়ে সেই প্রশ্নগুলোর একনাগাড় উত্তর দিয়ে গেল ভবেশকা যেগুলো মোমতাজ হিমঘরের কর্মীদের  করেছিল যিশু, অথচ তারা সঠিক জবাব দিতে পারেনি বা চায়নি ।

ওহ-হো, ভবেশকা আমি এখানে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে আসিনি, বলেছি তো তোমায় । রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা নাবার্ড কিংবা অমন কোনো ক্ষেত্রসমীক্ষক সংস্হার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই । আমি নিজের কনসালটেনসি খুলেছি তো । একসঙ্গে অনেক কাজ নিয়ে ফেলি, কুলোতে পারি না একলা । এই কাজটা মিৎসুবিশির জন্যে করছি । ওরা আলুর নানারকুম ব্যবসায় ঢোকার আগে জেনে নিতে চায় । আমি তো চাষবাসের ব্যাপার বিশেষ জানি না । তাই বাড়তি কথা জিগেস করে ফেলি ।

হ্যাঁল য়যোতাজপুরের মামুদ মাফুজ বলছিল, তুমি নাকি ওর বাপের কাছে জানতে চেয়েছিলে মাদার সিডের ব্রডকাস্টিং কখুন হয় । আমরা বলি বীজ আলু পাতা । আরেকটা কথা । তোমার রিপোর্টে লিখো যে আমি এই ব্লকে কাভুর জাতের লাভজনক ওল চাষে সফলতা পেয়েছি । কাভুর ওলে মুখি বিশেষ হয় না, গলা কুটকুট করে না, ছোটো-ছোটো টুকরো কেটে আলুর মতন বসানো যায় । তোমায় খাওয়াবো অখন, তা হলে টের পাবে । আগে এখেনে সবাই সাঁতরাগাছি ওল চাষ করত । সিঙুর, বলরামবাটি, বাসুবাটি, মির্জাপুর, ঝাঁকিপুর, বারুইপানা সবখানে এখন কাভুর বসাচ্ছে চাষিরা । পা#চশো গ্রাম বীজে দশ কেজি মতন ওল পাচ্ছি, বুঝলে । অনেকে তো ওলের সঙ্গে বাড়তি ফসল হিসেবে লাল শাগ কি নটে বুনছে । বকবকম ফুরোলে, নিম দাঁতনের সঙ্গে ওলের জ্ঞান-চেবানো কথাবার্তা একদলা থুতুতে পালটে থুক করে রজনীগন্ধার ঝাড়ে ফেলল ভবেশকা । শিউরে উঠল ফুলগুলো ।

ধবধবে ফুলগুলো শিউরে উঠছে, স্পষ্ট দেখতে পায় যিশু । এই সাতসকালে ওলের জ্ঞানে বিব্রত লাগে ওর । কেনই বা প্রসঙ্গটা, আর কী-ই বা উদ্দেশ্য, ঠা্র করতে পারে না ও । চন্দ্রমুখী ধেকে ওকে কাভুরে নাবাচ্ছে ভবেশকা । পরের বছর আলুর দাম তিনচারগুণ বেড়ে গেলে শ্রমিক-মজুরদের খোরাকিটা ওল দিয়ে সামলাবার জন্যে সম্ভবত নিজেকে আগাম তৈরি করছে পশ্চিমবাংলার বঙ্গসমাজ ।

ভবেশকা নিমজ্ঞান চেবানো বজায় রাখে । চোত-বোশেখে ওল লাগালে ভাদ্দর-আশ্বিনে ফি-একরে পঞ্চাশ কুইন্টাল মতন পাচ্চি, বুঝলে । আলু যাদের মার খেলো, ক্ষতি নেই, পুষিয়ে নেবে । বোরো থেকে পোষাবার উপায়নেই । চাষের জল নেই । আরেক-দলা থুতুর ছিবড়ে পড়ে রজনীগন্ধার জামাকাপড়ে । আচমকা প্রসঙ্গ পালটে যেতে শোনে যিশু । আমাদের পঞ্চায়েত বিদ্যুতের বিল বাকি রাখে না কখুনো, বুঝলে, একটা রেকর্ড সারা পশ্চিমবঙ্গে । আরেকবার থুতুর পর বকনা বাছুরটাকে আঙোই পেড়ে ডাকে ভবেশকা ।

জল তাহলে এক ভয়ংকর সমস্যা । এই তো মনে হচ্ছিল গাঁয়ে কত জল । মাটির তলাকার জল যাতে রাজ্যসরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাই ব্লকগুনোকে কালো, ধূসর, সাদা, তিনরকুম ভাবে ভাগ করতে বলেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক । কিন্তু কে কার কথা শোনে । চাষিকে বারণ করলেই অন্য পার্টিতে গিয়ে ঢুকবে । যার যেখানে ইচ্ছে শ্যালো বসাচ্ছে । সাদা ব্লক ধূসর হয়ে গেল । জল ফুরিয়ে ধূসর ব্লক হয়ে গেছে কালো । তারপর আর জল নেই । জল নেই তো জেলাশাসককে ঘিরে চেঁচাও । যেন কালেক্টর সায়েব মুতে-মুতে মাটির তলাটা আবার ভরিয়ে দেবে জলে । এরপর খাবার জলও জুটবে না । চাষের কীটনাশক চুয়ে-চুয়ে পাতালের জলও দূষিত হয়ে গেছে ।

কত নদীর বুকে, আজকাল, না, সাঁতার নয়, সাইকেল রেস হয় । নিজের চোখে দেখেছে যিশু । আর শুধু বোরো কেন ! ওই তো, বাঁকুড়ার মড়ার, বেলসুলিয়া, বাঁকদহতে রবি মরশুমে শ্যালো বসাতো না কেউ । উপচে পড়ত কংসাবতীর খালের জল । আচেরুদ্দি মল্লিক, আরেফ মণ্ডল জোড়া পাঞ্জাবি বলদ বিক্কিরি করে শ্যালো বসিয়েছিল খালের ধারেই । জল ওঠেনি । অক্টোবরে পাতা র‌্যাশন আলুর চারা বাঁচাতে গোরুর গাড়িতে ড্রামে করে ডিপ টিউকলের জল এনে ঢেলেছিল । বাঁচেনি । দিলশাদ বায়েন, আফিফ দালালদের চোপসানো চোখমুখ দেখে আগামী সংসারের দিনকাল আঁচ করেছিল যিশু ।

ওদিকে মেদিনীপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর, বাদলপুর, সাতমাইলের চাষিরা ভোগরাইতে গিয়ে উড়িষ্যা কোস্ট ক্যানালের লকগেট অপারেটারদের মোটা টাকা খাওয়ালে তবেই সেচের মিষ্টি জল জোটে। বাদলপুর পঞ্চায়েতের সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক দেবেন জানা নিজেই বলেছিল, নিজে । মাঝি-মালোরাও শংকরপুর মেছোঘাটায় ভুটভুটি নিয়ে যাবার জন্যে গাঁটের মালে হাসি ফোটায় অপারেটারবাবুদের মুখে । ফেরার পথে কিলো দশেক মাছ গচ্চা যায় । স্বাধীনতার আগে লোকে ওই খালে নৌকো বেয়ে কলকাতায় যেত, জানেন স্যার । বোরো তো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমসি হয়ে গেল । এবারে আর ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা হবে না, দেখে নেবেন, হবে জল নিয়ে ।

বহিরাগত, বহিরাগত, বহিরাগতর মতন এই হুগলি জেলার খানাকুল, মারোখানা, ডোঙ্গল, রামমোহন, চিংড়া, ধনেখালি, পাণ্ডুয়ায় দেখেছে যিশু, অশান্তির তোয়াক্কা করছে না চাষি । মুণ্ডেশ্বরী, শংকরী, দ্বারকেশ্বর নদী আছে । জল নেই । ডি ভি সি আছে । জল নেই । বড়োসায়েব জিপগাড়ি আছে । জল নেই । ভজহরি ভুঁইয়া সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল । ছোপছপে শংকরীর এখানে-সেখানে হাঁটু জলে বেআইনি বোরো বুনছে চাষি ।  মজা-যাওয়া কানা দামোদর আবার বর্ষায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় হুগলি-হাওড়ায় । ত্রাণবাবুদের ঢল নাবে ।

গড়চুমুকে আটান্ন কপাটের স্লুইসগেট কোন কাজেই বা এলো, বলুন দিকি ? যিশুকে সরকারি আধিকারিক ঠাউরে অভিযোগ করেছিল ক্ষুদিরাম ঢাং । বছর কুড়ির আগের বাণে দ্বারকেশ্বর রাস্তা পালটে সেঁদিয়ে গিসলো গোয়ালসারা, খিলগাঁ, চোটডাঙল, শ্যামবল্লভপুর, কৃষ্ণবল্লভপুর, কলাগাছিয়ায় । নদী তো শুধরে ফিরে গেল আগের খাতে । চাষের জমিতে ফেলে গেল এক মানুষ গভীর ধু-ধু দিগন্তের বালি । হাজার তিনেক জাতচাষি এখুন দিনমজুর । দিনমজুর হলেই তো আর কাজ জোটে না !

সেচ দপ্তর কী করে ? গ্রামোন্নয়ণ দপ্তর কী করে ?

অচেনা পাখির ডাকে, পর পর তিনবার, সোচ্চার জবাবে চমকে ওঠে যিশু । ভাবনা গুলিয়ে যায় ।

শেষবার থুতু ফ্যালে ভবেশকা । কী, এখুনও ছোটোবেলার মতন চমকাও নাকি ? ন্যাচুরোপ্যাথি করো না কেন ? আমার তো আলসার সেরে গেছে ।

কটা দাঁত আর আছে ভবেশকার যে নিমের ডাঁটাটা সজনে খাড়ার মতন চিবিয়ে ফেলেছে ? নকল দাঁত হলে দাঁতন কেন ?

নিমডালের কুচো-থুকথুক সেষে বলল, কালকে যখুন তোমার মা-বাবার দুর্ঘটনায় মারা যাবার খবরটা শুনলুম, মনটা বড্ডো খারাপ হয়ে গিসলো । ওঁয়ারা না থাকলে তো খুশিটা মানুষ হতো না । কত দুঃখের দিন গেছে । ঘাটে বসে পুকুর-কুলকুচো করে ভবেশকা ।

বাবা-মায়ের দুর্ঘটনার সূত্রেই আদিত্যর সঙ্গে যিশুর পরিচয় । বাগবাজারে গিসলো বাবা-মা, নয়ন সাহা লেনে ফাদার নরম্যানকে সেকেলে ধর্মান্তরিত বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের এখনকার হালহকিকতের তথ্য দিতে, অবহেলিত সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে । বিরল প্রজাতির এই ধর্মসম্প্রদায়ের নিশ্চিহ্ণ হবার কারণ গবেষণা করছেন ফোর্ড ফাউন্ডেশানের আওতায় । বাবা ছিলেন শেষ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে চাদর, পায়ে পাম্পশু খ্রিস্টান । ক্রিসমাসের দিন মা পরতেন গরদের শাড়ি । খাঁটি বাঙালি খ্রিস্টান মেয়ের সন্ধান করতে-করতে যিশুর বিয়ে দেওয়া হল না ।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে, ল্যাজ-ওড়ানো ঘোড়ায় বসা নেতাজির মতন দেখতে ব্রোঞ্জের মনীষীর চোখের সামনে, হাত উঁচিয়ে ট্যাক্সি ধরতে গেলে, তিন নম্বর রুটের প্যাঙপেঙে জবেদকা বাসের ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে রক্তাক্ত, মায়ের ডান হাত তখুনও  বাবার বাঁ হাতের মুঠোয় । রাস্তার লোকেরা প্রথমে বাসটাকে জ্বালিয়ে আর চালককে পিটিয়ে মেরে ফেলে, তারপর একটা পথচলতি প্রাইভেট গাড়িতে বাবা-মাকে চাপিয়ে নিয়ে গিসলো আর জি কর হাসপাতালে । পথেই মৃত্যু ।

মৃতদেহ অশনাক্ত অবস্হায় আর জি কর থেকে মাছি ভনভনে লাশগাড়িতে মেঝের ওপর দোল খেতে-খেতে চলে যায় নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে । সারারাত, পরের দিনও যিশু হন্যে হয়ে খুঁজেছে থানায়, চার্চগুলোয়, বাবার বন্ধু আর প্রাক্তন সহকর্মীদের বাসায়, হাসপাতালে । তৃতীয় দিন এন আর এস মর্গে পৌঁছে স্তম্ভিত । চাপা কান্না আর অসহায় ক্রোধে কন্ঠরুদ্ধ, ও আবিষ্কার করেছিল উদোম উলঙ্গ বাবা-মাকে । দুজনেরই বাঁ হাত আর কাঁধ থেঁতলে গেছে । ঘড়ি, চশমা, পার্স, আংটি, হার, চুড়ি তো নেই-ই, রক্তে ভেজা পোশাক আর অন্তর্বাস হাপিস। মা-বাবাই কেবল নয় । মর্গের টিমটিমে শীতের ইঁদুরমরা গন্ধে গাদাগাদি পড়ে আছে অনেক লাশ । উলঙ্গ । কাঠ। স্টার্ক নেকেড, ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে পড়ে আছে প্রত্যেকে । উদ্ভিন্ন কিশোরী, পীনোন্নত গৃহবধু, ঢাউস প্রৌঢ়া, হাড়গিলে বৃদ্ধার হাঁ-মুখ-খোলা চেয়ে-ধাকা মৃতদেহও রেয়াত পায়নি ।

মৃতদেহ খালাস করতে গেলে, কালু ডোমের স্পর্ধিত হাসির খিক-খিক সিগারেট টুসকি ভোলা যাবে না । এসট্যাবলিশমেন্টের নির্মম হাসিখানি । মহানগর কলকাতা আজ এইসব কালুয়া মুদ্দোফরাসের বজ্র-আঁটন মুঠোয় । ধর্মমঙ্গলের কালু ডোম এখুন পশ্চিমবাংলার নিখিল মর্গের যক্ষ । থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে সেখানে মুদ্দোফরাসের খিকখিকের বদলে পেটমোটা সরকারি হাসির খাকিরঙা গিগগিগ । পশ্চিমবঙ্গে হাসির সরকারিকরণ হয়ে গেছে । সোশাল অ্যাকশান ফোরামের শিশির ভট্টাচার্য, মানবাধিকার কমিশনের চিত্তোষ মুখোপাধ্যায়ও প্রতিষ্ঠানের উত্তরঔপনিবেশিক ডোমদের কাছে অসহায় । শেষে, একেবারে শেষে, ভেঙে পড়েছে যখুন, যখুন ওপরতলায় ধরাধরি ব্যর্থ, অরিন্দমের মাধ্যমে আদিত্য বারিকের কাছে পৌঁছেছিল যিশু । আদিত্যর দৌড়ঝাঁপে রেস্ত রফার পর খালাস করতে পেরেছিল মৃতদেহ ।

আদিত্য কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, এগুলো একটু-আধটু মেনে নিতে হয় যিশুদা । মন খারাপ করে লাভ কী ? স্বাধীনতার পর কত লোকের স্বজন যে অজান্তে পচেছে, কানের লতি নাকের পাটা চোখের পাতা খেয়ে ফেলেছে ইঁদুরে, মনে হয়েছিল যিশুর, ওফ, বীভৎস, বীভৎস ।

কী হল, কাঁদছ নাকি যিশু ? ভবেশকা বাঁ হাত রাখে ওর, যিশুর, কাঁথাঢাকা কাঁধে । লাল সুতো দিয়ে নকশা-করা একজোড়া উড়ন্ত প্রজাপতির ওপর রেখেছিল হাতটা । যিশু জানায়, না, আজকাল ভোরবেলা আমার চোখ দিয়ে জল পড়ে । ডাক্তার বলেছে কান্নার থলিটা চোখের তলা থেকে কেটে বাদ দিতে হবে ।

যিশি কিন্তু জানাল না যে ক্যরটেজে কফিনদুটো নিয়ে গিয়ে সমাধিস্হ করার দিন বিকেলেই, ও যখুন কমপিউটার টেবিলের সামনে অনাহারে ক্লান্ত ধানশীষের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছিল, দেয়ালে ভাসাই-এর সেকোয়েরার গড়া কাঠের বেদনাময় খ্রিস্ট, পার্ক স্ট্রিটের বাতিস্তম্ভে হ্যালোজেনের বিষাদে রবিবারের রাস্তা একদম একাকী, হৃদরোগের অতর্কিত আক্রমণে চেয়ার থেকে লুটিয়ে পড়েছিল সাদাকালো চৌখুপি মোজেকে । রক্তচাপ ছ্যাঁৎ করে পড়ে গিয়ে ওপরে সত্তর নিচে চল্লিশ, নাড়ি স্পন্দন কুড়ি । হুঁশাহুঁশহীন স্হানান্তরিত হয়েছিল, এত জায়গা থাকতে, কত জায়গায় খ্রিস্টানদের সুবিধে থাকতে, বাইপাসে একটা হাসপাতালে, যেখানে গেট থেকে ঢুকেই হিন্দু দেবতার মন্দির ডাক্তারদের দায়মুক্ত করার জন্য সদাজাগ্রত ।

যিশুর চব্বিশঘন্টা কাজের ছেলেটা, উত্তর দিনাজপুর ভাঙাপাড়া গ্রামে বাড়ি, পতিতপাবন কীর্টনীয়া, পুতু, যাকে কমপিউটার, ফ্যাক্স, ই-মেল, অডিও কনফারেনসিং, ইনটারনেট চালাতে শিখিয়ে দিয়েছে যিশু, সামনের ফ্ল্যাট থেকে অজয় ব্যানার্জিকে ডেকে আনতে, ওই অজয়ই ভরতি করিয়েছিল হাসপাতালটায়, চেনাজানা আছে বলে ।

নিজেই প্রচণ্ড টেনশনে ছিল অজয়, তবু অনেক করেছিল । ও তো নিজেও একলা থাকে ।  ওর দিদির হেনস্হার খবর সেদিনই বেরিয়েছিল খবরের কাগজে । যিশুকে ভরতি করে, পতিতপাবনকে ইনটেনসিভ কেয়ারের সামনে বারান্দায় বসিয়ে, বাগবাজারে নরম্যান সায়েবকে খবর দিয়ে, রাত্তিরের দূরপাল্লার ট্রেনে গিয়েছিল দিদির কাছে ।

কী হয়েছিল হে ? পুতু বলছিল নাকি অনেক নোংরামি ? বিছানায় শুয়ে, অজয় অসহায় ফিরে এলে, জানতে চেয়েছিল যিশু ।

কথা বলার আগেই ফুঁপিয়ে উঠেছিল অজয় । তারপর সরি বলে, ধাতস্হ হবার পর, যা বলল, তা শুনে, ওষুধগন্ধের পারদর্শী মশারির শীতাতপে শুয়ে, যিশুর মনে হয়েছিল, এসব স্বাধীনতা-উত্তর সমাজ আর দেশভাগোত্তর হিন্দুত্বের দোষ । খ্রিস্টান সমাজে এরকম ঘটনা অসম্ভব । কালু মুদ্দোফরাসের ইবলিস ঔরসে জন্মতে আরম্ভ করেছে বাঙালিরা ।

দিদি বেঙ্গলি কোলফিল্ড উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস । শুক্কুরবার ইশকুল খোলার সময় গেটের মুখে নানা বয়সের ছাত্রী আর তাদের বাবা-মা চাকর-চাকরানির সামনে একদল লোক কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে, শাড়ি-ব্লাউজ ছিঁড়ে দিয়েছে, তাদে মধ্যে মহিলাই ছিল বেশি । আসলে, একদল স্হানীয় নেতা ইশকুলের মধ্যেই জোর-জবরদস্তি দুটো ঘর জবরদখল করে আরেকটা ইশকুল চালাচ্ছিল বলে দিদি ওদের সেই কবে থেকে বলছিল সময়টা আরেকটু এগিয়ে নিতে, যাতে মাধ্যমিকের ক্লাস আরম্ভ হলে বাচ্চাদের চেঁচামেচি এড়ানো যায় । কথায় কান দেয়নি ওরা । দিদি তাই রেগে-মেগে জবরদখল করা দুটো ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল । তাইতে এই অবস্হা। ভেবে দেখুন একবারটি ।

সে আবার কী রে বাবা ! ইশকুলের মধ্যেই জবরদখল ইশকুল ? শুনিনি তো আগে । বলেছিল হতবাক যিশু । একদল ছত্রাক-প্রতিম বাঙালির কাছে জবরদখল একটা ভালো আর বৈধ মূল্যবোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে । ঘরবাড়ি জমিজমার জবরদখল ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে ও । ওদের নিজেদের ধানি জমি দখল হয়ে কলোনি হয়েছিল । তখনকার ওই অঞ্চলের মুসুলমান চাষিগুলোর জমি বসত দখল হয়ে পরের প্রজন্মে তো বলতে গেলে চাষবাস থেকে একেবারে উৎপাটিত । কিন্তু ইশকুল দখল করে ইশকুল ! নাঃ, ভাবা যায় না ।

হাসপাতালের সেবিকা মেনকা পাইক পাশে দাঁড়িয়ে গল্প গিলছিল । বলল, যাকগে, আর এসব শুনতে হবে না, মনিটর দেখুন হার্টবিট পঁচাশিতে চড়ে দপদপ করছে ।

হাসপাতালের কর্তারা এমন লোভী যে ভরতি হবার সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকিয়ে দিসলো ইনটেনসিভ কেয়ারে । তারপর টানা পনেরো দিন রেখে দিলে আই সি সি ইউতে, যিশু একজন মালদার রুগি টের পেয়ে । দরকার ছিল না, তবু দুবেলা ইসিজি, ইকো, রক্তের নানা পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান, অ্যানজিওগ্রাফি । তারপর বেলুন অ্যানজিওপ্লাসটি করে, কুঁচকির ওপর স্যান্ডব্যাগ চাপিয়ে, খাটের হাতলে পা বেঁধে রাখলে । মান্ধাতা আমলের সব চিকিৎসা পদ্ধতি । অনেক রুগি এদের খপ্পরে পড়েছে ঢাকা-চাটগাঁ থেকে এসে । যন্ত্রপাতি স্টেরিলাইজ করা ছিল না বলে যিশুর ডান দিকের উরু হাঁটু পর্যন্ত জোঁক লাগার মতন ছিট-ছিটে কালো ফোসকায় ভরে গিয়েছিল । ওফ, দুঃস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন । সরে উঠে ফেরার পর পুতু পুজো দিয়ে এসেছিল নবদ্বীপের মায়াপুরে, হিন্দুদের চার্চে ।

ইনটেনসিভ কেয়ারটা ছিল বিশৃঙ্খলা, অযত্ন, দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা আর অকর্মণ্যতার স্বর্গরাজ্য । ছোকরা ডাক্তার-ডাক্তারনিগুনো শোবার পোশাক পরে রাত্তিরে ঘুমুতে চলে যায় রুগিদের প্রতি খেয়াল রাখার বদলে । সেবিকা, নার্স আর ঝি-চাকরগুনো ঢুলতো পালা করে, নাকও ডাকত । মাঝেমধ্যে বকরবকর ফস্টিনষ্টি । হাঁসফাস রুগির উদ্দেশে ইয়ার্কি থামিয়ে ডাক্তারকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনতে-আনতে, দেখেছিল যিশু, শরীরে বারতিনেক খিঁচ ধরে সে টেঁসে গেল । রুগির মরে যাবার পর, বাইরে রাত-জাগা অভূক্ত দিশেহারা স্বজনকে ডেকে এনে, মৃতের দেহে লাগানো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চক্রাবক্রা সবুজ আলো দেখিয়ে, মুখে অভিনয়ের কাঁচু আর মাচু এনে বলেছে, পেশেন্টের অবস্হা খুব খারাপ, আমরা চেষ্টা করছি, ভগবানে ভরসা রাখুন । আত্মীয়রা বাইরে বেরিয়ে যেতেই ঊর্ধ্বতনরা অধস্তনদের নির্দেশ দিয়েছে, ডেডবডি এখন রিলিজ করিসনি, বিল সেকশান থেকে আগে পুরো পেমেন্টের কনফার্মেশান আসুক ।

শুনে-শুনে আর দেখে-দেখে, প্রতিদিন অন্তত একবার, মনে হয়েছিল যিশুর, ভগবান লোকটা হিন্দুদের অসাধারণ আবিষ্কার । তা না ঈশ্বর, না দেবতা ।

আত্মীয়স্বজনকে, মৃত অথচ জীবন্তের-অভিনয়রত রুগি দেখানো হয়ে যাবার পর, যন্ত্রপাতি অতিতৎপরতায় খুলে, খরচাপাতির কাগজ বানিয়ে, কমপিউটারে যোগফল মিলিয়ে, লাশকে সাদা চাদরে ঢেকে, স্ট্রেচারে চাপিয়ে, অপেক্ষারত ভগ্নহৃদয় আত্মীয়কে বলা হত, অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমরা, বাঁচানো গেল না । হোটেলের মতন, হাসপাতালটায় লাশেরও চেকআউট টাইম আছে । লাশ তো আর বলবে না যে সে অনেক আগেই চেকআউট করেছে, বিলটায় একদিনের বাড়তি খরচ দেখানো হয়েছে ।

দেখা করতে এসে সদ্য-পরিচিত আদিত্য বারিক বলেছিল, এসব মেনে নিতে হয় স্যার, সমাজ ব্যাপারটা তো চিরকাল এরকুমই ।

একজন পয়সাঅলা মারোয়াড়ি বুড়িকে অপারেশানের পর মেডিকাল চেয়ারে বসিয়ে, মুখের ওপর ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে, যাতে না ঘুমিয়ে পড়ে, লেডি অর্থোপেডিক সার্জেন হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে এসে দেখে, ইনটেনসিভের ইনচার্জ ডাক্তারটা, বুড়িটা যন্ত্রনায় চিৎকার করে প্রলাপ বকছিল বলে, কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশান দিয়ে অজ্ঞান করে নেতিয়ে রেখেছে । বুকের ওপর মাথা-ঝোলানো ধনী পরিবারের গৃহকর্ত্রীর সামনে, ইনটেনসিভের কাঁচঘরে আধমরা মানুষদের মাঝে দাঁড়িয়ে, দুই ডাক্তারের সে কী বাংলা-ইংরেজি খিস্তিখাস্তা । যিশুর মনে হচ্ছিল নিউইয়র্কের হার্লেমের ফুটপাতে শুয়ে গালাগাল শুনছে ।

কোনো রুগি প্রলাপ বকলে, ঝি-চাকরগুনো মাঝরাতেও তাকে নকল করে ভ্যাঙাত, যেন রাস্তার নির্মম চ্যাংড়ারা লেগেছে পাগলের পেছনে : মাঁ কোঁতায় গ্যাঁলে, জঁল খাঁবো জঁল খাঁবোঁ ডুঁডু খাঁবোঁ, ওঁরে আঁলোঁটা জ্বেঁলেদেঁ, যঁতীন কিঁ এঁলো, ওঁ মাঁ মঁরে গেঁলাঁম, ওঁহ আঁর কঁষ্ট সহ্য হঁয় নাঁ ঠাঁকুর, বাঁবাঁগোঁ আঁর পাঁরছি নাঁ, বাঁড়ি নিয়েঁ চঁল রেঁ, বাঁড়ি যাঁবোঁ, হেঃ হেঃ হেঃ, দাদু, সকালে পোঁদে ডুশ দেবো, আর চেঁচিও না । ভাষার নতুন কলোনাইজারদের বচননাট্য ।

শেষদিন তো কর্মীদের অতর্কিত স্ট্রাইকের ধাক্কায় বিজলিবাতিহীন ইনটেনসিভে একসঙ্গে তিনজন মরে গেল । আন্দোলনের কোল্যাটরাল ড্যামেজ ।

ভেলোর যাওয়া উচিত ছিল, বলেছিল ফাদার নরম্যান, বা কোনো খ্রিস্টান হাসপাতালে ।

হাসপাতালটায় কমবয়সী অগুন্তি নগণ্য মাস-মাইনের প্রশিক্ষার্থী নার্স । সবাই বলে সেবিকা । কলকাতায় শব্দের খেলায় বেশ্যারা যেমন যৌনকর্মী, মুটেরা যেমন শ্রমিক, ঝি-চাকররা যেমন কাজের লোক, তেমন ফালতু কাজের জন্য সেবিকা । শাসক তার শোষণপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেবার জন্য শব্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে রূপের প্রতিরূপ ।

শিশ্তথুতনি মেনকা পাইক মাছের কাঁটা বেছে, ভাত মেখে, যিশুর মুখে একগাল পুরে বলেছিল, কাকুদা, তোমায় তো শুয়ে-শুয়ে খেতে হবে এই কয়দিন । মুখের মধ্যে মেনকা পাইকের তর্জনী মধ্যমা অনামিকা যখন যিশুর অস্তিত্বকে স্পর্শ করেছে, মায়ের জন্যে অদম্য মন-কেমনের হাহাকারে আচমকা ফুঁপিয়ে উঠেছে ও, গোপনে । শোকের রক্তাভ শিহরণ কন্ঠকে রুদ্ধ করে ছড়িয়ে পড়েছিল ফুসফুসে ।

মেনকা নিজের নাম বলেছিল ম্যানকা । লেখা না বলে বলত ল্যাখা । জোড়াভুরু ছিপছিপে স্বাস্হ্যবতী, কালোর মধ্যে চটক, অতিসোনালি কানের দুল, প্যাতপেতে লালফুল ছাপাশাড়ি, মুখমণ্ডলে ঘামের ফসফরাস দ্যুতি, দুচোখে দুষ্টুবুদ্ধি বন্যের অদৃশ্য চোরাস্রোত, চকচকে কোঁকড়া চুল টানটান বাঁধা ।  আরেকজন, কিশোরী-থেকে-তরুণী মেবেকে সঙ্গে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একদিন ভিজিটিং আওয়ারে, আমার বুইন কাকুদা, মহাকরণে কাইজ করে ।

কোন বিভাগে ?

কুন ডিপাট রে তর ?

তিন তলায় ।

কৃষি আধিকারিক ডক্টর ত্রিবেদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিল যিশু, বাঁ হাতের আঙুলে ঝোলানো অনেকগুলো কাপ, ডান হাতে চায়ের কেটলি ।

ইশ রে, কাকুদা ! কেমন আছে তোমার শরীর ? একেবারে সেরে গেছে তো ? সম্ভাষণের আহ্লাদ উপভোগ করেছিল যিশু । চালু-চায়ের অনুকাপে চুমুক দিয়ে, বি-বা-দী বাগের আকাশে দেখেছিল, ছাইমাখা মেঘেদের সফরসূচি চূড়ান্ত করতে বেরিয়ে পড়েছে কালবৈশাখী ।

চলি রে কেটলি, একদিন তোদের দুজকে তাজ বেঙ্গলে লাঞ্চ খাওয়াব, মেনকাকে কথা দেয়া আছে । বলে, নিচে নেবে বেরোবার মুখে, দ্রুতগামী ট্রেনের নিশুতি শব্দের মতন বৃষ্টি । ওফুটে কারপার্কের মাকাল গাছে, ঠোঁটে খ্যাংরা নিয়ে ভিজছে স্হপতি কাকপুরুষ । আকাশচুম্বী হাওয়ায় প্রতিভাদীপ্ত বিদ্যুতের স্নায়ুপ্রদাহে, কাতরে ককিয়ে ওঠে কয়েকটা অল্পবয়সী মেঘ ।

ওঃ, মরে গেলুম হুজুর, আহ, আরেব্বাপ, অঁক, ছেড়ে দিন স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না স্যার, উঃ বাপরে, আঃ, বাবাগো, আআআআঃ ।

আদিত্যর জন্যে বহুক্ষুণ অপেক্ষারত অরিন্দম অসুস্হ বোধ করছিল ক্রমশ, লকাপ থেকে ছিটকে-আসা আর্তচিৎকারে । বমি-বমি আসছিল । অরিন্দমের কাহিল প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল টেবিলের ওদিকে মিটিমিটি তাগড়া ভুঁড়িদাস পুলিশ অফিসারটা, বোধয় ইন্সপেক্টার । অনেকবার এসেছে বলে মুখ-চেনা, বলল, আপনি বরং নিচে গিয়ে গেটের কাচে টাটকা হাওয়া নিন । আসলেই পাঠিয়ে দোবো ।

অরিন্দম উঠে পড়ল ব্রিফকেস নিয়ে । দশ কুড়ি পঞ্চাশ একশো টাকার প্যাকেট এনে দিতে বলেছিল অরিন্দমকে ওর অফিস থেকে । আদিত্যর বোনের বিয়ের যৌতুক । থোক টাকা থাকলে উঁচু জাতের ভালো চাকরে পাত্র পাওয়া সহজ, পাত্রী যে জাতেরই হোক না কেন । এই একগাদা টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে চায় না অরিন্দম । মা, ছোটো ভাই বা তার বউ জেনে ফেললে কেলেঙ্কারি । পাটনায় থাকতে হঠাৎই একবার ও মাসকতকের জন্যে পাগল হয়ে গিসলো বলে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল । পা ব্যথা করছিল । এই শহরের চতুর্দিকব্যাপী নিনাদে হারিয়ে যায় আর্তনাদ আর কাতরানির ছোট্টো-ছোট্টো শব্দকণা । আক্রমণ আর আত্মরক্ষার উপস্হিতি সারাটা শহরের চরাচর জুড়ে । পুরুষকর্মীদের চাউনি রুমার দিয়ে মুখের ওপর থেকে পুঁছতে-পুঁছতে বাড়ি ফিরছে আলগা চটকের গৃহবধু কেরানি । সঙ্গিনীর সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু গণেশঠাকুরের শুঁড় ডানদিকে শুভ না বাঁদিকে । ক্ষীণস্বাস্হ্য সরকারি বাস চলে গেল, নাগরিক বোঝাই, ফোঁটার মতন মানুষ ফেলতে-ফেলতে, জিরোবে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের জ্যামে । বাসে উঠলেই লোকে বসতে চায় এ শহরে, যুবকরাও, যাতে কাঁধে কাঁধ না মেলাতে হয় । দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অভ্যাসমতন পথচারিণীদের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল অপ্রস্তুত অরিন্দম । খিনখিনে ট্যাক্সির কাতার । ডিজেলের নাকজ্বালানো ধোঁয়া । ধোঁয়া-ধুলোয় মুখ ভার করে আছে আকাশ ।

অফিসে আবার এলেন কেন অরিন্দমদা ? পেছন ফিরে আদিত্যর থমথমে চেহারা দেখতে পেল অরিন্দম । মানুষকে নিজে হাতে পেটানোর আহ্লাদ থেকে, মুখের আনন্দময় প্রতিভা থেকেই  বেশ বোঝা যাচ্ছে, আর কোনও দিন মুক্তি পাবে না আদিত্য । প্রতিনিয়ত ওর দরকার পড়বে প্রহারযোগ্য দেহ, সারাজীবন । রিটায়ার করলে কী করবে ও ?

তোমায় তো বাড়িতে পাওয়া যায় না ।

তা নয় । এসব টাকাফাকা অফিসে রাখতে চাই না । দেখলেই তো হিংসে ।

কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও । ছুটি তো ? এখুন ?

কী যে বলেন না, এখুনও কবুলতি লেখানো হয়নি । চলুন ওফুটে চায়ের দোকানটায় একটা ছেলে আছে আমাদের গ্রামের । ওর হাতে পাঢিয়ে দেব । আদিত্য বিব্রত বোধ করে অরিন্দমের সারল্যে । নোটগুনো কোথা থেকে এলো, বড়ো মাপের নোট কেন, কিছুইকি সন্দেহ করে না অরিন্দমদা ? টিকে আছে কী ভাবে অমন অনর্থক বোকামি নিয়ে !

বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের ধর্মশিবপুর গাঁয়ে, অজয় নদের তীরে, আদিত্য বারিকের বাস্তুভিটে । ঝিলুট থেকে কাঁচা রাস্তা আছে গ্রামে যাবার, তৃণমূল-কংরেস-সিপিয়েম মকদ্দমাবাজিতে আধখ্যাঁচড়া । সপ্তম পাঁচসালায় রাস্তাটা হবার আগে গাঁয়ে ফুলপ্যান্ট পরে ঢোকা যেত না বর্ষাকালে । কাঁধে বেলবটম, বাঁহাতে জুতোজোড়া, আন্ডারওয়্যার পরে ঢুকতো কলকাতা-বর্ধমানের কুটুমরা । ওদের গ্রামটা বাদে আশপাশের গ্রামগুনো মুসুলমান চাষিদের । জোতদার বর্গাদার কামলা সবাই মুসুলমান । ধর্মশিবপুরে আজ যাদের বাস, সেসব শীল, কাঁসারি, বারিক, কর্মকার, সাহা, শূর, পাল, কুণ্ডু, দাঁ, সাঁপুই, বায়েন, গায়েন, সরদার, পোড়েল পরিবার এসেছিল গঙ্গারাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমের মন্ত্রী বিষ্ণু সিংহের রাঢ়দেশ অভিজানে সঙ্গী হয়ে । সেসব গৌড়ীয়দের প্লেস অব ডোমিসাইল এখন রাঢ় ।

র‌্যাদক্লিফ সায়েবের ভয়ে নেয়ামত মণ্ডল পালিয়েছিল পাকিস্তানে । পরে হাওয়া বুঝতে এলে নরহরি মণ্ডল নেয়ামতের একশো ছেচল্লিশ বিঘে জমি কিনে নিয়েছিল পচা আলুর দরে, মগফেজের দলিলে তারিখের গোলমাল করে । পাকা দলিল হয়নি, তাই রেজেস্ট্রি হয়নি । এর মধ্যে একশো বিঘে ছিল খোদখামার আর ওয়াকফ চিরাগি জমি, যা নরহরির ছেলে সত্যসাধনকে দিয়ে খাস লিখিয়েছিল ভূমিসংস্কার দপ্তর, আর যা রাঢ়ের লোক পায়নি । চাষবাস না করেও তার অনেকটা পেয়ে গেসলো সন্তোষ দাসের মামাতো ভাই । সন্তোষ দাস এ-তল্লাটে পার্টি করার জন্যে এসেছিল সত্তর সনে । বে-থা করে থেকে গেল । নিজেদের এখুন দাশ লেখে, বলে কায়েত ।

প্রথমে মুসুলমান গাঁয়ে-গাঁয়ে বকবক বকবক করে গান্ধির কোল থেকে মার্কসের কোলে চাষিগুনোকে তুলে নিয়ে গিসলো সন্তোষ জেঠু । মুসুলমানগুনো তো চালাক কম নয়, আগাম টের পায় । ওরা সদাসর্বদা শাসকের সঙ্গে আছে । কী লাটসায়েব, কী ফজলুল হক, কী নাজিমুদ্দিন, কী সুরাবর্দি, কী বিধান রায়, কী জ্যোতি বসু । হলে হবে কী ! কোথ্থেকে একদল কিশতিটুপি-পরা লিগি এসে ফিসফিস-গুজগুজ চালালে যে মুসুলমানগুনো আর সাউ সরদার নাইয়া ঘরামি পদবি রাখতে চায় না । মেটে মসজিদগুনোকে ওব্দি সবুজ তেলরঙে ছুপিয়ে ফেলেচে ।

প্রতিভা ছিল বটে সন্তোষ জেঠুর, বুঝলেন অরিন্দমদা, নইলে সহদেব মন্ডলের ছেলেটা নকশাল হয়ে ওর মুন্ডু কেটে লটকে দিত না, নিজের গ্রামর অরিন্দমকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল আদিত্য । শৈশবে দেখা সেই দৃশ্য আজও, সময় বুঝে, আদিত্যকে কাবু করে । বুঝলেন অরিন্দমদা, আমার মামার বাড়ি ছুতোর-গাঁ গ্রামের পরামাণিক শ্মশানসাধুরা মানুষের মুণ্ডু ঝুলিয়ে চোত সংক্রান্তির ভোরে যে নাচ দেখাত, তার চে ভয়ের দৃশ্য ছিল বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো সন্তোষ জেঠুর কাটামুণ্ডু । সারারাত শিশিরে-ভেজা জলজ্যান্ত মুণ্ডুটা চোখ রাঙাচ্ছিল, যে দেখতে গেছে তাকেই ।

সেই কবে, ছোটোবেলাকার কথা, পরের বছর শ্মশানসাধুদের হাতে ঝোলানো মুণ্ডুগুনোর মধ্যে দুটো ছিল সহদেব মণ্ডলের দুই ছেলের । ছোটোটা পূর্বস্হলী, ওই যে, গেছেন তো আপনি, ওখানে গুলি খেয়ে মরেছিল । বড়োটার ধড় পাওয়া গিসলো হুগলির শেষপুকুর গ্রামে । বুঝলেন অরিন্দমদা, সাধুরা অনেক দিন ধরে মাথাগুনো মাটিতে পুঁতে রেখেছিল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে, গাজনাতলায় নাচবে বলে । এখুন তো কাটামুণ্ডু বেআইনি হয়ে গেছে বলে সাধুরা কুলি দিয়ে কাজ চালায় , দুধের বদলে ঘোল, আর কি । তার ওপর নাপতেরা আর কেউ সাধু হতে চায়না । তার চেয়ে গেরুয়া পরে হিন্দু পলিটিক্স করলে তবু কিছু পয়সাকড়ি হয় । চলুন না মামার বাড়ি, ব্রামভোন অতিথি পেয়ে মামামামিদের আনন্দই হবে ।

আমার তো গায়ে পৈতে-ফৈতে নেই ।

আরে ও তো পুরুতমশাইকে সকালে অর্ডার দিলে বিকেলে সাপ্লাই দিয়ে দেবে । পুরুতটা আবার বিজেপি, আগে সিপিয়েম করত । সিপিয়েমের পুরুত আসে কালনা থেকে । লোকটা স্টেট ব্যাংকে সিকিউরিটি গার্ড । চলুন না, জিপের ব্যবস্হা করি থালে ।

চলো যাওয়া যাক, ওয়েস্ট বেঙ্গলের অত ইনটিরিয়রে যাইনি কখুনও ।

খড়্গেশ্বরী নদীর ধারে ছুতোর-গাঁ গ্রামে আদিত্যর মামার বাড়ি । ঈশানেশ্বরের খেসসা গান, ফোকলা দাঁতে, আদিত্যর দিদিমার উদ্ভাসিত কন্ঠে, পুলকিত করেছিল অরিন্দমকে । দুই মামা মিলে বর্ধমানে ফার্নিচারের দোকান খুলে, বেতাহাশা কাঁচা পয়সা করেছে, জমিজিরেত, ট্রলিট্র্যাক্টর, চারাকাটার যন্তর, বিলিতি গাই, দুটো শ্যালো, আড়াই  বিঘের পুকুর । আদিত্য যখুন বাবার কাঁধে চেপে মামার বাড়ি যেত, মামারা এত সচ্ছল ছিল না । কোচবিহার থেকে কাঠের টানামালের ব্যাবসা করে দিন ফিরিয়ে নিয়েছে । দহরম আর মহরম উঁচু মহলে । এফিডেভিট করে রায় পদবি নিয়েছে । মেয়েদের জন্যে ফরসা উদারচেতা বর পেয়েছে, মোটা টাকা যৌতুক দিয়ে।

বুঝলেন অরিন্দমদা, ছোটোমামা দৌড়ঝাঁপ না করলে, এ এস আয়ের ইনটারভিউটা গুবলেট হয়ে যেত । দুরাত্তির ওর মামারবাড়িতে থেকে, অরিন্দমের মনে হয়েছিল, আদিত্যর মামারবাড়ির সবায়ের গা থেকে র‌্যাঁদামারা কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরোয় । সত্যি । বড়োমামার শালকাঠ, বড়োমামির সেগুনকাঠ, ছোটোমামার নিমকাঠ, ছোটোমামির শিশুকাঠ । মাতুলালয় যেন ছালছাড়ানো গাছের জঙ্গল ।

কোচবিহারে তুফানগঞ্জে, মানসাই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তো মামাদের, মানে আমার মায়ের, মামাতো ভাই । একবারটি ওখানেও নিয়ে যাব আপনাকে । লুকিয়ে-লুকিয়ে আসাম থেকে কাঠ আসে । অবশ্য কাকেই বা লুকোনো । বনকর্মীরা ব্যবস্হা করে, মাস মাইনে পায় ।

তোমাদের শিডুল হপ্তা আর ওদের শিডুল মাস ?

বিক্কিরি বাবদ তোলা দিতে হয় আলফা আর বোড়োদের, সোনার বাংলা থেকে চিনের আর পাকিস্তানের বোমাবন্দুক আনার জন্যে । একটু ইদিক-উদিক হলেই ডুয়ার্সে এলেমজি চলে । কুমারগ্রাম, বকশির হাটে ছানবিন হয় । হাঃ হাঃ, পুলিশকেও তো দিতে হবে । ছোটোমামা নিজেকে টিম্বার মাফিয়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসে, কিন্তু কাঠের ব্যাপারিরা সে স্বীকৃতি দিতেই চায় না ।

কলকাতায় না থাকলে কোনো কিছুতেই স্বীকৃতি মেলে না ।

ছুতোর-গাঁ’র মুসুলমানগুনো ধর্মশিবপুরের মুসুলমানগুনোর চে ফরসা । করিম মুনশি আর ফরিদ মোল্লার বাড়ির সবাই ফরসা আর ঢ্যাঙা । দাদু বলে ওরা সব খাঁটি আর আমাদের গাঁয়ের কেলটেগুনো পাতি । ফরসা না হলে আমেদ মামুদ করিম জালাল নামগুলো ঠিক মানায় না । বুঝলেন অরিন্দমদা, ছুতোর-গাঁ’র নাম পালটে রায়গ্রাম রাখার দৌড়ঝাঁপ চলছে । বড়োমামা বলছিল, ছুতোর-গাঁ’র কুসুমেটে তেঁতুলে, দুলে, বাগদি, হাড়িয়া সব এফিডেভিট করে রায় হয়ে গেছে । মামাদের চে উঁচু পরিবার বলতে উগ্রক্ষত্রিয় মন্ডলরা আর ব্রামভোনরা ।

জমিদাররা যখুন ছিল, তখুন স্হাপত্য বলে একটা ব্যাপার ঢুকেছিল গ্রামগুনিয় । এখুন তো গ্রামে-গ্রামে তোমার মাম,আদের মতন পয়সাওলা লোক কম নয় । অথচ কোনো নতুন স্হাপত্য দেখা দিল না উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের পল্লিসমাজে । গরিব সাজাটাই এখুন গ্রামবাংলার স্হাপত্য ।

ভাগ্যিস অর্ডার দেওয়া পৈতেটা পরেছিল অরিন্দম । আদিত্যর দিদিমা-মাইমা-ছোটো বউদির কাছে ওটার জন্যে অনাস্বাদিত খাতির চলছে । অরিন্দমের চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো ওর দিদিমা আর মামিরা চান সেরে এসে হঠাৎ পায়ের কাছে মেঝেয় ঢিপ-ঢিপ । এই জন্যেই গ্রামে যেতে অস্বস্তি হয় । জাতিপ্রথা বেশ জেঁকে টিকে আছে ভেতরে-ভেতরে , নানা জাতের মানুষ এখুনও এক সারিতে খেতে বসতে চায় না, বামপন্হী রাজনীতির শেকড়ের ফ্যাঁকড়া ছড়ালেও  । অবশ্য ছোটো ভায়ের বিয়ের সময়েও পরতে হয়েছিল রেডিমেড পৈতে ।

তোমার বড়ো মামার ছেলে-বউকে দেখলুম না ?

বড়দা-বউদি ফিবছর পুজোয় চাইবাসায় শ্বশুরবাড়ি চলে যায় । ওখানে দশজন জামাই মিলে খুব হইহল্লা হয় । সত্যি, আরে স্ট্রাইক করেনি আগে । পনেরো বছর বিয়ে হয়েছে বড়দার, কিন্তু কোনও বার পুজোয় নিজের মা-বাপের কাছে থাকেনি ।

তুমি বিয়ে করে কী করো দেখা যাক ।

পুলিশে কাজ করে বিয়ে করার ঝামেলা আছে । আপনি করে ফেলুন না বিয়েটা । ব্রামভোন বাড়িতে কুচ্ছিত মেয়েরও রূপ থাকে । ছুতোর-গাঁয়ে ব্রামভোনরা সব ঈশানেশ্বরের পুজুরি, বুঝলেন তো । স্বাধীনতার পর সব মন্দিরের দখল নিয়ে নিয়েছে ব্রামভোনরা । দুলেদের ধর্মরাজের মন্দিরটা নিয়েছে । দেয়াসি তাঁতিরা বুড়ো-গাছতলায় কালাচাঁদ মন্দিরের সেবায়েত ছিল ; তাদের হটিয়ে সেটাও হাতিয়েছে । ব্রামভোনগুনোই দেশটাকে ডোবাল । জহোর্লাল তো ব্রামভোন ছিল, তাই না ?

একটা মন্দিরের মধ্যেই অতগুলো পুতুল ডাঁই করে রাখা দেখলুম । ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে নাকি ? শ্রীহীন দেবতাদে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অবশিষ্টাংশ !

আপনাদের আজগালকার ব্রামভোনদের ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে বড্ডো অচ্ছেদ্দা । ওগুনো ধর্মঠাকুরের মূর্তি । মামারবাড়ির এদিকটায় অনেক-অনেক মন্দির ছিল আগে । এখন আর কে দেখাশোনা করবে বলুন ? সেসব ঠাকুরের থান থেকে এনে রেখেছে ওই মন্দিরে । কত মূর্তি তো চুরি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেল  । অবশ্য বিদেশে গিয়ে যত্ন-আত্তি পায় মূর্তিগুনো, সেও তো একরকুম পুজোই, বলতে গেলে । সেবায়েতরা আজগাল দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমানে রিকশা চালায়, হকারি করে । বর্ধমানে দেখলেন তো, ঠেলায় চাউমেন বেচছে, আমায় যে দাকলে, ও ছেলেটা তাঁতি বাড়ির ।

আমাদের ধর্মশিবপুর গাঁয়ের অনেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রানিগঞ্জ, আসানসোল, নিরসা, গোবিন্দপুর, ধানবাদ গিয়ে দুপুরুষ কয়লাখনিতে কুলিগিরি করছে । এমন সাতবাষ্টে হাড়গিলে চেহারা করে ফেলেছে, যে দেখলে টের পাবেন না বাঙালি না বিহারি, হিন্দু না মুসুলমান । আমরা তো ঠাকুদ্দার জন্যে পার পেয়ে গেলুম, নইলে কী দশা যে হতো । তল্লাটের মুসুলমানগুনো তো সোশালিস্ট ছেড়ে মুসলিম লিগে ঢুকে পড়েছিল, বুঝলেন, তার মধ্যেই ঠাকুদ্দার দৌলতে আমাদের ফ্যামিলির নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ভেদিয়া বেরাণ্ডা ছাড়িয়ে নিগন কৈচর উজানি কোগ্রাম ওব্দি । ঠাকুদ্দা তো বাবাকে ওয়ার্ধা আশ্রমে নিয়ে গিসলো । জহোর্লালের কোলে-বসা বাবার ফোটো আছে । তখনও টাক পড়েনি জহোর্লালের । সেসব এখন বাক্সবন্দি । আর বোধয় বেরুবে না ।

তোমার পুলিশে চাকরি এবার অন্যরকুম ইজ্জত এনে দিয়েছে, কী বলো ?

ধুৎ, ইজ্জত-টিজ্জত নয় । ভয় পায় লোকে । বেশ ভাল্লাগে লোকেদের ভয় পাওয়াটা । শ্রদ্ধার ভালোলাগার থেকে ভয়ের ভালোলাগাটা সুপিরিয়র । হাঃ হাঃ ।

তুমি ছুতোর-গাঁ, ধর্মশিবপুর, মঙ্গলকোটের অ্যাতো গল্প জানলে কোথ্থেকে ? ঠাকুদ্দার কাছে ?

না-না । ইশকুলে আসলাম স্যারের কাছে । ভুগোল পড়াতে-পড়াতে লোকাল ইতিহাস পড়িয়ে দিত । নিজেকে বলত রাঢ়ীশ্রেণি পাঠান । পূর্বপুরুষ কে একজন মোহম্মদ শামিম খান নাকি আলিবর্দি খাঁর সেনাদের সঙ্গে আরবি ঘোড়ায় চেপে বর্গিদের তাড়াতে-তাড়াতে এসে পৌঁছেছিল কাটোয়ায় । গঙ্গারাম নামে একজন কবি ছিল আগেকার  কালে, তার লেখা মহারাষ্ট্রপুরাণে আছে নাকি গল্পটা । আসলাম স্যার তো কুচকুচে কালো । আর ঘোড়াটার টাট্টু বংশধররা এখন মন্তেশ্বর কিংবা দাঁইহাটে এক্কা টানে ।  হাঃ হাঃ, এক্কাও উঠে গিয়ে চাদ্দিকে ভ্যান রিকশা অটো ম্যাক্সি-ট্যাক্সি চলছে । আসলাম স্যার আজও ভূগোলের ক্লাসে ইতিহাস পড়ায় । ইতিহাস তো গপপো, বানিয়ে নিলেই হল । ভূগোল তো তা নয় ।

এখুনও পড়াচ্ছেন ? স্কুলমাস্টাররা তো শুনি রিটায়ার করে পাঁচসাত বছর ওব্দি পেনসন পাচ্ছে না ।

টাকের ওপর টুপি পরে আঙুল দিয়ে সাদা ধবধবে দাড়ি আঁচড়ায় আর দুপুরে ছেঁড়া আসন পেতে দেয়ালমুখো নামাজ পড়ে টিচার্স রুমে । এখুন তো টিচার্স রুম বলতে পশ্চিমের নোনা ইঁটের স্যাঁতসেঁতে ঘরটা, প্রায়ই ঠান্ডা খড়ামারা মেঝের ওপর দিয়ে গোখরো সাপ এদিক থেকে ওদিক নিশ্চিন্তি মনে চলে যায় । ছাত দিয়ে জল পড়ে । এখুন তো একটাও ক্লাসঘরে দরোজা-জানলার আড়কপাট নেই ।

আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল অরিন্দম । নিজেকে ঘিরে গ্রেটনেসের বুদবুদ তৈরি করতে চাইছে ও, আদিত্য । সবাই, ওর চেয়ে ছোটো, দরিদ্র, নিকৃষ্ট, দুস্হ, শ্রীহীন, অবহেলিত । অনেক মানুষ প্রেমহীনতাকে ভালোবাসে । অরিন্দম বলল, তুমি তো নিজেই স্কুলে  মাস্টারির চেষ্টা করেছিলে, বলেছিলে একবার।

ওঃ, সে এক কেলো হয়েছিল বটে । মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া হাইস্কুলে গিসলুম ইন্টারভিউ দিতে । এগারোজন প্রার্থী ছিল, বুঝলেন । চৈতন্য খামরুই বলে এক প্রার্থীর তো পাঞ্জাবির তলায় ছেঁড়া গেঞ্জি ওব্দি দেখা যাচ্ছিল । কুন্তু গুজগুজ ফিসফিস হাসাহাসি থেকে দশ মিনিটেই আমরা টের পেয়ে গিসলুম যে স্কুল কমিটি ওই পদের জন্যে আগে থাকতেই লোক ঠিক করে ফেলেছে । ইন্টারভিউটা লোকদেখানে ।

আমরা তো ইন্টারভিউ না দিয়ে বাস ধরার জন্যে ফিরে গিয়ে গ্যাঁজাচ্ছিলুম রাস্তার ধারে । হঠাৎ না, হইহই করতে-করতে তিরিশ চল্লিশজন লোক এসে ঘিরে ধরে কিল চড় লাথি থাপ্পড় কঞ্চিপেটা আরম্ভ করে দিলে । আমি ভাবলুম আমাদের ডাকাত ভেবে গণপ্রহার আরম্ভ হল বুঝি । আজগাল গ্রামে শত্রুপেটানোর এটা সবচে সহজ আর সস্তা কায়দা বেরিয়েছে । ভাবলুম আর বোধয় বাঁচার উপায় নেই । সব তো পাঁচ ফিটের গাঁইয়া বাঁটকুল । তিনটেকে দিলুম একটা করে পাঞ্চ, বুঝলেন । কেঁউয়ে কুকুর হয়ে কাৎ ।

তখুন ওদের নেতামতন লোকটা হুকুম ঝাড়লে যে ইন্টারভিউ না দিয়ে ফেরত যেতে পারবে না কেউ । ঘাড় ধরে হিড় হিড় করে, জামা খামচে, পেছন থেকে ঠেলে, স্কুল ওব্দি ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে নিয়ে গিসলো আমাদের , পেছন-পেছন গ্রামের প্রায় একশো হাফল্যাংটো কচিকাঁচার দল, নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ, একদল পাতি হাঁস গোঁতা খেয়ে নেবে গেল পুকুরে, তাইতে তিন-চারটে রুই-কাতলা লাফিয়ে উঠল, উড়িসশালা, সে অভিজ্ঞতা ভোলা যাবে না । কয়েকজন চাষি বউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিল । ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউ কিসসু নয় । হেডমাস্টারের ঘরে একটা রেজিস্টারে সবাইকে দিয়ে সই করিয়ে নিলে । ইন্টারভিউ না দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেলে তো শিক্ষক বাছাই বাতিল হয়ে যেত । তাই অমন হেনস্হা । কয়েকটা লোকের মুখ মনে রেখেছি । কখনও যদি পেয়ে যাই কলকাতায় কোথাও তো পোঁদের চামড়া তুলে নেব ।

এক্ষুনি লকাপে সেই কাজটা করছিলে বুঝি ?  কী করে পারো ? আমার তো গলা শুকিয়ে বুক ধড়ফড় করতে লাগল বলে বেরিয়ে এলুম । তোমার সঙ্গে এবার বোধয় আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে । বলার পর, অরিন্দমের খেয়াল হল যে এই কমবয়সি আদিত্য ছাড়া ওর আর বন্ধু নেই কোনও ; এমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে বসর গল্প করা যায় । নানারকুমের গোলমালে আক্রান্ত হয়ে উঠেছে অপরিহার্য ।

আরে, এই ক্রিমিনালগুলোকে আপনি জানেন না । মহাফেজখানা থেকে কিছু গুণ্ডা ফাইল বের করিয়ে দেবো আপনাকে পড়তে, তাহলে টের পাবেন । আদিত্যর মুখময় ঘুরঘুর করছিল বিমূর্ত অভিভাবকত্বের গর্ব । তাস যেভাবে তার তুরুপ লুকিয়ে রাখে, সেভাবে হাসির মৃদুতা ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রেখেছিল আদিত্য ।

অরিন্দম যেন হেমন্তের স্মৃতিভারাক্রান্ত কাঠফড়িং । বলল, জবাবদিহির সুরেই বলল, করেছে কী লোকটা ? শুনি।

তিলজলার গোলাম জিলানি খান রোডের নাম শুনেছেন ? গেছেন ওদিকে কখনও ? র‌্যাফ নেবেছে । দুটি পাইপগান, রামদা, আর একগাদা বোমা পাওয়া গেছে । পুলিশের ওপর বোমা চালিয়েছে, অ্যাতো বুকের পাটা । কন্সটেবল গোপাল দাসকে তো চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে । শঙ্কর ঘোষ, কুমার দত্ত, এরশাদ খান, শঙ্করনারায়ণ পাণ্ডে, ওদেরও অল্পবিস্তর চোট লেগেছে । আসল দুটো খুনে হাওয়া হয়ে গেছে বোমার ধোঁয়ায় । চারটে হারামজাদাকে ধরেছি আমরা ।

তিলজলা ? অরিন্দমের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত ।

কেন ? তিলজলায় আবার কী আছে ?

তিলজলায় একজন থাকে । আমি তাকে কখুনও দেখিনি । তার বিষয়ে জানিও না কিছু । এমনকী নামও জানি না । আমি তাকে বিয়ে করতে চাই ।  মনের ভেতর প্রেমের ফাঁকা জায়গাটায় বসিয়ে রেখেছি তাকে ।

আদিত্য স্তম্ভিত । রেশ কাটলে বলল, আপনাদের এইসব ন্যাকান্যাকা পারভারটেড কথাবাত্রা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায় ।

নিঃস্ব,  সন্ত্রস্ত, অভুক্ত ভবেশকাকা কাঁধে খুশিদিকে চাপিয়ে বর্ডার স্লপি হাতে বনগাঁ হয়ে শ্যালদা প্ল্যাটফর্মে উঠেছিল । জহোর্লাল ওদের মাটি থেকে ওদের উপড়ে ওদের দুরবস্হা দেখতে গিসলো নিজের চোখে । শ্যালদা থেকে চটকলের গুদামে । সেখান থেকে বালিগঞ্জের যশোদাভবন ক্যাম্প । তারপর কলকাতার দক্ষিণে ধানখেত আর জলাজমিতে যে যেমন ঠাঁই নিতে পারে । যিশুর দাদুর অনেক ধানিজমি ছিল ওদিকে । মুসুলমান ভাগচাষিদের বাস ছিল । এখুন তো সেসব জলাজমির নাম হয়েছে সূর্যনগর, আজাদগড়, নেতাজিনগর, শ্রীকলোনি, গান্ধি কলোনি, বাঁশদ্রোণি, বিজয়গড়, রামগড়, বাঘাযতীন, কত কী । যিশুর দাদুর ইংরেজ বন্ধুরা ডিঙি চেপে পাখি শিকারে যেত সেসব জলাজমিতে ।

আচমকা মানুষের ঢলে ভরে যেতে লাগল দিগন্ধ ওব্দি ধানখেত আর জলাজমি । ঠ্যাঙাড়েরা রাতবিরেতে তুলে দেবার চেষ্টা করত লোকগুনোকে । যিশুর দাদুও ভাড়াটে লেঠেল আর তাগড়া সব বৌবাজারি গুণ্ডা লাগিয়েছিল, গল্প করেছিল ভবেশকা । ভবেশকারা যে জায়গাটায় থাকত, লেঙেল-গুণ্ডাদের অনেকদিন ঠেকিয়ে জিতেছিল বলে জায়গাটার নাম দিয়েছিল বিজয়গড় । বারোভূতের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল জিতে । নিজেরা ভারি-ভারি রোলার টটেনে রাস্তা বানিয়েছিল ভবেশকারা । রাত্তিরে পাহারা দিত দল বেঁধে । সেসব রাস্তায় সাইকেলে ঘুরেছে যিশু, দিনের বেলায় । বাঘাযতীন, বিদ্যাসাগর, শান্তিপল্লি, চিত্তরঞ্জন, রিজেন্টপল্লি, বিবেকনগর, দাশনগর, আদর্শপল্লি, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, বাপুজিনগর, বঙ্গশ্রী, নেলিনগর, শহিদনগর, মিত্রবাস, পোদ্দারনগর, মনেও নেই সব । এখুন গিজগিজ করছে মানুষ, উঁচুউঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, ধনীদের আবাসন, চেনাই যায় না ।

ভবেশকা ছিল অসাধারণ নেতা । চলে আসার সময়ে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ছিল ফার্স্ট ইয়ারে । পোড়-খাওয়া তাঁবাটে পেশি, ড্যাংডেঙে হাত-পা, চওড়া ছাতি, কোঁকড়াচুল ভবেশকা রোজই বেরিয়ে যেত আন্দোলন করতে । খুশিদিকে যিশুর মায়ের কাছে রেখে যেত । এরকুম নেতাকে হাতে রাখা ভালো, এই ভেবে বাবা বলেছিল, যিশুর সঙ্গে খুশিও যাক না স্কুলে, টিউটর রেখে নিচ্ছি না হয় । প্রস্তাবে ভবেশকার কীইই রাগ । বললে, তাহলে আর আপনাদের বাড়ি আসব না । মিতালিদের বাড়ি রেখে যাব ।

ট্র্র্যামের ভাড়া যখুন এক পয়সা বাড়ল, প্রথম ট্র্যামটায় ভবেশকাই আগুন ধরিয়েছিল, পুলিশ রেকর্ডে আছে । পাকিস্তানি ওপার বাংলা থেকে তখুন সত্তর হাজার লোক এসে কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করছে, অথচ রোজগারপাতির কাজ নেই । তখুনও কলোনিগুনো পশ্চিমবঙ্গে ছিল, কলকাতা হয়নি । নিত্যিদিন কলকাতায় গিয়ে পিকেটিঙ, ট্র্যাম জ্বালানো, বাস পোড়ানো, ব্যারিকেড, বোমা, অ্যাসিড বালব, মিছিল, র‌্যালি । বোমা বানাতে গিয়ে ভবেশকার কড়ে আঙুল উড়ে গিসলো । খুশিদির কান্নাই থামে না । কাঁদলেই টোল পড়ত থুতনিতে ।

তেসরা জুলাই জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ, জ্যোতিষ জোয়ারদার, সুবোধ ব্যানার্জি গ্রেপ্তার হতে, কালিঘাট ট্র্যাম ডিপো, শোভাবাজার-চিৎপুর ক্রসিং, একডালিয়া বাজার, শ্যামবাজারে তুলকালাম হয়েছিল । রাত্তিরে বাড়ি ফেরেনি ভবেশকা । টিয়ারগ্যাসের শেল কুড়িয়ে এনে দিত ভবেশকা ।  খুশিদির মোটে ছাব্বিশটা জমেছিল । যিশুর আটচল্লিশটা । দুটো আজও আছে ডাইনিং টেবিলে নুন-গোলমরিচ রাখার কাজে । ভবেশকা ইউসিআরসি আর ট্র্যামভাড়া বৃদ্ধি কমিটি, দুটোতেই ছিল । অক্টারলোনি মনুমেন্টের গোড়ায় দাঁড়িয়ে রোজ বক্তৃতা দিতে যেত আর তারপর ভিড়ভাঙা মিছিলে শ্লোগান । বক্তৃতা দিতে-দিতে অল্প সময়েই কলকাতার কথা বলার টান রপ্ত করে ফেলেছিল ।

পনেরো জুলাই হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট । সেই প্রথম বাংলা বন্ধ । উৎসব । পশ্চিমবাংলার বাঙালির জীবনের মূল্যবোধ পালটে গেল । কর্মসংস্কৃতি পালটে গেল ।

একদিন বিকেলে বাবার হাত ধরে গড়ের মাঠের মিটিং দেখতে গিসলো যিশু । দ্রোহের জ্যোতিতে মথিত ভবেশকার মুখ মনে পড়ে । ষোলোই জুলাই কলকাতার রাস্তায় সেনা নেবে গেল । তখুনকার দিনে র‌্যাফ ছিল না । শোভাবাজারে ভিড়ের ওপর গুলি চলেছিল আঠেরো তারিখে । প্রফুল্ল সেন ভয়ে এমন কেলিয়ে গিসলো যে বিদেশে আরাম আদ্দেক বাকি রেখে তিরিশ জুলাই তড়িঘড়ি ফিরতে হয়েছিল বিধান রায়কে । জহোর্লালের তো তখুন কানে-তুলো চোখে-ঠুলির রোগ, ভবেশকা বলেছিল । আইন ভাঙা ছাড়া উপায় ছিল না । কিন্তু সবাই মিলোএ ভাঙা আইন আর জোড়া লাগে না । যত আইনই তৈরি হোক পশ্চিমবঙ্গে, সেই থেকে, ভেঙে-ভেঙে ঝনঝন করে পড়ে যায় । আদালতের জজকে চটি ছুঁড়ে মারে । টেলিফোনে হুমকি দেয় । উপায় নেই । উপায় যে ঠিক কী, কেউই জানে না । চায় না জানতে ।

চিনের সঙ্গে যুদ্ধের সময়, ভারতরক্ষা আইনের প্যাঁচে যখুন টালিগঞ্জ থানার সেপাইরা অশোকনগরে পঁয়তাল্লিশটা আস্তানা ভাঙতে এলো, তখুন ছুটি হয়ে গেসলো নাকতলা স্কুলে, যাতে ছাত্র আর টিচাররা প্রতিরোধে শামিল হয় । সন্তোষ দত্তর চেলা ছিল ভবেশকা । যুগান্তর বলতে যেটুকু টিকে ছিল, তা-ই করত দুজনে । পুনর্বাসন মন্ত্রী আভা মাইতিকে ওনার অফিসে গিয়ে ধমকে ছিল ভবেশকা । কী রোয়াব, ওহ, দ্যাখে কে !

বিধান রায়ের আমলে যে খাদ্য রায়ট হয়েছিল, তা আবছা মনে আছে যিশুর । তখুন তো বর্গা আইনও হয়নি, পিএল চারশো আশির ল্যাং খেয়ে সবুজ বিপ্লবও হয়নি । ধানচালের কেনাবেচা সরকারি আওতায় নিয়ে গিয়ে গুবলেট করে ফেললে বিধান রায় । বাজার ধেকে উবে গেল চাল-গম । খাবার খুঁটতে কলকাতার ফুটপাথ ভরিয়ে ফেলেছিল গাঁয়ের লোকে, যে লোকগুনো কানিতে মাটির রং নিয়ে জন্মায় । ভবেশকা বিধান রায়কে মুখের ওপর বললে, সংগ্রহ বিতরণ তদারকির জন্যে গণসমিতি গড়া হোক পাড়ায়-পাড়ায় । বিধান রায় ভাবল, অ, বিরোধী দল পেছনের দরজা দিয়ে সেঁদোতে চাইছে । খাদ্যমন্ত্রী তখুন প্রফুল্ল সেন । তিরিশ হাজার পুলিশকে ধানচাল যোগাড়ের তদারকির কাজে লাগিয়ে দিলে । দাম বাঁধার হুকুম আর লেভি অর্ডার তুলে নেওয়া সত্ত্বেও, চাল গম ডাল তেল মশলার  দাম বাড়তে লাগল । হু হু । হু হু । বিধান রায়ের বুকের ব্যারাম ধরিয়ে দিলে প্রফুল্ল সেন আর অতুল্য ঘোষ । খাদি-খদ্দর জামাকাপড় তো উঠেই গেল পশ্চিমবঙ্গে ।

গোলমাল আঁচ করে শুরু হল ভবেশকাদের ধরপাকড় । সেই নিয়ে তেইশবার জেল । গোলমাল কী আর সহজে থামে । ছাপোষার পেটে দানা নেই । আগস্টের শেষ দিনে , ডালহাউসি স্কোয়ারে, হাজার লোকের মিছিলের মাথায় ভবেশকা । ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট আর এসপ্লানেড ইস্ট ঘিরে রেখেছিল পুলিশ । একশো চুয়াল্লিশ চলছে । কী ভিড়, কী ভিড় । লাউডস্পিকারের দরকারই হতো না তখুনকার দিনে । মিছিল ভাড়াও করতে হতো না । রাস্তার ওপরেই বসে গিয়েছিল বউ-ঝি, পোলাপান, মরদরা । হাতাহাতি আর ঢিল ছোঁড়াছুড়ি ছড়িয়ে পড়ল ধর্মতলা, চৌরঙ্গি, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ, কলেজ স্ট্রিট । ট্র্যামের লাইন নিজের হাতে উপড়ে ফেললে ভবেশকা । ড্রাইভারের ফেলে-পালানো বাসটায় আগুন ধরিয়ে দিলে । পুলিশের সোঁটা ভবেশ মন্ডল, অমর বসু, রাম চ্যাটার্জি, চিত্ত বসু, মাখন পাল, মোহিত মৈত্র কাউকে রেয়াত করলে না ।

পরের দিন ভোর পাঁচটায় খুশিদিকে মায়ের জিম্মায় দিয়ে বিধান রায়ের বাড়ির সামনে ছাত্রদের জড়ো করে ফেলেছিল ভবেশকা । মাথা-গরম টাটকা সভা-ভাঙা মিছিলটা যখুন এগুচ্ছে, প্রিন্সেপ স্ট্রিট থেকে রইরই করে এসে হামলে পড়েছে পুলিশ । খণ্ডযুদ্ধ । সুযোগ বুঝে গুণ্ডা-মস্তানরাও ফাঁকতালে নেবে পড়েছিল । তোড়ে বৃষ্টি এসে কিছুক্ষণের বিরতি দিলে কী হবে, ভবেশকা আশুতোষ বিল্ডিঙে ছাত্রদের জড়ো করে, ঠেলাগাড়ি আর বিদ্যুৎ বিভাগের মই এনে রাস্তা জ্যাম করে দিলে । পুলিশের হাত থেকে বেটন ছিনিয়ে নিয়েছিল ভবেশকা । সন্ধে নাবতে, রাস্তায়-রাস্তায় আলো ভেঙে ফেলার নেতৃত্ব দিলে । অন্ধকারে জ্বলেছে গাড়ির টায়ার, ট্র্যাম-বাস । ঠেলাগাড়ি দমকল অ্যামবুলেন্স । মরে ছাই হয়ে গেল সনাতন কলকাতিয়াদের তিলোত্তমা কলকাতা । গোবিন্দ বল্লভ পন্হের মাথা-কাঁপানো অনুমতি নিয়ে গুলি চালালে পুলিশ । ভবেশকার বাহুর মাংস খাবলে শিস দিয়ে চলে গিয়েছিল গনগনে বুলেট ।

ভবেশকা তোমার সেই গুলি লাগার দাগটা আছে ?

না হে, অ্যাতো দিন থাকে নাকি ! কবেই মিলিয়ে গেছে । পুকুরের জলে মুখ ধুয়ে গোরুর গোয়ালের দিকে চলে গেল ভবেশকা । এই সাত সকালেই গেরুয়া আলখাল্লা পরে আছে । ওটা পরেই শোয় বোধয় ।

ভবেশকা বলত, কংরেসের জন্য, শিশুর জন্য, কাশ্মীরের জন্য, হিন্দির জন্য, এডউইনার জন্য, কৃষ্ণমেননের জন্য, আনন্দভবনের জন্য, জহোর্লালের প্রাণ কাঁদে । আমাদের দুর্গতির জন্য কাঁদে না । এখন ভবেশকাও জন্যকে বলে জন্যে ।

কিন্তু দোসরা সেপ্টেম্বর জহোর্লাল আর ওনার খাদ্যমন্ত্রী এস কে পাতিলের টনক পঙ পঙ করে নড়ে উঠতে, পশ্চিমবঙ্গে ট্রেন-ভরতি চাল-গম পাঠিয়েছিল কেন্দ্রিয় সরকার । তেসরা সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘতের ডাক দিয়ে রেখেছিল মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি । ভবেশকা এই কমিটিতেও ছিল । হাওড়ার খুরুট থেকে বামনগাছি ওব্দি ধোঁয়াক্কার হয়ে গিসলো দড়িবোমায় । দাশনগরে চটকলের গুদোমে আর মজদুরদের ঝুপড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল ভবেশকা । দাউ দাউ দাউ দাউ দাউ দাউ । জগাছা, বামনগাছি, মালিপাঁচঘরায় গিয়ে আম-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগল ভবেশকা । ধর্মঘটকে সফল করে তুলেছিল সুভাষ মুকুজ্জের পদ্য গেয়ে-গেয়ে । কমরেড তুমি নবযুগ আনবে নাআআআআআ ? খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তখুন প্রায় রোজই নাক-ফোলানো ভবেশকা ।

সকাল হতে না হতে শোভাবাজার আর বিডন স্ট্রিটে শুরু হয়ে গেল হ্যাঙ্গাম । মায়ের কাছে খুশিদিকে সোপর্দ করে সেখানেও পৌঁছে গেছে চটি আর ধুতি-শার্ট পরা উশকোখুশকো ভবেশকা । রাত্তিরে মানিকতলা থানা আক্রান্ত । নেতৃত্বে ভবেশকা । ঢাকুরিয়ায় পুলিশ আউটপোস্টে বোমা । ভবেশকার কাঁধে বোমাভরা ব্যাগ । খিদিরপুর, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, ভবানীপুর, বেলঘরিয়ায় ভবেশকার খ্যাপানো জনতার ওপর গুলি চালালে পুলিশ । বাহালার বাসের গুমটি আর ট্র্যাম ডিপোয় আগুন ধরিয়ে দিলে রাগি জনতা । নেতৃত্বে ভবেশকা । ভবেশকার মাথা থেকে প্রতিদিন নতুন-নতুন প্রতিবাদের শব্দ, শব্দবন্ধ, ভাষা বেরোচ্ছে । বনধ, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, ধরনা, র‌্যালি, মিছিল, সমাবেশ, পথসভা, গেটসভা, পিকেটিং, মোড়মিটিং । ভুল বানানে ছেয়ে গেছে শহরের দেয়াল ।

চৌঠা সেপ্টেম্বর তো যারই মুখে রাগি-রাগি ভাব দেখেছে, তাকেই গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ । কতজন যে মরেছিল কে জানে । মর্গে লাশ ল্যাংটো করার সেই শুরু । লাশ লোপাটের গণিতের ম্যাজিক তো আগেই শিখিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা । পুলিশকেও নিজের হাতে গড়ে-পিটে পুলিশ বানিয়েছিল ব্রিটিশরা । দুশো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ।

কলকাতা আর শহরতলির অবস্হা একটু-একটু করে থিতোল ।

সেবার তবু সামলেছিল । ষাটের মাঝামাঝি আর পারল না প্রফুল্ল সেন । একে বিধান রায় নেই, তার ওপর ভারতজোড়া ঘাটতি । আলু তো বাজার থেকে একদম লোপাট ।  প্রফুল্ল সেন বললে, তাতে কী, কাঁচকলা খাও, আপেল খাও । ধানের লেভি হুকুম জারি করলে সরকার । মানে, চালকলগুলোর পুরো মাল চলে গেল সরকারের একচেটিয়ায় । ভবেশকা বলেছিল, বুড়ার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াসে ।

ব্যাবসাদাররা রেগে কাঁই । কলকাতার বড়োবাজারকে চটিয়ে দিলে কোনো সরকার টেকে না । তাদের বিকিকিনি তো লাটে । সরকারি দর আর বাজারদরের মধ্যেকার গভীর খাদে পড়ে গেল বেচারা কংরেস । থান পাকাত আগেই তুলে নিয়ে বিহার আসাম পাকিস্তানে চালান করে দিতে লাগল জোতদাররা । রেশনের দোকান ফাঁকা । মাছিরাও ডানা গুঁজড়ে গুমুচ্ছে । লোকে বলে সেটা ছিল তিতকুটে ফসলের শীত । খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রে ভবেশকা ।

চাষিবাড়ির খেতমজুর-বউ ঝিরা চালপাচারের মজায় সেই যে ফেঁসে গেল, সংসার করার কায়দাই পালটে ফেললে । সংসারের ঝক্কি নেই , কাঁচা ট্যাকা, ট্রেনের গুলতানি, একদিনের টিকিটে প্রতিদিন যাতায়াত, রাত্তিরটা হাজতে কখনওবা, হোমগার্ড আর পুলিশের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি । মোড়লদের বানানো এতকালের বেড়াগুনো ছেদরে গেছে সেই থেকে ।

আগেরবার বিধান রায় তড়িঘড়ি দার্জিলিং থেকে ফিরে তুলে নিয়েছিল লেভি অর্ডার । এবার বুড়োহাবড়া কংরেসের তলানিরা টেরই পায়নি যে পথে-পথে নেবে পড়েছে কচি ছোকরার রাগি দল । ভবেশকা বললে, পচা গাছডারে শিকড়সুদ্ধ উপড়াইয়া ফেলার এই-ই সুযোগ । এবিটিয়ে, ওয়েবকুটা, বারো জুলাই, এসেফাই, পিয়েসিউ, এয়াইয়েসেফ, ডিয়েসো, সিটু, কোঅর্ডিনেশান, কিসান সভা, এসপ্লানেড ইস্টে মিলে-মিশে একাক্কার । ওপাড়ার সরকারি আর সওদাগরি অফিসের চাকরেরা আওয়াজে-এওয়াজে কালা হয়ে যেতে লাগলো বলে ওখানে লাউডস্পিকার বাজানো বন্ধ করে দিয়েছে হাইকোর্ট । তা সত্ত্বেও চাষাভুষোরা মহাকরণে কাজে এলে কেরানিরা  তাদের অনুরোধ-উপরোধ আর শুনতে পায় না । স্ফিকসের মতন বোসথাকে ।

তখুন ভবেশকার গড়নপেটনের আদলে দিকে-দিকে শ্রমিক-কৃষকের ছবি এঁকেছিল বড়ো দেবুদা । সেই থেকে লালশালু হলে দেয়াল-পেন্টাররা ওরকুমই শ্রমিক আঁকে । এমনিতেও, যদিও বাঙালি শ্রমিকগুনো প্যাংলা, বেঁটে আর রুগণ । আবার এরকুম ছবিও আঁকা হয়েছিল, মঞ্চে মাইকের ডান্ডা বাঁ হাতে আর আকাশের দিকে ডানহাত, বক্তৃতা দিচ্ছে ভবেশকা । অবস্হান, অনশন, ফেস্টুন, শ্লোগান, ওঃ, সরকারের ধনুষ্টঙ্কার হয়ে গেল ।

ভবেশকার গরিমা তখুন দ্যাখে কে । বসিরহাটে মহকুমায় হামলা । নেতৃত্বে ভবেশকা । কৃষ্ণনগরে স্টেশনে আগুন । নেতৃত্বে ভবেশকা । মদনপুর, পায়রাডাঙা, বিরাটির এলআইসি, স্কুল পর্ষদ, উদবাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর তছনছ । নেতৃত্বে ভবেশকা । রামরাজাতলায় বম্বে মেল থামিয়ে আগুন । নেতৃত্বে ভবেশকা । কৃষ্ণনগরে পুলিশের গুলিতে মরা আনন্দ হাইতের শব মর্গ ভেঙে বের করে মিছিলের আগে-আগে ভবেশকা । ভবেশকার নির্দেশে, যে যেখানে মরেছিল, রাস্তায় গলিতে পার্কে মাঠে, লাল সিমেন্টের দেড় বাই আড়াই ফুটের শহিদ বেদি বানানো হচ্ছিল সেদিনকেই । অনেক জায়গায় শহিদ বেদির বদলে রাস্তায় হাম্প তৈরি হয়েছিল ।

তারপর ব্যাস, ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনের একদিন সকালে পাড়ার সবাই টের পেল, ভবেশকা রাত্তিরে ফেরেনি । কিন্তু খুশিদিও বাড়িতে নেই । আগের দিন সন্ধে থেকেই দেখা পাওয়া যায়নি ওদের । কলোনির লোকেরা কত জায়গায় খুঁজল  ওদের ।  কোথাও ওদের লাশ পাওয়া গেল না ; হাসপাতালে, থানায়, মর্গে । কত জায়গায় সাইকেলে চেপে খোঁজ করেছিল যিশু, দিনের পর দিন । ভোরে তিলকনগর, সকালে পোদ্দারনগর, দুপুরে নেলিনগর, বিকেলে বাপুজিনগর । না, কেউ ওদের খবর জানে না । কেউ দেখেনি ওদের । অমন চটক আর গা-গতর, কেউ তুলে নিয়ে যায়নি তো খুশিদিকে, মা বলেছিল বাবাকে । খুঁজতে-খুঁজতে, নিজের প্রগাঢ় অনুভূতির ক্ষত আবিষ্কার করে কেঁদে ফেলেছিল যিশু, একা-একা দাশনগরের কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ।

আর ভবেশকা-খুশিদি কিনা এখানে, কলকাতার এত কাছে, মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধারে এই শেষপুকুর গ্রামে, সেই থেকে । কলকাতা থেকে টানা গাড়িতে সারাতি, তারপর ভ্যান রিকশায় গোপের হাট । চাঁপাডাঙা ওব্দি ট্রেনে এসে ম্যাক্সিট্যাক্সিতে সারাতি আসা যায় । ভবেশকা কিনা এখানে । কলকাতায় যায় নিশ্চই । প্রথঞ পোড়ানো ট্র্যামের ছাই মেখে বাঙালির যে নতুন সৎসমাজ, ভবেশকা আজ তার অগুন্তি সন্তানদের একজন ।

কীইইইইরে, রোদ উঠে গেল, ক্যাঁদরা গায়ে দাঁড়িয়ে আছিস ঠায়, যা দাঁত মেজে নে ।

কন্ঠস্বরের জলতরঙ্গে ধ্বক করে উঠেছিল যিশুর হৃৎপিণ্ড । চ্যাটা খোঁপায় যিশুদি । হ্যাঁ, সকাল বেলাকার, রোদ্দুরে তার প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেলেছে । পুকুরে ভাসছে মাদুরকাঠির মতন চিকচিকে রোদ । পাঠরত স্কুলবালকের মতন দোল খাচ্ছে সুপুরু গাছের ঝাঁকড়া মাথা । যিশু বলল, তোমার গলার আওয়াজ অবিকল সেরকুমই আছে খুশিদি ; তুমি একটুও বদলাওনি । চলো না, আজকেই চলে যাই ।

না না না না না না না না । খুশিদি স্পষ্টত আতঙ্কিত ।

অ্যাতো কীসের ভয় খুশিদি । এই বয়সেও ভয় পাও !

ভয় তোর জন্যে । আমি বড্ডো অপয়া । তোর যদি বিপদ হয় । বৈশাখী পূর্ণিমার মেলার ভিড় যেদিন থাকবে, অনেক লোকের ভিড় হয়, তখুন যাওয়াই ভালো । টের পাবে না কেউ । কলকাতা থেকে টানা গাড়ি আনিস । ঘোমটা দিয়ে নেব ।

এখুন তোমার গা থেকে তোমার মতন গন্ধ বেরুচ্ছে না । ভয় পেয়েছ বলে ।

আমার মতন গন্ধ ? আছে বুঝি ? পঞ্চায়েত প্রধান আচে না ? অসীম তালোধি  ওর মেয়ের ভুতের ব্যারাম আচে । দাদা ওষুদপথ্যি করে । রোগবালাই ঝাড়ার জন্যে রাসপা ত্রিফলা হিং রসুন শুঁঠ নিসিন্দে কুঁচিলা বেড়ালা হোত্তুকি চিতেমূল সব বাটছিলুম একসঙ্গে । বোধয় তারই গন্ধ পাচ্ছিলি । বাটতে-বাটতে কালকের মন্তরগুনো, যেগুনো আমার জন্যে বলছিলিস, মনে পড়ে গেল । তাই দেকতে এলুম অ্যাতোক্ষুণ ধরে ঘাটে কী কচ্চিস ।

ভবেশকা ঝাড়ফুঁক করে বুঝি ? অদ্ভুত । কোথায়, ভবেশকা ?

দাদা তো বেরিয়েচে । কাজ ছিল কি ? দুপুরের আগে ফিরবে না ।

তাহলে এসো । খুশিদির হাত শক্ত করে ধরে যিশু । এসো আলুর গল্প করি । অভিভূত হাতের পর্যটনপ্রিয়তার কাছে সমর্পিত, স্পর্শে অবহিত হয়ে ওঠে দেহ । মুগ্ধ যিশু গলা নাবিয়ে বলল, যদি জানতুম তুমি এই গ্রামে আছ, তাহলে বাঁকুড়া বীরভূম বর্ধমান মেদিনীপুরে অযথা সময় নষ্ট করতুম না । এসো ।

শেষপুকুরের হিমঘর কখনও মুসুলমান মালিকের ছিল । শাজাহানের তাজমহলের মতন হিমঘরটাকে দ্বিতীয় বেগমের স্মৃতিমন্দির করেছিল । হিমঘরের পেছনের মাঠে স্বামী-স্ত্রীর কবর, ইঁটের দাঁত-বেরোনো, ছাগলছানারা ওটায় চড়ে লাফ খেতে শেখে । লোকটার ছেলে দেশত্যাগের কাটাকাটির সময়ে গায়ে হাতে পায়ে ছোরাছুরির চোট নিয়ে পাকিস্তানে ভৈরব নদীর ধারে পালিয়েছিল । ভবেশকার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা ভবেশকার নাছোড় অধ্যাবসায়ের ফসল ।

বর্ধমান থেকে আরামবাগ হয়ে সারাতি পৌঁছেছিল যিশু । আসার দিনই দেখেছিল, তারকেশ্বর-আরামবাগ রোডে চারটে করে আলুর বস্তা সাইকেলে চাপিয়ে সার বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্যাংলা গলদঘর্ম ছেঁড়ালুঙ্গি খালি-গা চাষিরা । চাষির কাছ থেকে ফ্যালনা দামেও আলু কেনার লোক নেই । চাষি ধারে বেচবে ছোটো আড়তদারকে, ছোটো আড়তদার বড়ো আড়তদারকে, বড়ো আড়তদার শ্যালদার কাঁচাবাজার কিংবা বড়োবাজারের পাকাবাজারকে । চাষিরা আর ছোটো আড়তদাররা কবে যে টাকা পাবে ঠিক নেই ।  আলুর চেয়ে খড়ের আশি আঁটির দাম বরং ভালো । আলু বিকোচ্ছে না । এদিকে খড়ের দাম চড়ছে । আলু বিকোয়নি বলে চাষিরা বীজ আলুর ঋণ শোধ করতে পারেনি । ছোটো আড়তদাররা বীজ আলুর টাকা আদায় করতে না পেয়ে অসহায় । ধরট নিতে চাইলেও এগিয়ে আসছে না কেউ ।

প্রশ্ন তুলে উত্তরটা লিখে নিতে দেখলে, কুন্ঠিত-সঙ্কুচিত হয় গাঁয়ের লোক । লেখালিখিকে সন্দেহ করে সবাই ।  বুকপকেটে একটা ছোটো টেপ রেখেছে যিশু যাতে কেউ টের না পায় । যারা অভিযোগ জানাতে চায়, তাদের জিগেস করতে হয় । কোন চাষির দুঃখের বোতাম কোথায়, আঁচ করে টিপলেই, গল-গল করে বেরোতে থাকে ক্রোধ কষ্ট দুর্দশা হতাশা গ্লানি অভিশাপ । চাষির অভিশাপ একদিন ফলবেই, চাষিরাই বলে সেকথা ।

বড়োতাজপুরের মামুদ মাফুজ । আগে তো লোডিঙের সময় থেকেই আলুর দর চড়ত । বণ্ডের ব্যামো ধরিয়ে দর কমিয়ে দিলে । আমরা কিচু বুঝিনে ? ঘোড়ার ঘাস খাই ? ওই তো, আলু চাষের জন্যে ঋণ নেয়নি শ্বেতলেশ্বর গাঁয়ের সমবায় সমিতি । তাদের সদস্যরা বণ্ড পেলে কী করে ? হাঃ । আমাদের কাচ থেকে সংরক্ষণ বাবদ বাড়তি ট্যাকা আদায় হচ্ছে । অথচ মহাজন আর ফড়িয়া দালালরা চাষি সেজে বণ্ড পেয়ে গেল । ভক্তিপদ কুণ্ডুর চার হাজার প্যাকেট ঢোকানো হয়েচে, ইদিকে এক ডেসিমাল জমিও নেই । হাতে-পায়ে কুঠ হয়ে মরবে যত বেজন্মার দল, এই আমি বলে রাকচি ।

খিলগাঁয়ের ক্ষুদিরাম ঢাং । এবছর শীত পড়েছিল টানা, না কী গো ? বিষ্টিবাদলা ঝড়ঝাপটা হয়নে । হাওয়াটাও শুগনো ছিল এবার । তা বোরো চাস তো হবে নে । আর গেল বছর আলুর দাম উটেছিল ভালো । ভেবেছিলুম, আলু তুলে সব ধার-দেনা মিটিয়ে দিতে পারব এবার, ওই যে দেকুন না, ওই চালটাও সারিয়ে নিতুম, মেজো মেয়্যাটার বিয়ের জন্যিও জমাতে পারব কিছু ট্যাকা । কিচ্ছু হল নে । আমাদের দেকার কেউ নেই । আমাদের কতা শোনার কেউ নেই । কীটনাশক খেয়ে মরতেও ভয় করে গো বাবু ।

বেলসলিয়ার আচেরুদ্দি মল্লিক । দেখেন না কেন, বাড়িতে সকাল থেগে উটে কাজ হয়েচে পচা আলু আর ভালো আলু আলাদা করার । নিত্যি দিন । আলুর তো পাহাড় জমে গেচে ।পচা বাছতে বেলা হয়ে যায় , তাপপর দাগ ধরলিই কেটে-কেটে গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্চি । গরুগুনোও আর আলু খেতে চায় না । আগে তো টানের সময়ে  দাগি আলুও কাঁচাবাজারের মহাজন নিয়ে যেত । রাত্তিরে আলুর পাহারাও হয়েচে ঝকমারি । ছেলে দুটোর রাত জেগে-জেগে শরীর বরগতিক হয়ে গেল । ওর মায়ের হাত দুটো দেকুন । দেকাও হাত দুটো, দেকাও, দেকাও না, লজ্জাশরমের কী, উনি তো হালিম-কালিমের চেয়েও ছোটো । দেকুন, পচা বেছে-বেছে হাতময় দানা বেরিয়ে গেচে।

হালিম মল্লিক । আমাদের গাঁয়ে পচা আলুর নাম হয়েচে কলিমালু, নেতার নামে । আলুর গোলমালের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী  ওনাকে ওননো বিভাগে পাটাচ্চেন শুনলুম ।

বাদলাপুরের দেবেন জানা । চল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের বিজনবাড়িতে আলুর ধসা রোগ হয়েছিল, বুঝলেন বিশ্বাসদা । কেন্দ্র সরকার তখুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেছলো । তা সে অর্ডার তোলবার কারুর খেয়াল হল না অ্যাদ্দিনেও । তেনারা পোঁদে তেল দে ঘুমুচ্চেন । ইদিকে অন্ধ্র উড়িষ্যা থেকে তো ফি বছর আলো এসছে এখানের বাজারে । এখান থেকে নুকিয়ে-নুকিয়ে গেছে সিকিম ভুটান আসাম । লাগ-লাগ টন আলু পচার পর এখুন অর্ডার তোলার কাগজ বেরুচ্চে বলে শুনিচি । কেন্দ্র সরকারে জহোর্লালের টাইম থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের লোক নেই । জহোর্লাল দিনকতকের জন্যে চারু বিশ্বাসকে মন্ত্রী করেছিল, তাও ফ্যালনা । নেতাগুনোর বাপের দুটো করে বিয়ে । তাই বিমাতা-বিমাতা করে নাকে কাঁদে ।

খাগড়াপাড়ার সত্যনারায়ণ সামান্ত । আমি স্যার দিসি উপায় করিচি । এই বটগাছতলায়, ওই যে, ওখেনটায়, আড়াই ফুট গত্তো খুঁড়ে প্রথমে বালি, তার ওপর কীটনাশক ছড়িয়ে আট কুইন্টালটাক আলু রেকিচি । তার ওপর আড়াআড়ি-লম্বালম্বি খড় বিছিয়ে আবার ওষুদ ছড়িয়ে দিইচি । ওই ইঁটের পাঁজা চাপিয়ে ঢেকে দিইচি । তিনচার মাস তো অন্তত থাগবে । তারপর কপাল । ঠাকুরের যা ইচ্ছে তাই হবে । কত দৌড়োদৌড়ি কল্লুম । এক প্যাকেট মতনও জায়গা পেলুম না । পঞ্চায়েতের কোটাও পেলুম না, সরকারি কোটাও পেলুম না । আর কত দাম ধরে মালিকের কোটা নিতে গেলে আমাদের মতন চাষির পুষোবে না । জেলাসদরে বল্লে, মন্ত্রীর ঠেঙে চিটি আনো, থালে সরকারি কোটা পাবে । কাকে ধরি ? বলেন । তাই এই উপায় করিচি । ইদিকে সেলসিয়াস আবার চল্লিশে চড়তে চলেচে ।

গুপ্তিপুরের বুড়ি । আলু-পচা আন্ত্রিকে নাতি মারা গেচে । নিববংসো হবে, অ্যাই বলে রাগলুম । যমে নেবে, যমে নেবে ।

খড়ি নদীতে জোড়া-নৌকোর মাচানে দাঁড়িয়ে কুতিরডাঙার অক্ষয় ঘোষাল । আলু পুরটসুন্দরদ্যুতি কদম্ব সন্দীপিতঃ সদ্য পকেটকন্দরে স্ফূরতুবঃ হিমঘরনন্দনঃ ।

বড়োপলাশনের শ্যামদাস প্রামাণিক । দশ প্যাকেট আলুর জন্যে মাসে এক প্যাকেট সুদ । অতিষ্টো করে মাল্লে । পাপের ভোগান ভুগতিই হবে ।

ষাটপলনের কেষ্ট দেবনাথ । দাদা সিপিয়েম করে, আমি ফরোড ব্লক করি । আমি না পেলে দাদা । দাদা না পেলে আমি । কেউ তো বন্ড পাবো । তাছাড়া কৃষি বিপণন আর সমবায় তো আম,আদের দলের হাতে । আমাদের অসুবিধা তেমন হয় না ।

জমিরাগাছির অনন্ত কুণ্ডু । আপনি একবার ভেবে দেখুন স্যার । ধান আর গমের বেলায় সংগ্রহমূল্য  বছর-বছর বাড়িয়ে দিলে বলোরাম জাখড় । আলু কি জাখড়ের অ্যাঁড়, অ্যাঁ ? তা কেন সংগ্রহ করবে না সরকার ? তার কেন সংগ্রহমূল্য হবে না ? বলুন আপনি । আলুও তো ক্যাশ ক্রপ । আসলে পঞ্জাব আর হরিয়ানার বেলায় দরোজা হাটকরে খোলা । আমাদের বেলায় পোঙায় লাতি ।

এর আগে অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে যিশু । কত কারখানা আর ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিতে সাহায্য করেছে মোদি গোয়েঙ্কা মল্ল ভারুচা খান্না খৈতান লালওয়ানি কেশওয়ানি মাহিন্দ্রা শিল্পপতিদের । বিদেশি বিনিয়োগকারীদের । স্রেফ মগজ খাটিয়ে । এরকুম অভিজ্ঞতা হয়নি আগে । পেরু না বোলিভিয়া কোথ্থেকে এসে বাঙালি জীবনে ঢুকে পড়েছে নির্বিকল্প আলু ।

আলুহীন পৃথিবী ভাবাই যায় না । বেলে কিংবা পলি দোআঁশ অল্প-টোকো জমিতে মখমল মাটির লেপ চাপা দিয়ে কেমন ডিম্বাশয় গোলগাল, তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে গভীর আয়ত চোখে ভূমিষ্ঠ হয় চন্দ্রমুখী আলু । ভূমিষ্ঠ হয় জ্যোতি অলঙ্কার কুন্দন সিঁদুরি নবীন সফেদ কুমার বংশের খোকাখুকু যুবকযুবতি । এদের অনেকে চন্দ্রমুখীর সদবংশের নামে পৌঁছোয় বাজারে । ভিজে হাওয়া আর কুয়াশা সহ্য হয় না ওদের । নাবি, ধসা, ভুষা, সাঙ্কোষপোরা রোগে ধরে । বড্ডো সুখী ওরা, তাই উই পোকা, পিঁপড়ে, কাটুই পোকা, লাল বিটল, জাব পোকা, থিপস, সাদা গ্রাব, সুতলি পোকার দলবল সুযোগ পেলেই ওদের শীতের রাত্তিরে জাপটে ধরে । ওদের আঃ উঃ লক্ষ্মীটি পায়ে পড়ি, প্রাণে মেরো না, বাঁচাও-বাঁচাও নিঃশব্দ চিৎকার মাঝরাতে মাটিতে কান পেতে শুনতে পায় আলমপুর গ্রামের কাশীনাথ মাইতি । টাকার মতন আলুও বহুবল্লভা ।

সে আলু, পচলে যে আটদশ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের দখল নিয়ে নেবে, নানা রকুমার মাছি আর উনকিকে দূরদূর দেশ থেকে ডেকে আনবে সোহাগ পেতে, সে অসহ্য দুর্গন্ধের সঙ্গে গতবছর বৈশাখে পরিচিত হল যিশু, পরপর কয়েকটা হিমঘরের তথ্য যোগাড় করতে গিয়ে । ওফ, নরক,  নরক ।

শীতযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল পোলবা দাদপুরের বালিকুখাড়ি সমবায় হিমঘরে । পচে জল হয়ে গেল আলু । পাঁচ হাজার চাষি পরিবার সর্বস্বান্ত, রিপিট, সর্বস্বান্ত , লিখে রেখেছে যিশু । চাষিরা হিমঘরের সামনে গিয়ে ধরনা দিচ্ছিল বলে একশো চুয়াল্লিশ জারি হল । একদিকে হিমঘরের লোকেরা আরেক দিকে চাষিরা । সে কী হাতাহাতি মারামারি লাথালাথি । চুঁচড়ো থেকে বিরাট পুলিশপার্টি গিয়ে লাঠিপেটা করে বাগে এনেছিল । দিনদুপুরে মশারির মধ্যে বসে ল্যাপটপ খুলেছিল, অ্যাতো মাছির ঝাঁক । না খেয়ে ছিল বারোঘন্টা, নিরম্বু । তারপর পালিয়েছে । কত জনের যে হাঁপানি ধরে গেল কে জানে । চারটে চাষির বাড়িতে সাতটা বাচ্চা মরেছিল আন্ত্রিকে । অনেকের গা-ময় দাগড়া দাগ বেরিয়েছে । দুর্গন্ধ সৃষ্টি করায় মানুষের জুড়ি নেই । যত উন্নতি, তত আবর্জনা, তত নোংরামি, তত দুর্গন্ধ ।

গোস্বামীমালপাড়ার হিমঘরে সাতষট্টি হাজার প্যাকেট নষ্ট হয়েছিল । গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য হালিম মাজেদ ছিল জেলাশাসকের আপিসে, কোনো কাজে । বললে, বিমার টাকা উশুল করেও হিমঘর সমিতি বিমা করায়নি । চোত মাসে  বিমা কোম্পানির লোক এসেছিল, কিন্তু কম ভোল্টেজে যন্তর বিকল হয়ে আলু পচার ভয়ে বিমায় রাজি হয়নি । বেলমুড়ি থেকে বিজলি আসে টিমটিম করে । দুটো জেনারেটর , তা দুটোই পড়ে আচে ভেঙে । হিমঘরের সহসভাপতি মহম্মদ জাকারিয়া বলেছিল, কিচু আলু বাঁচানো যাবে । তা বাঁচানো যায়নে কিচুই । নির্বাচন এসে পড়েছিল বলে মজুর-কামলা-মুটিয়া পাওয়া যায়নে । এলেকশান এলে কিচু পয়সার মুখ দেখতে পায় ওরা ।

পচে হালুয়া হয়ে গিসলো আলু । অমন সুন্দরী চন্দ্রমুখী কন্দ নিজেরা পচেছে, থলেগুলোকেও পচিয়েছে । আলুর পাহাড় থেকে আগ্নেয়গিরির পচা লাভাস্রোত । আশপাশের ভাদিলপুর, দেপুর, কেয়োলপার গাঁয়ের লোকেদের পাতলা পায়খানা আর ভেদবমি থামতেই চায় না । প্রাণ একেবারে অস্হির, আইঢাই, কাহিল । সরকারি স্বাস্হ্যকেন্দ্র এই আলুপচা রোগ সারাতে বিফল । হিমঘরের বাইরে পচা আলুর কাই কেঁখে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়েছিল । দুর্গন্ধ আর একরোখা মাছি যায়নি তবু । পচা আলুর গ্যাস বের করতে ছেঁদা করা হয়েছে দেয়াল । তবু হিমঘরে গুমরে মরছে পচা আলুর শবের বদগন্ধ । কলকাতায় তখুন বিদেশি সিনেমার উৎসব চলছে ।

আর যেটুক বেরোতে পেরেচে, বলেছিল বালিকুখাড়ির লুৎফর রহমান, এমনভাবে চাষিবাড়ির ছেল্যামেয়্যার পেচনে লেগেচে বাবু, যে ওঝা ডেকেও ছাড়চেনে । বিষ্টি পড়লে আর দেকতে হবেনে । আলুর গুয়ের বান ডাকবে । নিমাই ঢোলের মিষ্টির দোকান একমাস বনদো ।

কালনার বংশীধর হিমঘরে বীজ আলু পচে গেছে । হিমঘরের ভাড়া জমা দিয়ে গেটপাস পাবার পরও বীজ আলু দিলে না । অ্যাতোটা পথ এসে চোপোররাত হয়রানি । একদিন তো চারঘন্টা রাস্তা অবরোধ হল । হয় বীজ দাও নইলে দাম দাও । হিমঘরের চাকরে বাবুরা গণপিটুনির ভয়ে টেবিলে খোলা কলম ফেলে হাওয়া । শয়ে-শয়ে চাষি জড়ো হচ্ছে আর গলার শিরা ফোলাচ্চে । ভবভূতি কপালি জমি তৈরি করে, ছেলেকে বীজ আনতে পাঠিয়েছিল । শক্তি সরকার পাওয়ার টিলার ভাড়া নিয়ে, জমিকে দিন দশবারো পতিত রেখে, জল কমপোস্ট রেড়ির খোল নিমের খোল দিয়ে, জো বুঝে মাটি ভেঙে আলু বোনার নালা কেটে ফেলেছিল । অলদ্রিন আর ব্রাসিকল এনে রেখেছে । তারপরই বজ্রপাতের মতন সর্বনাশা খবর । আলুর মড়কে বীজ নষ্ট । দিন দশের মধ্যে না পাতলে ফলন হবে না ।

দুজনেরই করোনারি থ্রমবোসিস, আলুপচা রোগে, বললে সদর হাসপাতালের ডাক্তার ।

মুটিয়া মজুর সর্দারদের ভাগ্য আর কমিশন থেকে কাটমানির নিষ্পত্তি না হওয়ায় বীজের আলু বাইরেই পড়েছিল টানা পনেরো দিন । বীজ আলু হল চাঁপা ফুলের পাপড়ি । অযত্ন ওদের সহ্য হয় না । তিন নম্বর চেম্বারে তিরিশ হাজার প্যাকেট বীজ আলু নষ্ট হল । এক চাষির বীজ অন্যকে দিয়ে যদ্দিন চলে চালিয়েছে । দিতে-দিতে ফুরিয়ে গিসলো । আলুর অদেষ্ট, চাষির অদেষ্ট ।

কিন্তু আলুর গপ্পো নিয়ে তুই কী করবি রে ? বলল খুশিরানি মণ্ডল ।

ভবেশকা  অ্যাতো সম্পত্তি আর টাকা নিয়ে কী করবে, বলো তুমি, অ্যাঁ ? সেই ভবেশকার এমন ভুঁড়িটুড়ি, ঠাকুরদেবতা, ঝাড়ফুঁক, দলাদলি, ওফ, আমি তো ভাবতেই পারি না । ট্র্যামের ভাড়া এক পয়সা বেড়েছিল বলে, আর আলু পাওয়া যাচ্ছিল না বলে, কী-ই না করেছিল ভবেশকা । ভবেশকাকে দেখছি আর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে । গেরুয়া, বাবরিচুল, সত্য সাঁইবাবা, মাদুলি, গোমেদের আঁটি । আধুনিক লোকটার তো দফারফা । কেন, অ্যাঁ, কেন ?

যিশু জানে খুশিদি অবোধ, নিষ্পাপ, অজ্ঞান, তাই নির্বাক ।

তোমার জন্মের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভবেশকা তোমায় একটা ভারি কালো লোহার শেকলে আষ্টেপৃষ্টে আগলে রেখেছে, রুমালে চোখ বেঁধে । কত চাষির আলু নিশ্চিন্তে পচিয়ে ফেললে ভবেশকা । পঞ্চায়েতের যে পঁচাত্তর শতাংশ বন্ড তা-ও গোলমাল হয়েছে, কালোবাজার হয়েছে, আর মালিকদের কুড়ি শতাংশ তো সোজা বেচে দিয়েছে পাকাবাজারে । এমনকী চাষির বন্ডেও ভবেশকার সই না থাকলে হিমঘরে তোলা যাবে না । সেই ভবেশকা, ভাবতে পারো তুমি ! বুকের মধ্যে চব্বিশঘন্টা বারোভুতের মেলা চলছে ভবেশকার ।

জানি । খুশিদির চোখের পাতা কাঁপে ।

খুশিদি কেঁদে ফেলবে । যিশুর হৃৎপিণ্ডের কপাটক ফরফর শব্দ করে নিঃশব্দে । ভবেশকার প্রসঙ্গ পালটায় । বুঝলে, বীরভূমে ষাটপলসা হিমঘর চালানো নিয়ে সে কী খেওখেয়ি । হিমঘর সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ দাশ আর বাদবাকি সদস্য রেবতী ভট্টাচার্য, অম্বিকা দত্ত, জনার শেখ এরা হল ফরোয়ার্ড ব্লকের, কিন্তু আরেক সদস্য মিনতি ঘোষ, যিনি পঞ্চায়েত প্রধান, তিনি সিপিয়েমের । সমবায়ের পাঁচ লাখ টাকার হিসেব মিলছে না অভিযোগ তুলে বিশ্বনাথ দাশ বরখাস্ত করলে সহকারি ম্যানেজার শিশির ঘোষ আর ক্যাশিয়ার বৈদ্যনাথ মণ্ডলকে । ব্যাস, আর দ্যাখে কে ; বেঁধে গেল দু-দলের কাজিয়া । ময়ূরেশ্বরের সিপিয়েম সভাপতি ত্রিপুরেশ্বর মণ্ডল দখল নিলে চেয়ারম্যানের কুরসি । আদালতের হুকুমে বিশ্বনাথ দাশ ফিরে পেয়েছে চেয়ার । এই আলুমন্হনের বিষের ভাগটা চাষিদের ।

জানি, এখানেও সিপিয়েম, তৃণমূল, কংরেস আর বিজেপি হয়েচে । সবাই মিলে একটা নাম নিলেই তো হয় । চাপা কান্নায় খুশিদির অন্যমনস্ক কন্থস্বরে ভাঙন ।

গল্পের রেশ থামলে খুশিদির আপ্রাণ ধরে রাখা অশ্রুবিন্দু টপ করে ঝরে পড়বে আর যিশু চেতনায় ঘটে যাবে বিস্ফোরণ । কথা বলা বজায় রাখে ও, যিশু । পুরশুড়ার হরপার্বতী হিমঘরে কী হয়েছে জানো না ? দেড় কোটি টাকার আলু পচিয়ে, বিদ্যুৎ পর্ষদের কয়েক লক্ষ টাকার বিল না মিটিয়ে, পুরোনো মালিকরা নতুন এক ব্যাবসাদারকে চুপচাপ হিমঘর বেচে দিয়ে পালিয়েছে । চাষিদের ক্ষতিপূরণ যে কে দেবে বা আদৌ দেবে কিনা, কেউ জানে না । নতুন মালিক পচা আলু বাইরে বের করে পোড়াচ্ছিল । সেই তেল-চিটচিটে ধোঁয়ায় গোলাপজাম আর জামরুল ওব্দি পাকা জামের মতন কালো হয়ে গেছে । পুরশুড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পতিতপাবন জানা শেষে গিয়ে আলু পোড়ানো বন্ধ করলে ।

খুশিদির ম্লান মুখাবয়বে তবু পরিবর্তন নেই ।

যিশু বলল, এবছর মোহনবাটির হিমঘরে অ্যামোনিয়ার ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে সোমথ্থ পাটগাছগুলো অজ্ঞান হয়ে গিসলো । খুশিদির ভাব পাল্টাচ্ছে না দেখে যিশু দুবাহু ধরে চোখে চোখ মেলে জানায়, মিছেই এসব গল্প করছি । তুমি কি কিছু বলবে ? খুশিদি ? বলবে কিছু ?

সন্ধ্যা । চাঁপাডাঙা লোকাল থেকে হাওড়ায় নেবেই সুটকেস হাতে দৌড় লাগাতে চাইছিল যিশু । পারছিল না । রাস্তা আটকে ধিরে-ধিরে হাঁটছে ফণাতোলা সাপের মতন সতত উদ্যত নিতম্ব, একগাদা, নানা আদল আর আদরায় । সামান্য ফাঁক পেতেই পাশ কাটিয়ে আবার দৌড়োয় । একজন ষণ্ডা পুলিশ অফিসার আচমকা ওর বাহু আঁকড়ে থামাতে, রক্ত চলকে ওঠে হৃৎপিণ্ডে । পায়ের পাতা, আঙুলসুদ্দু, শিরশির করে ওঠে মোজার ভেতরে, ভয়ে, গলায় শ্লেশ্মা উথলোয় হঠাৎ । কোনো অপরাধ না করেও অপরাধের বোধ মগজে ঘুরঘুর করে ওর, মুহূর্তে মনে হল ।

সম্বিতস্হ হয়ে যিশু থ আর ক্রুদ্ধ । আদিত্য । সঙ্গে অরিন্দম, বিটকেল জুটি ।

আদিত্যর ভিড়-জমানো অট্টহাস্য, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ওফ ভয় পান পুলিশকে ! কী কেলেঙ্কারি করে ফিরছেন দাদা ? অ্যাগবারে চোখকান বুজে দৌড়োচ্ছিলেন । তা কই, কোনো কেটলিবাই বা খুন্তিসুন্দরীকে তো দেখছি না । ওপাস ডিয়ে সটকিয়ে দিয়েছেন ?

হাত ঝাঁকিয়ে ছাড়ায় যিশু । শ্যাঃ, এরকম ইয়ার্কি ভাল্লাগে না । অরিন্দম, তুমি আবার অপর্ণা সেনের মতন মার্কেটেবল হাসি দিচ্ছ কেন ?

আদিত্য পাছায় দুহাত, পেছনে ঝুঁকে, জিভের ডগা মুড়ে কথা বলার কায়দা, পুলিশে চাকরি পেয়ে শিখেছে, বজায় রাখে । ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ, নির্ঘাৎ কিছু গোলমাল করে ফিরছেন আটপুর জাঙিপাড়া থেকে, বলে দিন দাদা, বলে দিন, আমরাই বাঁচাব, আমরাই হলুম গে রোকখোক আর ভোকখোক ।

আরে ট্যাক্সি ধরতে ছুটছিলুম, কেঁচিয়ে দিলে । চলো, একটা ট্যাক্সি পাইয়ে দাও । সুটকেস প্ল্যাটফর্মে রেখে, সিগারেট বের করে ধরায় যিশু, তারপর খেয়াল হওয়ায়, এগিয়ে দ্যায় আদিত্যর দিকে ।

অ্যাতো টাকা রোজগার করেন, একটা গাড়ি কেনেন না কেন ?

গাড়ি ? বাবা-মায়ের বিয়ের দিনেই গাড়ি কিনে দিয়েছিল দাদু, সেটা চুয়াল্লিশ সন । সে গাড়িতে চেপে শ্রীরঙ্গমে শম্ভু মিত্তির বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন দেখতে গিসলো দুজনে, প্রথম দিনের শো । পরে তো শ্রীরঙ্গমের নাম হয়েছিল বিশ্বরূপা, এখুন কাছাকাছি পার্ক করা যায় না । তা হল থেকে বেরিয়ে দেখলে গাড়ি হাপিস । আর পাওয়া যায়নি গাড়ি । বাবা আর গাড়ি ছোঁয়নি । আমিও বাবাকে ফলো করছি । গাড়ি রাখা আর চালানো কলকাতায় ঝকমারি, এমন তোদের গিরগিটি এসট্যাবলিশমেন্ট ।

মানে ? অন্য দিকে তাকিয়ে অন্য কিছু খোঁজায় মনস্ক, ধোঁয়ার টুসকি ঝেড়ে জানতে চায় আদিত্য ।

গিরগিটির মাথা কখুনও লাল, কখুনও সবুজ, কখুনও কমলা রঙের হলেও, গিরগিটিটা গিরগিটিই থাকে । তুই এসব বুঝবি না । অরিন্দম এখানে কেন ? কেউ আছে-টাসছে নাকি ?

হ্যাঁ, অরিন্দমদা অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়ে বিহার থেকে আসা সব গাড়ি অ্যাটেন্ড করছে । অরিন্দমদার এক পুরোনো বন্ধুর কলকাতায় আসার কথা আছে । লোকাল ট্রেনটা এখুনও বিয়োচ্ছে, তাই চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে আদিত্য ।

অরিন্দমের বন্ধু তো তোর তাতে কি ?

এককালে অরিন্দমদার সহকর্মী ছিল লোকটা । চাকরি ছেড়ে এখুন গয়া পালামউ জাহানাবাদ হাজারিবাগে খেতমজুর খেপিয়ে বিপ্লব করছে । সে ব্যাটা ব্রামভোন ।

তা করুক না ; তোর চাকরিতে তো বাধ সাধছে না ।

আরে কলকাতায় আসছে অ্যাসল্ট রাইফেল বোমাফোমা কিনতে । শালা আর জায়গা পেলে না । লোকালের টুপটাপ বিয়োনো শেষ । নিত্যযাত্রীদের পচা কর্মসংস্কৃতির ঘেমো গন্ধ । মমমম।

ওওওও । তাই ফুল ড্রেসে চোর ধরতে বেরিয়েছিস আর অরিন্দ এসচে খোচরগিরি করতে । যিশু কাঁধ নাচিয়ে হাসে ।

আদিত্যর জিভের ডগা এখুনও মোড়া । আরে এই সাবভারসিভ এলিমেন্টগুলো দেশের কাঠামোটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে । আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দিচ্ছে না । আগে তবু রঞ্জিত গুপ্ত, দেবী রায়, রুণি গুহনিয়োগীর মতন দায়বদ্ধ অফিসাররা ছিল । সেরকম ডেডিকেটেড অফিসার আর আজগাল কোথায় ।

অরিন্দম গম্ভীর, নিরুত্তর । এরকুম অনেকবার হয়েছে ওর । ওর উপস্হিতিতে ওর উদ্দেশে করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আরেকজন । লোকালটা বিইয়ে শেডে ফেরার ভোঁ ।

বাড়ি ফেরার তাড়া, তার ওপর ক্লান্ত, দৌড়ে ট্যাক্সি ধরার ধান্দায় কুলি নেয়া হয়নি ; যিশু স্টেশানের ভিড়ে বিরক্ত । বলল, বেশি-বেশি পোঁদপাকামি করিসনি, বুঝলি । মরবি শেষকালে । ভদ্রেশ্বর থানার ওসি ভোলানাথ ভাদুড়ি, ডোমকলের কন্সটেবল তপন দাস, জয়নগরের এস আই  অশোক ব্যানার্জি, ওদের মতন বেঘোরে মরবি । আর ডেডিকেশান সাবভারসান এসব কপচাসনি ফালতু । এই তো জুন মাসে, রায়গঞ্জ থেকে খড়-বিচুলি নিণে একটা ট্রাক শিলিগুড়ি যাচ্ছিল, তার ড্রাইভার অরুণ দাস তো ইসলামপুর থানার বেরাদরদের তোলা দিতে পারেনি বলে ওকে আর খালাসিটাকে আড়ংধোলাই দিয়ে ওদের রক্ত জবজবে মুখে মুতলেন তেনারা । ইটস আ ফ্যাক্ট, আই অ্যাম নট জোকিং । আমি তখুন ইসলামপুরে ছিলুম । অন্য লরি ড্রাইভাররা জানতে পেরে যখুন একত্রিশ নম্বর হাইওয়ে অবরোধ করল, তখুন কেস গুবলেট করার জন্যে তোর ব্রাদাররা খালাসিটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলে পাশের চোপড়া থানায় । আমার কাচে খাপ খুলিসনি, বুঝলি । দুশো পাতার প্রজেক্ট রিপোর্ট প্যারা বাই প্যারা মুখস্হ বলতে পারি । ভুলে যেও না ইন্দিরা গান্ধি যে অভিশাপ কোড়োল তাতে নিজে তো গেলই, ছেলে দুটোও অপঘাতে মারা গেল । আর তোদের তো হেমেন মণ্ডল, শ্রীধর দাস, রাম অবতার, জয়চাঁদ শৈঠিয়া, রশিদ খান, বালা ভাগানি, রমেশ সিংদের মতন দায়বদ্ধ ক্যারেক্টার না হলে চলে না । যিশু, সংলাপের অস্বাভাবিক দ্রুততায় হতবাক করে ওদের দুজকে ।

ওদের ঘিরে বেগতিক শুরু হওয়ায়, অপ্রস্তুত আদিত্য বলল, আপোষের স্তুতিময় কন্ঠে, আরে চটছেন কেন, চলুন-চলুন, ট্যাক্সি পাইয়ে দিচ্ছি । দেশভাগের পর আর ফলে, ভিড়ের ঠ্যাঙাড়ে, খামখেয়াল, প্রতিদ্বন্দ্বীর যে কোনও একটা পক্ষকে গণশত্রুর ছাপ দিয়ে দিতে চায় ।  কাউকে শত্রূ ঘোষণা করার মধ্যে  ঘোষকের আত্মপ্রসাদের হহুকুমনামা থাকে । বাঙালিজীবনে এখুন শত্রু না থাকাটা অবক্ষয় । প্রেম, তার মানে, শুধু ঈশ্বরের জন্যে, প্রকৃতির জন্যে । অরিন্দম বিব্রত । গণশত্রু শব্দটা খাঁটি বাঙালির নয় ।

পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে আদিত্যর যিশুকে প্রস্তাব, অরিন্দমদা আপনার আবিষ্কার-করা কেটলিউলির সঙ্গে পরিচয় করতে চাইছিল ।

কেন ? ওর কি নিজের মুখ নেই কথাটা পাড়ার ? যিশুর পক্ষে রাগ করাটা ওর স্বাস্হ্যের পক্ষে জরুরি । কারুর দিকে না তাকিয়ে বলল, আগের নিজের বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করুক, মুচলেকা দিক, ধরিয়ে দিক, ভারতরত্নটত্ন পাক ।

যিশুদা আপনি আমায় জানেন, তবু এমন কথা বলছেন কেন ? আসার আগে আদিত্য আমায় কিছুই বলেনি । অরিন্দম স্বার্থপর আম-জনতা আর ফিচেল হাবড়ুস নিত্যযাত্রীর ধাক্কা, এড়াবার চেষ্টা সত্ত্বেও, খেতে-খেতে, যিশুর সুটকেস আদিত্যর হাতে, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড পর্যন্ত তিনজন চুপচাপ হাঁটে । আদিত্যকে দেখে একজন সাদাপোশাক ভিকির বেঁকানো শিরদাঁড়া সোজা করে সেলাম ঠুকল । পোশাকের রাষ্ট্র-ক্ষমতার দাপটে আদিত্যকে জায়গা ছেড়ে দেয় লোকে । হাঁটেও সেভাবে আদিত্য । উত্তরআদর্শবাদী নবযুগের কমিসার । কিউ-এর চ২ছামেচিকে দাবড়ে, আদিত্যর দরজা খুলে দেয়া প্রথম ট্যাক্সিটায় বসে, অরিন্দমের দিকে স্মিত তাকিয়ে, প্রশমিত যিশু জানায়, কেটলিউলি ঘৌড়দৌড় দেখতে চায় অরিন্দম, পরিচয় করিয়ে দেব, নিয়ে যাবেনখন রেসকোর্সে । নিজে গেছেন তো কখুনও ? না গিয়ে থাকলে রাসেল স্ট্রিটে খোঁজ নিয়ে শিখে নিন ।

যিশু হাত নেড়ে চলে গেলে, আদিত্য অসংকোচে বলল, আচ্ছা অরিন্দমদা, আপনি তো ক্যানসারে বুককাটা প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, সে এপিসোড শেষ, নাকি ? না, মানে এমনিই জিগেস করছিলুম ।

অফিস এক বছরের জন্যে ম্যানিলায় আমাকে ট্রেনিঙে পাঠিয়েছিল, জানো তো ? এক বছরের ছাড়াছাড়িতে ব্যাপারটা কেমন যেন আপনা থেকেই চুকে-বুকে গেছে । আমি যখুন ছিলুম না তখুন অফিসে এ নিয়ে এমন ফিসফিস-গুজগুজ হয়েছিল যে ওর পক্ষে পিছোনো ছাড়া উপায় ছিল না । বেশিদিনবাঁচবে না, লিখেছিল আমাকে । সত্যিই বোধয় বাঁচবে না । রুগণ চেহারা হয়ে গেছে । আর তো কথাবাত্রাও হয় না । ও-ও এড়িয়ে যায়, আমিও এড়িয়ে যাই । একই অফিস বলে খুবই এমব্যারাসিং । ট্রান্সফার নিয়ে লখনো চলে যাব ভাবচি । এখানে একদম ভাল্লাগে না । অরিন্দমের কন্ঠে পরাজয়বোধ । অসহায়তার ঘূর্ণিপাকে বুঁদ হয়ে সদাসর্বদা প্রেমে পড়ে থাকতে চায় ও । একজন নারীকে ছেড়ে আরেকজন নারীর কাছে পৌঁছোনো ওব্দি ও ছটফট করে, আতঙ্কের ঘোরে থাকে । থিতু হতে পারে না কোনও নারীতে । বয়স বেড়ে যাচ্ছে । ছোটো ভাই বিয়ে করে নিয়েছে । মা চিন্তিত । ম্যানিলায় গিয়েও মালয়েশিয়ার যুবতী প্রশিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্কে পাতিয়ে ফেলেছিল ।

অরিন্দমের কথা শুনে আদিত্য বলে ওঠে, আরে না-না, এখুন যাবেন না । আগে লোকটাকে শনাক্ত করে দিন । কেরিয়ারের ব্যাপার । সিগারেটের বোঁটা মাটিতে ফেলে সরকারি জুতো দিয়ে মাড়ায় আদিত্য । ভিড়ে মধ্যে দিয়ে আবার প্ল্যাটফর্মে তাড়াতাড়ি ফিরতে অসুবিধা হচ্ছিল ওদের । পাজামা-পাঞ্জাবি-লুঙ্গিতে একদল ক্লান্ত পুরুষের জটলা লক্ষ করে আদিত্যর মন্তব্য, এই মালগুনিকে দেখচেন, সব বর্ডার পেরোনো ঢাকাইয়া পাতি-নেড়ে, রাতারাতি ঢুকে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের গাঁয়ে-গাঁয়ে , সবকটা লিগি, অ্যান্টি ইনডিয়ান এলিমেন্ট । ধমমো-শিবপুরেও জুটেচে । এগুনো আর ওই বাঙালগুনো, আমাদের পুরো পশ্চিমবঙ্গটাকে নষ্ট করে দিলে । আর ভারতবর্ষকে ডোবালো ব্রামভোনগুনো ।

আদিত্য যে কতরকুমের অ্যান্টিবডি খুঁজে বেড়াচ্ছে, কে জানে, মনে হল অরিন্দমের । মুসুলমানরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় কেউ-কেউ এভাবে নিজের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করে হয়তো । ও বলল, কিন্তু ওরা এখানে চিত্তরঞ্জন দাসে বেঙ্গল প্যাক্টও করতে আসেনি, আর তোমার কর্মসংস্হান কেন্দ্রে নাম নথি করে কাঁদতেও আসেনি । ওরা জানে পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ-লক্ষ লোকের কাজ ফাঁকা পড়ে আছে । সেই কাজগুনো করতেই আসচে ওরা । খাটবে-খাবেদাবে, বাচ্চা বিয়োবে, সাধ-আহ্লাদ করবে, মরে যাবে । কেন, বিহার-উড়িষ্যা থেকেও তো বছর-বছর লোক আসছে, কাজ পাচ্ছে, কাজ করছে, থেকে যাচ্ছে । শুধু এখানকার বাঙালিদেরই দেয়াল-জোড়া ন্যাকা-শ্লোগান প্যানপ্যানানি আর বুকনি ।

আদিত্যর পচন্দ নয় এরকুম যুক্তি । ঘরে-ঘরে কত বেকার ছেলেমেয়ে, দেশ রসাতলে যাচ্ছে, কেন্দ্র সরকার বঞ্চনা করছে, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, সমাজের অবক্ষয় নিয়ে বক্তব্যের রেকর্ড বাজায় । অরিন্দমকে বহুক্ষণ চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, রসিক পাসওয়ান লোকটা বড়ো হলে কী হবে । সহজে মুখ খোলেনি বুঝলেন । চারদিন সময় নিয়েছে ভাঙতে । বাকিগুনোকেও আমরা ধরবই ।

অরিন্দম ভিন্ন খেয়ালে । ও যখুন পাটনা অফিসে এইচ আর ডিতে কাজ করত, অতনু চক্রবর্তী আর সুশান্ত ঘোষ দুই জিগরি বন্ধু ছিল ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে । টাকাকড়ি পরীক্ষক, কয়েন-নোট এগজামিনার । চাকরি ফেলে রেখে, কাউকে কিছু না বলে, দুজনেই পর-পর দুম করে উধাও । বাড়ির  আরাম আর স্বজনজ্ঞাতির সংস্রব ছেড়ে এভাবে কেন চলে যায় মানুষ ! তারা কি কারুর বা কোনও কিছুর সোহাগ-বঞ্চিত ? ওভাবে উধাও হবার সাহসকে আসলে ও ঈর্ষা করে । নয়তো আদিত্যর সঙ্গে কাল আর আজ দুটো ছুটি নষ্ট করছে কেন ! পচা টাকার উপত্যকায় দিনের পর দিন কাজে হাঁপিয়ে উঠেছিল বোধয় ওরা দুজনে । এখানে যেমন রোজকার দশ কিলো-কুড়ি কিলো কয়েন ওজন করার চাকরিতে বিরক্ত হয়ে পুলিশে আদ্দেক মাইনেতে ঢুকে গেছে আদিত্য ।

প্রথমে সুশান্তটা উধাও হয়ে গিসলো । দুশো একর জমি আর সাত একর ফলবাগান আর রোববারি হাট ছিল ওর দাদুর, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে । ফাঁসির হুকুমপ্রাপ্ত জোতদার ব্যাজনাথ সিংকে উচ্চ আদালতে বাঁচিয়ে দেবার পুরস্কার হিসেবে তোপেয়েছিল ওর উকিল-ঠাকুদ্দা । যতদিন যাদব ক্রিমিনালদের দৌরাত্ম্য ছিল পিপারিয়ায়, সুশান্তরা গোপ বলে, ফসলের বখরা আর হাটের খাজনা পেতে ওদের অসুবিধা হয়নি । বস্তা-বস্তা চাল  ডাল গম সরষে রাখা থাকত পাটনায় ওদের গর্দানিবাগের বাড়িতে । কজ্জল ধানুকের দৌরাত্ম্যে সুশান্তর বাপ জ্যাঠা কাকা পরে আর পিপারিয়া-মুখো হতে পারেনি । ধানুক, বিন্দ, ভূমিহাররা তখন একদিকে আর যাদবরা আরেক দিকে । যাদবদের নিত্যিদিন খুন করত ধানুকরা ।

তারিণী মণ্ডল নামে আরেকজন নির্মম ক্রিমিনালের সাহায্যে, ওই সব জমিজমা আবার দখল করার উদ্দেশ্যে, কাউকে কিছু না বলে, কিছু টাকা জমিয়ে সুশান্ত গিসলো নওয়াগাছির কাজি-কোরাইয়ায় । ওই মণ্ডলরা এককালে হুগলি জেলার চাষি ছিল, থেকে গেছে দিয়ারায় গিয়ে । আরেকজন মানুষের যা কিছু ভালো, সে সদগুণ আমার নেই, সেই দুর্বলতার খাতিরে আমি, আমরা, তাকে আক্রমণ করি, ভাবছিল অরিন্দম । প্রথমে সুশান্তকে আটকে রেখে মণ্ডলরা ওর বাবা-জ্যাঠার কাছে দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা ক্ষতিপুরণ চেয়েছিল । অত টাকা কোথ্থেকেই বা দেবে । সুশান্তকে পছন্দ হওয়ায় তারিণী মন্ডল নিজের চোদ্দো বছরের মেয়ের সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে দিয়ে দিলে । আর ফিরতে পারেনি সুশান্ত । অপরাধীদের সঙ্গে দিনভর আর তাদের মেয়ের সঙ্গে রাতভর কাটাতে-কাটাতে অপরাধকেও ভালোবাসতে অভ্যস্ত এখুন ও, সুশান্ত । বাপ জ্যাঠা কাকার বিশাল একান্নবর্তী ছিল সুশান্তদের । ওর জন্যে সব পাঁকমাটি ।

লালু যাদব মুখ্যমন্ত্রী হবার পর যাদব ক্রিমিনালরা তাদের হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছে, লড়ে দখল করে নিয়েছে । অপরাধের জাতীয়করণ হয়ছে অনেক গাঁয়ে-গঞ্জে, এমনকী শহরেও । জেলাশাসককেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে হাজিপুরে । পিপারিয়ার দুশো একর জমি আর সাত একর ফলবাগান ফিরে পেয়েছে সুশান্ত । পাটনায়ও গিয়েছিল তারপর, নিজের বাড়িতে, গর্দানিবাগে । অন্তরালকে ভাঙা, হয়ে গেছে অসম্ভব । বাংলা কথাবাত্রাও আর গড়গড় করে বলতে পারে না, গাঁইয়া হিন্দি মিশিয়ে বাংলা বলে । দূরত্ব বেড়ে গেছে সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় । ফিরে গেছে শ্বশুরের দেশে । দিয়ারা-দুপুরের উড়ন্ত রুপোলি বালিয়াড়িতে ।

সুশান্তর পর উধাও হয়ে গেল অতনু । একদম বেপাত্তা । কতরকুমের যে গুজব রটেছিল ওর নামে । একজন লোক যতদিন বাঁচে, তার নামে কতরকুমের গল্প হয় । মরে গেলে গল্পগুনোও মরে যায় । কেউ যে বেঁচে আছে তাকে নিয়ে রটনাগুনোই তার প্রমাণ । একা থাকত অতনু । নিজেদের বাড়ি । সব ছিল । স২সার পাতলেই মিটে যেত । সাজানো বাড়ি ছেড়ে আচমকা নিরুদ্দেশ । হাওয়া । পালঙ্ক, বিছানা, হাফ-তোলা মশারি, ডাইনিং টেবিলে চায়ের কাপ, মিউজিক সিসটেম, বিছানায় টেপে এনরিকো কারুসোর ক্যাসেট, টিভি, ডিম-মাখন, সবজি, কোল্ড ড্রিংকস ভরা থকথকে বরফ-ঝোলা ফ্রিজ, মিক্সার-গ্রাইণ্ডার, থালা-বাসন, জামাকাপড়, বাংলা-ইংরিজি হাজারখানেক বইপত্তর, পড়ে রইল যেমনকার তেমন, যেন ফিরবে এইমাত্তর, বাজারে গেছে । ওর প্রতিবেশি পদমদেও সিনহার বিধবা স্ত্রী দরোজায় তালা দিয়ে খবর দিসলো উদবিগ্ন বন্ধু-বান্ধদের ।

কতরকুম জনশ্রুতি পাক খেয়েছে অতনুকে নিয়ে । পাগল হয়ে গেছে । আত্মহত্যা করেছে । সাধু হয়ে চলে গেছে নেপালে । ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে বেঘোরে মরেছে । শেফালি বাউরি নামে এক হাফ-গেরস্তর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সংসার পেতেছে । শেষে কিনা, আশ্চর্য, অরিন্দম ওকে দেখতে পেল হাজারিবাগের ঘন জঙ্গলে । মাওবাদি কমিউনিস্ট সেন্টারের নিখোরাকি খেতমজুরের ছেলেমেয়েদের অনাড়ম্বর গণবিবাহে । রেড বুক থেকে ইংরিজিতে মন্তর পড়ে বিয়ে দিচ্ছিল । রেড বুককে বিয়ে দেবার বই করে ফেলেছে ! দেড়-দুশো হতদরিদ্র, ময়লা, স্নানহীন, হাফল্যাংটো গ্যাঞ্জামে বিয়ে শেষে অতনুর দিকে ভিড় ঠেলে এগোবার আগেই লোপাট হয়ে গিসলো । দেখতে কি আর পায়নি অরিন্দমকে ? এড়িয়ে গেল । স্রেফ উপেক্ষা করল । অদ্ভুত । অতনুর জীবনে অরিন্দমের জন্যে আর এক চিলতেও পরিসর নেই ।

পাটনা অফিসের চাপরাশি রসিক পাসওয়ানই নিয়ে গিসলো ওই জঙ্গলে । পাটনা থেকে অসীম পোদ্দারের ডিজেল অ্যামবাসাডর গাড়িটা কিনে কলকাতায় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অরিন্দম । অনেককে বলেছিল সঙ্গে যেতে । রসিক রাজি হল । দুজনে পালা করে চালিয়ে কোন্নোগর আসার পর রসিক পাসওয়ান বাসে করে চলে গেল হাওড়ায় ওর জেলার লোকের কাছে । আশ্চর্য, এই দেড় বছর চাকরি থেকে বেমালুমনিরুদ্দেশ ছিল রসিক । ভোটবাগানেই ধরেছে ওকে পুলিশ । ধরেছে গুণ্ডাদের দেওয়া তথ্যে । লোহার বাবরির সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত ক্রিমিনালদের সাহায্যে বন্দুক-টন্দুক জোগাড় করছিল । ও যে ভোটবাগানে লুকিয়ে রয়েছে, সেই চিঠিটা অরিন্দমকে আদপে সত্যিই কে যে লিখেছিল, সে সন্দেহ আরও গভীর হয়ে যাচ্ছে । আদিত্যর কি হাত আছে তাতে ?

সমাজ কাউকে নিরুদ্দিষ্ট থাকতে দেবে না । খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে খুঁজে বের করবেই । এবার টেনে বের করতে চায় অতনুকে । লোকচক্ষু নামের একটামাত্র চোখের এই সমাজ । জিভ তার অনেক । আদিত্য সেদিন বলছিল, লেকচার ঝাড়ছিল, যে, সমাজ যাদের সহজে খুঁজে পায় না, তারাই যতরকুমের গোলমাল বাধায় । লুকোছাপা, গোপনীয়তা, প্রায়ভেসি দেখলেই তাকে উপড়ে ফেলতে হবে, হিঁচড়ে বের করতে হবে সবার সামনে । রঞ্জিত গুপ্ত, দেবী রায়, রুণু গুহনিয়োগীর দায়বদ্ধতার সেটাই ছিল চাবিকাঠি । আদিত্য সেই আদিম বুনো চাবিটা প্রায় করায়ত্ত করে ফেলেছে ।

অধ্যাপকের দামি উন্নাসিকতার আদলে বলেছিল আদিত্য, এই এখুন যদি রুণু স্যার গোয়েন্দা বিভাগে থাকত তাহলে অ্যাতো মার্ডার হত না । জানেন, গত বছর, এক হাজার আটশো আটত্রিশটা মার্ডার হয়েছিল, আর তার আগের বছর এক হাজার সাতশো পাঁচটা, যখুন কিনা মেয়েদের ওপর অত্যাচার গত বছর হয়েছিল সাত হাজার তিনশো উনআশি আর তার আগের বছর সাত হাজার তিনশো একাত্তরটা । ওই যে বললুম, ডেডিকেটেড অফিসার নেই । আগে ডিসি বিভূতি চক্রবর্তীর মতন লোক ছিল । অফিসারদের আর কত নাম করব ? রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, রাজকুমার চ্যাটার্জি, নীহার চৌধুরী, রবি কর, উমাশংকর লাহিড়ি, অরুণ ব্যানার্জি, আদিত্য কর্মকার, দীপক কর, আশিস মুখার্জি, তারপর আপনার পাঁচুগোপাল মুখার্জি, বুঝলেন, এসব নাম বাঙালির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । পিওর গোল্ডে । এরা না থাকলে নকশাল মিনেস ইর‌্যাডিকেট হত না পশ্চিমবঙ্গে ।

তা থাকবে । অন্যমনস্ক বলে, অরিন্দমের খেয়াল হল যে, সোনার বাংলা অক্ষর সত্যিই দ্যাখেনো ও আজ ওব্দি । এবারে ছোটোভাইয়ের বউয়ের জন্মদিনে একটা ভারি সোনার গিনি গড়িয়ে দেবে । বাংলা হরফ থাকবে তাতে, ‘সোনার বাংলা’ । চাঁদ সদাগরের মুখ ? বল্লাল সেনের মুখ ? না, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ । কিন্তু কোন মুখ্যমন্ত্রী ?

আজগাল তো পদ্য লিকিয়েরাও পুলিশ কমিশনার হয়ে যাচ্চে । জিভের ডগা মুড়ে জানায় আদিত্য । রুণু স্যার ঠিকই বলেছিল, পদ্য লিকে-লিকে কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল তুষার তালুকদারটা ।

তুমিও লেখো না । তুমি পারবে । ধর্ষণকে বলতে হবে নিগ্রহ বা নির্যাতন ।

অরিন্দমের খোঁচাটা সূক্ষ্ম হয়ে গেল বোধয়, মর্মার্থ বুঝতে পারল না আদিত্য । বলল, পাগল নাকি । পদ্য লেকে বলে দীপক রুদ্র আর পার্টসারথী চৌধুরী সুপারসিড হয়ে মুখ্য সচিব হতে পারল না , দেখচেন না । প্রত্যুষপ্রসূন ঘোষ তো পদ্য লেকে বলে প্রোমোটি আই এ এস হতে পারেনি । তারাপদ রায় অবশ্য হয়েছিল মজার-মজার পদ্য লিকতো বলে । চাকরিটা খাবেন দেকচি । পদ্য নাটক-ফাটক লিকে মন্ত্রী-টন্ত্রী হওয়া যায় বটে । কিন্তু সিরিয়াস সরকারি কাজে ওসব চলে না । আদিত্য নিজে নিজের জন্যে স্তোকবাক্যের বুজকুড়ি কেটে মাথামুণ্ডু বকে যায়।

নিজের ভাবনায় মডগুল হবার দরুন, হাওড়া স্টেশানের অখিল ভারতীয় কচকচানি অরিন্দমের চারিপাশে শ্রুতির অবুঝ পার্টিশান তোলে । যিশুকে ওভাবে ধরে একটা ড্রাই রান দিলে আদিত্য । বর্ধমানের কোন-এক ধর্মশিবপুর গ্রামের, যেখানকার মানুষ এই একুশ শতকেও মাঠে হাগতে যায়, সেখানের এই স্বাস্হ্যবান যুবক একদিন মহিলাদের সামনে-পেছনে রুল ঢুকিয়ে রাষ্ট্রের আইন সামলাবে । যাকে ইচ্ছে ধরে তার পায়ের আর হাতের নখ উপড়ে নেবে, এক-এক করে । মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, কিল চড় ঘুষি লাঠি লাথি, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, যতক্ষণ না পেশি থেঁতলে লোকটা হেদিয়ে পড়ে । লোকটার ধড় সাপের লেজের মতন ছটফট না করা পর্যন্ত মুণ্ডু জবরদস্তি চুবিয়ে রাখবে জলে । ফেটে রক্তাক্ত অজ্ঞান না-হওয়া ওব্দি পায়ের পাতায় অবিরাম লাঠির বাড়ি মারবে ; কড়িকাঠ থেকে উল্টো ঝুলিয়ে । যতক্ষণ না শব্দ ওঠা বন্ধ হয়, হাতের গাঁটে পায়ের গাঁটে রুল পেটাবে । চুলের মুঠি ধরে, একবার এদেয়ালে একবার ওদেয়ালে মাথা ঠুকে দেবে । শিশ্নে মারতে থাকবে ফুটরুল দিয়ে । হাত-পা বেঁধে শুইয়ে বুটজুতো পায়ে উরু মাড়াবে । সিগারেটের টুকরোর ছ্যাঁকা দেবে, মেয়েদের নরম জায়গায় ।  ফাঁকে-ফাঁকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করবে মা-বাপ তুলে । পালাতে বলে, জলজ্যান্ত গুলি করবে পেছন থেকে ; মরে গেলে চ্যাংদোলা এক-দুই-তিন দুলিয়ে ফেলে দেবে হাসপাতালের আঁস্তাকুড়ে । এসবই ব্রিটিশের কাছ থেকে কংরেসিরা পেয়ে, দিয়ে গেছে বামপন্হীদের ; তারা আবার পরের কর্তাদের দিয়ে যাবে, অম্লানমগজে । সমাজ বোধয় কোনোকালেই বদলায় না । অধঃপতনের যাত্রাপথকেই বোধয় প্রগতি বলে । কিন্তু যতই যাই হোক, যিশু বিশ্বাসের কথাটাই ঠিক । ‘প্রান্তিক চিরকার ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যায়।’

অরিন্দম দেখল, জি আর পির চারজন কন্সটেবল তিনটে দেহাতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আদিত্যকে সেলাম ঠুকলো কন্সটেবলগুনো । আদিতছ, কী রে জবাই করতে যাচ্ছিস, বলায়, একজন অম্লপিত্তকফে ভোগা কন্সটেবল চোখ টেপে, গাঁইয়াগুলা মহিলা কামরায় চাপতাসিলঅঅ ।

অরিন্দমের প্রশ্নবাচক ভুরুর উদ্দেশে আদিত্য রসিক হয়ে ওঠে । ওরা ওই দেহাতিগুনোকে জি আর পি থানায় ঢুকিয়ে একটাকে বলবে জামিনদার খুঁজে আনতে । এই বিদেশ-বিভূঁয়ে এসে টপ করে তো আর পাবে না জামিনদার । থানার দরোজার সামনে, দেখগে যাও, উবু হয়ে বসে আছে হুদো-হুদো হবু জামিনদার । ছাড়ান পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে দেহাতিগুনো । কত রকুমার কেস যে সারাদিন ধরছে তার ইয়ত্তা নেই । জি আর পির সঙ্গে বেশ ভালো বোঝাপড়া আছে জামিনদারদের । রেস্ত খসালেই ছাড়া পেয়ে যাবে লোকগুনো । জামিন, জামিনদার, জামিনের কাগজ সব ভুয়ো । রেস্ত পাওয়া হয়ে গেলেই ছিঁড়ে ফেলে দেবে ওসব কাগুজে প্রমাণ-টমান । অনেক দেহাতি-পার্টি তো হাতে হেভি মালকড়ি নিয়ে কলকাতায় আসে । আমাদের ওদিকের কালনার শৈলেন ঘটক জামিনদারি করে এক বছরেই সাত বিঘে দোফসলা জমি কিনে ফেলেছে । অবশ্যি উবু হয়ে বসার ওই জায়গাটুকু অনেক দাম ধরে পেতে হয়েছিল শৈলেন ঘটককে ।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি-অভিমুখী যাত্রী-ঠাসা লোকাল ট্রেনের চকিত-করা ভোঁ বেজে ওঠে । স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঘটকালি মন্দ নয়, বলল ও , অরিন্দম । ট্রেনটা ঘট করে শব্দ করে ছাড়তেই, আদিত্যকে ভ্যাবাচাকায় ফেলে, তাতে উঠে পড়ল অরিন্দ । টা-টা ।

১০

বাড়ি ফিরলেও অশান্তি । ছোটো ভাইটার বউ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে কেরানি । অ্যামবাসাডরে পাশে বসিয়ে, সুপর্ণাকে ওর অফিসে নাবিয়ে, অরিন্দম চলে যায় বি-বা-দী বাগে নিজের দপ্তরে । তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে ভয় করে । ভাইয়ের অনুযোগ যে, ইচ্ছে করে গাড়ি আস্তে চালায় অরিন্দম । জ্যামহীন হরিশ মুখার্জি দিয়ে যাবার বদলে সিগনালের অজস্র ব্যারিকেড-বাধা গাড়িকন্টকিত আশুতোষ-শ্যামাপ্রসাদ দিয়ে যায় । বাসে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি । চলন্ত গাড়িতে হাসাহাসি করে ভাসুর ভাদ্দরবউ । অনেকে নিজের চোখে দেখেছে । পাড়ার বেকার ফুটপাতবাজরা পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছে ওদের হাসির আদান-প্রদানে, ছি ছি । পাড়া কমিটির উদবাস্তু নেত্রী অঞ্জনা হাজরার একমাত্র মেয়ে বলে খাপ খোলে না কেউ । কই, বাড়ি ফিরে তো হাসাহাসি হয় না ।

কী ঘোর বিপদ অরিন্দমের ।  হঠাৎ কী করেই বা বলবে, এই সুপর্ণা, কাল থেকে তুই বাসে যাস । ঘড়ির ব্যাপারে পাগলামি আছে সুপর্ণার । টেবিলে-টেবিলে, প্রতিটি ঘরের দেয়ালে-দেয়ালে, বিভিন্ন বাজনার গোল লম্বাটে চারকোণা ছকোণা ঘড়ি ঝুলিয়েছে । বৈঠকখানার দেয়ালে টাঙিয়েছে ্রিণ-শিং বিদেশি ঘড়ি, আধঘন্টা অন্তর পাখি বেরিয়ে ডাকে । একঘন্টা অন্তর সমস্ত ঘড়িগুনো বাজতে থাকলে নিভৃত আ্‌লাদ হয় অরিন্দমের । অবশ্য সব ঘযিগুলোই দিনের বেলায় বাজে ; অন্ধকার হলেই তারা বোবা । সাতদিনের জন্যে অরিন্দম ওকে সাতরঙা ঘড়ি কিনে দিয়েছে বলেও উষ্মা ।

ভাদ্রবধুর অফিসে প্রশ্নফাঁস, জাল মার্কশিট, ফেলকে পাশ করানো, নম্বর বাড়ানো কেলেংকারির দরুন সেদিন অরিন্দমের টেবিলের সামনে বসে হিঁয়াঃ হিঁয়াঃ হিঃ হিঃ হিঃ খিক খিক হিঁয়াঃ ইঁয়াঃ করে হাত-পা-মাথা নাড়িয়ে-নাচিয়ে হাসি উপহার দিয়ে গেল পাটনা অফিসের মহাত্যাঁদোড় নোটপরীক্ষক মোহন রাজবংশী, যেন ওসব নোংরামির জন্যে অরিন্দমই দায়ি । ব্যাটা তো কোনও কাজ করে না অফিসে । নোটের প্যাকেট গোনার বদলে বাঁ পাশ থেকে ডানপাশে নিয়ে সই মেরে দিত । তারপর সারাদিন কোনো অফিসারের চেলেমেয়েকে কোথায় ভরতি করাবে, ডোনেশানের দরদস্তুর, পরীক্ষায় ভালো নকল চেলেকে বসানো, ইনভিজিলেটারের সঙ্গে রফা, এইসব সমাজসেবা করে বেড়ায়, আর তার জন্যে কমিশন খায় । পাটনায় থাকতে একবার প্রচ্ছন্ন টিটকিরি মেরেছিল অরিন্দম । তার প্রতিশোধ নিয়ে গেল ।

অরিন্দম ভাবছিল যে ওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সবায়ের সমস্যা । সেই ছাত্রজীবন থেকে একের-পর-এক প্রেমাস্পদার সঙ্গে ও সম্পর্ক গড়েছে আর তা ভেঙে গেছে । গড়া-ভাঙার মাঝখানটা ঘিরে একটা করে দূষিত গল্প ছড়ায় । বিশ্বাসযোগ্যতায় দূষণ ঘটে । শেষ গল্পটা তুলি জোয়ারদারকে নিয়ে । যারা কখুনও প্রেম করেনি, তারা মনে করে  প্রেমের জন্যে বুঝি মেয়েমানুষটাই সবকিছু । তা তো নয় । নেসায় যেমন নেশাটাই মুখ্য, ড্রাগটা তো গৌণ । ম্যানিলায় একবছর ট্রেনিঙে ছিল বলে, নারীসঙ্গ বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কথা ও কাহিনি ছড়িয়েছে অফিসে । ডলার বাঁচিয়ে হংকং আর ব্যাংককের লাল-আলো এলাকার সুমসৃণ মোঙ্গল-ত্বক আদর করার উত্তেজক জিভ-ভেজা গল্প । ছোটোভাইটাও অরিন্দমের নানা গল্পগাছায় ছোটোবেলা থেকে প্রতিপালিত । তার কাছে বিশ্বাস্য হয়ে ওঠা অসম্ভব ।

শ্যাওড়াফুলি লোকালে উদ্দেশ্যহীন উঠে পড়েছিল অরিন্দম । কোন্নোগরে নাবল না, ছোটোকাকার শ্রাদ্ধে যাওয়া হয়নি । হিন্দমোটরে নাবল না, অ্যাতো রাতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়বে মেজোকাকা । স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এমন সমস্ত কেউটে গোখরো লাউডগা অজগর শঙ্খচূড় কিরাইত চিতি চন্দ্রবোড়া কানড় ময়াল বের করে-করে কামড় খেতে থাকবে যে রাতভর ঘুমুতে দেবে না । প্রতিটি কামড়ের আগে বলবে, গল্পটা হল এই ; অথচ তা গল্প নয়, তাঁর জীবনের দুঃখকষ্টের চিলতে ।

লাটের পর লাট ঘামে পচা নিত্যযাত্রী উঠছে-নাবছে, কোথাও না কোথাও যাবে । তীর্থযাত্রীর মতন একটা ইদ্দেশ্যময় নির্ধারিত গন্তব্য তো আছে । বাড়ি, পরিবার, দিনানুদিনের যৌনতা, রুটিনবদ্ধ কর্মসূচি । এটাই তো সুখপ্রদ আধুনিক জীবন ।

ট্রেনটার শেষ স্টেশান শ্যাওড়াফুলিতে, নেবে পড়ল অরিন্দম । মাকে টেলিফোন করে দিল, পিসিমার বাড়ি যাচ্ছে, পরশু অফিস হয়ে ফিরবে । অন্ধকারের অন্ধিসন্ধিতে পঁকপঁক তুলে এগোয় রিকশা । খোঁদল-কানা টিমটিমে রাস্তায় বৃষ্টির আবেগ-মাখা কাদা । দুপাশের হামলে-পড়া দোকানদারিতে নোনাডাঙা রোডটা অনোন্যপায় । বৃষস্কন্ধ ট্রাক চোখ বুজে র‌্যাশান পাচার করাচ্ছে । পাঁঠার শিড়িঙে মরদেহের অবশিষ্টাংশ ঝুলে আছে একাকী উদাসীন কসায়ের চ্যাঁচারি-চিলমনের আবডালে । শহুরে বর্ষার অকাল-ছপছপে গলিতে রিকশা থামল । ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যতটা চোখ মেলা যায়, থিতু হয়ে জিরোচ্ছে কৃষ্ণপক্ষের সজল মেঘ ।

পিসিমা যে পাঁচ বছর আগে মারা গেছে তা পৌঁছে টের পেল অরিন্দম । পিসতুতো ছয় ভাই, ইঁটের অর্থেক তৈরি দাঁত-বেরোনো বাড়িতে ঢুকে দেখল ও, আলাদা-আলাদা মিনি সংসার বানিয়ে ফেলেছে যে-যার ছাদ-পেটানো নানান মাপের খুপরি-ঘর ফ্ল্যাটে । আজকে বড়ো বউদির জন্মের সুবর্ণজয়ন্তীতে, ওদের একত্রে মদ খেতে বসার দরুন, স্কচ হুইস্কির ভরাযৌবন বোতলদুটো পিসিমা-পিসেমশায়ের উপস্হিতির কাজ করল । নয়তো অরিন্দম ঠিক কোন ভায়ের অতিথি, সে সমসয়া এক অপ্রস্তুত ঝামেলায় ফেলে দিত এই বাদলা রাত্তিরে । দুই বোন আর তাদের স্বামীসন্ততিও হাজির । গ্রামীণ প্রকৃতি-পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন প্রতিটি পরিবার নিজের বাড়ির মধ্যেই মেলা বসাচ্ছে এ-যুগে । পাঁঠাবলির বিকল্প ব্রয়লার । নাগরদোলা আর ফকির-বাউলের বদলে ভিসিপি-ভিসিআর এনে বা কমপিউটারে হিন্দি সিনেমার জগঝম্প । একান্নবর্তী এ-যুগে একবোতলবর্তী ।

সত্যিকারের বাউল-ফকিররা বোথয় আর টিকবে না বেশিদিন । লালন থাকবে ইশকুল-কলেজের পুঁথিপত্তরে । টিভি আর নাটক-মাচানে থাকবে পূর্ণদাস বাউল । অফিসের কাজে একবার মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল অরিন্দম । তাঁতিদের কীভাবে সাহায্য করা যায় যাতে মুর্শিদাবাদি সিল্কের শাড়ি কর্ণাটক আর তামিলনাডুর শাড়ির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারে তা খতিয়ে দেখতে ধরমপুর, কুমিরদহ, ছয়ঘড়ি, নতুন হাসানপুর, দুর্লভপুর, গুধিয়া, হাসানপুর, হরিহরপাড়া, বাগড়ি, আলিনগর অঞ্চলে ঘোরাঘুরির সময় ফকির-বাউলের হেনস্তার অভিযোগ পেয়েছিল অরিন্দম ।

বোঝলেন বাবু, আমরা নাকি কাফের, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদা করি না বলে আমরা নাকি আল্লার বান্দা নয়, আমাদের গানবাজনা নাকি হারাম, রোজা রাখি না বলে ইন্তেকালের পর জান্নাতে আমাদের জায়গা নেই । বলেছিল সিরাজ ফকির । আড়াই হাজার ট্যাকা দিতে হয়েচে গান করি বলে । কংরেস সিপিয়েম ফরোড ব্লক তৃণমূল কেউ বাঁচাতে আসলেনে ।

স্বাধীন বাংলাদেশ হলে কী হবে, পাকিসতানি জামাত আছে সেখানে লুক্যে । কুষ্টিয়া রাজশাহি পাবনা থিক্যা আসসা বুল্যে যায় ফকির যেন কাফেরের মতন দোল না খ্যাল্যে, যেন নুন না খায় কাফেরের ভোজে । পরামাণিক ঘরামি কলু মোহন্ত মাঝি পদবি বাদ না দিল্যা তার ঘর‌্যে সাদি-নিকা বন্ধ করা হব্যে । বিয়া আকিকা ইদ বকরিদে লালনের গান গাইবা না । কাজেম মোহন্তর মেয়্যের সোহরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি আর তার আবার বিয়া কাফেরদের মতন দিল্যা, তাই লবণচল বন্ধ । রইসুদ্দি ফকির, একবাল হোসেন, কাজেমালি দোতারা নিয়্যা নেচেছিল । তেনাদের হুমকি দিয়্যা গেছে ওপারের তবলিগ । পাসপোট-ভিসা লাগ্যে নাই তবলিগঅলাদের । আমরা আল্লার বান্দা না পাকিস্তানের বান্দা বল্যেন আপনে । জানতে চেয়েছিল ফজলু ফকির ।

এমন অবস্হায় বালুচরি শাড়িকে ঢাকার বাজারে আর প্রবাসী ধনী বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় করা শক্ত । বাঁকুড়া জেলায় বিষ্ণুপুর মহকুমার মাধবগঞ্জে মহাজন আর তাঁতিরা গোঁ ধরে আছে যে হিন্দু মোটিফ পালটাবে না । মুর্শিদাবাদি তাঁতিকে বালুচরি বোনা শিখতে হলে প্রথমে মাধবগঞ্জের মোটিফ শিখতে হবে । চাঁদ তারা উট তাঁবু খেজুরগাছ মিনার এসবের নকশা জ্যাকার্ডে তুলে যে সরকারি কম্পিউটারবিদ বিষ্ণুপুরে প্রচার করতে গিসলো তাকে তাঁতিরা আর মহাজনরা প্রচণ্ড মার দিয়েছিল । অরিন্দমের মনে হয়েছে এ তো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অতীত এক দুর্বোধ্য সমাজ , এর জট পাকাতে-পাকাতে দড়ির মুখ খোঁজাকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে । অথচ মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামেই জন্মেছিল বালুচরি ।

হতভম্ব অরিন্দম বলেছিল, কিন্তু জেলা সদরে যে শুনলুম বাউল ফকির সংঘের সভাপতি শক্তিনাথ ঝা, তারপর কলকাতার সব গণ্যমান্য লোকেরা, মহাশ্বেতা দেবী, আবুল বাশার, প্রকাশ কর্মকার, মনোজ মিত্র, আজিজুল হক, কবির সুমন, সুজাত ভদ্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ওনারা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দরবার করেছেন ।

সিরাজ ফকির : ওই কলকাতায় গান-গপপো-থেটার করেন, তেনারা ?

অরিন্দম : হ্যাঁ হ্যাঁ ।

সিরাজ ফকির : তা তেনারা থাকে কলকাতায় আর নাসিরুদ্দি ছায়েব ভোটে জেতে হেথায় ।

অরিন্দম : ওহ ।

সিরাজ ফকির : খেতে জল দিচ্ছিল জব্বার ফকির । ওর পাম্প তুলে নে গিয়ে রেখে দিলে পঞ্চায়েতের ছইফুদ্দি সরকারের বাড়ি । যে-ই জব্বারের জন্যে তদবির করেছে সে-ই জরিমানা দিয়েছে । তুঁত খেত আর পলু চাষ লাটে উতেচে গো । আর আপনে এসেচে মুরসিদাবাদি সাড়ি বাঁচাতে ।

অরিন্দম দেখেছে, বাহকরাও বলেছে, মহাকরণে মন্ত্রী আর সচিবরাও জানে, চিন আর কোরিয়ার উন্নতমানের রেশমসোতো চোরাপথে আসচে মালদা মুর্শিদাবাদ নদিয়া বাঁকুড়ায় । আহা, করে খাচ্চে গরিব মুটেরা । বড্ডো দুঃখুগো কুষ্টিয়া কোটচাঁদপুর কুমিল্লায় । বিদেশি সাম্যবাদী দেশের সরকার তাই স্মাগলিঙে নিয়োজিত । বাঁকুড়ায় দেখেছিল অরিন্দম, তাঁতি আর মহাজনের আড়ংধোলাই-খাওয়া কম্পিউটারবিদ দেখিয়েছিল, বালুচরি শাড়ির মফসসলি দিকটা এদেশি রেশম, আর শাড়িটার  সদর পিঠে কোরিয়ার সিল্ক ।

এখানের রেশমচাষিরা পড়ে-পড়ে মার খাচ্চে । দিনকতক পর দড়িদঙ্কা হয়ে মরবে । আমাদের কিছু করার নেই স্যার ল আমরা স্মঅঅঅঅল ফ্রাই ।  হ্যান্ডলুম অফিসার, নস্যি-নাকি হুতাশ জানিয়েছিল অনুকুলচন্দ্র বসাক । আর তুঁত-চাষি হাজি ইসরাইল বলেছিল, পাশের মালদা জেলায় অবস্হা আরও খারাপ । আমরা লাভজনক দাম পাই না । ভালো জাতের ডিমও পাই না আজ্ঞে । কাজের সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না । সেচের জল বাড়ন্ত । সারের দাম বেড়েই চলেছে । আমাদের কতা কেউ ভাবে না । আমাদের দেখার কেউ নেই । এই আপনারা কলকাতা থেকে আসেন, লিখে নিয়ে চলে যান । বিহিত হয় না । এই অ্যাতোক্ষুণ আপনার সঙ্গে কতা বলে কত সময় নষ্ট করলুম । আজকে হাটবার ছিল । আগে আমরা বছরে চারবার পলুপোকা পুষতুম । এখুন একবার পোষা দায় ।

আছেরুদ্দি মহাজন, দাড়িপাকা, গোঁফকামানো, বললে, বাঁ পা চেয়ারের হাতলে তুলে পায়জামা নাবিয়ে হাঁটু চুলকোতে-চুলকোতে, সরকার তো পাওয়ারলুম বসাতে দিতে চায় না  যাও বা রেশমসুতো হয়, তার বেশিটা নিয়ে চলে যাচ্ছে ভাগলপুর বেনারস মোবারকপুরের ফড়ে । অঙ্গুলিহেলন জানেন তো ? আপনাদের কলকাতার বড়োবাজার সুতোর দাম বেঁধে দিচ্ছে ষড় করে । অঙ্গুলিহেলন-কমরেডদের সঙ্গে ষড় করে । সঅঅঅঅব সমস্যা কলকাতার তৈরি । মুর্শিদাবাদি রেশমশাড়ির দিনকার ফুরুল ।

১১

কী হল অরিন্দমদা, স্যাওড়াফুলি ইসটিশান থেকে হেঁটে এলে নাকি গো, অমন হাঁপ ছাড়চ ? জিভে জড়ানো উত্তর আগে জানিয়ে তার প্রশ্নটা পরে বলে সবচে ছোটো পিসতুতো ভাই পল্টু, থলথলে তাঁবাটে খালি গায়ে নেয়াপাতি ভুঁড়ির ওপর পৈতে, ডানবাহুতে রুপোর চেনে তাঁবার ডুগডুগি-মাদুলি, মুখের মধ্যে ভেটকি বৃদ্ধের লাশের ঝালঝাল টুকরো । সামনে কাঁচের গেলাসে মদের আদরে বিগলিত-চিত্ত বরফ-টুকরো । বলল, সময় লাগল বলতে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ক্লাস টু ফাইভ এইট, ওঃ, কত যে ধকল গেল, নাঃ, বুঝবে না তুমি ; আগে বিয়ে করো, ছেলেপুলে হোক । মাদুলির চেন বাজিয়ে এক চুমুকে শেষ করে । দাঁতে বরফ ভাঙার কড়মড় ।

পল্টুর বউটাই কেবল হাঁটুমুড়ে টিভিতে নাক ঠেকিয়ে  হিন্দি মারপিটে উৎকর্ণ । ছাপাশাড়ি, এলোখোঁপা, ছোট্ট কপালে মেরুন টিপ, পায়ের কাছে ফাঁকা গেলাস । বাদবাকি ননদ ভাজ ভাসুর ননদাই মদের পলু থেকে কথার মাকড়সার ঘরকুনো জাল বুনছে । গোল হয়ে সবাই । সামনে একাধিক কাঁসার থালায় আস্ত পারসে ভাজা, আরামবাগি মুরগি-ঠ্যাঙের সুস্বাদু পাহাড়, হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার ভুষিমাল, দুফাঁক ডিমসেদ্ধ, মাছের ডিমের বড়া, শশা পেয়াজ গাজর । ভাইরা, জামাইরা, সবাই খালিগা, কারুর চেহারাই ব্যায়াম করা পেশল নয় । পায়জামার ওপর একটা করে বিশার তাঁবাটে কুমড়ো । বউরা, বোনরা মোটার ধাতে এগুচ্ছে । বোধয় মাঝে-মাঝেই হুইস্কির ক্যালরিতে তনু ভেজে ।

শতরঞ্চিতে বসে মাছের ডিমের একটা বড়া মুখে পুরে অরিন্দম যখুন চিবিয়ে অবাক ওর মধ্যেকার কাজু কিসমিস রসুনকোয়া সাদা-তিলের উপস্হিতিতে, বড়ো বউদি, যার আজকে জন্মদিন, ছেঁচিয়ে হুকুম জারি করে, এই অরিকেও একটা গেলাস দাও, দাও,দাও,দাও, কতদিন পরে আমাদের বাড়ি এল, তাও আবার রাত্তিবেলা ।

অরিন্দম স্পষ্টত বিচলিত । বলল, আরে না-না, আমি এসব খাই না, ককখুনো খাইনি ; সিগারেট ওব্দি খাই না ।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফরসা ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে, আর বাঁহাতে অরিন্দমের গলা আঁকড়ে নিজের কানা-ভরা গেলাস দাঁতেদাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উল্টে দিলে । খাবিনে মানে ? তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী । বিশাল বুকের মাঝে অরিন্দমের মাথা ঠাসা ।

তোমার বুকে চেতল মাছের গন্ধ, বলতে, বড়ো বউদি চাপা গলায়, মাছটা কুরে রেখেছিলুম রে, হয়ে উঠল না । অরিন্দমের ফাঁস আলগা হয় না । জামা ভিজে গেছে । ফাঁসের দরুন কষ্ট হচ্ছে । আবার ভালোও লাগছে । নারীর বুকটুকুর এক পৃথক মাতৃত্ব আ্ছে মনে হয় ।

অ্যাই, দামি স্কচ বলে ভাবচ ওতে চান করলে নেশা হবে ? দুপাটি দাঁত ভিজছে গেলাসের হুইস্কিতে, ওয়ালরাসের হিলহিলে ঠোঁট নেড়ে বলল বড়ো জামাই । অরিন্দম, তার চে তুই বরং কিছু ভালগার জোক শোনা । গ্রামীণ বিকাশের অনুদান লোটা মাংসল জামাইয়ের কন্ঠস্বর ।

জাপটানো অবস্হাতেই বড়ো বউদির হুকুম, হ্যাঃ, তাই শোনাহ । বুজলি অরি, আমরা হলুমগে শান্ডিল্য গোত্রের মাতাল ; গোত্রের ভেতরেই শুঁড়িখানা । বিয়ের আগে তোর মতন ভারজিন কাশ্যপ গোত্র ছিলুম । নেশার কুয়াশায় ক্রমশ ঝিমোনো বউদির কন্ঠস্বর । জাপট আলগা হলেও অরিন্দম মাথা সরায় না । পাফ দিয়ে গুঁড়ো দুধ মাখানো বুক হলে ভালো হতো ।

আমি একটা বলছি । টিভি থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা করেছে ছোটো বউ । স্বতঃপ্রণোদিত মাতাল । একবার না, অ্যাঁ, হি-হি, একজন না, অ্যাঁ, রাস্তার ধারে নর্দমায় হিসি করছিল, হি-হি । অশ্লীল নয়, অশ্লীল নয়, অ্যাঁ, নালির ধারে তোমরা যেমন করো । লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের বোতাম লাগায়, অ্যাঁ, তখন জিপ ছিল না, বোতাম ছিল, বোতাম লাগিয়ে, অ্যাঁ, টের পেল ওর ঘাড় বেঁকে গেছে, হি-হি, একদম সোজা হচ্ছে না । ডাক্তারের কাছে গেলো, ওষুদ খেলো, মালিশ লাগাল, ইনজেকশান নিলে, অ্যাঁ, হি-হি, কিন্ত কিছুতেই কিছু হল না, ঘাড় সোজা হল না । মহাবিপদ । কী করে বেচারা । বেঁকা ঘাড় নিয়েই কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি গেল, বউকে বলল । বউ বললে, তা এই কতা, দাঁড়াও এক সেকেণ্ডে ঘাড় সোজা করে দিচ্চি । বলে, হি-হি, প্যান্টের বোতাম খুলে দিতেই ঘাড় সোজা হয়ে গেল । উউউউফ । লোকটা কোটের বোতাম প্যান্টের বোতামঘরে লাগিয়ে নিয়েছিল।

সবাই, মাতাল ভাজ ননদ ননদাই ভাসুর হাসবে বলে উদগ্রীব করে তুলেছিল নিজেদের, কিন্তু নিরুৎসাহিত হল । অরিন্দমের হাসি পেয়েছিল, ছোটোবউ তার স্বামীকে তির্যক আক্রমণটি করল অনুমান করে । কিন্তু হাসার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে গিয়ে টের পেল, বড়ো বউদি আবার জাপটকে আঁট করে ফেলেছে ; হয়তো নিজের চেয়ে বেশ ছোটো একজন যুবকের গ্রন্হিসুগন্ধের মাদকতা মদের সঙ্গে মিশে জরুরি আহ্লাদ এনে দিচ্ছে ।

নোংরা চুটকি না হলে কেউ হাসবে না রে, সেজো বউদির বিজ্ঞ মন্তব্য । নোংরা মানে সেক্স !

ছোটো জামাই তলানিটা চুমুক মারে । আঁচ্ছা আমারটা শোনো । তেমন নোংরা নয় যদিও । ওই সেক্স-টেক্স নিয়ে নয় । আমাদের রাজনীতিকদের নিয়ে । সো-সো । একজন মাঝারি নেতা, ভাষণ শেষ করে যখুন চেঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল, ওনি কোঁৎ করে নকল দাঁতের পাটি গিলে ফেলেছে । এক্সরে হল, সোনোগ্রাফি হল, গু পরীক্ষা হল, নিউক্লিয়ার মেডিসিন টেস্ট হল, দাঁতের পাটি-জোড়ার কোনো হদিস পাওয়া গেল না । একদোম যেন উবে গেচে । কলকাতায় কিছু হল না বলে ভেলোর, অ্যাপোলো, রামমনোহর লোহিয়া, হিন্দুজা, যশলোক, এ আই এম এস কত জায়গায় দেখালে, ব্রেন স্ক্যান হল, রাজনীতিক তো, হয়তো ব্রেনে চলে গিয়ে থাকবে দাঁত-জোড়া, এই ভেবে । দাঁত পাওয়া গেল না । শেষে বিদেশে নেতাদের একটা দল যাচ্ছিল মৌমাছির চাষ কী ভাবে করে দেখার জন্যে, তা একে-তাকে, মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকে ধরে প্রতিনিধি হয়ে ঢুকে গেল তাতে । উদ্দেশ্য হুসটনে গিয়ে রাষ্ট্রের খরচে ডাক্তার দেখাবে । দলটা আমেরিকায় পৌঁছোল । নানান পরীক্ষার পর যখুন ল্যাংটো উপুড় করে বডি চেক করছে, ডাক্তার অবাক । বললে, ইন্ডিয়ার রোপট্রিক শুনেছি বটে, কিন্তু এরকুম হাসিমুখ গুহ্যদ্বার এর আগে দেখিনি । ইন্ডিয়ার সব পলিটিশিয়ানদেরই কি এরকুম হাসি ? কয়েক মুহূর্ত ধেমে ছোটো জামাই বললে, হয়েছে কী, দুপাটি দাঁত ওইখানে গিয়ে আটকে গিয়েছিল ।

সমবেত হোঃ হোঃ হয় বটে তবে অভিপ্রেত অট্টহাস্য হয় না । অরিন্দম হাসতে পারে না । বড়ো বউদির ঢাউস বুকের মাঝে মাথা আটক । আসতে গেলে যদি আটক আলগা হয়ে যায় , তাই । সেজো বউদির মন্তব্য, নিজেকে ছাড়াচ্চিস না যে বড়ো ? অরিন্দম নিশ্চুপ, নিরাবেগ, নিরুত্তেজ ।

আঁচ্ছা, আমি একটা আসল অশ্লীল নোংরা অবসিন জোক বলছি । বড়ো জামায়ের প্রস্তাব সমর্থিত হবার মুহূর্তে অরিন্দম আঁৎকায়, জোকের জন্যে নয়, মহিলাদের সামনে অমন জোক শোনার অভিজ্ঞতা ওর নেই । না না না না, আমি তাহলে উঠে পড়ব, ধ্যাৎ ।

অরিন্দমের গলা আঁকড়ে রেখেই বড়ো বউদি,  কেনওওওরে ? এখনও বে-থা করিসনি বলে ? কবে আর করবি ? আমার কাচে অনেক ছাত্রী-পাত্রী আচে । ফিগার-চটকে ভালো চাস ? না পড়াশুনোয় ? বলিস তো দেকি ।

মেজো বউদি : তোর সেই মাইকাটা শুদদুর প্রেমিকাটার কী হল রে ? আমাদের এদিকেও সব খবরাখবর আসে । খুব ঝুলোঝুলি করেছিলি নাকি বে করার জন্যে । তা কেঁচে গেল কেন ?

বড়ো জামাই : অশ্লীল অঙ্গ দুটো নেই বলে ।

সমবেত মহিলা আর পুরুষের অট্টহাস্যের দমবন্ধ দমকা বোমাটা এবার ফাটে । হেসেই সামলে নেয় সবাই, ভাই বোন ভাজ ভাসুর ভাদ্দরবউ দেওর জামাই ননদ শালা ননদাই । চোখাচুখিতে ঝটিতি ইশারা বদল হয় । সবাই জানে, পাটনায় থাকতে অরিন্দম ওর চেয়ে বিশি বয়সের বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর কিছুটা-খোলা হৃদয়ের গবাক্ষের নরম মাংসে করাঘাতের সাঁঝবিহান সম্পর্ক গড়ে তুলতে-তুলতে পাগল হয়ে চিকিৎসাধীন ছিল । পাড়াতুতো দিদিটার বর টাকা জমাবার ধান্দায় নিত্যিদিন ট্যুরে ।

কলকাতায় এসে ক্যানসারে এক-স্তন তুলি জোয়ারদারকে বিয়ে করার প্রস্তাবে, অরিন্দমের মায়ের, কিন্তু-কিন্তু বলতে যা বোঝায়, সে দুশ্চিন্তা ছিল । ছেলেটার আবার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে আধখ্যাঁচড়া মেয়ের পাল্লায় । তবু, অন্য কাউকে না করলে ওকেই করুক, কাউকে করুক, স্হির হোক জীবন । তুলি এগিয়ে এসে পিছিয়ে গিয়েছে, কেননা মৃত্যুর আহ্বান বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, উচিত সময়ে লজ্জাবশত চিকিৎসা না করাবার দরুণ । ছোটো ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে বলে বড়ো ভায়ের মা এখুন যাহোক একটা বউ চায় । এজাত বেজাত কালো ধলা কানা খোঁড়া মুখু বিধবা বর-পালানো বাচ্চাসুদ্দু যাকেই চাস আমি বাড়ির বউ করে আনব, গত দশ বছরে মা ওকে একা পেলেই বলেছে । কয়েকজন ঘটককেও বলে রেখেছে মা, যোটক-ফোটক কিচ্ছু চাই না, এককাপড়ে হলেও চলবে । ঘটকরা প্রতিদিন একজন-দুজন বিবাহযোগ্যাকে এনে ছুতোনাতায় বসিয়ে দিয়েছে ওর চেয়ারের সামনে, অফিসে এনে । ওফ, কী কেলেংকারি । চলকে ওঠার মতন নয়কো তারা কেউ । মেয়েগুলোরও অমন ডেসপারেট অবস্হা ? অপমান সহ্য করেও একজন স্বামী চাই । মেজোবউদি এক্ষুনি প্রতিশোধ নিল এগারো বছর আগে ওনার ছোটো বোনকে প্রশ্রয় দেয়নি বলে ।

আবার মেজবউদির খচানে উক্তি : মেয়েটা কিন জাতের রে ? কুলিকামিন ? নাকি ?

বড়দা সর্বাধিক চুর । বুড়ো আঙুলে সুতো-ছেঁড়া পৈতে জড়িয়ে তরলীকরণের সরলীকরণ করে । এতঃ ন শুদ্রং ব্রাহ্মণাদি জাতি বিশেষং ভবতি সিদ্ধং, সর্বে লোকা একজাতি নিবদ্ধাশ্চ সহজ মেবিতি ভবঃ ।

মোনতোর-টোনতোর নিয়েচেন নাকি বড়দা ? আমাকে জানাতেন যদি তো আমিও নিতুম । বড্ডো অশান্ত থাকে মনটা । কার মোনতোর ? অনুকুল ঠাকুর না রামঠাকুর ? অ্যাঁ ? নাকি বাবা লোকনাথ ? বালক ব্রহ্মচারীর জপ শুনিচি বেশ কাজে দ্যায় । বড়ো জামায়ের কন্ঠে অকৃত্রিম আপশোশ ।

সেজো বউদি : আরে বামুনরা আবার মোনতোর নেয় নাকি ?  ওসব কায়েত সুদদুরদের ব্যাপার । বামুনদের তো গায়িৎরি মনতোর আচেই । তাই-ই জপ করুন না দুবেলা মন দিয়ে ।

বড়ো জামাই : অঅঅঅঅ । অরিন্দম ভাবছিল, জোয়ারদার কোনো জাত হয় ? কেটলিউলি কোন জাত ? জাতিপ্রথার জন্মের সময়ে তো চা খাবার ব্যাপার ছিল না । দেখতে কেমন ? নাম কী ? কোথায় থাকে ? একদিন গেলে হয় মহাকরণে । কিন্তু সেখানে তো অনেক কেটলিউলি আছে । চিনতে পারবে নিশ্চই ও । চলকে ওঠা থেকে ঠিক টের পেয়ে যাবে ।

প্রধানশিক্ষিকা নিজের পুরো সুরাসক্ত ওজন ঢেলে রেখেছিল অরিন্দমের ওপর । বড়দি, তোমার ব্লাউজের বোতাম খুলে অরির ঘাড়টা এবার সোজা হতে দাও । মেজোবউদির কথায় অরিন্দম ছাড়া পায় ।

আগে লোকে সমাজের চাপে বাড়ির বাইরে মদ খেত । এখুন সমাজের ভয়ে বাড়ির মধ্যে বাড়িসুদ্দু সবাই খায় । তার কারণ আগে সমাজ বলতে যা বোঝাত তা আর নেই । সবাই সবাইকে ভয় পায় আজকাল । অন্যে কী করছে-করবে সবাই আঁচ করে টের পায় । কেউ বিশ্বাস করে না অথচ গালভরা কথা বলে । আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল । বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি । কোনো বিশেষ তীর্থ নেই । কত গোঁড়া ছিল এই বাড়িটা, পিসিমা-পিসেমশায় বেঁচে থাকতে । মুরগির মাংস তো নিষিদ্ধ ছিলই, মুরগির ডিমেরও বাড়িতে প্রবেশাধিকার ছিল না । খেতে বসে গণ্ডুষ না করা অপরাধ ছিল ।

পিসেমশায়ের বাস্তুভিটে ছিল হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের ফুলতলা গ্রামে । সেসব ছেড়েছুড়ে বেচেবুচে এখন শ্যাওড়াফুলিতে । এই বাড়িটায় অরিন্দম যখুন শেষ এসেছিল, টালির চালের দুটো মাত্র ঘর ছিল, সামনে-পেছনে ফুলের উচ্ছৃঙ্খল জঙ্গল । বলাগড়ের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিল, মনে আছে । পিসেমশায় টাকমাথা, মোটা কাঁচের ভারিক্কি চশমা ।

ফুলতলার বসতবাড়ি, ভাগচাষ দেওয়া জমিজিরেত, সব ভেঙে-ভেঙে বিস্কুটের টুকরোর মতন তারিয়ে খেয়ে ফেলেছে গঙ্গা । কলকারখানার ফেনানো পাঁক আর পূণ্যার্থীর গু-মুত, গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে, বাঁকবদল ঘটেছিল নদীর । মাঝরাতে, চাঁদনি আলোর অগোচরে, কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে, ডাঙাজমিন, ভরাখেত, কুরেকুরে শেষ করেছে নদীটা । অরিন্দম গিয়েছিল স্কুলে পড়ার সময় । গঙ্গা বয়ে গেছে জিরাট, শ্রীপুর-বলাগড়, চরকৃষ্ণবাটি, গুপ্তিপাড়া, সোমড়া, খামারগাছি আর ডুমুরদহ-নিত্যানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর দিয়ে ।

সুলতাপুর, গুপ্তিপাড়া, রিফিউজিবাজার, ভরপাড়া, বেনালি, চররামপুর, গোঁসাইডাঙা, রসুলপুর, সুন্দরপুর, চাঁদরা, ভবানীপুর, চরখয়রামারি, রুবেশপুর, রামনগর গ্রামগুলোর অনেক ঘরদালান, রাস্তাঘাট, দেউড়িদেউল, দোকানবাজার, ইশকুল, শিবের থান, মেটে মসজিদ, ফকিরের কবর, রঙেশ্বরীর একচুড়ো গর্ভগৃহ, তিনফসলি জমি, সব সঅঅঅঅব, গিলেছে গঙ্গা । ইঁট আর শালবল্লা পুঁতে থামানো যায়নি নদীটার বেয়াড়াপনা । সেসব ইঁট-কাঠ নিজেদের বসতকে অহেতুক ঠেকনো দিতে যে যার তুলে নিয়ে গেছে । কারুর চেষ্টাই টেকেনি বেশিদিন । বাঁধাগাছি আর পালপাড়ার বামুনরা শ্যাওড়াফুলিতে চলে যাচ্ছে খবর পেয়ে পিসেমশায়ও কিনেছিল চারকাঠা জমি । ছেলেরা নিজেদের অবস্হামতন খুপরি তুলেছে ।

এই ঘরটা সর্বজনীন ।

ফুলতলায় থাকতে আলতাপাতার ব্যবসা ছিল পিসেমশায়ের । ওনার বাবার আরম্ভ করা ব্যবসা । অনেক ঘর রংবেনে মণিবণিক ছিল তল্লাটে । লাক্ষা গালা আলতার কাজ করত । রাসায়নিক আলতা বেরোবার পর দুবেলা দুমুঠোর ওপর চোট সামলাতে রংবণিকরা স্যাকরার কাজ ধরে একে-একে চলে গেল সুরাট, মুম্বাই, বাঙ্গালোর, কিংবা ঘড়িকোম্পানির জহুরি হয়ে গেল । পিসেমশায় রংবেনেদের কুলদেবতা রঙেশ্বরীদেবীর পার্টটাইম সেবাইত হয়ে চালিয়েছিল কিছুদিন । আজকে দেয়ালের খুঁতখুঁতে টিউবলাইটের তলায় ফ্যাকাসে রঙেশ্বরীদেবীর উদাসীন দৃষ্টিবলয়ে বসে নোংরা-নোংরা মোদো চুটকি চলছে ।

তোমরা কেউ আলতা পরো না ? বলে ফেলেছিল অরিন্দম ।

অ্যাই ছুটকি, তোর কাছে আলতা আছে তো ? নিয়ায় । ফ্লোর লিডার মেজবউদির গম্ভীর অনুচ্চস্বর আদেশে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় ছোটো বউ, এক রাশ চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে । অত চুল দেখে হঠাৎ ভয় করে ওঠে অরিন্দমের । অবাক হয় নিজেই । আজগে অরি আমাদের সবাইকে আলতা পরাবে । মেজবউদির দ্বিতীয় আদেশে ধাতস্হ হয় ।

ছুটকি দেয়াল, দরোজার কপাট, জানলার গ্রিল, বাকসোর থাক ধরে-ধরে নিজেকে সামলে ঘর থেকে বেরোয় আর ফিরে আসে বাঁ হাতে আলতার শিশি, তুলোকাঠি আর ছোট্ট কাঁসার বাটি নিয়ে । যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই মাতাল দেহবল্লরীকে সামাল দিয়ে । অরিন্দমের পাশে বসে । শাড়ি সামান্য তুলে পা বাড়িয়ে নিভৃত আবদার, আগে আমাকে পরাও । আলতাটা আমার বিয়ের ক’বছর যাবত পড়ে আছে । সময়ই হয় না । প্রফেসারির ঝকমারি, একটা তো মোটে রোব্বার, শাড়ি কেচে ইসতিরি করতেই সময় চলে যায় ।

ছুটকির বাঁ পা কোলের ওপর তুলে নিয়েছে অরিন্দম । প্রায় নিঃশব্দে বউটি বলে, তাড়াহুড়ো কোরো না, রয়ে-সয়ে সময় নিয়ে ভালো করে পরাও । অরিন্দম গলা নাবিয়ে বলল, তাহলে নেলকাটার আনো, নখ অনেক বেড়ে গেছে । নখ পালিশ লাগাও না বুঝি ? ছুটকি ঝটিতি উঠে দাঁড়াতে, মদ টলমল করে ওঠে ওর দেহ জুড়ে, বাতাসের ওপর দিয়ে হেঁটে নেলকাটার আর নখপালিশ আনে । কোলের ওপর পা তুলে নিয়ে অরিন্দম টের পায়, পা ধুয়ে মুছে এসেছে, আগের চে ঠাণ্ডা ।

মেয়েদের পা অপরিমেয় শ্রদ্ধার । তোমার পায়ে ছন্দ লেগে আছে । নখকাটার কুটকাট শব্দের চে আস্তে বলল অরিন্দম ।

ছন্দ ? কী ছন্দ ?

অরিন্দম বিপাকে পড়ে । উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ভাষাটা মন দিয়ে পড়েনি । দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে বলল, মুক্তক ।

যাঃ । ও তো বাংলা ।

হলেই বা । এই তো গোড়ালিতে তিল হয়ে লেগে রয়েছে অনুষ্টুপ ।

আবার সেই । না না । আমার পায়ে আছে আয়ামবাস, এই দ্যাখো, ট্রোকি ।

ওওওওও । ইংরেজি । ইংরেজি পড়াও ।

হ্যাঁ । ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলুম । ব্লেকের ম্যারেজ অব হেভেন অ্যান্ড হেল মুখস্ত । বুঝেছি । অমন বিয়েই করেছ । এখুন তো আর কিছু করার নেই ।

কে বললে ? সাহস থাকলে ভাসুরের কোলে পা তুলে সবায়ের সামনে বসা যায় । সাহস থাকলে, মরনিং আফটার ওষুধের জোরে, অনেক কিছু করা যায় । কটা বউ পারে ?

এখন তুমি মাতাল । মাতাল গৃহবধু । কী বলছ, না বলছ, তার হুঁশ নেই ।

মাতাল ? ঠিকাছে, আমি না হয় মাতাল । তোমার তো হুঁশ আছে । মুক্তক আর অনুষ্টুপ ছন্দে ঠোঁট রাখতে পারো? ছন্দ তো শুধু চরণেই থাকে না । থাকে সবখানে । ভালো করে চোখ মেলে দ্যাখো ।

বড়োবউদি শয়ে পড়েছিল । ওদের দিকে পাশ ফিরে । তোদের গুজগুজ ফিসফিস সঅঅঅব শুনতে পাচ্ছি আমি । অরিকে চেনো না । চুপচাপ জাল বিছিয়ে দেবে , টেরটি পাবে না । ভয়ংকর চিজ । অ্যাগবারে কাপালিক । ছু-মন্তর এড়াতে পারবি না । মাতন লেগে যাবে ।

ছুটকি বড়োবউদিকে, তুমি তো ওর জালে ছিলে এতক্ষুণ । এবার আমি না হয় থাকি । কাল থেকে তো আবার জাঁতা পেষা । তারপর অরিন্দমকে, কই দেখালে না কী রকম তোমার হুঁশ । আমি একজন স্বঘোষিত আদেখলে ।

শব্দবধির হওয়া সত্ত্বেও, সাপ যেভাবে তার চোয়ালের মাধ্যমে জমির সূক্ষ্ম স্পন্দন অনুভব করতে পারে, অনুভব করে শিকারের উষ্ণতার সংবাদ পায়, সেই গোপন অনুভুতি নিয়ে, বেশ যত্নে, নখপালিশ লাগায় আর আলতা পরায় অরিন্দম । এত কাছ থেকে, এভাবে কোনো যুবতীর কেবল পাটুকু এর আগে খুঁটিয়ে দেখেনি অরিন্দম । মুখ নিচু, ঠোঁটে ধূর্ত হাসি,  ছুটকির চোরাস্রোত-চাউনি অরিন্দমের উদ্দেশে । ফিসফিস কন্ঠে অরিন্দম বলল, বেশ কয়েক বছর মদ খাচ্ছ তাহলে, অধ্যাপিকা ? মাথা নাড়ে ছুটকি, হ্যাঁ, এট্টুখানি, নমাসে-ছমাসে, ভাললাগে, এটারচে কোকাকোলার সঙ্গে রাম ভাল্লাগে, কিন্তু বড়ো আর সেজোর যে শুগার । স্নায়ুসুখে আপ্যায়িত দেহকে পাশ ফিরিয়ে, বাঁ পা নাবিয়ে, ডান পা অরিন্দমের কোলে তুলে দিলে ছুটকি ।

তোমার জামায় মদ, প্যান্টে আলতা, বাড়ি যাবে কী করে ?

এমনি করেই । আমার তো পায়ে কবকব নেই, ছন্দ নেই, লোকলজ্জার ভয় নেই ।

শুদুই বকবক। পথিক তুমি পথ হারাইতে ভুলিয়া গেছ । যাও, গিয়া দেয়ালে পোস্টার সাঁটো, ইনক্লাব-জিন্দাবাদ করো, কিন্তু প্রেমাপ্রেমি কোরো না ।

হুঁ।

রেখেছ বাঙালি করে, পুরুষ করোনি ।

হুঁ।

আচমকা ওপরতলা থেকে বিলিতি বাজনার তারস্বর আসে । ওপরেও ঘর আছে বুঝি ? জানতে চায় অরিন্দম, স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে । আগেরবার যখুন এসেছিল তখুন ছিল না ওপরতলায় কোনো ঘর । ফাঁকা ছাদ ছিল । আলসেতে গোলাপফুলের টব ।

এইটে যেমন আমাদের কমনরুম, ওপরেরটা বাচ্চাদের । ছাতের ওপর ওই একটাই ঘর । একটু থেমে, ছুটকি বলে, অরিভাসুর, প্রেম না থাকলে প্রাণটা বড্ডো খাঁ-খাঁ করে, না গো ? তোমার প্রেমের গল্প অনেক শুনেছি । প্রেম ছাড়া তুমি অসুস্হ হয়ে পড়ো, শুনেছি । তোমাকে আমার হিংসে হয় । জানাই হল না প্রেমে পাগল হওয়া কাকে বলে ।

ছুটকির পর গরমমশলার গন্ধের মতন স্বাস্হ্যবতী, ভূমিসংস্কার দপ্তরের করণিক সেজো বউদি এগিয়ে আসে পাছা ঘষে । হাঁটুর ওপর ওব্দি সাড়ি উঠিয়ে মেদনরম পা জোড়া তুলে দিলে অরিন্দমের কোলে । নে, সেবাযত্ন কর । শাড়ির পাড়ে আঁকা ফুলের গোছা ধরে পা ওব্দি নাবিয়ে এনে অরিন্দম বলল, অমন কোরো না, এখুনও অটুট আছ তুমি ; উলটে মাঝখান থেকে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে । শুনে, আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কেঁপে-কেঁপে হাসে সেজো বউদি । বলল, আমার পায়ের ওপর রাজহাঁস এঁকে দে, ছোটোবেলায় ঠাকমা একবার এঁকে দিসলো, আমি তখুন পানিশ্যাওলার ইসকুলে পড়তুম । তারপর তো বাবা বদ্যিবাটিতে চলে এলো ।

প্রতিদিন সবাই মিলে কলকাতা ঠ্যাঙাও, ওদিকেই ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনে নাও না কেন ?

কীইইই যে বলিস । এখেনে একসঙ্গে আছি সবাই, বিপদে-আপদে দেখি । এরম তো বসা হবে না আজগের মতন । কলকাতায় সবাইকে আলাদা-আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে, পুকুর-বাগান থাকবে না, দম বন্ধ হয়ে যাবে ।

অ্যাই, অরিকে আমাদের বাংড়ির জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা দিয়ে দিস । থালে ফি-মাসে আসতে পারবে । ছুটকির ঠেঙে নিয়ে নিস অরি । মনে পড়ে গেল, অরি, কালকে আমার আয়কর রিটার্নটা ভরে দিস । মদঘুমের জগতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে বড়োবউদির আদেশ । শতরঞ্চিতে মেদবহুল গতর এলিয়ে কৃতবিদ্য প্রধানশিক্ষিকা । অজস্র ছাত্রীর প্রণাম সংগ্রহকারী পদযুগল । শোয়া অবস্হাতেই মাতাল চরণে আলতা পরায় অরিন্দম । গোড়ালি ফাটা । নখ বড়ো হয়ে গেছে । বাড়িটার জীবননাট্যে বোধয় পারস্পরিক যত্নের সময় নেই । সবাই মগ্ন জীবিকায় । আর ফাঁক পেলেই এক চিলতে যৌথ সীমালঙ্ঘনের মৌতাত ।

তর্জনীতে গণ্ডারের শিঙের আংটি, ছোটো জামাই বলল, যেন মদের বুদবুদ ফেটে স্মৃতি ফিরে পেয়েছে, বলল, সেনসেক্স চারশো পয়েন্ট উঠেছে, বড়দা, তেমন-তেমন স্ক্রিপস থাকলে এই বেলা ঝেড়ে দাও ।

একে-একে বউদের, তারপর দুই ধুমড়ি বোনের নখ কাটে অরিন্দম, নখপালিশ লাগায়, আর আলতা পরিয়ে দেয় । ওদের পরানো শেষ হতে বড়দা আচমকা এগিয়ে দিয়েছে নিত্যযাত্রীর ট্রেনে ওঠায় রপ্ত হাড়প্যাংলা ঠ্যাং, শিরাপাকানো, যেভাবে পুরোনো শ্যাওলাধরা মন্দিরকে দুমড়ে জড়িয়ে থাকে অশ্বথ্থ গাছের শেকড় । অরি, আমাকেও লাগিয়ে দে দিকিনি, ভাবিসনে যে মাতাল হয়ে গেচি, আপিসে তো বুট জুতো পরে যাই । অরিন্দম তাকায় বাদামি কুয়াশামোড়া নতোদর প্রৌঢ়ের মুখের পানে । পুরসভার স্বাধিকারপ্রমত্ত অ্যাসেসমেন্ট ইন্সপেক্টর । বাঙালির, পশ্চিমবাংলার বাঙালির, স্বাধীনতা-উত্তর খাঁটি প্রতিনিধি । ছেলে মণিপুরে মোইরাঙে পোস্টেড । মোটা টাকা দিয়ে মণিপুর রেভলিউশানারি পিপলস ফ্রন্টের কাছ থেকে ইমিগ্র্যান্ট পারমিট নিতে হয়েছিল থাকার জন্যে । কালকে বিপ্লবীরা ওকে বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিয়েছে মোইরাঙ ছাড়ার জন্যে, উদ্বিগ্ন মুখে বললেন বড়দা । অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভের ভালো সরকারি চাকরি ছেড়ে ফিরে চলে আসছে । শত্রুতা না বাড়ালে বিপ্লব সফল হয় না । বিপ্লব ছাড়া বিদেশি অস্ত্র কারখানা লাভে চলবে না ।

বড়দার একপায়ে কাস্তে-হাতুড়ি, আরেক পায়ে পদ্মফুল আঁকে অরিন্দম ।

ছাদের ঘর থেকে আরেকবার ষাঁড়াষাঁড়ি ডেসিবল আচমকা এঘরের মদ সিগারেট মাংস মাছ চানাচুর ডিমসেদ্ধর মাথাভার বাতাসে কুচি-কুচি আছড়ে পড়তে, ছাদে যাবার সিঁড়িতে ওঠে অরিন্দম । এঘরে আর কেউ কথা কইবার অবস্হায় নেই । প্রশস্ত ছাদ । টবের গাছে ছোটো-ছোটো ফুলকপি ক্যাপসিকাম লংকা । আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে । অরিন্দমের মনে হল, অজানা কোনও কিছুর জন্যে ওর মর্মমূল ধ্বনিত হচ্ছে । ছন্দের বোধয় নিজস্ব ধর্ম হয় । চৈতন্যের পায়ে ছিল একরকুম, রামকৃষ্ণের আরেকরকুম । বুদ্ধের ছিল । যিশুখ্রিস্টের ছিল । কেটলিউলির আছে কি ?

১২

ছাদের ঘরের দিকে ছাইরঙের দরোজা ঠেলে অরিন্দম দেখল, কুচোকাঁচা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাশেষ ছেলেমেয়ের দল, যে যার মতন নেচে যাচ্ছে, হাত তুলে কোমর বেঁকিয়ে । একজন ফ্রক উড়িয়ে শাস্ত্রীয় নাচের অঙ্গভঙ্গী করছে ইউরোপীয় বাজনার তালেতালে, বোধয় শাস্ত্রীয় ভারতীয় নাচ শেখে, কুচিপুড়ি ভারতনাট্যম কোনো-একটা হবে । ঘরে ঢুকতেই অরিন্দমকে ঘিরে ধরে সবাই । বড়দা-মেজদার মেয়ে দুটো অরিন্দমের হাত ধরে অরিকাকু অরিকাকু বলে হাঁক পাড়ে । এদের দুজনকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না অরিন্দম । কেউ গিয়ে বাজনা বন্ধ করে । জামায় তীব্র হুইস্কির গন্ধ আর প্যান্টময় খাপচা লাল রং যে এরা কেউই অনুমোদন করছে না, ভুরু কোঁচকানো অনুসন্ধিৎসা দেখে আঁচ করে অরিন্দম । বলল, খাইনি আমি, বমি পায়, ওদের গেলাস থেকে চলকে পড়েছে । এই কচিকাঁচাদের কাছে নিজের দুর্বলতা মেলে ধরে কিছুটা ভারমুক্ত বোধ করল অরিন্দম । বয়সের সাহায্যে নিচের তলায় আর ওপর তলায় আনন্দের মুহূর্ত গড়ে নিয়েছে এই বাড়ির সদস্যেরা । ওই বা কেন যে বঞ্চিত হয় আনন্দের পরিসর থেকে !  কেন যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা !

বালক-বালিকাদের মাঝে ভালো লাগে ওর, অরিন্দমের । আশ্বস্ত বোধ করে । পাটনায়, অফিসের লাঞ্চটাইমে পাশের নার্সারি স্কুলের ছুটি হত । ছোটো-ছোটো খোকা-খুকুর ছুটির হইচইয়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত অরিন্দম, দাঁড়িয়ে থাকত বেশ কিছুক্ষণ । চারিদিকে অজস্র কচি ছেলেমেয়ের ছোটাছুটি আর কোলাহলের মাঝখানে চুলচাপ দাঁড়িয়ে থাকত ও । পুজো আর গ্রষ্মে যখুন ইশকুলটা বন্ধ থাকত তখুন মন খারাপ লাগত অরিন্দমের । এখানে, কলকাতায় বি-বা-দী বাগে ওর অফিসের কাছে ইশকুল নেই । এই অফিস পাড়াটায় বালক-বালিকাদের প্রবেশাধিকার নেই । আজ পর্যন্ত কোনও ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের এই এলাকায় দেখতে পায়নি  ও, অরিন্দম ।

ওর সামনে হিচইরত ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে বুঝতে পারছিল অরিন্দম, ওকে বিশ্বাস করছে না এরা । শিশু কিশোর তরুণদের চেখে এখুন আগের প্রজন্ম সন্দেহজনক । জনকেরা সন্দেহজনক । মেজদার বড়ো মেয়ে এই ফাঁকে বাবার জামা-প্যান্ট এনে দিয়েছে । যাও, নিচে বাথরুমে চান করে পাউডার মেখে পালটে এসো, গিজার আছে ।

চান করে, জামা-প্যান্ট পালটে এসে বসলে, কাছে এসে মুখ থেকে গন্ধ শুঁকে আশ্বস্ত করে নিজেদের , শাড়ি-পরা উচ্চ-মাধ্যমিক, চুড়িদার মাধ্যমিক । এদের মধ্যে সবচে ছোটোটা, তুলতুলে বছর তিনেকের, পায়ে রুপোর মল, বিস্ফারিত তাকায় । কোলে চাপতে চাইছে । তুলে নিলে, কাঁধে মাথা রাখে । ঘুমের গন্ধ আসছে শিশুটির মুখ থেকে । কত ভালো লাগে এই গন্ধ ।

তোদের খাওয়া হয়েছে তো ?

সমস্বরে, হ্যা আ্য আ্য আ্য আ্য আ্য, সন্ধেতেই । আজ তো ভুরিভোজ ছিল ।

জানলা দিয়ে দেখা যায়, বাতিস্তম্ভের আলোয় , বাড়ির পেছনের থমথমে পানাপুকুর । একগাল হাসিমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে ঝাঁকড়া স্হলপদ্ম । পুকুরের দক্ষিণে বৈদগ্ধ্যে ভারাক্রান্ত আমগাছ , স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে থাকবে, ফলহীন । পুকুরের এদিকে জানলার তলায়, গোলাপ ঝাড় দুহাত তুলে খরচ করছে মোলায়েম সুগন্ধ । গাছগুনোর পাতাকে ফুঁ দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে অন্ধকার । লাস্যময়ী বাদলাপোকারা ঘরে ঢুকেই, ডানার ওড়না ফেলে দিচ্ছে পার্ক হোটেলের ক্যাটওয়াকে মডেলখুকিদের ঢঙে । অন্ধকারে তিরতির কাঁপা কৃষ্ণপক্ষের কনকনে আকাশে ভিজেভিজে বিদ্যুতের শব্দহীন আলো । কোনও প্রতিবেশির বাড়িতে উদাত্তকন্ঠ অ্যালসেশিয়ানের রোমশ ডাকের তরঙ্গ ।

পাঁচ-সাত বছরের গালে-টোল ফরসা দুঝুঁটি এগিয়ে আসে । তুমি কে গো ও ও ও ?

আমি ? আমি হ্যামেলিনের কেটলিওলা । অরিন্দম কথাটা বলেই থ । এখনও তো কেটলিউলি অদেখা । তবে ?

তুমি বাঁশি বাজাতে জানো ?

বাঁশি ? উঁহু, জানি না ।

তবে কেটলড্রাম বাজাও ?

না, তাও জানি না ।

লিটলুটা ঘুমিয়ে পড়েছে কেটলিকাকুর কোলে ; টুম্পা ওকে শুইয়ে দিয়ায় । আলো জ্বেলে মশারি টাঙিয়ে দিস । পিগটেল ফ্রকপরার হুকুম মান্য করে ববছাঁট ফ্রকপরা ।

কেটলিকাকু, তুমি গান জানো ? জানতে চায় ক্লস নাইনের পরীক্ষামুক্ত কিশোর ।

গান । মমমমমমম, ভেবে দেখি । গানের কিছুই জানে না অরিন্দম । কী করে লোকে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্র নজরুলের গানের সুরের তফাত বোঝে, ঠাহর করতে পারে না ও, পারেনি। গানের আলোচনায় কুন্ঠিত বোধ করে । ওর সামনের ফ্ল্যাটে লরেটোতে পাঠরতা কিশোরী তিনচারটে গান কতকাল যাবৎ সেধে যাচ্ছে, সকালের আলো ফুটলেই, অবিরাম । শুনে-শুনে সুর আবছা মুখস্হ হয়ে গেছে অরিন্দমের । খোকাখুকু শ্রোতার মাঝে চেষ্টা করা যেতে পারে । শ্রোতাদের সামনে নিজেকে গান শোনানোর ভালই সুযোগ । শ্রোতারা যখুন অত্যুৎসাহী ।

কই গাও । গাইছি ।

মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কল্লে না যে । ঠাকুর পাপ দেবে । গাইবার আগে, নাচবার আগে, পড়তে বসে, মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কত্তে হয় । বিদেশী বাজনার তালে স্বদেশী নাচছিল যে কিশোরী, তার উপদেশ ।

অরিন্দম চোখ বুজে হাতজোড় করেছে । মগজের মধ্যে একাগ্র ভগবদভক্তি কী করে জোটায় কেউ-কেউ ? ব্যাপারটা ঠিক কী ? কোন উপায়ে অমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘটে ! আমি কেন ওই বোধ থেকে বঞ্চিত ?

জীবনে প্রথমবার ও, অরিন্দম, সিরিয়াসলি গান ধরে :

II { স..সপা…T পা…পধা…ধপহ্ম-T হ্ম…হ্মা…গসাঃ… I সগঃ…সপা…TI

সাঁ….ঝে০….রপা….খি….রা০০…০…ফি…রি…ল০….০কু…লা০…য়

I গহ্ম…ক্ষণা…নর্সা…ধনা…পাঃ I পহ্মগঃ…হ্মপা-T – T গমাগমা…গরসা }I

তু০…মি০…ফি০…রি০…লে০…না ০০০ ঘরে ০  ০ ০০০০  ০০০

I প…পনা—TI  না….সর্ণা….র্সর্সনধা I ধনা…পধর্নারা…র্সনধা I ধনা…ধপা–TI

আঁ….ধা০….র…ভ…ব০….০০০ন…জ্ব০…লে০০০…নি০০…প্র০…দী০…প

I  সা….রা….রা….I  রা…গহ্মপধা….গহ্ম I  – T হ্মপা- TI  গমা…গগা…রসা I

ম…ন…যে…কে…ম০০০…০ন….০করে…০….০০…০০…০০

ভুল ভুল ভুল ভুল, জানোওওওওনা, হলোওওওনা । হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শাড়িপরা উচ্চমাধ্যমিক ।

অরিন্দম স্তম্ভিত । ঠাহর করতে পারে না গানের হওয়া না হওয়া । অথচ গাইতে-গাইতে বিভোর আত্ম্রীতিতে আক্রান্ত হয়েছিল । কোকিল যেভাবে কাককে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, ও-ও নিজেকে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল অচেনা আনন্দের পরিসরে ।

হ্যাঁ, তুই বড়ো কুমার শানুর মা এসচিস । মাধ্যমিক অরিন্দমের পক্ষে ।

তুমি তো মিশ্র ইমনে গাইছিলে । গানটা তো নজরুলের, মিশ্র মল্লারে হবে । তুই গেয়ে শোনা দেখি । মাধ্যমিক চ্যালেঞ্জ জানায় ।

উচ্চমাধ্যমিক বসে পড়ে মেঝেতে । চোখ বোজে । কোলে হাত । প্রথমে গুনগুন । তারপর গান ধরে ।

II { সা   মরা   মা I পা  ধা ণা I ণা  ধপা  মপধাঃ I পঃ মজ্ঞা    রসা I

সাঁ    ঝে০    রা   পা  খি   রা    ফি রি০ ল০০০ কু  লা০       ০য়

I স   সরজ্ঞা   রা  I সা    ণা ধ পা I  পনা    না   সা  I   সা   সা   র্সা }

তু    মি০০   ফি   রি   লে   না      ঘ   ০   ০              রে   ০   ০

I মা    মরা     মা  I   মপা   পাধ    মপাঃ I    মঃ    পা সর্ণা  I  ধা   পা  পা I

আঁ     ধা০    র      ভ    ব    ন                জ্ব   লে  নি          প্র   দী   প

I পধা    পধা   পমা I   গা   মগা    রসাণ  I  না   সা   গা I   রগা   মা  মা I

মা০     ০ন    যে      কে   ম০     ০ন        ক     রে০        ০০   ০    ০

কেটলিকাকু, আমিও গান জানি । নাদুস কিশোরের প্রস্তাব ।

গাও তাহলে, শুনি ।

আমমি চিন্নিগো চিন্নি তোমাআআড়ে ওগ্গো বিদেশিন্নি, তুমি থাআআআকো শিনধু পাআআআড়ে….

অরিন্দমের হাসি পেয়ে যেয় । দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকাদের কী সর্বব্যাপী প্রভাব । অত্যন্ত জোরে হেসে ফ্যালে ও কিশোরটিকে জড়িয়ে ধরে । অট্টহাস্য । দিলখোলা হাসি । হাসতেই থাকে । এভাবে খোলামেলা হাসেনি বহুকাল । হাসতে-হাসতে ভালো লাগে ওর । ওর দেখাদেখি সবাই হাসতে থাকে । সব্বাই ।

অতর্কিতে, বাইরে থেকে, বাঁদিকের বন্ধ জানলার ফুলকারি ঘষাকাচের শার্শির ওপর ভারি একটা ঢিল পড়তে, থমকে থেমে যায় হাসি । সবায়ের মুখমণ্ডলে আতঙ্কিত অনুসন্ধিৎসা । শার্শির ঠিক মাঝখানে, যেখানে ইঁটটা পড়ল, সেখানে ঘাপটি-মারা ছোট্টো মাকড়সাটা সেই মুহূর্তে, তক্ষুনি, কাচের বুক জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের আলোকিত তন্তুজাল, শার্শির ফ্রেমের কোণে-কোণে ।

কেভ রে হারামজাদার বাচ্চা । গালাগালটা অরিন্দমের নিজেরই ভয় কাটাবার উপায় হিসাবে আরেকটু হলেই , এতগুলো কচিকাঁচা কিশোর-কিশোরীর সামনে বেরিয়ে যেত । ঠিক তখুনই, খোলা জানলাটা দিয়ে, ওরা দেখতে পেল, হ্যালোজেনের আলোয়, মাছরাঙার ঢঙে ছোঁ মেরে, ছোটো-ছোটো অগুনতি সাদা বরফের ছররা, ঝেঁপে নাবছে পানা-পুকুরের দাম সরিয়ে , মটকা-মেরে ঘুমোবার ভানরত কালবোস-কাতলার ওপর । জলতলের ওপরে লাফিয়ে উঠল কয়েকটা সোমথ্থ রুই ।

সাদা বরফ টুকরোর টিমটিমে প্রভায় উদ্ভাসিত হয় খোকাখুকুদের কচি-তুলতুলে মুখগুলো । পৃথিবীর মাটিতে নাবার আহ্লাদ-মাখানো শিলাবৃষ্টির খই খাবার নেমন্তন্নে, ছাদের দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে আগত টুকরো মুখে পোরে মিনি টিঙ্কু টুম্পা তাতাই বুবুন খোকন বাবাই টুঙ্কা হাবলু গাবলু ।

অরিন্দম জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । ফুঁ-এর মতন মুখময় বিচরণকারী আরামপ্রদ হাওয়ার আদর ।  গাছের পাতাদের গা শিরশির করছে ঠাণ্ডায় । বরফ-পাথরের টুকরো মেরে-মেরে ভ্যাপসা গরমকে তাড়িয়েছে বৃষ্টি । শিলাদের নাচের তাল ক্রমশ বিলম্বিত হয়ে থেমে যায় । বিদ্যুচ্চমকে, পুকুরের জলকে সর্পিল করল হেলে সাপ ।

দুকানে দুহাত চাপা দিয়ে তাতাই বলে ওঠে, যাআআআআআ ।

কেন ? কী হল ?

এবার আর হিমসাগর খাওয়া হবে না । সঅঅঅঅঅব ঝরে গেল ।

১৩

পেঁকো জলজমা তপসিয়া সেকেন্ড লেন, নানান মাপের আধোডোবা ইঁটের ওপর দিয়ে যিশুর পেছন-পেছন বস্তির একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল অপ্রস্তুত অরিন্দম, এ জায়গায় অন্য জুতো পরে আসা উচিত ছিল । ফুলপ্যান্টের গোড়া ভিজেছে নর্দমা-ওপচানো এঁদো গলির বিষাক্ত জলে । ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে খালি-গা লেংটি-লুঙ্গি পরা কয়েকজন প্যাংলা মানুষ জমা জল খোঁচালেও, ঘূর্ণি খেয়ে নালির গু-গোলা জল উগরে উঠে গলির ভেতর সেঁদোচ্ছে ।

সামলে-সামলে যেতে হবে, গোলাম জিলানি রোডে মসজিদে জল ঢোকা নিয়ে হ্যাঙ্গাম হয়েছে । আসার সময়ে হুঁশিয়ার করেছিল যিশু । খেয়াল করেনি তখুন । হতদরিদ্র মুসুলমান পাড়া । গলির বেহালে, অপুষ্টিতে লালিত লোকগুনোকে, মহরমের পতাকা দেখে, ভয় করছিল অরিন্দমের । নাকে রুমাল চাপা দিলে হাসবে এরা । টিটকিরি মারবে । পেটের ভেতর ওব্দি ঢুকে পড়ছে দুর্গন্ধ । এমনকী রি-রি করছে, নোংরা জলের ওপর চলকে-পড়া রোদের গা । নর্দমাটা ডাকাবুকো ।

বাসার সামনে টাঙানো বাঁশে ছাপা-শাড়ি, কালো শায়া, লাল ব্লাউজ, হাতা অলা গেঞ্জি, সিড়িঙে ফুলপ্যান্ট শুকোচ্ছে । ডিজেল ড্রামের ঢাকনার ওপর রবারের পাকানো ক্লান্ত পাইপ । আলকাতরা-রাঙানো করুগেটেড টিনের দরোজার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে ঝুলমাখা টিউবলাইট । শালের কালো খুঁটিতে পেরেকে ঝোলানো আংটায় গাঁথা কাগজপত্র ; শিকেতে চালকুমড়ো । দেয়াল দেখা যাচ্ছে যেটুকু, কালচে কাঠের তাকে শিশি-বোতল-কৌটো-ডিবে । মেঝের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের বিশাল গামলা আর কয়েকটা তেল-চটচটে কালচে ট্রে ।

খাইয়াঁ-খাইয়াঁ পেট ভরাবার মতলব রহেছেঁ, আঁ । গলা জড়াই ধরি মুহে চুম খালেক । তাঁয় উড়াই ফেল্লেক তামাম । মজাদারি পাহিছেঁক । আঁচতা ধাকালি দিবঁ একটা । মেয়েলি কন্ঠে বকুনি ঘরের মধ্যে । সাদা কেঁদো বেড়াল বেরিয়ে, আধডোবা ইঁটের ওপর লাফিয়ে-লাফিয়ে ওদের পায়ের কাছ দিয়ে দৌড়োতে, অরিন্দমের ডান পা জলের মধ্যে পড়ে, নোংরা জল ঢুকে যায় জুতোয় ।

এই কেটলি । হাঁক পাড়ার পর, অরিন্দমের দিকে ফিরে যিশুর আবেগহীন কন্ঠ, গতবছর জলের মধ্যে খোলা ম্যানহোলে একটা আড়াই বছরের মেয়ে পড়ে গিসলো । দমকলের লোক এসে, শেষকালে হুক নাবিয়ে, বডি তুললে। ময়না তদন্ত হয়েছিল । তা এরা গরিব লোক, বুঝতেই পারছ, রিপোর্ট-ফিপোর্ট নিয়ে কীই বা করবে । হুক দিয়ে না তুলে কেউ নিচে নেবে চেষ্টা করলে বেঁচে যেত বোধয় । কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে এতো বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে মানুষ যে সুযোগ পেলেই খপ করে ধরে নেবে পৃথিবী । অরিন্দম ভয় পাচ্ছে দেখে যিশু কথাগুলো বলে গেল চিউইংগাম খাবার ঢঙে । তারপর কাঁধ নাচিয়ে হাসে ।

আড়হল্যা লাগ্যে নেঁও ; জলটো অধন হল্যে মেরায়েঁ দে । কথ্যভাষার মধ্যেকার জলতরঙ্গে অরিন্দম মুগ্ধ । বাঙালির জিভ থেকে এই সমস্ত স্হানিক বুলি ক্রমশ মুছে যাবে । হারিয়ে যাবে বাংলার মাটি থেকে । শহর গিলে খেয়ে নেবে বাংলা বুলিগুলোকেও ।

আসছি কাকুদা, মোড়ে গিয়ে দাঁড়াও । খুকুস্বর তরুণী-কন্ঠের ভেতর থেকে আসা আশ্বাসে ভারমুক্ত হয়েছে অরিন্দম । কাকা আর দাদা মিলিয়ে নতুনতম এক সম্পর্ক পাতিয়েছে বটে মেয়েটা । কাকুদা ! বাশ লাগল শুনতে। কলকাতায় বেগুনউলিকে লোকে বলে মাসি, অথচ নিজের মাসিকে পাত্তা দেয় না । বাসযাত্রী বা পথচারীকে যুবকেরা বলে দাদু, কিন্তু নিজের দাদুকে দুমুঠো খেতে দেয় না । কলকাতায় শব্দের মধ্যে সম্পর্কগুলো আর নেই।

অতর্কিতে এক ঝলক ভ্যানিলা গন্ধের ঝাপটা । এই নোংরা পেঁকো দুর্গন্ধের সমুদ্রে কোথ্থেকে এই সুগন্ধ ! যিশু বলল, কেটলির বাপ দিশি বিস্কুট আর কাপ-কেক বানায়, তারই গন্ধ । কেটলির পা-দুখানার দিকে তাকিয়ে দেখো তুমি, সদ্য ধানচারা রোয়া হাতের চেটোর মতন পরিষ্কার । ওই অ্যালুমিনিয়াম গামলাটা দেখলে তো ? ওর মধ্যে পা দিয়ে কেক-বিস্কুট বানাবার ময়দা-টয়দা মাখে । পুজো করার যুগ্যি । ভারজিন মেরির মতন । সত্যি, কলকাতার রাস্তায় হাঁটাচলার পরও যে অমন পা থাকতে পারে কারুর, ধারণা ছিল না আগে । রাইটার্সে ভালোই বিক্রি হয় ওর কেক-বিস্কুট ।

বাপরে ! কলকাতায় এরম গা-সওয়া জায়গা আছে জানতুম না । কী করে থাকে লোকে ? প্রশ্ন তোলে অরিন্দম, উত্তর নেই জেনেও । ফেরার পথে টের পায় জমা জল বাড়ছে । প্রায় পুরো ডুবে গেছে ইঁটগুলো । অন্য জুতোটাও চপচপে জলে ঢুকে মোজা ভেজাচ্ছে । গলি থেকে জলটা বেরোচ্ছে না-ই বা কেন ? আবার প্রশ্ন তোলে অরিন্দম ।

এখুন তো অবস্হা তবু ভালো । বর্ষাকালে এলে দেখবে যতরকুম প্রজাতি আর ভাষার মানুষ কলকাতায় আছে, এই গলিটা তাদের সব্বায়ের গুয়ের মিলনমেলা । এখানে আন্ত্রিকের টিশু কালচার হয় । কড়াইডাঙার চামড়া টাউনশিপের জন্যে এগারোশো একর নিচু জমি ভরাটের কাজ চলছে ডি ডাবলু খালের বুকে বাঁধ বেঁধে মাটি কাটার জন্যে । তুমি ওদিকটায় যাওনি বোধয় । এখুন বেশ কিছুদিন বেরোবার উপায় নেই । জল বেরুচ্ছে না বলে বানতলার ভেড়িগুনো চোতমাসের গরমে ভেপসে উঠে মাছ মরছে । ভেড়িগুনো এখানকার নোংরা জল খাল থেকে টানে । এখুন তো চারাপোনা ছাড়ার মরশুম ।

ওফ, যিশু বিশ্বাস তো মগজের মধ্যে খবরের ব্যাংক বানিয়ে ফেলেছে । এর জন্যেও কনসালটেনসি পাবার তালে আছেন নাকি ? প্রশংসা জানায় অরিন্দম ।

নিজের সংগৃহীত তথ্য ঝালাবার কাজ চালিয়ে যায় যিশু । বালিগঞ্জে, পামার বাজার, চৌবাগায় পাম্পং স্টেশানগুনো কলকাতার মাটির তলাকার নর্দমার জল ওই খালটায় পাঠায় । তিলজলার ট্যানারির চামড়াধোয়া জলও মেশে । অতএব বুঝতেই পাচ্ছ, এই গলির কলকাতা বহুকাল এই গলিতেই থাকবে । গুয়ের ভেনিস । সিগারেটের প্যাকেট সামান্য খুলে অরিন্দমের দিকে বাঁহাত বাড়িয়ে, ও তুমি তো খাও না ।

তোমরাদের বললুম না মোড়ে গিয়া দাঁড়াও । একটু আগেই শ্রুত কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফেরে অরিন্দম । কালচে টেরাকোটা রঙের মেদুর-ত্বক স্বাস্হ্যবতী । কৈশোর আর যৌবনের সেই নিদারুণ সংযোগ-মুহূর্তে, যখন আজেবাজে চেহারাও হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য । ভ্যানিলা-সুগন্ধের জেল্লা । নিজেকে হতবাক করার জন্য আরেকবার ফিরে চাইতে হয় । অরিন্দমের এভাবে তাকাবার বাধ্যবাধকতাকে উপভোগ করছিল যিশু । এখানে আসার আগেই সতর্ক করেছিল যিশু, এ তোমার বিশুদ্ধ বাঙালি পাড়ার কলকেতিয়া লাফড়াউলি নয় যে দশবছর বয়েসেই দুলুর-দুলুর বুক নাচিয়ে ঘুরবে ।

নর্দমার নোংরা জল-জমা গলিটার ঢোকার মুখেই, বিতৃষ্ণা, কুন্ঠা ও সার্বিক ভয় যখুন ওকে পেড়ে ফেলতে চাইছিল, মনে-মনে মনে হয়েছিল অরিন্দমের, এই পেঁকো ছমছমে ঘুঁজির বাসায় ভালো কি সত্যিই থাকা সম্ভব, সৎ থাকা ? অত্যন্ত ধনী আর ভীষণ গরিবের পক্ষে সৎ থাকা বেশ কঠিন । সেরকম সৎ-টাকাকড়ি রোজগার করে বাঁচা যায় কি এখানে, এই এঁদো এলাকায় ? পরিচ্ছন্ন কোনো পাড়ায় চলে গেলেই তো হয় । মহাকরণে চা আর সস্তা বাটি-কেক বেচে দু-তিনজন লোকের কুলিয়ে যায় হয়তো ।

এরকুম একটা পাড়ায় থেকেও কেটলিউলির স্বাস্হ্য নিখুঁত, সূর্যকরোজ্জ্বল । হাত দুটো শ্রম-সুডোল । চকচকে ত্বকের স্নেহপরবশ মসৃণতায় পিছলে যায় অরিন্দমের মুগ্ধ দৃষ্টি । দ্রুত বেঁধে ফেলেছে ঘনকালো কমনীয়-উজ্জ্বল কোঁকড়াচুল হাতখোঁপা । প্রিন্টেড শাড়িটাকে বেগনে-নীল-হলুদ কল্পরাজ্যের ফুলগুনো শাড়িটাকে সহজে নোংরা হতে দিতে চায় না বলে বেশ কিছুদিন সযত্নে না-কেচে চলে যায় । মেয়েটা লম্বায় কত ? পাঁচ ফিট ? তাই হবে । যিশুর চেয়ে কয়েক ইঞ্চি বেঁটে । প্লাসটিকের স্ট্র্যাপবাঁধা বর্ষাকালের কালো জুতো, নোংরা জলে উঠছে-নাবছে । জুতোর গোড়ালিটা নরম নিশ্চই, নইলে মহাকরণে হরেক প্রকার হাওয়ায় চেপে-থাকা রাজনীতিবিদ, আমলা, কেরানি, আর কৃপাপ্রার্থী নাগরিকদের সামনে দিয়ে কাঁচের গেলাস আর কেটলি হাতে গটগটিয়ে হাঁটলে তো বারান্দা থেকে ঠেলে বিনয়-বাদল-দীনেশের কাছে পাঠিয়ে দেবে আদিত্য বারিকের ভুঁড়ি-ভোম্বোল সহকর্মীরা, যারা বারান্দায় বসে সারাদিন হাই তোলে আর মুখের কাছে টুসকি বাজায় ।

পা দুখানা সত্যই প্রতিভাদীপ্ত । সকাল-দুপুর সংগৃহীত প্রতিদিনের সূক্ষ্ম নোংরা সন্ধ্যাকালে চালান হয়ে যায় কেকগুলোয় । অরিন্দমের মগজে নির্বাক হইচই । প্রাকগ্রীষ্মেও মেয়েটা ঠান্ডা হাওয়ায় মোড়া । মেদহীন নারীত্ব বোধয় হয় না । মোড়ে পোঁছে কলের মুখহীন সতত বহমান জলে, জুতোসুদ্দু পা এগিয়ে প্রথমে ডান তারপর বাঁ হাঁটু ওব্দি শাড়ি তুলে ধুয়ে নিল মেয়েটি নির্দ্বিধায় । বোঝা যায়, রোজকার, যেদিন মহাকরণ খোলা থাকে, অভ্যাস।

যিশু চাপা গলঅব, কীইইইইরে, তোর এই একটাই শাড়ি, বলতে ততোধিক নাবানো গলায় মেয়েটি জানায়, অন্য দুটা কাচার সময় হয়নি, পরে কেচে নিবো । ওর গিঁটপড়া ভুরুর তলায় ঝলমলে চাউনিতে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছিল, এই লোকটা আবার কে, কাকুদার সঙ্গে জুটেছে সাতসকালে ।

ওর নাম অরি, অরিন্দম মুখোপাধ্যায় । খুব ভালো লোক । তোকে রেস খেলা দেখতে নিয়ে যাবে । প্রস্তাব আর আদেশ একসঙ্গে মিশিয়ে, মাথা পেছনে হেলিয়ে, থুতনি দিয়ে অরিন্দমের দিকে নির্দেশ করে যিশু । কেটলিউলি ঝটিতি জরিপ করে ওকে, যেন এই কচি বয়সেও, মানুষের দিকে স্রেফ একটি বার তাকিয়ে, তার চরিত্রের ভালোমন্দ বুঝে ফেলবে ।

ভুরুর গিঁট বজায় থাকে । মাঝখান থেকে এই লোকটা আবার কেন ? কাকুদা তো নিজেই নিয়ে যাবে বলেছিল ঘুড়ার দৌড়ানো দেখতে । তা নয়, একজন অচেনা উটকো লোকের ঘাড়ে চাপাচ্ছে । এ কি ঘুড়ার পিঠে বসে ?

যিশু নিজের সাফাইকে সাফসুতরো করে । আমি যেতুম, কিন্তু আমার দুদুটো রিপোর্ট ফাইনাল করা হয়নি এখুনো । একটা তো আজকে স্পাইরাল বাইন্ডিং করতে পাঠাব, যাতে রাত্তিরে কুরিয়ার করতে পারি । তার ওপর আবার কমপিউটারের প্রিন্টারটা আবার খারাপ হয়ে পড়ে আছে । ফ্লপিতে তুলে দেখতে হবে কাছেপিঠে কোথাও যদি প্রিন্টআউট নেয়া যায় । লাইটও থাকছে না সন্ধের দিকে । হাতের কাজ দু-এক দিনের মধ্যে শেষ করতেই হবে, নইলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে । অরিন্দম অনেক ভালো লোক । বাড়িয়ে বলছি না । সত্যি । আলাপ করলেই টের পাবি । তোর অফিসের পাশেই ওর অফিস । ওই ডানদিকে যে তেরোতলা বাড়িটা । অফিসে এসকালেটার আছে, মেট্রোরেলের মতন । তোর অফিসে তো শ্রমিকদের সরকার তোকে চাপতেই দেয় না লিফ্টে, দিনে পঁচিশবার একতলা, তিনতলা করিস । ওর অফিসে ও অনেক বড়ো অফিসার । ওর গাড়িও আছে নিজের, তোকে চাপাবে । ওই তো, ওই যে, ওই ঘিয়ে রঙের গাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস, ওইটে ।

কেটলিউলিকে কমপিউটারের বিশদ কেন ? ও কি কমপিউটার শিখছে ? কিন্তু অরিন্দম সম্পর্কে কথা বলার বদলে ওর অফিস, অফিসারি, তেরোতলা, এসকালেটর, গাড়ি এসমস্ত ওর সচ্চরিত্র হবার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মেয়েটির এজলাসে পেশ হল । কেটলিউলির চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, যিশুর প্রয়াস দিব্বি সফল । মসৃণ তেলালো ত্বকে আভা দেখা যায় । ভুরুর গিঁট খোলে ।

তুইতোকারি করা বা তুমি বলা উচিত হবে কিনা নিশ্চিত হতে না পারায়, বিব্রত অরিন্দম বলল, আমাকে কাকুদা-অরিদা গোছের কিছু বলবেন না । স্রেফ অরি কিংবা অরিন্দম বলে ডাকবেন ।

যিশু কাঁধ নাচায় । ওহ হাসালে বটে । তুমিই বোথয় প্রথম আপনি-আজ্ঞে করছ ওর জীবনে । মহাকরণে সবাই তুইতোকারি করে । অত তোল্লাই না দিয়ে ওকে তুমি বলেই ডেকো । ঠিক, না রে কেটলি ?

কেটলি বেশ বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে, মাসখানেক আগে একবার বলে ফেলেছিল যিশু । ওর দাদু, মানে ওর মায়ের বাবা, নামকরা লোক ছিল, খাঁটি ডাকসাইটে । কুচকুচ করছে চুল । থমথম করছে মুখ । কুতকুত করছে চোখ । টনটন করছে জ্ঞান । খসখস করছে কন্ঠস্বর । তিরতির করছে চাউনি । গটগট করছে চলন । কনকন করছে আঙুল । দশাসই । পিস্তল রাখত । ভালো জামা-কাপড় পরার শখ ছিল । দু-দুটি বডিগার্ড থাকত সব সময় । স্বাধীনতার আগের বছর তো জান লড়িয়ে দিয়েছিল । আদিত্যকে জিগেস কোরো । যিশু আদিত্যর কথা পাড়ায় নিজের ক্ষুন্নতায় আশ্চর্য হয়েছিল অরিন্দম । আদিত্য তো বোধয় ওরচে অন্তত দশ বছরের ছোটো । যিশু আদিত্যর চেয়ে কুড়ি বছরের বড়ো ।

আদিত্যর দেওয়া তথ্যে বিস্মিত আর আকৃষ্ট হয়েছিল অরিনদম । সত্যি । অফিসের মহাফেজখানা থেকে ধুলোপড়া পুরোনো খড়খড়ে ফাইল এনে দিয়েছিল আদিত্য । ফাইল খুঁটিয়ে পড়ে, অবিচল অস্হিরতায় আক্রান্ত, ভেবেছিল অরিন্দম, বিকেলের বর্ষীয়ান আলোয় নিজের বিছানায় শুয়ে, টেবিলে রাখা চায়ে কখুন সর পড়ে গেছে খেয়াল নেই, ভেবেছিল ও, কলকাতার বিখ্যাত পরিবার বলতে ঠাকুর পরিবার মল্লিক পরিবারের মতন কয়েকটা উচ্চবিত্ত পরিবার বোঝায় কেন ! কত বাঙালি আছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পঞ্চম ষষ্ঠ পুরুষ ওব্দি বংশলতিকা জানে বলে গৌরব বোধ করে । তারপর একদিন তারা মরে হাওয়া হয়ে যায় । সেই গৌরববোধটা কি তখুন হাওয়ায় ঈথারে ভেসে বেড়ায় ?

আরও গোটাকতক ফাইল লুকিয়ে এনে দিয়েছিল আদিত্য । বর্ণময় সব চরিত্র ।

কেটলিউলির দাদুর নাম কেষ্টবাহাদুর জহোর্বাদি । দার্জিলিঙের বাঙালি । মা-বাপ অজানা । একজন চিনে মুটিয়া লালন-পালন করেছিল । তাকেই বাপ বলে জানত । দার্জিলিঙ থেকে কলকাতায় পৌঁছে, বছর ফুরোবার আগেই, পটল তুলল চিনে বাপ । কারা যে ওর মা-বাপ, চিনে বাপ সাঙ্গ হতে, জানা হল না আর । সব বাবারাই তখুন ওর চিনে বাপ । ফেকলু ছেলেটাকে শুয়োর মাংসের এক কসাই পুষ্যি নিলে । পযঅর বজ্জাতগুনোর সাকরেদিতে শিখে ফেলল চুরি-বাটপাড়ি, চাকুবাজি, হার ছিনতাই, ব্লেডমারা, পার্স তুলে চিতাবাঘ দৌড় । চোদ্দ বছর বয়সে রেফরমেটরি-জেলখানায় । কলকাতার আর আশেপাশের জেলখানায় যা হয়, গাঁজা চরস, হেরোইন, আফিম, কোকেন, সমকাম, ঝাড়পিট, অসুখ, অখাদ্য, অপুষ্টি । সেখান থেকে বেরিয়ে এলো পোড়-খাওয়া ঘ্যাঁচড়া । তারপর অবিরাম ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে…।

ছেচল্লিশের প্রাকস্বাধীনতা আর মানুষ-জবাই উৎসবে, মুসুলমানদের পাড়া টেরিটিবাজার ছেড়ে পালাল মলঙ্গা লেন, আর সেখানে গিয়ে গোপাল মুকুজ্জের হিন্দু বাঁচাও দলের ঠ্যাঙাড়ে ও সদস্যে পদোন্নতি পাওয়া কেষ্টকে তখুন দ্যাখে কে ! যত খুন করে ততো প্রতিষ্ঠা বাড়ে । শার্টের কলার, গোপাল মুকুজ্জের দেওয়া হলেও, গাধার কানের মতন উঁচু । ও দার্জিলিঙের লোক ছিল বলে ওর অ্ত্রটার নাম সেই থেকে হয়ে গেছে ন্যাপলা । অন্তত শ’খানেক মুসুলমানকে নুলো খোঁড়া কানা করেছিল, পাঞ্জাবি পুলিশের নজর এড়িয়ে । কচুকাটা কন্দকাটা হেঁটেকাটাও করেছিল দাদু । ওই ফাঁকেই, দেশ স্বাধীন হব-হব, একজন তাগড়া হেলে কৈবর্তের মেয়ের সঙ্গে থাকতে লাগল । ফাইলের মার্জিনে লেখা বিয়ে হয়নি । বাচ্চা হতেই জিনহা আর জহোরলাল যে যার আঁতুড়ে যখুন স্বাধীনতার বিগুল বাজাচ্ছে, বউটা কাঁখে বাচ্চা নিয়ে এক গাঁট্টাগোঁট্টা তেঁতুলে বাগদির সঙ্গে পালাল পুরুলিয়ার আরসা ব্লকের হেঁসলা গ্রামে ।

দেশ স্বাধীন হতে, হাত-পা ছড়াবার অনেকটা জায়গা দিয়ে অনেক মুসুলমান তো ডানদিকের আর বাঁদিকের পাকিস্তানে পালাল । গোপাল মুকুজ্জেরা আর তাই কেষ্টটেষ্টদের পুষতে চাইল না । তখুন সংবিধান লেখালিখি হবে, দিশি বুড়ো-হাবড়ারা চেয়ার-কুর্সি পাইক-পেয়াদা পাবে, ফলে কেষ্ট গিয়ে সমাজের বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে চিৎপটা২ । তারপর কখুনও পটুয়াটোলার সত্যেন বিশ্বাস, ভূবন সরকার লেনের ব্রজেন সরকারের কাজে, কিংবা ফ্রিল্যান্স ঠ্যাঙাড়ে । সাতচল্লিশে টালিগঞ্জ থানার বন্দুক-কার্তুজ লুট, আটচল্লিশের নভেম্বরে মহরমে মারপিট । পঞ্চাশের ফেবরারি-মার্চের দাঙ্গায় গোপালবাবু-সুধাংশুবাবুদের স্যাঙাত হয়ে আবার দেশপ্রেমিকে উন্নীত । কেষ্টোবাহাদুর জহোর্বাদি বাঙালি-সমাজের প্রথম মস্তান । তারপর থেকে মস্তান ছাড়া সরকারি দল অচল । পশ্চিমবাংলার রাজনীতি অচল ।

কেষ্ট তারপর আরম্ভ করে দিল ডাকাতি । খুল্লমখুল্লা ঘুরে বেড়াত স্টেনগান নিয়ে । গড়িয়াহাটের গিনি ম্যানসনের ডাকাতিটা ওই করেছিল । তখুনকার দিনে মুখোশ পরে মুখ লুকিয়ে ডাকাতির চল হয়নি । তবুও প্রমাণ করা যায়নি । কে আর সাক্ষী হয় । মানুষের ভয়ডরের শরীর । তার ওপর দেশ স্বাধীন হতেই পুলিশকেও একই রকুম ভয় পেতে আরম্ভ করেছে লোকে । ছাড়া পেয়ে কেষ্ট দিনকতকের জন্যে পালাল মুম্বাই । ফিরে আসতে, একদিন রাস্তায় হঠাৎ, ছেচল্লিশের প্রতিরোধ সমিতির পাণ্ডা শিবপ্রসাদ সাহার সঙ্গে কেষ্টবাহাদুরের দেখা । বউবাজারে সাহার চালডালের দোকান । চলছিল না । একদিন বউবাজারের বড়ো ব্যাপারি শ্যামলাল গুপ্তর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ব্যবসার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল শ্যামলাল । কেষ্ট তো ওকে গুলি মেরে খুন করে বোমার ধোঁয়া উড়িয়ে ব্যাগ হাতিয়ে পালাল । কিন্তু পাবলিকের তাড়া খেয়ে সেঁদিয়েছে গিয়ে রূপম সিনেমাহলে । ধরা পড়তে রাগি জনগণের হাতে দেম্মার, পেড়ে ফেলে আড়ং ধোলাই । স্বাধীনতার পর সেই প্রথম বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ আর রাজনীতি-নিরপেক্ষ গণপ্রহার , কেননা মাত্র ক’বছরেই পুলিশের ওপর থেকে ভরসা উবে গিয়েছে নাগরিকদের । বলেছিল যিশু ।

মাউনব্যাটোন যাবার সময়ে জহোরর্লালকে বলে গিসলো, এই স্বজন-ঠ্যাঙাড়েদের ভার তোমার হাতে সঁপে যাচ্ছি, এরা অনেক কাজে দেবে, তোমার মেয়ে যখুন বড়ো হবে তখুন, এমনকী তোমার নাতি আর তাদের ছেলেমেয়েদেরও কাজে দেবে । তুমি আবার বাহাদুরি মেরে মানবতাবাদ ফলাতে গিয়ে খোলনলচে পালটে ফেলো না যেন । জিনহাকেও একই কথা বলিচি । তা কথাটা অমান্য করেনি দুজনে । বলেছিল যিশু ।

অনেকদিন চলেছিল কেষ্টর মকদ্দমা । জেল হাজতে তো ওর দাড়ির চুল সাদা হয়ে গেল । স্বাধীনতার পর বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখার সেই শুরু, ফউজদারি হোক বা দেওয়ানি । সাতান্ন সনের কলমের নিব ভেঙে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল কেষ্টর । সে নিব পালটে নতুন নিব লাগালে, রাষ্ট্রপতির দয়ায় যাবজ্জীবনের পর কেষ্ট বেরিয়ে এল একেবারে লোলচাম বুডঢা, ভুরু আর কানের চুল পেকে দঙ্কাদড়ি । মেয়ের কাছে তপসিয়ায় বেঁচেছিল, অথর্ব । নাতনির টেরাকোটা হামাগুড়ি শেষ হবার আগেই, বাটিকেকের সদ্য নাবানো গরম ডালার মধ্যে পড়ে ঝলসে মরে গিয়েছিল । চিতায় ক্রিমিনালের লাশ থেকে ভ্যানিলার ভুরভুরে সুগন্ধ নিমতলার ঘাটকে শোকমুক্ত করে দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে । বলেছিল যিশু ।

কেটলি ওর মায়ের কাছ থেকেই শিখেছে পা দিয়ে ময়দা চটকানো । ডালহাউসিতে ওর বাপ ফিরি করত সেসব কেক । উদবাস্তুরা তখুন সবে বড়োদিন, নিউ ইয়ার, হ্যাপি বার্থডে করতে শিখছে । নিয়মিত বিক্রিবাটা তো কেটলি মহাকরণে ঢোকার পর আরম্ভ হয়েছে । ঢোকার জন্যেও পুরুলিয়ায় গিয়ে ঝাড়খন্ড দলের বিরুদ্ধে বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে হয়েছিল ওর বাপকে, নির্বাচনের সময় । বলেছিল যিশু ।

তাহলে মেনকা, আই মিন ম্যানকা পাইক, ওর বুইন নয় ? জিগেস করেছিল অরিন্দম ।

না-না। ও-ও তিলজলা বা বাইপাসের দিকে জবরদখল জমিতে থাকে কোথায় যেন । মস্তান ট্যাক্স আর পার্টি ট্যাক্স দিতে হয় ।

ওর নাম কী ? কেটলির ?

নাম ? নাম দিয়ে কী করবে ?

নিজের কাছে রাখব ।

ফাইলটার মার্জিনে একগাদা বানান ভুল সম্পর্কে মন্তব্য ছিল, পেনসিলে । মন্তব্যগুলোতেও বানান ভুল ছিল । উদবাস্তুরা এসে কমিউনিস্ট পার্টিটাকে দখল করে নিয়ে প্রাইমারি স্তরে ইংরিজি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, যাতে বাঙালিদের একঘরে করে রাখা যায় । ফল ভুগছে ।

মন্দ বলোনি ।

আরেকটা ফাইল থেকে তো জেরক্স তুলে নিয়েছে অরিন্দম, আদিত্যকে খ্যাপাবে বলে । খেপছেও আদিত্য । প্রসঙ্গ তুললেই, এমনকী ওর ভুঁড়িদাস খাকি সহবেতনভূকরাও । একজন কন্সটেবল, ব্যাটা কেবলমাত্র কন্সটেবল, মেদিনীপুরের পাণ্ডে, অ্যাঁ, সে তো রেগে কাঁই । আসলে, মেছুয়াপট্টির ফলবাজারে ব্যাটার একটা ম্যাটাডর ভ্যান খাটতো ; পুরসভা সেটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল । সতেরোটা হাতে-টানা রিকশা খাটে ওর । সবকটা রিকশা একটা লাইসেন্সেই চলে ।

কলকাতা থেকে হাতেটানা রিকশা কেন তুলে দেয়া হচ্ছে না জানো তো ? সব রিকশাই হয় পুলিশের নয়তো পলিটিকাল মাফিয়ার ।

ওই ফাইলটা, যেটার জেরক্স রেখেছে অরিন্দম, গৌরীবাড়ি লেনের হেমন্তকুমার মণ্ডল ওরফে হেমেন মণ্ডল ওরফে হেমা এজেন্টের । লুম্পেন কলকাতার জনকরাজা । ফাইলে, নামের আগায় ‘শ্রী’ জুড়ে দিয়েছিল কেউ সবুজ কালিতে । মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় পড়েছিল অরিন্দম, মনে আছে, হেমেন মণ্ডলটা ছিল রুণু গুহনিয়োগীর স্যাঙাত ঠ্যাঙাড়ে । বোঝো তাহলে । শেষে এই রুণু কিনা আদিত্যর রোল মডেল !

স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস নাইন ওব্দি পড়েছিল হেমেন মণ্ডল । ক্লাস টেনে যাবার মুখে চলে গেল অন্যলোকের মালকড়ি-টানার ইশকুলে । গড়ে ফেলল হাড়-বজ্জাতদের হাড়হাভাতে হাড়গিলে দল । ভাড়াটে তুলতে হেমেন । চটকলে ভর্তি করাতে হেমেন । বানতলার ইঁট-বালি-লোহা কিনতে হেমেন । অবরোধকারীদের প্যাঁদাতে হেমেন । পুজোর চাঁদা তুলতে হেমেন । হেমেন রক্তদান ক্যাম্প করলে রোগাপটকা বুড়ো বাচ্চা সব্বাইকে দিতে হত ওর পাতা ফোলডিং খাটে কাঠ হয়ে শুয়ে । নইলে নয়ছয় লণ্ডভণ্ড খিস্তিখেউড় আড়ংধোলাই । লাশ লোপাট । নকশাল খুনের রেকর্ড করেছিল ও ।

রাষ্ট্র তখুন মহাকরণে কাগজ-কলম নিয়ে নাজেহাল । গৌরীবাড়িকে ভারতীয় সংবিধানের বাইরে নিয়ে যেতে সফল হয়েছিল হেমেন মণ্ডল । স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল । পঞ্চান্ন হাজার লোকের ঘাড়ের ওপর সন্ত্রাসের ছত্রপতি হেমেনজি । ফি হপ্তায় কে কত তোলা দেবে তা বেঁধে দিয়েছিল হেমেন । খেরোর খাতায় হিসেব রাখত । চাইলেই গাড়ি টিভি ফ্রিজ চেয়ার টেবিল বাসন-কোসন বিছানা-মশারি তক্ষুনি দিয়ে দিতে হবে হেমেনজিকে । তক্ষুনি । বাড়ি বা ফ্ল্যাট চাইলে, তাও । তক্ষুনি ।

অনিতা দত্তর ভায়ের ফ্ল্যাট দখল করে থাকতে লাগল হেমেন আর ওর ল্যাংবোট সেনা । অনিতার কাজ ওদের জন্যে রান্না করা, বাসন মাজা, জলতোলা, কাপড় কাচা, ঘরমোছা, জামাপ্যান্ট ইস্তিরি । অন্ধকার ভাঁড়ার ঘরটা অনিতার ভায়ের জন্য বরাদ্দ । পাড়ার লোকেরা তো ভয়ে লেংটু গুটিয়ে কেঁচো । রাষ্ট্র তখুন মহাকরণে বৈপ্লবিক ফাইলবাজি শিখছে ।

হেমেন কি আর ধরা পড়ে না ? পড়ে বইকি । ধরে রাখা যেত না । উকিলরা ছাড়িয়ে এনে আবার ছেড়ে দিত সমাজে । হেমেন সমাজের ভেতর । পুলিশ সমাজের বাইরে হাই তুলছে । হেমেন যতবার ছাড়া পায় ততবার ওর ইজ্জত বাড়ে । এরম হতে-হতে আলটপকা একদিন খেলাচ্ছলে শ্যামপুকুর থানার পরশুরাম রায়কে খুন করে ফেলেছিল । যাবজ্জীবন হল । কিন্তু হেমেন মণ্ডল বলে কথা । দিব্বি ছাড়া পেয়ে গিসলো হাইকোর্টে । বুকের পাটা ফুলে হিমালয় । বড়োতলার গুণ্ডা হারু আদককে গিয়ে খুন করে দিলে, তারই পাড়ায়, হিন্দি সিনেমার সংলাপ বলতে-বলতে । ইন্দি ফিলমে তখুন সবে ক্রিমিনালরা নায়কের পিঁড়িতে বসছে । বাড়ির ছেলে-ছোকরা আর বউঝিরা বাংলা ফিল্ম ছেড়ে হিন্দির দিকে ভিড়ছে তখুন । পাড়ার কচি কিশোররা হিন্দি সিনেমার ঢঙে কথা বলে আহ্লাদে আটখানা হতে শিখছে ।

কংরেসের সিদ্ধার্থ রায় বিদেয় নিলে কী হবে, জনদরদী বামপন্হী সরকার সেশন আদালত থেকে হারু আদকের খুনের মামলা চুপিচুপি তুলে নিলে । এদিকে হেয়ার স্ট্রিটে, মানিকতলায়, উল্টোডাঙায়, শ্যামপুকুরে, পার্ক স্ট্রিট, বড়োতলা আর চব্বিশ পরগণার থানায়-থানায় হেমেনের নামে শ’খানেক কেস ঝোলানো । ঝোলানো মকদ্দমার দড়ি আপনা থেকেই পচে যায় । হেমেনের খাতিরে বিশেষ আদালত হল । হতেই, নাকচ করে দিলে হাইকোর্ট ।  জনদরদী সরকার জানতো যে হাইকোর্ট নাকচ করে দেবে । আইন বলে কথা । তা-ও আবার ইংরেজদের বানানো।

শুধুমাত্র তিনটে কেসের তল্লাশিতেই হেমেনের বৈভবে পাওয়া গিসলো লাখের বেশি কাঁচা টাকা, বিলিতি মটোরগাড়ি, অনেকগুলো ব্যাংকের মোটা ফিক্স ডিপোজিত, লকার, গয়নাগাটি, ট্রাক, এমনকী ওর পাঁচ-পাঁচটা লাইফ ইন্সিয়োরেন্স । বিদেশি ইনসিয়োরেন্স কোম্পানিরা এসে যাতে না ব্যবসায় ভাগ বসায় তাই অনেক কাল আগে থাকতেই খুনি-ডাকাত-মস্তানদের জীবনবীমা আরম্ভ হয়ে গিসলো । পরে তো খুনি ধর্ষক আর ডাকাতরা বিধায়ক আর সাংসদ হয়ে যেতে লাগলো, খাদি-খদ্দরে ধবধবে ।

হেমেনকে শেষে শায়েস্তা করলে গৌরীবাড়ি পাড়ার মেয়েরা । পাড়ায় বিনে পয়সায় কোচিং চালাত লাবু স্যার, একটু খোঁড়া । সবাইকে নানা রকুমার কাজে সাহায্য করত লাবুবাবু । সবচে শ্রদ্ধেয় লোক ছিল পাড়ায় । লোকে লাবুকে এতো ভালোবাসছে শ্রদ্ধা করছে দেখে হেমেন আর ওর কেল্টে-খ্যাংরাটে সাঙ্গো-পাঙ্গোরা একদিন লাবুবাবুর ছেঁড়া কলার ধরে হুমকি দিলে, কোচিং-ফোচিং বন্দ করো, যথেষ্ট ল্যাখাপড়া শিখিয়েচো পাবলিককে । লাবুবাবু তাতে কান দিলে না । না শোনার ফলে একদিন ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের সামনেই ফাইট-মাস্টার হেমেন মণ্ডলের হাতে কোচিং ভাঙচুর আর লাবুস্যারকে লাথি গুষি চেন সোঁটা মেরে-মেরে বেধড়খ হল । থ্যাঁতা লাবুবাবুকে দেখতে গলায় স্টেথোঝোলানো ডাক্তার এলে তারও হল রামপ্যাঁদানি আড়ংধোলাই । শেষে থাকতে না পেরে একজন গেরস্ত বউ জোর করে ডেকে নিয়ে এল আরেক ডাক্তারকে । হেমেনরা আবার ট্যাঁ-ফোঁ করতেই পাড়ার সমস্ত বউ মেয়ে বুড়িরা হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে গাছকোমরে নাবল রাস্তায় । জনদরদী সরকারের বরকন্দাজরা হেমেনকে বাঁচাতে গেলে তাদেরও জুটল চটিপেটা আর গুঁড়োলংকা । হেমেন-রাজ ফুরোলো ।

পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের বোধ আর সংবেদনকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়ে গেছে রুণু গুহনিয়োগী-হেমেন মণ্ডলের দলবল । মর্গের আর ভাগাড়ের বেওয়ারিশ লাশের কংকাল বিদেশে চলে যাচ্ছে বিক্কিরির জন্যে । গঙ্গায় নৌকো ভাসিয়ে দিয়ারায় নিয়ে গেলেই হল । ওই তো, নিজের চোখেই দেখেছে অরিন্দম মুর্শিদাবাদের ট্যুরে  গিয়ে । হরিহরপাড়ার স্বরূপপুরে জমির খেয়োখেয়ির ছোরাছুরিতে কাঙালি শেখের বারো বছরের ছেলে হাবল শেখের হাত কেটে দিলে কংরেসিরা । সেই কাটা হাতটা বাজারের থলেতে পুরে জেলা আর মহকুমা আধিকারিকদের দেখিয়ে বেড়াচ্ছিল এসিউসির ছেলেরা । ওই কাটা হাতটা দিয়েই একজন অনুসন্ধিৎসুর গালে চল কষিয়ে দিলে ।