মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোমতাজ হিমঘরের অংশীদার, পঁয়ষট্টি বছরের গেরুয়া-পোশাক, বাঁ হাতের সরু-সরু তামাটে আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে-থাকা সাদা ধবধবে দাড়ি, কালো-ফ্রেম গ্রাম্য বাইফোকাল, বাবরিচুল ভবেশ মণ্ডলকে হুগলি জেলার এই প্রত্যন্ত গ্রামে দেখে যতটা স্তম্ভিত হয়েছিল, তার চেয়েও অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছিল যিশু, ভবেশকার বোন খুশিদিকে দেখে । খুশিরানি মণ্ডল ।
কাঁসার বগি থালায়, কম্বলের আসনে খেতে বসে, প্রথম গপঅস মুখে তুলে, তিতকুটে লাগায়, যিশু বলে ফেলেছিল, এ বড্ডো তেতো নিম-বেগুন, আপনাদের দেশে নিমপাতা একটু বেশি তেতো বউঠান । সরাসরি যিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে খুশিদি বলে উঠেছিল, নিমপাতা নয়, একে বলে বামমি শাগ, খেলে মাথা খোলে । আমি কি তোর বউঠান ?
তিরিশ বছর পর শোনা পরিচিত কন্ঠস্বরে যিশু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট । ওর সামনে, হাতে হাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, ন্যাতানো আনারদানা জামদানিতে খুশিদি, ভবেশকার সৎ বোন । বিস্ময়ের নিষিদ্ধ স্বগতোক্তিতে বলে ফেলেছিল, আরে খুশি, খুশিদি, আর স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়েছিল গম্ভীর ভবেশকার দিকে । মুখাবয়বে দ্রুত বদল ঘটতে দেখল চাষি মেয়ে আর গ্রামীণ ক্ষমতাকেন্দ্রের মালিক দাদার । ভবেশকার চাউনিতে বিদ্যুৎগতি তিরস্কার । বোধয় ওঁর ছোটো বোনকে চিনতে না পারায় । আজকাল গ্রামগুনোয় সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাদের হাতে ।
এই বয়েসেও খুশিদিকে দেখতে কত ভালো । অচেনা শব্দ খুশিদির কন্ঠে, না-বলা কথা গিলে ফেলার আওয়াজ, অনেকটা হেঁচকির মতন । কন্ঠ বেয়ে কান্নার ঘূর্ণি চলে এসেছে চোখের ডাগরে, মুখ না তুলেই টের পায় যিশু ।
সূর্যনগরে আমি একটা অশথগাছ পুতেছিলুম । সেই গাছটা আচে ? প্রসঙ্গ খোঁজে খুশিদি । তুই কেমন আচিস রে যিশকা ?
হ্যাঁ, সেটা তো এখুন গাছতলা নামে বিখ্যাত । অনেক বাস ছাড়ে গাছতলা থেকে । তুমি দেখলে আর চিনতে পারবে না । গাছটা বিরাট হয়ে গেছে । উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে গেছে । আদিগঙ্গার ওপারেও গিজগিজ করছে বাড়ি । তুমি কি ভাবছ এখুনও ধানখেত আছে সেখানে ? যিশু কাঁধ নাচিয়ে নিজের স্বাভাবিক হাসি উপভোগ করে । যিশু আবার তাকায় খুশিদির মুখের দিকে, আর আমূল আক্রান্ত হয় ভারাক্রান্ত স্মৃতিতে । অশথ্থ গাছটার গোড়ায় একটা ঠাকুর আছে কী যেন ।
নমঃশুদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখুন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সালে, যুবক ভবেশকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে । ভবেশকার ঠাকুমা দাদু বাবা মা দাদা বউদি কেউ বাঁচেনি । ভবেশকার সৎ মা নিশ্চই ফর্সা আর সুন্দরী ছিল । অনেক জমিজমা ছিল ওদের, নয়তো অমন ভালো দেখতে দ্বিতীয় পক্ষের বউ কী করেই বা পেয়েছিল ভবেশকার বাবা । উদবাস্তু কলোনির চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যেও অনেকের ঈর্ষা উদ্রেক করত খুশিদির চাঞ্চল্য । ডান চোখে তিল । কাঁদলে থুতনিতে টোল পড়ত । নিটোল টোল ।
তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাচে কংরেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিল ভবেশকা । তাঁবাটে পেশিতে দোহারা, ঝাঁকড়া অবিন্যস্ত, একদিনের খোঁচা-খোঁচা, নোংরা ধুতি-শার্ট, থমথমে চোখে-মুখে চেঁচাত, দেশভাগ আমরা চাইনি । হাতে পেলে জহোর্লাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে । আর আজ হিমঘরের অংশীদার ভবেশকা, সংরক্ষণের ক্ষমতার দ্বিগুণ আলু হিমঘরে ঢুকিয়ে দুলাখ কুইন্টাল আলু পচিয়ে, সেই একই হুগলি জেলার চাষিদের ভয়ংকর বিপদে ফেলেও নির্বিকার । পচেছে আরও অনেক হিমঘরে । চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায় ।
পশ্চিমবঙ্গে টোটো ঘুরে, ব্রিফকেসে ফ্লপি আর ল্যাপটপ, তিন রকুমের হিমঘর দেখেছে যিশু : একলাখ কুইন্টালের বেশি, পঞ্চাশ হাজারের বেশি, পঞ্চাশ হাজারের কম । কৃষি বিপণনের বাবুদের তোয়াজে তেলিয়ে লাইসেন বের করতে হয়, হেঃ হেঃ, বলেছিল মোমতাজ হিমঘরের ক্যাশিয়ার শাসমল । তাও দাঁড়িয়ে যাবার পর তদারকিবাবু দেকে গেলে, মাত্তর দুবছের জন্যে, বোঝলেন, আবার দেবা-থোবার পালা, হেঃ হেঃ হেঃ । যে দেবে তাকে তো তুলতেও হবে , হেঃ হেঃ ।
ষাট হাজার কুইন্টালের হিমঘরে পাঁচতলা চেম্বারটা একশোদশ ফিট লম্বা, একশো আট ফিট চওড়া, ছাপ্পান্ন ফিট উঁচু । প্রত্যেক তলায় বারোটা করে তাক । মদ্যিখান দিয়ে যাতায়াতের জন্যে আড়াই ফিটের গলি । চ্যাঁচারির চালি দিয়ে আলাদা ভাগ-ভাগ করা থাকে তাকগুনো, যাতে তালাবন্ধ হাওয়া মনের আনন্দে খেলতে পারে চেম্বারের মধ্যে । সবচে ওপরে ছটা কনডেসেট কয়েল । তার ওপর ঘোরে ছাদপাখা । দেয়ালে চল্লিশ মিলিমিটার আর ছাদে আশি মিলিমিটার থার্মোকোলের পলেস্তারা ।
আরও, আরও টাকা করার পাঁয়তাড়ায় ভবেশকারা চলাফেরার আর হাওয়া খেলার জায়গাতেও ঠুসে দিয়েছিল বাড়তি বস্তা । তার ওপর বিজলির গোলমালে তাপের গুমোট বেড়ে গিসলো । শীতে জমে যাবার বদলে আলু ভেপসে গলদঘর্ম । কার জন্যে টাকাকড়ি জমিজমা চাই ভবেশকার !
হিমঘরের আয়ু তো কুল্লে ষাট বছর । মেশিনঘরে থাকে সিনকো, কির্লোসকার, অশোক লেল্যাণ্ড, ক্রম্পটনের কমপ্রেশার, তেল-ইঞ্জিন, ইনডাকশান মোটর, ডিজেল জেনারেটার, অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক, অয়েল সেপারেটার পাম্প, রেফ্রিজারেশান পাইপ । খড়গপুর আই-আই-টির মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার যিশুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে-দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল জাবেদালি ঘরামি । শিক্ষানবিশের মতো মাথা নেড়েছে যিশু, ও, আচ্ছা, হ্যাঁ, তাই বুঝু, কেন, ঠিক, বুঝেছি ।
বৌজলেন বিশ্বেস মোসাই, ছাব্বিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হপ্তা রেকে দেয়া যায় আলু, পঁয়ত্রিশ থেকে আটতিরিশ ডিগ্রি ফারেনহাইটে, বললে ম্যানেজার, নাক সামান্য ফুলিয়ে । দাম বাড়লে অসময়ে বিক্কিরির ঘামের দাম পায় চাষি ।
কিন্তু পচ ধরে তো জলের দরে বিকোচ্ছে ?
আসছে বছর দ্যাখবেন । আলুখোরদের বাঁশ দেবে চাষিরা ।
খাতাপত্তরে ফি-বছর লোকসান দেখান কেন ? মাল তো লোডিং হয় অনেক বেশি ? আপনার নাম তো কৃপাসিন্ধু, না ?
ও আপনেরা কলকেতার লোক, বুজবেন না । গ্রামে তো আর খবরের কাগজের রাজনীতি হয় না ।
চাষবাসের ব্যাপার, সত্যিই, এভাবে জানা ছিল না যিশুর । কারখানার রাজনীতি, স্কুলের রাজনীতি, অফিসের রাজনীতি, চাষের রাজনীতি, সবই আলাদা । আলুর চাষ শুরু হয়েছিল নভেম্বরে, শুরু হয়েছে রাজনীতির হালখাতা । এক হেক্টরে দুশো থেকে আড়াইশো কুইন্টাল ফলন হয় আলুর । প্রথম ফসল জানুয়ারিতে । বাজারের জন্যে । নতুন ধবধবে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ আলু, দামটা ভালো পাওয়া যায়, ফড়ে মেড়ো কাঁচা-বাজারের দালাল ওপরপড়া পার্টিদার সত্ত্বেও ।
আজ্ঞে মুসুলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমলের কালে স্যার হয়েচে পার্টিদার, আজগালগার জমিদার । বলেছিল পুড়শুড়ার নিতাই মাইতি, ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারের বড়ো ছেলে । যিশু কোনো চাকরি করে না, বুদ্ধি বিক্রি করে, শুনে ঠাহর করতে পারেনি চাকুরিপ্রার্থী ছোকরা ।
হিমঘরে রাখার আলু ওঠে ফেবরারির শেষাশেষি, বলেছিল জাঙ্গিপাড়ার নারায়ণ পোড়েল, ওখানকার হিমঘরের সুপারভাইজার, টাকমাথা, থলথলে, ময়লা । চাষিরা গোরুর বাড়ি আর মিনিট্রাকে চটের বস্তা ভরে আনে । হুগলি বর্ধমানে ষাট কেজিতে এক বস্তা । মেদিনীপুরে পঞ্চাশ কেজি । বস্তাকে বাংলায় বলে প্যাকেট । একখেও গোরুর গাড়ি মানে পাঁচ থেকে দশ কুইন্টাল, বলদ অনুযায়ী । আজ্ঞে বাঙালি বলদেরা তো আর হরিয়ানার বলদের মতন তাগড়া নয় । মিনিট্রাকে পঁচিশ থেকে চল্লিশ কুইন্টাল । তায় আবার ফি-বছর ডিজেলের দাম ডবল-ডবল বাড়ছে । হিমঘরে লোডিঙের সময় দেড়শো আর আনলোডিঙের সময় আশিটা কেঁদো মজুর আসে মুর্শিদাবাদ থেকে, সারা পশ্চিমবঙ্গে । নারায়ণ পোড়েল সিগারেটের টুসকি ঝাড়ে । মজুরগুনোকে আনে ওদের সরদার । বহরমপুরের কাসিমুদ্দি কাঠামি । সে দুদিকেরই ভাগা আর কমিশন খায় ।
আপনি তো হিমঘরে কাজ করে টেম্পো কিনে ফেলেছেন পোড়েলবাবু, মাইনেপত্তর ভালোই পান বলুন । ধনেখালি হরিপাল লাইনে চলে টেম্পোটা ।
না-না, কে বললে, এ আবার মাইনে নাকি । সরদারদের কাছ থেকে, মাটিঅলার কাছ থেকে, বাছনদারের কাছ থেকে, চাষির কাছ থেকে টাকা খাই । বস্তা পিছু ঘুষ নিই, ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ এবিলিটি । আরে বিশ্বাসবাবু, এদিকের মাল ওদিকে না করলে কেউই সুস্হ জীবন কাটাতে পারে না । টাকা ছাড়া শান্তি কই । আমার ওসব ঢাক-ঢাক গুড়গুড় নেই । যিশুকে হতচকিত করেছিল নারায়ণ পোড়েল । সত্যবাদীরা আজও আছে পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গসমাজে ।
ঠিকাছে, তারপর বলুন । ল্যালটপে টাইপ করতে থাকে যিশু, শুনে-শুনে । পেছন থেকে গ্রামীণ খোকাখুকুরা দেখতে থাকে পদিপিসির মার্কিন বাকসো ।
যে আলু রাখছে তাকে হিমঘর একটা রসিদ দ্যায় । তাতে তার নাম, সাকিন, আলুর হাল, ওজন, ভাড়া, বিমাখরচ দর্জ । এই রসিদটা বিক্কিরি করা যায় । কিনে কদজা নেয়া যায় আলুর । শ্যালদা বাজারের কাঁচা ফড়ে, বড়োবাজারের মেড়ো, হিমঘরের মালিক, পঞ্চায়েতের পাঁচুরা সময়মতন রসিদে কোপ মারে । সে এক জবর লড়াই । পার্টিবাবুরাও মারচে আজগাল ।
হ্যাঁ, বলে যান, বলে যান ।
প্যাকেটগুলো ঠিক জায়গায় রাখা, নম্বর লেখানো, মেলানো, এসব আমিই তদারকি করি । পনেরো দিন থেকে মাস খানেক লেগে যায় লোডিঙে । লোডিঙের দুদিন আগে থেকে মেশিন চলে । চেম্বারের তাপ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে নাবিয়ে আনতা হয় । লোডিঙ যেমন-যেমন এগোয়, ভেতরের তাপ বেড়ে সাত ডিগ্রিতে ঠেকে । আলুর বুকের গরুমটা বুঝুন থালে । চা খাবেন নাকি ?
না-না, আগে শেষ করুন ।
হ্যাঁ, কী বলছিলুম যেন ? ও, হ্যাঁ । তাপ বেড়ে গেলে তাকে নাবিয়ে আনতে হবে আবার দেড় ডিগ্রিতে, একটু-একটু করা, টানা একমাস । যদ্দিন আলু থাগবে, বজায় রাখতে হবে দেড় ডিগ্রি । আর্দ্রতা রাখতে হবে পঁচাত্তর শতাংশ । দুঘন্টা অন্তর কমপ্রেশার পাম্প, জেনারেটার চেম্বারের তাপ, বাইরের তাপ চেক করেন অপারেটারবাবু, সুকান্ত যুগি । ওই যিনি তখন মুটিয়াদের কাছ থেকে তামাকপাতা নিচ্ছিল, মোটামতন, জাতে তাঁতি, সিপিয়েম । আলুর দম খাবার সময়ে এই খাটনির হ্যাঙ্গাম কে-ই বা জানতে পারে । বুঝেছি । তারপর ?
মে মাস থেকে আলুর বস্তা বের করা শুরু হয় । চলে সেই আপনার নভেম্বর ওব্দি । শুকোবার ছাউনিতে এনে রাখা থাকে । বীজ আলুকে কুন্তু শুকুলে চলবে না । শুকিয়ে ছোটো-বড়ো ছাঁটাই করে বাছনদাররা । আজগাল অবশ্যি সিঙুর থানার রতনপুরে বিরাট খোলাবাজারে কিংবা আপনার বদ্যিবাটি আর তারকেশ্বর রোডের আড়তে চাদ্দিক থেকে আনা মাল ফেলে বাছাই করাচ্ছে ব্যাপারি । সস্তা পড়ে । বাছনদারদের চাগরি নেই । বাছনদাররা তাই ইউনিয়ান করেচে । তাতে আর কার কী ! অমনেও মরবে এমনেও মরবে ।
জানি । বদ্যিবাটি তারকেশ্বরে গিসলুম । তা ফড়েরা চাষিদের রসিদ কিনে রাখে বলে নম্বর মিলিয়ে ওরা মুটিয়া দিয়ে নিজেরাই মাল বের করায় । চাষিরা মাল ছাড়াতে এলে ওৎ পেতে থাকে ব্যাপারির লোক । হিমঘরে মাল রাখা বাবদ তিন থেকে পাঁচ শতাংশ শুকোবার জন্যে বাদ যায় ।ঔ তা নিয়েও নিত্যিদিন কিচাইন । নভেম্বরের পরেও হিমঘরে মাল পড়ে থাগলে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে । ডিসেম্বরে মেরামত, চালিবদল, ওভারহলিং, কনডেনসার পাইপ পোস্কারের কাজ । নতুন রঙের পোঁচ পড়ে ।
কী, তুমি খাচ্ছ না ? ভবেশকার কথায় নিঃশব্দ গলাখাঁকারি ছিল । চেতনার ঝটকায় জাঙ্গিপাড়া থেকে সোজা শেষপুকুরে পৌঁছে যায় যিশু । সারাতির শেষপুকুর গ্রামে ।
হ্যাঁ, ন্যাকোরচোকর করচিস । বলল খুশিদি ।
কী বলবে ভাবতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হল যিশুর । বলল, তোমরা না চাইলেও ঠিক খুঁজে বের করেছি তোমাদের । বের করতুমই একদিন ।
ময়ূরভঞ্জের রানির কুঠির কাছে ছিল না তোদের বাড়ি । এখুনও চোকে ভাসচে । মনে হচ্চে এই তো সেদিন । সবকিচু পালটে গেচে, না রে যিশকা ?
রানির বাড়ি এখুন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ । আমাদের বাড়িটা একটা কারখানা কে বেচে দিয়ে আমরা তো বহুকাল পার্কস্ট্রিট চলে গেছি ।
তা ভালো করেছ । পার্কস্ট্রিট তো দামি জায়গা, সোনার খনি । ভবেশকার বৈষয়িক মন্তব্য ।
থালা থেকে মুখ না তুলে একের পর এক পদ গিলছিল যিশু । সারা বাড়ি চুপচাপ । ভবেশকার পুঁইডাঁটা চেবানো দাঁতহীন শব্দ । খেয়ে উঠে, কালো রঙের কাঠের চেয়ারের হাতলে তোয়ালে । যিশুর জন্যেই তোয়ালেটা বেরিয়ে এসেছে কাপড়ের গাদা থেকে । মুখ মুছতে গিয়ে আলতো ঘ্রাণ টানে যিশু । হ্যাঁ, জলজ্যান্ত খুশিদির অমোঘ সুগন্ধ রয়েছে এতে, সংস্কৃতির কৃত্রিমতামুক্ত প্রকৃতির গন্ধ ।
তুমি একটু শুয়ে জিরিয়ে নাও । আমি দেখিগে, জালি বণ্ডের খবর পেয়েচি । বলতে-বলতে বাড়ির বাইরে বেরোয় ভবেশকা, খালি পায়ে, গোড়ালি ওব্দি ঝুলে আছে টেরিকটের গেরুয়া আলখাল্লা । পঞ্চায়েতের মাদারির খেল খেলতে যাচ্ছে বোধয় ।