লোহার ভারি কালো চপারটা রোগা লোকটার ঘাড়ের ওপর পেছন থেকে সজোরে পড়তেই, চার ইঞ্চির আঘাতের রেখা-বরাবর, ময়লা চামড়ার তলা থেকে উথলে ওঠে সাদা গোলাপি নরম মাংস, টুটসি সমর সেনার হাসির ঠোঁতের মতন দুফাঁক কাটা জায়গাটা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে গলগলে গরম তাজা রক্তের নিটোল ছররা । বাতাসের ছোঁয়ায় গলে গড়িয়ে পড়ে ছররাগুনো । আক্রান্ত রোগা প্রৌঢ়ের শ্বাসনালিকায় প্রশ্বাস মোচড় দিয়ে ওঠে, বাঁদিকে হেলে পড়ে মাথা, আর দুলদুলে ঘাড় নিয়ে জীবনে শেষ দ্রুততম দৌড়ের নিশিডাক ওকে পেয়ে বসে।

শ্বাস-ফুরন্ত লোকটা দৌড়োয়, সামান্য ঝুঁকে ভীত রাজহাঁসের মতন পা ফেলে পা ফেলে, সাদা টেরিকটের শার্ট জবজবে লাল, দৌড়োয়, দৌড়োতে থাকে, ছোটে, ছুটতে থাকে, পালাতে থাকে । পারে না আর । মৃগি রুগির মতন পড়ে যায় ভোটবাগানে জয়বিবি রোডের ধুলোর ওপর, চিৎ, হাত-পা ছড়িয়ে, সসব্দে, মাঝপথের প্রাচীন ধুলো উড়িয়ে । মুখে ছিট কাপড়ের রুমালবাঁধা আরও দুজন আক্রমণকারী, অপেক্ষারত, বাজারের নাইলন-থলে থেকে বের করে আরও ভারি, কালো, হাড়কাটার চপার । লোকটার ধূসর ট্রাউজার-পরা ঠ্যাং-ছেতরানো দেহে খিঁচুনি উঠে স্হির হয়ে যেতে, রক্ত-চিটচিটে চপার থলের মধ্যে পুরে, তিন দিকে পালাল স্বাস্হ্যবান যুবক খুনিরা ।

কয়েক মুহূর্তের দর্শক, শ্লথ পথচারীরা, প্রথমটায় থ, বিমূঢ়, তারপর ঘটনাস্হল থেকে পালাতে শুরু করে আতঙ্কে । সবাই মুক্ত হতে চাইছিল ঘটনা থেকে খ ঘটনা থেকে বিচ্যূত হবার আরামপ্রদ স্মৃতিতে ফিরে যাবে গলির নাগরিক । এই খুনের চেয়েও তারা ভীত হত্যা-পরবর্তী রাষ্ট্রযন্ত্রের আস্ফালন-নকশায় । ঠেকগুলোর ঝাঁপ বন্ধ করার উদ্বিগ্ন তাড়াহুড়ো, দোকানগুলোর শাটার নাবাবার ঘড়ঘড়, পথের কিনারা থেকে ভিকিরিদের পয়সা তুলে দৌড়ুবার সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলায় ফাঁকা হয়ে যায় জয়বিবি রোড । শুনশান লাশ, একা, চিৎ, পড়ে আছে । হাওয়ায় ফুরফুর করছিল ওর কোঁকড়া কাঁচাপাকা চুল ।

অপঘাতে মরার সময়টাতে মানুষের একা অসহায় দেহ কেমন ন্যালবেলে, হেলে সাপের মতন হয়ে যায়, নিজের চোখে তা দেখল অরিন্দম, অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, দেখল হত্যা, আততায়ী, আক্রান্তকে, চাক্ষুষ, আর গা গুলিয়ে তলপেট থেকে শ্বাসহীনতার ঘূর্ণিবাতাস পেঁচিয়ে উঠে এল কন্ঠনালি ওব্দি, কিন্তু বমি হল না । হাতের চেটোয়, কপালে, ঘাম । অথচ ওই লোকগুলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ওর, অরিন্দমের । ঘটনাটার এ এক জবরদস্তি ।

বছর পঁয়তাল্লিশের সদ্যখুন দড়ি-পাকানো লোকটা , ওইখানে, জয়বিবি রোডে, রক্তেভেজা, ধুলোর ওপরে যে এখুন  হাত-পা ছড়িয়ে স্হির পড়ে আছে, হাঁ-মুখ আর দুচোখ খোলা, অরিন্দমের সামনে দিয়েই একটু আগে টেলিফোন বুথটায় ঢুকতে যাচ্ছিল, দেয়ালে সাইকেল দাঁড় করিয়ে, ঠিক তখুনই, ওফ, লোকটার গলা আর ঘাড়ের মাঝে পেছন দিক থেকে সজোরে কোপ মেরেছিল সবুজ টিশার্ট পরা ষণ্ডা ছেলেটা । চপারের ওপরে ওঠা, বাতাস ভেদ করে নাবা, গদ আওয়াজ, নরম তাঁবাটে চামড়া কেটে মাংসে ঢুকে যাওয়া আর উথলে বেরিয়ে আসা রক্তের ভলক, থমথমে দৃশ্যের ভয়াবহতা, ঘিরে ধরে ওকে । অননুভেদ্য জোঁকেরা ছড়িয়ে পড়ে মর্মস্নায়ুর রক্তজালিকায় ।

সবুজ টিশার্টের বুকে সাদা হরফে লেখা স্লোগানটাও, আততায়ী যখুন চপার হাতে এদিকে ফিরেছিল, দেখে ফেলেছিল অরিন্দম : ‘ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে’।

ওর কবজিতে টান পড়তে, চমকে উঠল অরিন্দম । হুঁশ ফিরে এলো যখুন আদিত্য বারিক ওর হাতে টান মেরে দৌড়ুতে-দৌড়ুতে দাঁতে দাঁত যত আস্তে সম্ভব চেঁচিয়ে জানায়, এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয় অরিন্দমদা, চলুন চলুন, ওই ভদ্দরলোক বালি পুরসভার কমিশনার শামিম মহম্মদ খান । তখুনই আদিত্যের নির্দেশের গুরুত্ব টের পায় অরিন্দম । পর পর চারটে বোমা ফাটার শব্দ হল আর পেছন ফিরে দেখতে পেল অরিন্দম, গন্ধকের নীলাভ-ধূসর ধোঁয়ায় জয়বিবি রোড ধোঁয়াক্কার, আকাশ থেকে বারুদের গন্ধ মেখে নেবে এসেছে ভীতির মশারি । পাঁচ মিনিট আগের গ্যাঞ্জাম রাস্তাটা, অকালপ্রয়াত নদীর মতন উষর । বালি থানার অধীন দুপুরের রোদ্দুর ততক্ষুনে, ওইটুকু সময়ের মধ্যে, সরে গেছে উত্তরপাড়া থানার এলাকায় ।

ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায় হনহনিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা, আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় মিশে যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর ফাঁকে ডান দিকে, এস কে চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, দেখতে পেল গোটা  তিরিশেক লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলেছে ঝাড়পিটের তুমুল । ভিড় চিরে বছর আঠারোর রক্তাক্ত সুঠাম তরুণ ছিটকে বেরোয়, ওদেরচ দুজনের পাশ কাটিয়ে কয়েকপা এগোয় গণপ্রহারে থ্যাঁতলানো দেহ বজায় রেখে, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাস্তার ওপর ।

থ্যাঁতলানো তরুণকে অনুসরণকারী নাগরিকরা, তরোয়াল, ভোজালি, লাঠি, রড, শেকল, বর্শা হাতে ওদের দিকে ছুটে আসতে দেখে, ওরা দুজনে শাটার-বন্ধ  দোকানের সিঁড়িতে উঠে পড়ে । সশস্ত্র নাগরিকরা ওদের সামনে দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মাটিতে কাতরাতে থাকা ছোকরার কাছে । ঝুঁকে দাঁড়ানো মানুষের কালো-কালো মাথার ওদিকে, লাঠি আর তরোয়াল উঠছে-নাবছে দেখতে পায় অরিন্দম । হিন্দি গালাগাল । অরিন্দমের হাতের তালু ঠাণ্ডা আর কপালে বিনবিনিয়ে ঘান ফিরে আসছে । অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতন অনুভূতি হয়, কিন্তু গা গুলিয়ে ঢলে পড়া থেকে ওকে সামলায় আদিত্য । ছেলেটা মরে গেছে নিশ্চই । তবু ওকে পিটিয়ে যাচ্ছে । মৃতদেহকে পিটিয়ে তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা খুঁজছে লোকগুনো । অরিন্দম পড়ে গেছে সেই ভাষার সন্ত্রাসের খপ্পরে ।

তরুণের ন্যালবেলে দেহটা ধরে টানতে-টানতে ওদের সামনে দিয়ে নিয়ে যায় লোকগুনো । পেট ধেকে নাড়িভুঁড়ি ঝুলে বেরিয়ে আছে । এখুনও বোধয় প্রাণ আছে খিঁচোতে থাকা নাড়িভুঁড়িতে । আদিত্য যখুন বলল, এর নাম শেখ হিরা, শামিম খানের বিরোধী দলটার গুণ্ডা, তখুনও অরিন্দম শরীরের অসুস্হতা কাটিয়ে ওঠেনি । ঠোঁটের ওপর থেকে নিজের ম্লান হাসিটুকু জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে জানায়, ইউটোপিয়ার স্বপ্ন বিক্কিরির জন্যে দুর্বৃত্তের দরকার হয়।

বড়ো রাস্তার বাসস্টপে পৌঁছে, বাসে চেপে, বসার জায়গা মিনিট পনেরো পরে পেয়ে, বি-বা-দী বাগে নাবার পরও, অরিন্দমের গলায় শ্লেষ্মার দুঃস্বপ্ন আটকে ছিল । অফিস পাড়ার রাষ্ট্রীয় অভয়দানকারী বহুতলগুলোর ছায়ানম্র চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে, বেশ কিছুক্ষুণ দাঁড়িয়ে, স্বাভাবিকতার আভাস অনুভূত হলে আদিত্যকে বলল অরিন্দম, তুমি পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টার হয়ে পালালে ? তোমার কাজ তো আইন বজায় রাখা, প্রতিরোধ করা, নাগরিকদের আগলানো । ছ্যাঃ, অন্তত কাছাকাছি থানাটাকে খবর দেওয়া উচিত ছিল ।

অরিন্দমদা আপনি তো পুলিশে চাকরি করেন না, তাই উপদেশ ঝাড়াটা সোজা । বিজ্ঞের ধাতস্হ মন্তব্য আদিত্যর । চাকরির এই ক’বছরেই সরকারি অভিজ্ঞতা ওকে মনুষ্যজনোচিত যুক্তিবাদীতে পালটে ফেলেছে । এরকুম হলেও বোধয় একজন লোক মানুষ থেকে ঞানব হয়ে যায় । মানব সন্তান । কলকাতা শহরটা দেশভাগের পর মানব উৎপাদনের কারখানা হয়ে গেছে ।

অভিজ্ঞতা এক ভয়ঙ্কর চিজ, গলার স্বর বদল করে বলল আদিত্য, যত নষ্টের গোড়া ।

ছ-ফিট, দোহারা ময়লা, থ্যাবড়া, আদিত্য বারিকের সঙ্গে অরিন্দমের পরিচয় পাটনা থেকে কলকাতায় অরিন্দমের বদলি হয়ে আসার পর । সাম্প্রতিক জলবসন্তে ওর, আদিত্যর, চেহারা এখুনও খানাখন্দময় । মাদার ডেয়ারির দুধের সরের মতন একপোঁচ হাসি লেগে থাকে পুরুষ্টু ঠোঁটে । গুঁড়ো দুধের জলগোলা হাসি, কথা বলার সময় । ময়লা হলেও জানে আদিত্য, ওর দিদি আর ছোটোবোন ওর গায়ের রঙকে ঈর্ষা করে । অরিন্দমের অফিসে আগে কাজ করত আদিত্য, ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে, আরও শ’চারেক কর্মীর মতন কয়েক নোট এগজামিনার । শুনতেই যা রমরমে । আসলে মজুর আর কেরানি মেশানো দোআঁশলা চাকরি । কলারের বাঁদিকটা নীল, ডান দিকটা সাদা । সে চাকরিতে বেশি মাইনে কম কাজ সত্ত্বেও, আত্মসন্মানবোধের পরিসর, ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ, আর জীবনকে উদ্দেশ্যহীন করা কাঁচা টাকার তাড়ার গাঁট উপরি হিসাবে পাবার সুযোগ-সুলুক না থাকায়, সুযোগ পেতেই আদিত্য পালিয়েছে মনের মতন চাকরির আশ্রয়ে, পুলিশে । ওর আদর্শ রুণু গুহনিয়োগী নামে এক প্রাক্তন অফিসার, যদিও তাঁর সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় নেই, কিংবদন্তি শুনেছে, কাগজে পড়েছে, আদালতে গিয়ে দেখেছে সহকর্মীদের সঙ্গে, জয়ধ্বনি করেছে, যখুন অযথা বিচার চলছিল নায়কোচিত লোকটার । কর্মজীবি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার সক্ষম পায়ের দিকে ।

কয়েন-নোট এগজামিনারের চাকরিতে ওর কাজ ছিল খুচরো ্জন করানো, চটের নানান মাপের বস্তার প্যাকেট তৈরি, থলের মুখ বেঁধে গরম গালার সিলমোহর । চটের রোঁয়া অস্বাস্হ্যকর, নোংরা আর দাম বেশি বলে মোটা পলিথিন চাদরের স্বচ্ছ থলে পরে-পরে চটের জায়গা নিয়েছিল । কেউ যদি পাঁচ-দশ হাজার টাকার এক টাকা বা পঞ্চাশ পয়সা চায়, দিন কাবার হয়ে যাবে গুনে দিতে-দিতে । তাই ওজন করে আগে থাকতে গাঁটরি বেঁধে রাখার ব্যবস্হা । দু-পয়সা পাঁচ-পয়সা উঠে গিয়ে নিশ্চিন্দি । হালকা পয়সাগুনোর জন্যে বড়ো-বড়ো থলেতে একশো টাকা করে খুচরো ভরে রাখতে হতো । অনেজক খদ্দের বাড়ি নিয়ে গিয়ে একটা-একটা করে গুনে ফিরে এসে চেঁচাত, চারটে কম, সাতটা কম, তিনটে কম, আর তাই নিয়ে ফয়সালাহীন নিত্যিদিনের খিস্তি খেউড় । যে রেটে টাকার দাম পড়ছে, দশ কুড়ি পঁচিশ পয়সা আর এক দুই পাঁচ টাকার কয়েন তুলে দিতে হবে বছরকতক পর । হলদে কুড়ি পয়সা তো পাবলিক গলিয়ে অন্য কাজে লাগিয়ে ফেললে । কুড়ি পয়সার কয়েনটাই এক টাকায় বিকোতো । সময় ব্যাপারটা যথেষ্ট হিসেবি ।

কাগজ আর ছাপার খরচ বেড়ে যাওয়ায়, এক দুই পাঁচ টাকার নোট বন্ধ করে ছাড়া হয়েছে কয়েন । কয়েন নেবার পাবলিকের ভিড় তাই এদান্তি বেড়ে গেছে কাউন্টারে । পাবলিকের চাকর হওয়া আর সরকারের চাকর হওয়া যে দুটো এক্কেবারে আলাদা ব্যাপার, তা জেনেছিল আগের খুচরো-গোনার চাকরিতে । তার ওপর প্রথম দিকে চটের রোঁয়ায় কফের, আর পরে পলিথিনের জন্যে চামড়ায়, রোগের অ্যালার্জি হয়ে গিয়েছিল দোহারা আদিত্যর । দিনের পর দিন পাঁচমিশালি-অ্যালুমিনিয়াম মুদ্রার পর্ণমোচী জঙ্গলে ধাতব গন্ধের মাঝে হাঁপিয়ে উঠেছিল ওই চাকরিতে । মাখা ভাতে ওব্দি দোআঁশ ধাতুর অম্লকষায় স্বাদ চারিয়ে যেত হাতের তালু থেকে । যখুন ওই চাকরিতে ঢুকেছিল, তখুন সত্যিসত্যি বিশাল ওজনপাল্লায় কিলি-দশকিলোর বাটখারা চাপিয়ে মাপা হতো কয়েনের থলে । পরে এসেছিল ওজনের ইলেকট্রনিক মেশিন । আদিত্যর মনে হতো, অর্থনীতিতে স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম । অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করাবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর-প্রাপক স্নাতক । অসাধারণ স্হাপত্যের বহুতলগুনোয়, সারা দেশজুড়ে, স্নাতকরা এমনতর মাশুল গুনে যাচ্ছে পড়াশুনোয় ভালো বা অন্ত্যজ হবার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে । ইশকুল-কলেজের জ্ঞান বোধয় কারুরই বিশেষ কাজে লাগে না ।

কয়েন বিভাগে কাজ করার আগে নোট বিভাগেও কিছুকাল ছিল আদিত্য । সে আরও ভয়ঙ্কর । মাথা-খারাপ হবার যোগাড় । কাজ ছিল টাটকা নোট আর পচা নোট আলাদা করার, একশোটা ভালো আর একশোটা পচা নোটের প্যাকেট তৈরি, দশ প্যাকেটের বাণ্ডিল, ভালোর আলাদা পচার আলাদা, পচা নোটে গোল-গোল চাকতির মতন মেশিনে ফেলে কয়েকটা ছ্যাঁদা করানো, ভালো নোটগুনোকে জনগণের ব্যবহারের জন্যে আবার পাঠানো, আর ছ্যাঁদা করা নোট চটের বস্তায় সিলবন্দি করে চুল্লিতে পোড়াবার জন্যে তুলে রাখা । পরে অবশ্য নোট কুচোবার আর তা থেকে মণ্ড বানাবার যন্ত্র এসেছিল বিদেশ থেকে । এক-দুই-পাঁচ টাকার নোট উঠে গিয়ে রেহাই হয়েছে । ওফ, ওই ছোটো নোংরা হিলহিলে স্যাঁতসেতে ছাতাপড়া নোট গোনা, শেষই হতে চাইত না ।

একটা পচা নোট কাছে থাকলে সেটা লোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি পেতে চায় । যাহোক-তাহোক খরচ করে ফেলতে চায় । দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক নষ্ট করে । দেশের যে অঞ্চল যত গরিব, সে অঞ্চলে চলে তত পচা নোট, নানা কায়দায় জোড়া নোট । কেমন নোট চলছে দেখে একটা অঞ্চলের আর্থিক অবস্হা টের পাওয়া যায় । অর্থনীতির সিলেবাসে পড়ানো হয়নি এসব । অভিজ্ঞতার লাথি খেয়ে শিখেছে ।

সেরকম অজস্র নোটের মাঝে বসে যৌবন খরচের চাকরি । আকাশে তখুন হয়তো বসন্ত ঋতুর স্নেহভাজন বকদম্পতিরা বেরিয়ে পড়েছে বাৎসরিক আমোদের জোড়ে-জোড়ে ; লালদিঘিতে পরকীয়া জলে ভাসছে বংশ-গৌরবহীন মাছ-যুবক, বা মহাকরণের চূড়োয় রাগতস্বরে আরম্ভ হয়ে গেছে বৃষ্টি, ছাড়া পেয়েছে ক্রিকেটশেষ ইডেনের সবজান্তা গড্ডলিকা, কিংবা গাড়ি পার্ক করার এলাকায় চলছে ঝড়ে গাছেদের হাওয়ার সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি, কিংবা কাঠকয়লার আঁচের পাশে ঞাঝে-মাঝে টুসকি বাজিয়ে ফেলছে তাম্রশ্মশ্রু ভুট্টা । প্রকৃতি সুযোগ পেলেই শহরকে গপঅমে পালটে ফেলতে চায় । চারশো যুবক-যুবতির দেখা হয় না কিছুই ।

ওই বিভাগে বয়স্ক কাউকে দেখেনিকো আদিত্য । সবাই তরতাজা যুবক-যুবতি । পচা, হিলহিলে, স্যাঁতসেতে, ছাতাপড়া, তেলচিটে, নোংরা নোট গুনে চলেছে আনকোরা ধোপদোরস্ত যুবক-যুবতি, সুদর্শন ও সুশ্রি যুবক-যুবতি, মাথা নিচু করে, প্রাব চুপচাপ, দিনের পর দিন, দুপুরের পর দুপুর । আর কোনো কাজ নেই তাদের । ঘাড় গুঁজে নোটের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাওয়া, ধান রোয়ার মতন । একটা বিরাট অট্টালিকার মধ্যে তারা হাসি মুখে টিফিনের ডিবে হাতে প্রায় নাচতে-নাচতে ঢুকছে, নোট গুনছে বাণ্ডিলের পর বাণ্ডিল, বেরিয়ে আসছে গোমড়া কীটদষ্ট চেহারায়, বাড়ি যাচ্ছে কালকে আবার একই ঘানিতে পাক খাবে বলে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-ভালো সব স্নাতক । ইশকুলে অনেকে প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছিল রাত জেগে, বাড়ি থেকে জ্যোতি ছড়িয়ে হয়তো আহ্লাদিত করেছিল সারাটা পাড়া ।

এখুন তারা কেবল গণছোঁয়ায় বিরক্ত নোট মুখ বুজে গুনে যায় । মাঝে-সাঝে নিশি পাওয়া অবস্হায় তারা বেরিয়ে পড়ে দলবেঁধে পথসভা গেটসভা ঘেরাও ধর্না হরতাল ধিরেচলো বয়কট কর্মবিরতি অবস্হান অবরোধের ডাকে । প্রশ্ন তোলার জাগরুকতা আর নেই । পরের দিন থেকে ফিরে গেছে তারা স্বয়ংক্রিয় কাজে । পুরো ব্যাপারটা আদিত্যর মনে হয়েছিল ভুতুড়ে । ভালো মাইনে দিয়ে ভুত বানাবার কারখানা ।

পচা ছ্যাতলা-পড়া নোটের বদগন্ধের কী রমরমা । যত কম টাকার নোট, তত তার বদগন্ধ । পৃথিবীতে এরকুম গন্ধ যে জন্মাতে পারে, মানুষের হাতে-হাতে ঘুরে-ঘুরে যোগাড়-করা দুর্গন্ধ, অমন চাকরি না করলে অজানা থেকে যেত । একটা পচা নোট আলাদা করে শুঁকলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায় না । অথচ কয়েক হাজার পচা নোট একজোট হলেই প্রকাশিত হয়, দেশটার পীড়ার অভিব্যক্তি, হেমন্তের শুকনো পাতার সঙ্গে মেশানো গুয়ের গন্ধ । দেশটার সংস্কৃতি কতটা পচেছে তা বোধয় ওই গন্ধ থেকে টের পাওয়া যায় । মুমূর্ষ গন্ধটা থেকে ছাড়ান পাবার জন্যে আদিত্য তখুন বুশশার্টের বগলে বিদেশি পারফিউম লাগাত ।

আড়াই লক্ষ স্নাতকের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আদিত্যকে নিয়ে আরও উনিশজন ওই চাকরিটার পরীক্ষায় সফল হয়েছিল । অথচ সেই চাকরিতে তিতিবিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে ও । শালা বেনের আড়তে চাল ডাল গম আটা ওজন করার মতন ভারি-ভারি বাটখারা চাপিয়ে চকচকে মুদ্রা ওজন করানোর চাকরি । প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন রোজরোজ রোজরোজ রোজরোজ, ছ্যাঃ । এখুন না হয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রে ওজন হয় । কিন্তু তখুন তো ঝুল-চাকরিতে জান একেবারে শ্মশানকয়লা হয়ে গিয়েছিল ।

অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টারের চাকরি পেয়ে নিজেকে সুগন্ধিত করে তোলার অভ্যাসে কিছুটা রদবদল করেছে ও, আদিত্য ।  এখুন ও জনসনের বেবি পাউডার, বাচ্চাদের সাবান-শ্যাম্পু, শিশুদের ক্রিম আর অলিভ অয়েল ব্যবহার করে । আগেকার এক আই জি, এখুন অবসরপ্রাপ্ত, দুটো কারখানার মালিক, শিখিয়েছিলেন জীবনদর্শনটা । নিষ্পাপ থাকার নিজস্ব গন্ধ আছে, বুঝলে হে, পুলিশ অফিসারের উচিত সেই গন্ধটাকে সবচে আগে দখল করা । ফি-বছর পুজোয় অধস্তন অফিসারদের জন্যে শিশুদের ব্যবহার্য সাবান পাউডার ক্রিম শ্যাম্পুর সারা বছরের কোটা উপহার পাবার ব্যবস্হা করে দিতেন উনি । ওঁর বাবা তো এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে, কিন্তু কত উন্নতি করেছেন । রিজেন্ট পার্কে জবরদখল-করা জমিতে প্রোমোটারকে দিয়ে কী পেল্লাই এক-একখানা ফ্ল্যাট পেয়েছেন ওনারা তিন ভাই । প্রায় সব উদ্বাস্তু নেতারাই আজ কোটিপতি । উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, এই এলেম বেচেই লালে লাল হয়ে গেল কত লোক । তারা কেবল টাটকা করকরে নোট গুনছে । আসল উদ্বাস্তুগুনো ফুটপাতে হকারি করছে আজও ।

আদিত্যর এখনকার উপরি-দামি চাকরিটা মাঙনায় হয়নি । দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল । বাড়ি বয়ে একজন প্যাংলা ডাকমাস্টার জানিয়ে গিসলো কার সঙ্গে কখুন কোথায় দেখা করলে চাকরিটা হবে । ডাকমাস্টারহীন বাঙালিসমাজ ভাবা যায় না । এরা থানার জন্যে টাকা তোলার অঞ্চলভিত্তিক ঠিকেদারি নেয় । পুলিশে ঢোকার আগে জানতই না আদিত্য যে তথ্য আর সংস্কৃতির এরা বাঙালি জীবনের চাবিকাঠি ।

সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টের রাত্তির বারোটার পর থেকে খর্চাখরচ না করলে, এমন কী ক্ষমতাধারী স্বজনজ্ঞাতি থাকলেও, সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন । তারপর ফি-বছর বেড়েছে খর্চাখরচের হার । আর আদিত্য তো জন্মেছে তার পঁচিশ বছর পর, রজতজয়ন্তীর রাত্তিরে, বর্ধমান জেলার মামার বাড়িতে । কর্মসংস্হান কেন্দ্র থেকে নাম সুপারিশ করাতে লেগেছিল হাজার পাঁচেক, পার্টির তদবির সত্ত্বেও, নইলে বেশি লাগত আরও । ডেসপ্যাচের কেরানিকে কিছু না দিলে চিঠি ছাড়ে না, কিংবা পাঠিয়ে দেয় ভুল ঠিকানায় । কর্মসংস্হান কেন্দ্রের চিঠি দেখে পোস্ট অফিসে দেরি করে সরটিং করবে । আদিত্য প্রতিটি ধাপকে মসৃণ রেখেছিল, করকরে তাজা নতুন নোট দিয়ে, যার আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে প্রাপকের মুখ । অপার বৈভব গড়ে তুলতে চায় ও, আদিত্য । নইলে ওর মতনই, ওর ছেলেপুলে নাতিদের, বনেদি ঘরের ছেলে বলে স্বীকৃতি দেবে না কেউ ।

আদিত্যর ঠাকুদ্দার জন্ম উনিশশো পাঁচ সালের ষোলুই অক্টোবর । সেদিন কিছু একটা হয়েছিল বলে পরিবারের স্মৃতিতে ঢুকে আছে তারিখটা । সবরমতী আশ্রমের দরোজা-জানলা বানাবার জন্যে ঠাকুদ্দা গিসলো নিজের বাবার সঙ্গে । অনেক যত্নে বানিয়েছিল দরোজাগুনো । গান্ধি মহারাজ নিজে বলে দিয়েছিলেন যে দরোজাগুনো এমন হবে যে কেউ খুললেই ক্যাঁচোওওওর আওয়াজ হবে, যাতে কেউ ঢুকলেই টের পাওয়া যায় । গল্পটা আদিত্যদের পারিবারিক সম্পত্তি । গান্ধি ইয়েরভাদা জেলে গেলে, নিজের গ্রাম ধর্মশিবপুরে ফিরে এসেছিল ঠাকুদ্দা। উনিশশো উনত্রিশের জানিয়ারিতে বাবার জন্ম ।

আওয়াজঅলা দরোজা বানাবার দরুন বাবু জগজীবন রাম ঠাকুদ্দার জন্যে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মাসোহারার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন । লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিল, এরকমটাই লেখা ছিল প্রমাণপত্রে । আদিত্যরা তো ছুতোর, তত নিচু জাত তো আর নয়, তাই জগজীবন রামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে হয়েছিল । আজকাল অমন প্রণামে কোনও কাজ হয়না । প্রণামী চায় সবাই, আদিত্যও চায় ।

লেখাপড়া শেখেনি ঠাকুদ্দা । কংরেস সভাপতি ভূপেন বোস পাঠিয়েছিলেন সবরমতীতে ছুতোরের কাজে । ঠাকুদ্দা কিন্তু দূরদর্শী ছিল বলতে হবে । স্বাধীনতা সংগ্রামীর মাসোহারার টাকায় নিজের আর একমাত্র নাতি আদিত্যর নামে যৌথ রেকারিং ডিপোজিট খুলেছিল । পুলিশে চাকরির শুভ কাজে লেগে গেল চক্রবৃদ্ধি । নয়তো অত থোক টাকা একলপ্তে কয়েক বিঘে জমি বেচলেও উঠত না । গান্ধির সঙ্গের লোকজনদের পায়ের কাছাকাছি থেকে, ঠাকুদ্দা বোধয় টের পেয়ে গিসলো অনেক আগেই, যে দেশটা ভাগ হবে, আর তার দরুন বাঙালিরা এক ধাঁচের বামপন্হী হবে । তাই জন্যেই হয়তো বাবাকে ইনডিয়ান প্রলেটারিয়ান রিভলিউশানারি পার্টির বিজয় মোদকের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটার কাজে লাগিয়েছিল দশ বছর বয়সে ।  অত বড়ো-বড়ো মানুষের চোপরদিনের গুজগুজ-ফিসফিসের কাছাকাছি থাকার চাপে ওদের পরিবারটা ভদ্দরলোক হতে পেরেছে আর ছুতোর শ্রমিক বদনামটা ঘুচেছে ।

নোট গোনা আর কয়েন ওজন করার চাকরিতে, মনে হত আদিত্যর, রোজ কিছু-কিছু সরিয়ে গড়ে ফেলা যাক ধনী হবার তহবিল । কিন্তু ধরা পড়ার কেলেঙ্কারির গ্রাম্য ভয়ে, আর যারা অমন কাজ করে ধরা পড়েছে তাদের এনস্হা দেখে, বাতিল করেছে সে ভাবনা । তাছাড়া তাতে লেগে যেত অনেককাল । রোজ দুটো-চারটে একশো-পাঁচশো টাকার নোট সরালেও বহু বছর লেগে যেত ভৈভবশালী হতে । শুধু টাকা হলেই তো হয় না, সেটাকে খাটিয়ে-খাটিয়ে ফাঁপাতে হয় । এ এস আই এর চাকরিটা ধর্মঠাকুরের পাঠানো । টাকাও আপনা থেকে আসতে শুরু করেছে তাঁর কৃপায় । ধর্মরাজের কৃপায় একদিন-না একদিন রুণু গুহনিয়োগীর মতন প্রভাব-প্রতিপত্তি লোকবল ঐশ্বর্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর গণমাধ্যমের আদরযত্ন পাবে । বাসের সিটে বসে হাতজোড় করে আদিত্য । কপালে ঠেকায় ।

সত্যি, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ ছাড়া আর গতি নেই, যেভাবে চালাচ্ছিল গাড়িটা, বলতে-বলতে বাস থেকে নাবলেন ফর্সা মোটা গলদঘর্ম গৃহবধু কেরানি । সওদাগরি অফিসে এত বেলায় হাজিরে দিলে চাকরি চলে যাবে । নির্ঘাৎ কোনও জনসেবা বিভাগের ।

বি-বাদী বাগে বাস থেকে নেবে একটু এগোতে, এক হাড়-ডিগডিগে শতচ্ছিন্ন্ ভিকিরে বউ, কাঁখে পেটফোলা রুগ্ন শিশু, বোধয় ব্রিগেডের কোনো গ্রাম-ফোসলানো সমাবেশে এসে থেকে গেছে কলকাতায়, ওদের দিকে অনুকম্পা চাইবার হাত বাড়াতে, আদিটভ পাঁচশো টাকার একটা নতুন সবুজ নোট বুক পকেট থেকে বের করে ভিকিরি যুবতীর হাতের ওপর রাখলে, বউটি বলে ওঠে, পাকস্হলী থেকে নিজের দরদ টেনে বের করে আনা কন্ঠস্বরে, লটারির টিকিট লিয়ে কী করব বাবু ? কিছু পয়সা দাওনা ক্যানে, মেয়্যাটা মুড়ি খায় । আদিত্য বইটির হাত থেকে নোটতা তুলে নিয়ে ফুলপ্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো খুচরো ভিকিরিটিকে দিলে, যুবতীর হনু-ঠেলা মুখমণ্ডল কৃতজ্ঞতায় উদ্ভাসিত হল ।

আদিত্যর অট্টহাস্য আর অরিন্দমকে শুনিয়ে স্বগতোক্তি, ওফ, এই নিয়ে বোধয় একশোবার হল ।

অরিন্দম স্তম্ভিত, হতবাক, থ ।

কী, খুব হাসি হচ্ছে দেখছি । ধর্ষণ-টরশন আজকাল কোটা অনুযাবী ভালোই চলছে তাহলে ! অফিসপাড়ার ভিড়ে, পরিচিত কন্ঠস্বরের মন্তব্যে, দুজনে একসঙ্গে সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, যিশু বিশ্বাস, শেষ যৌবনে খুদে চোখে মিটিমিটি, ফর্সা গোলগাল, চুল অত্যন্ত পরিপাটি, ভ্যান হিউসেন, অ্যালান সলি, লুই ফিলিপে, বেনেটন, অ্যাভাই, রেভলন, রে ব্যান জগতের অধিবাসী । খ্রিস্টান, কিন্তু টের পেতে দেয় না । ব্রাহ্মরা যেমন হিন্দুর ভিড়ে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে আজকাল, যিশুও তাই । মিশুকে । ব্রাহ্মরা নিজেরা একসঙ্গে জুটলে হিন্দুদের নিয়ে এখুনও রেনেসঁসি হাসাহাসি করে । যিশুর অমন জমায়েত নেই । পুলিশে চাকরি করে বলে আদিত্যকে ঠেস দিয়ে বলেছিল কথাগুনো । অরিন্দমের অফিসে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ছিল । এখন পার্কস্ট্রিটে নিজের ফ্ল্যাটে কনফারেনসিং যন্ত্র বসিয়ে আন্তর্জাতিক কনসালটেনসি খুলেছে । আহমেদাবাদের এম বি এ । বিদেশে যায় প্রায়ই । অকৃতদার বলতে যে নৈর্ব্যক্তিক স্ফূর্তি আর আত্মমগ্ন অস্হিরতা । পাতলা ল্যাপটপ কমপিউটার আঁটে এমন ব্রিফকেস ।

বড্ডো খোঁচা দেন যিশুদা । আদিত্যর তরফদারি করে অরিন্দম ।

আর আপনার আলুর দোষ তো বিখ্যাত । যিশুর মন্তব্যের প্রতিদানে আদিত্য ।

যিশু বিশ্বাস অনভিপ্রেত যৌন টিটকিরিতে অভ্যস্ত । হাসল কাঁধ নাচিয়ে । বললে, ঠিক ধরেছিস । মেদনিপুর বাঁকড়ো বর্ধমান গিসলুম হিমঘরের স্টাডি করতে । এখুন বারাসাত থেকে ফিরছি । আলু সম্পর্কে আমার সত্যিই দুর্বলতা আছে । মাছ মাংস ডিমের চেয়ে আমার আলু খেতে ভাল্লাগে । কলেজে পড়তুম যখুন, প্রফুল্ল সেন আলুর বদলে কাঁচকলা খেতে বলেছিল । তোরা তো সেসব জানিস না, লিকুইড ছিলিস । পয়লা জুলাই বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে বিদেশে হাওয়া হয়ে গিসলো, আর প্রথম ট্র্যামটায় ভবেশকাকা আগুন ধরিয়ে দিলে ।

ভবেশ কাকা ? এই কাকার কথা বলেননি তো আগে ? সমস্বর প্রশ্ন ।

হ্যাঁ, ভাবতে পারিস ? স্বাধীনতার পর কলকাতার ট্র্যামের প্রথম মুখাগ্নি । আমরা তখুন নাকতলার কাছে থাকতুম । অ্যাতো গরিব রিফিউজিতে ভরে গিসলো ওদিকটা তখুন যে কলকাতার লোকে ভয়ে ও-মুখো হতো না । বাবাও ভয়ে বেচেবুচে এদিকে চলে এল । পুরোনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশান কাইউনসিলের আগুন-খেকো নেতা ছিল ভবেশ মণ্ডল, ইয়া মাসকুলার বডি । পাকানো পেশি বলে একটা কথা আছে না ? ঠিক তাই । বাড়িতে না বলে কত্তো মিটিঙ-মিছিলে গেছি ওনার সঙ্গে । কিন্তু বুঝলি, ভবেশকাও একদিন ছোটো বোনকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল ।

যিশু থামে । চুপচাপ। বাকিটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে দুজনে । এবার হুগলি জেলায় গিয়ে খুঁজে পেলুম ওদের, আশ্চর্য, তিরিশ বছর পর । কথাগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে ম্লান উদাসীনতা ছেয়ে যায় যিশুর ফর্সা মুখমণ্ডলে ।

গল্পের আশানুরূপ সমাপ্তি না পেয়ে আশা পুরণের অন্য এক গল্পের দিকে যিশুকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে আদিত্য । বলে, রাইটার্স থেকে কেটলিসুদ্দু একজন কালো সুন্দরী চা-উলিকে নাকি ফুসলিয়ে নিয়ে গিসলেন ? তাও কিশোরী !

তাতে কী ? আরে ! মেয়েমানুষ মানেই ওসব নাকি ? সস-শালাহ ! তোকে ওই ট্র্যাফিক সার্জেন্টটা বলেছে, না ? নির্মল বেরা না কি যেন নাম ? আচ্ছা চলি ।

হত্যা আর মৃত্যু থেকে যৌনতার এলাকায় খেলাচ্ছলে পৌঁছে উপশম হল অরিন্দমের । থেকে-থেকে হত্যার দু-দুটো দৃশ্য পুনরাভিনীত হচ্ছিল ওর মগজের মধ্যে । যা ভালো, তার চেয়ে যা খারাপ, তা বেশি করে মনে পড়ে। আধুনিকতা মানুষকে প্রকৃতি থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে সংস্কৃতিবান বানিয়ে ফেলার পর তাকে নির্মমতার ওপারে অন্য কোনও মমতাহীনতায় পৌঁছে দিয়েছে । স্পষ্টই টের পাওয়া যাচ্ছে যে আদিত্যও পৌঁছে গেছে সে জায়গায় । কত সহজে খুনের আতঙ্ক থেকে নিজেকে যৌনতার আমোদে নিয়ে এলো ।

পাটনা থেকে কলকাতায় এসে নিজের গাড়ি নিয়ে সরকারি ঝুটঝামেলায় পড়ার পর আদিত্যর সঙ্গে অরিন্দমের পরিচয় । রাস্তার প্রায় মাঝকানে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল এক ব্যাটা নিরক্ষর । যারা কলকাতার আদিনিবাসী নয় তারা এই শহরের ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ক্যারদানি অবলম্বন করে । বারদুয়েক হর্ন দেবার পর লোকটা সরে যাবে, ভেবেছিল অরিন্দম । সরেনি । ধাক্কাও লাগেনি লোকটার । রাস্তঅব পড়ে দুমড়ে-কুঁকড়ে আহত হবার অতিঅভিনয় করতে লাগল, হাতে খবরের কাগজ ধরা । নিখুঁত । আদিটভ পরে খোঁজ নিয়ে জানিয়েছিল যে লোকটা কোনো এক গ্রুপ থিয়েটারে কিশোর মালোর চরিত্রে অভিনয় করে, চাকরি নেই, দুই মেয়ে এক ছেলে আছে । আজকাল অমন পথনাটিকায় যাহোক রোজগারপাতি করে সংসার চালায় ।

লোকটা  পথনাটিকা আরম্ভ করতেই গোটা আষ্টেক ষণ্ডা পৌঁছে গেল ওর সাহায্যের জন্যে । বাঙুর হাসপাতালে তো মেঝেতে শোবার ওব্দি জায়গা জোটে না রুগিদের ; দুর্ঘটনায় মাথা ফাটলে ব্রেন স্ক্যানিঙের তারিখ পাওয়া যায়  সাত মাস পর । ও ব্যাটাকে অরিন্দমের গাড়িতে তুলে ষণ্ডাগুনো নিয়ে যেতেই বেড পেয়ে গেল । সঙ্গের স্যাঙাতদের কি খাতির । তারপর ওদের সঙ্গে থানায় যেতে গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে নিলে ওসি । থানাতেও কি খাতির ওদের । পরের দিন থানার সামনে ফুটপাত ঘেঁষে নানা গাড়ির কঙ্কালের মাঝে রাখা গাড়িটা পরখ করতে গিয়ে দেখে ওয়াইপার, ব্যাটারি, এসি উধাও ; চারটে চাকাই পালটে টাকপড়া পুরোনো টায়ার লাগানো । আচমকা, ছাঁৎ করে, রক্তের চলকানির মাঝে মনৈ হয়েছিল অরিন্দমের, ওর পূর্বপুরুষদের এই পশ্চিমবঙ্গটা আর ওর নয় ।

অফিসে শলা-পরামর্শ-উপায় খুঁজতে গিয়ে , লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাব ইন্সপেক্টর আদিত্য বারিকের হদিস পেয়ে, গাড়িটা ওই অবস্হায় ছাড়িয়ে এনেছিল রেকার দিয়ে টো করে । আর কদিন থাকলে মেশিনটাও পালটে যেত । কিশোর মালোর চরিত্রাভিনেতাকে আর থানায় খর্চাখরচ দিতে হয়েছিল মোটারকুম । আদিত্য বলেছিল, এসব মেনে নিতে, সব্বাই মানে, মেনে নিলে অসুবিধে হবে না । মেনে নিয়েছে অরিন্দম । মেনে নিয়েছে জনসেবার নতুন সংজ্ঞা । বহুকাল পাটনা শহরে থাকার ফলে অন্যায়, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, যথেচ্ছাচার, সন্ত্রাস মেনে নেওয়াটা রপ্ত করে ফেলেছে ও । কিন্তু পাটনায় সবই ছিল রাখঢাকহীন, খোলাখুলি । কলকাতায় সরকারি দফতরগুনোয় সবাই সততার মুখোশ পরে থাকে । মুখোশটার নাম হয়েছে সংস্কৃতি ।

আজকে আদিত্যকে নিয়ে ভোটবাগান গিসলো পাটনা থেকে ওর সঙ্গে আসা রসিক পাসওয়ান নামে পাটনা অফিসের এক চাপরাশির খোঁজে । গাড়িটা পাটনায় অসীম পোদ্দারের বাবার কাছ থেকে কিনেছিল অরিন্দম । চালিয়ে কলকাতায় এনেছিল ওরা দুজনে, ও আর রসিক পাসওয়ান । অরিন্দম এক রাত্তির কোন্নগরে বাপ-পিতেমোর ভিটেতে থেকে গিসলো আর রসিক চলে গেসলো হাওড়ায় ওর গ্রামতুতো জ্ঞাতির আস্তানায় । সে আজ দেড় বছরের বেশি হল । অরিন্দম তো এরই মধ্যে এক বছরের জন্যে ম্যানিলায় ট্রেনিঙে গিয়ে ফিরে এসেছে । অফিস পাঠিয়েছিল । এতদিন হয়ে গেল অথচ ফিরে গিয়ে অফিসে যোগ দেয়নি রসিকটা । আশ্চর্য । কদিন আগে পাটনা থেকে মোতিলাল কুশবাহা এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে, ভোটবাগান অঞ্চলে রসিকের খোঁজ করার জন্যে । হাতের লেখা দেখে মনে হয়েছিল অতনুচক্রবর্তীর । সম্বোধন করেছে কমরেড । কেউ কমরেড বলে ডাকলে যে মনে-মনে এরকুম অস্বস্তি হতে পারে, আগে ঠাহর করার সুযোগ হয়নি অরিন্দমের ।

সেই অতনু, সে মাওবাদি কমিউনিস্ট সেন্টার নাকি এম এল লিবারেশানের নেতা, আত্মগোপনের সমাজে থাকে এখুন । এককালে পাটনা অফিসে কয়েক-নোট এগজামিনার ছিল মুখচোরা অতনু । গাড়ি চালিয়ে আসার সময়ে নিয়ে গিসলো রসিক, হাজারিবাগের জঙ্গলে, নিখোরাকো খেতমজুরদের ছেলেমেয়েদের গণবিবাহে । মাও-এর লেখা রেডবুক থেকে পড়ে-পড়ে সে-কথাগুলোকেই মন্তর হিসেবে আওড়ে বিয়ে দিচ্ছিল । বেয়ের পরই ভিড়ের সুযোগে অন্ধকার জঙ্গলে উধাও । কথা হয়নি । এড়িয়ে গিয়েছিল অরিন্দমকে । বিহারি হতদরিদ্র অন্ত্যজদের বাঙালি ব্রাহ্মণ নেতার সঙ্গে মেলাতে বিভ্রান্ত বোধ করেছিল অরিন্দম ।

ভোটবাগান অঞ্চলটা সুবিধের নয় শুনে আদিত্যকে সঙ্গে নিয়ে গিসলো অরিন্দম । ওখানে এশিয়ার সবচে বড়ো লোহার ছাঁটের স্ক্র্যাপইয়ার্ড । সারসার খুপরি ঘর । অনুজ্বল শ্যামবর্ণ নর-মরদদের পাঁচমিশালি ভিড় । হলদে কমজোর টুনি । জেনারেটারের চাপাকান্না । অশীতিপর পাঁক । মাইকচোঙে পাঁচ-প্রহর লটারি । লোহার কালচে ছাঁট আর ভাঙা-ত্যাবড়ানো লোহার মরচে-পড়া ঠেক । এলাকাটা জুড়ে তেলকালির নড়বড়ে চোগা পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কারখানার সারিসারি ঢাঁচা । পুরো জায়গাটা  মনে হয় নারী-বিবর্জিত । ছাঁট আর লোহাটুকরোর সাম্রাজ্যের দখল নিতে শেষ হয় না গান্ধী, গোলওয়লকর, মার্কসের কুলাঙ্গারদের কাজিয়া । ডোম বাগদি দুলে বর্ণাশ্রমের জেল ভেঙে স্বাধীন হবার পর, আধুনিকতার উন্নতি তত্ত্বের সাহায্যে বর্ণাশ্রম গড়ে ফেলেছে গামা রসগুল্লা মুন্না কওসর সীতারাম ড্যানি শেখ হিরার প্রজন্ম । ভেবে, রোঁয়ায় আতঙ্ক খেলে যায় অরিন্দমের । এ-ই তাহলে বঙ্গসংস্কৃতি ।

হাওড়া জেলার ভোটবাগানে যেমন লোহার ছাঁটের বাবরি, তেমনি নদীয়া জেলার কালীগঞ্জে কাঁসা-পেতলের ভাংরি ।  সুইস ডেভেলাপমেন্ট কোঅপারেশানের আর্থিক সাহায্যে কাঁসা-পেতল কারিগরদের স্টেনলেস স্টিলের শ্বদাঁত থেকে বাঁচানো যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখতে অরিন্দমকে পাঠিয়েছিল অফিস । যাদের পয়সাকড়ি আছে তারা আজকাল স্টেনলেস স্টিলে খায় । যাদের অঢেল পয়সা তারা খায় লা-ওপালা কাঁচে । গরিবরা এনামেল ছেড়ে ধরেছে অ্যালুমিনিয়াম । রুজি-রোজগার বন্ধ হবার পর কাঁসারিরা ভিটে ছেড়ে চলে গেছে, কাঁখে কোলে বাচ্চা-বোঁচকাসুদ্দু, কৃষ্ণনগর শান্তিপুর নকাশিপাড়া কালনা মেমারি পাণ্ডুয়া চুঁচড়ো । রাস্তার পাশে খুপরি-দোকানে, কোণে-কোণে দড়িবাঁধা প্লাসটিক চাদরের তলায় হাড়গিলে হাঁটুমুড়ে বসে থাকে তারা, উশকো-খুসকো উদাসীন ঘোলাটে চোখে, স্টোভ কুকার গ্যাসের উনুন সারাবার খদ্দেরের জন্যে । তার ওপর ফুটপাতে বসলেই পুলিশের ডাকবাবু আর পার্টির হাঁকবাবুকে ফি-হপ্তায় কিছু তো অন্তত দিতেই হবে ।

মাটিয়ারি গ্রামের সুভাষ খামরুই অরিন্দমকে শুনিয়েছিল সেনকিট হ্যাজাকের গল্প । ব্রিটিস আমলে কালীগঞ্জ থানার মাটিয়ারির হ্যাজাক কব্জা করে ফেলেছিল কলকাতা ঢাকা কটক লখনো চাটগাঁ । বরযাত্রীরা ফিরতে পারত না সেনকিট হ্যাজাকের জ্যোৎস্না ছাড়া । বিজলিবাতি এসে খেয়ে ফেলল হ্যাজাকসুদ্দু কাঁসারিদের খ মোরাদাবাদের কাঁসারিরা বাজার বুঝে মাল পালটে ফেলেছে । সেখানে তো কাঁসারি বাড়ির ছেলে ইন্দিরা গান্ধীর সুন্দরী নাতনিকে বিয়ে করেছে । এখানে দ্যাখেন খামরুইরা বাপ-পিতেমোর কাজ নুকোতে কোর্টে হলফনামা দিয়ে পদবি পালটে ফেলছে ।

মাটিয়ারি ধর্মদা মুড়াগাছা সাধনপাড়ার কারিগরদের আর বিদিশি ডলার যুগিয়েও বাঁচানো যাবে না । কাঁচামাল নেই, কাজের সময়ে বিজলি নেই, জেনারেটারের খরচ, রোলিং শিট মেশিনের এস এস আই রেজিস্টারি বন্ধ । ভাংরি দেখলেই উপরির খোঁজে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বিয়েসেফ শুল্কবাবুরা । থানার ডাকমাস্টারের টোকেনে কারখানাগুলান লাটে । তার ওপর বিক্কিরির টেসকো । কেঁদে ফেলেছিল নরহরি বর্মন, ছাপ্পান্ন বছরের দশাসই । কান্না শোনার, চোখের জল মুছে দেবার, লোক নেই । কাঁসা ভাঙলেই, বললে নরহরি কাঁসারি, নুকোনো কান্না বেরোয় গো ।

পাটনা অফিসের সেই সুন্দরী দেখতে মানসী বর্মন, ফোলা-ফোলা আঙুলে টরটরিয়ে নোট গুনত ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে, হঠাৎ চলে গিয়েছিল চাকরি ছেড়ে, অরিন্দমের কলকাতা বদলি হবার ঠিক আগে । ও কি কাঁসারি ছিল ? ওর তো প্লেস অব ডোমিসাইল নদীয়া জেলার কালীগঞ্জে । অমন নয়নাভিরাম আঙুল । মনে হত যেন জ্বরের রুগির কপালে রাখা ছাড়া আর কোনও কাজের জন্যে নয় হাত দুটো । নোট গুনে-গুনে কী ক্ষমাহীন অপচয় ।

কী অরিন্দমদা, আপনিও কি কেটলিউলির চিন্তায় মশগুল ?

আদিত্যর কথা শুনে, অরিন্দম নিজেকে বলতে শুনল, পাটনা থেকে এক মুহূর্তে কলকাতায় পৌঁছে, হ্যাঁ, চেনো ? পরিচয় করিয়ে দাও না ।

আরে কী বলছেন কি আবোল-তাবোল । পুলিশের চাকরি করি । যিশুদার না হয় লোকলজ্জা নেই । আমার দ্বারা হবে না । যিশুদাকেই বলবেন । ভোটবাগানে ফের কবে যেতে চান একটা টেলিফোন করে জানিয়ে দেবেন ।

আর যাব না, বলল অরিন্দম । ভোটবাগানের হত্যার মাঝে দাঁড়িয়ে তখুনই মগজে তৈরি হয়ে গিয়েছিল উত্তরটা । তারপর আদিত্যর প্রত্যাখ্যানের জবাবে বলল, পুলিশ তো পশ্চিমবঙ্গে সত্যের মালিক ।

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ।

মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোমতাজ হিমঘরের অংশীদার, পঁয়ষট্টি বছরের গেরুয়া-পোশাক, বাঁ হাতের সরু-সরু তামাটে আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে-থাকা সাদা ধবধবে দাড়ি, কালো-ফ্রেম গ্রাম্য বাইফোকাল, বাবরিচুল ভবেশ মণ্ডলকে হুগলি জেলার এই প্রত্যন্ত গ্রামে দেখে যতটা স্তম্ভিত হয়েছিল, তার চেয়েও অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছিল যিশু, ভবেশকার বোন খুশিদিকে দেখে । খুশিরানি মণ্ডল ।

কাঁসার বগি থালায়, কম্বলের আসনে খেতে বসে, প্রথম গপঅস মুখে তুলে, তিতকুটে লাগায়, যিশু বলে ফেলেছিল, এ বড্ডো তেতো নিম-বেগুন, আপনাদের দেশে নিমপাতা একটু বেশি তেতো বউঠান । সরাসরি যিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে খুশিদি বলে উঠেছিল, নিমপাতা নয়, একে বলে বামমি শাগ, খেলে মাথা খোলে । আমি কি তোর বউঠান ?

তিরিশ বছর পর শোনা পরিচিত কন্ঠস্বরে যিশু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট । ওর সামনে, হাতে হাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, ন্যাতানো আনারদানা জামদানিতে খুশিদি, ভবেশকার সৎ বোন । বিস্ময়ের নিষিদ্ধ স্বগতোক্তিতে বলে ফেলেছিল, আরে খুশি, খুশিদি, আর স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়েছিল গম্ভীর ভবেশকার দিকে । মুখাবয়বে দ্রুত বদল ঘটতে দেখল চাষি মেয়ে আর গ্রামীণ ক্ষমতাকেন্দ্রের মালিক দাদার ।  ভবেশকার চাউনিতে বিদ্যুৎগতি তিরস্কার । বোধয় ওঁর ছোটো বোনকে চিনতে না পারায় । আজকাল গ্রামগুনোয় সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাদের হাতে ।

এই বয়েসেও খুশিদিকে দেখতে কত ভালো । অচেনা শব্দ খুশিদির কন্ঠে, না-বলা কথা গিলে ফেলার আওয়াজ, অনেকটা হেঁচকির মতন । কন্ঠ বেয়ে কান্নার ঘূর্ণি চলে এসেছে চোখের ডাগরে, মুখ না তুলেই টের পায় যিশু ।

সূর্যনগরে আমি একটা অশথগাছ পুতেছিলুম । সেই গাছটা আচে ? প্রসঙ্গ খোঁজে খুশিদি । তুই কেমন আচিস রে যিশকা ?

হ্যাঁ, সেটা তো এখুন গাছতলা নামে বিখ্যাত । অনেক বাস ছাড়ে গাছতলা থেকে । তুমি দেখলে আর চিনতে পারবে না । গাছটা বিরাট হয়ে গেছে । উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে গেছে । আদিগঙ্গার ওপারেও গিজগিজ করছে বাড়ি । তুমি কি ভাবছ এখুনও ধানখেত আছে সেখানে ? যিশু কাঁধ নাচিয়ে নিজের স্বাভাবিক হাসি উপভোগ করে । যিশু আবার তাকায় খুশিদির মুখের দিকে, আর আমূল আক্রান্ত হয় ভারাক্রান্ত স্মৃতিতে । অশথ্থ গাছটার গোড়ায় একটা ঠাকুর আছে কী যেন ।

নমঃশুদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখুন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সালে, যুবক ভবেশকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে । ভবেশকার ঠাকুমা দাদু  বাবা মা দাদা বউদি কেউ বাঁচেনি । ভবেশকার সৎ মা নিশ্চই ফর্সা আর সুন্দরী ছিল । অনেক জমিজমা ছিল ওদের, নয়তো অমন ভালো দেখতে দ্বিতীয় পক্ষের বউ কী করেই বা পেয়েছিল ভবেশকার বাবা । উদবাস্তু কলোনির চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যেও অনেকের ঈর্ষা উদ্রেক করত খুশিদির চাঞ্চল্য । ডান চোখে তিল । কাঁদলে থুতনিতে টোল পড়ত । নিটোল টোল ।

তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাচে কংরেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিল ভবেশকা । তাঁবাটে পেশিতে দোহারা, ঝাঁকড়া অবিন্যস্ত, একদিনের খোঁচা-খোঁচা, নোংরা ধুতি-শার্ট, থমথমে চোখে-মুখে চেঁচাত, দেশভাগ আমরা চাইনি । হাতে পেলে জহোর্লাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে । আর আজ হিমঘরের অংশীদার ভবেশকা, সংরক্ষণের ক্ষমতার দ্বিগুণ আলু হিমঘরে ঢুকিয়ে দুলাখ কুইন্টাল আলু পচিয়ে, সেই একই হুগলি জেলার চাষিদের ভয়ংকর বিপদে ফেলেও নির্বিকার । পচেছে আরও অনেক হিমঘরে । চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায় ।

পশ্চিমবঙ্গে টোটো ঘুরে, ব্রিফকেসে ফ্লপি আর ল্যাপটপ, তিন রকুমের হিমঘর দেখেছে যিশু : একলাখ কুইন্টালের বেশি, পঞ্চাশ হাজারের বেশি, পঞ্চাশ হাজারের কম । কৃষি বিপণনের বাবুদের তোয়াজে তেলিয়ে লাইসেন বের করতে হয়,   হেঃ হেঃ, বলেছিল মোমতাজ হিমঘরের ক্যাশিয়ার শাসমল । তাও দাঁড়িয়ে যাবার পর তদারকিবাবু দেকে গেলে, মাত্তর দুবছের জন্যে, বোঝলেন, আবার দেবা-থোবার পালা, হেঃ হেঃ হেঃ । যে দেবে তাকে তো তুলতেও হবে , হেঃ হেঃ ।

ষাট হাজার কুইন্টালের হিমঘরে পাঁচতলা চেম্বারটা একশোদশ ফিট লম্বা, একশো আট ফিট চওড়া, ছাপ্পান্ন ফিট উঁচু । প্রত্যেক তলায় বারোটা করে তাক । মদ্যিখান দিয়ে যাতায়াতের জন্যে আড়াই ফিটের গলি । চ্যাঁচারির চালি দিয়ে আলাদা ভাগ-ভাগ করা থাকে তাকগুনো, যাতে তালাবন্ধ হাওয়া মনের আনন্দে খেলতে পারে চেম্বারের মধ্যে ।  সবচে ওপরে ছটা কনডেসেট কয়েল । তার ওপর ঘোরে ছাদপাখা । দেয়ালে চল্লিশ মিলিমিটার আর ছাদে আশি মিলিমিটার থার্মোকোলের পলেস্তারা ।

আরও, আরও টাকা করার পাঁয়তাড়ায় ভবেশকারা চলাফেরার আর হাওয়া খেলার জায়গাতেও ঠুসে দিয়েছিল বাড়তি বস্তা । তার ওপর বিজলির গোলমালে তাপের গুমোট বেড়ে গিসলো । শীতে জমে যাবার বদলে আলু ভেপসে গলদঘর্ম । কার জন্যে টাকাকড়ি জমিজমা চাই ভবেশকার !

হিমঘরের আয়ু তো কুল্লে ষাট বছর । মেশিনঘরে থাকে সিনকো, কির্লোসকার, অশোক লেল্যাণ্ড, ক্রম্পটনের কমপ্রেশার, তেল-ইঞ্জিন, ইনডাকশান মোটর, ডিজেল জেনারেটার, অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক, অয়েল সেপারেটার পাম্প, রেফ্রিজারেশান পাইপ । খড়গপুর আই-আই-টির মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার যিশুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে-দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল জাবেদালি ঘরামি । শিক্ষানবিশের মতো মাথা নেড়েছে যিশু, ও, আচ্ছা, হ্যাঁ, তাই বুঝু, কেন, ঠিক, বুঝেছি ।

বৌজলেন বিশ্বেস মোসাই, ছাব্বিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হপ্তা রেকে দেয়া যায় আলু, পঁয়ত্রিশ থেকে আটতিরিশ ডিগ্রি ফারেনহাইটে, বললে ম্যানেজার, নাক সামান্য ফুলিয়ে । দাম বাড়লে অসময়ে বিক্কিরির ঘামের দাম পায় চাষি ।

কিন্তু পচ ধরে তো জলের দরে বিকোচ্ছে ?

আসছে বছর দ্যাখবেন । আলুখোরদের বাঁশ দেবে চাষিরা ।

খাতাপত্তরে ফি-বছর লোকসান দেখান কেন ? মাল তো লোডিং হয় অনেক বেশি ? আপনার নাম তো কৃপাসিন্ধু, না ?

ও আপনেরা কলকেতার লোক, বুজবেন না । গ্রামে তো আর খবরের কাগজের রাজনীতি হয় না ।

চাষবাসের ব্যাপার, সত্যিই, এভাবে জানা ছিল না যিশুর । কারখানার রাজনীতি, স্কুলের রাজনীতি, অফিসের রাজনীতি, চাষের রাজনীতি, সবই আলাদা । আলুর চাষ শুরু হয়েছিল নভেম্বরে, শুরু হয়েছে রাজনীতির হালখাতা । এক হেক্টরে দুশো থেকে আড়াইশো কুইন্টাল ফলন হয় আলুর । প্রথম ফসল জানুয়ারিতে । বাজারের জন্যে । নতুন ধবধবে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ আলু, দামটা ভালো পাওয়া যায়, ফড়ে মেড়ো কাঁচা-বাজারের দালাল ওপরপড়া পার্টিদার সত্ত্বেও ।

আজ্ঞে মুসুলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমলের কালে স্যার হয়েচে পার্টিদার, আজগালগার জমিদার । বলেছিল পুড়শুড়ার নিতাই মাইতি, ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারের বড়ো ছেলে । যিশু কোনো চাকরি করে না, বুদ্ধি বিক্রি করে, শুনে ঠাহর করতে পারেনি চাকুরিপ্রার্থী ছোকরা ।

হিমঘরে রাখার আলু ওঠে ফেবরারির শেষাশেষি, বলেছিল জাঙ্গিপাড়ার নারায়ণ পোড়েল, ওখানকার হিমঘরের সুপারভাইজার, টাকমাথা, থলথলে, ময়লা । চাষিরা গোরুর বাড়ি আর মিনিট্রাকে চটের বস্তা ভরে আনে । হুগলি বর্ধমানে ষাট কেজিতে এক বস্তা । মেদিনীপুরে পঞ্চাশ কেজি । বস্তাকে বাংলায় বলে প্যাকেট । একখেও গোরুর গাড়ি মানে পাঁচ থেকে দশ কুইন্টাল, বলদ অনুযায়ী । আজ্ঞে বাঙালি বলদেরা তো আর হরিয়ানার বলদের মতন তাগড়া নয় । মিনিট্রাকে পঁচিশ থেকে চল্লিশ কুইন্টাল । তায় আবার ফি-বছর ডিজেলের দাম ডবল-ডবল বাড়ছে । হিমঘরে লোডিঙের সময় দেড়শো আর আনলোডিঙের সময় আশিটা কেঁদো মজুর আসে মুর্শিদাবাদ থেকে, সারা পশ্চিমবঙ্গে । নারায়ণ পোড়েল সিগারেটের টুসকি ঝাড়ে । মজুরগুনোকে আনে ওদের সরদার । বহরমপুরের কাসিমুদ্দি কাঠামি । সে দুদিকেরই ভাগা আর কমিশন খায় ।

আপনি তো হিমঘরে কাজ করে টেম্পো কিনে ফেলেছেন পোড়েলবাবু, মাইনেপত্তর ভালোই পান বলুন । ধনেখালি হরিপাল লাইনে চলে টেম্পোটা ।

না-না, কে বললে, এ আবার মাইনে নাকি । সরদারদের কাছ থেকে, মাটিঅলার কাছ থেকে, বাছনদারের কাছ থেকে, চাষির কাছ থেকে টাকা খাই । বস্তা পিছু ঘুষ নিই, ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ এবিলিটি । আরে বিশ্বাসবাবু, এদিকের মাল ওদিকে না করলে কেউই সুস্হ জীবন কাটাতে পারে না । টাকা ছাড়া শান্তি কই । আমার ওসব ঢাক-ঢাক গুড়গুড় নেই । যিশুকে হতচকিত করেছিল নারায়ণ পোড়েল । সত্যবাদীরা আজও আছে পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গসমাজে ।

ঠিকাছে, তারপর বলুন । ল্যালটপে টাইপ করতে থাকে যিশু, শুনে-শুনে । পেছন থেকে গ্রামীণ খোকাখুকুরা দেখতে থাকে পদিপিসির মার্কিন বাকসো ।

যে আলু রাখছে তাকে হিমঘর একটা রসিদ দ্যায় । তাতে তার নাম, সাকিন, আলুর হাল, ওজন, ভাড়া, বিমাখরচ দর্জ । এই রসিদটা বিক্কিরি করা যায় । কিনে কদজা নেয়া যায় আলুর । শ্যালদা বাজারের কাঁচা ফড়ে, বড়োবাজারের মেড়ো, হিমঘরের মালিক, পঞ্চায়েতের পাঁচুরা সময়মতন রসিদে কোপ মারে । সে এক জবর লড়াই । পার্টিবাবুরাও মারচে আজগাল ।

হ্যাঁ, বলে যান, বলে যান ।

প্যাকেটগুলো ঠিক জায়গায় রাখা, নম্বর লেখানো, মেলানো, এসব আমিই তদারকি করি । পনেরো দিন থেকে মাস খানেক লেগে যায় লোডিঙে । লোডিঙের দুদিন আগে থেকে মেশিন চলে । চেম্বারের তাপ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে নাবিয়ে আনতা হয় । লোডিঙ যেমন-যেমন এগোয়, ভেতরের তাপ বেড়ে সাত ডিগ্রিতে ঠেকে । আলুর বুকের গরুমটা বুঝুন থালে । চা খাবেন নাকি ?

না-না, আগে শেষ করুন ।

হ্যাঁ, কী বলছিলুম যেন ? ও, হ্যাঁ । তাপ বেড়ে গেলে তাকে নাবিয়ে আনতে হবে আবার দেড় ডিগ্রিতে, একটু-একটু করা, টানা একমাস । যদ্দিন আলু থাগবে, বজায় রাখতে হবে দেড় ডিগ্রি । আর্দ্রতা রাখতে হবে পঁচাত্তর শতাংশ । দুঘন্টা অন্তর কমপ্রেশার পাম্প, জেনারেটার চেম্বারের তাপ, বাইরের তাপ চেক করেন অপারেটারবাবু, সুকান্ত যুগি । ওই যিনি তখন মুটিয়াদের কাছ থেকে তামাকপাতা নিচ্ছিল, মোটামতন, জাতে তাঁতি, সিপিয়েম । আলুর দম খাবার সময়ে এই খাটনির হ্যাঙ্গাম কে-ই বা জানতে পারে । বুঝেছি । তারপর ?

মে মাস থেকে আলুর বস্তা বের করা শুরু হয় । চলে সেই আপনার নভেম্বর ওব্দি । শুকোবার ছাউনিতে এনে রাখা থাকে । বীজ আলুকে কুন্তু শুকুলে চলবে না । শুকিয়ে ছোটো-বড়ো ছাঁটাই করে বাছনদাররা । আজগাল অবশ্যি সিঙুর থানার রতনপুরে বিরাট খোলাবাজারে কিংবা আপনার বদ্যিবাটি আর তারকেশ্বর রোডের আড়তে চাদ্দিক থেকে আনা মাল ফেলে বাছাই করাচ্ছে ব্যাপারি । সস্তা পড়ে । বাছনদারদের চাগরি নেই । বাছনদাররা তাই ইউনিয়ান করেচে । তাতে আর কার কী ! অমনেও মরবে এমনেও মরবে ।

জানি । বদ্যিবাটি তারকেশ্বরে গিসলুম । তা ফড়েরা চাষিদের রসিদ কিনে রাখে বলে নম্বর মিলিয়ে ওরা মুটিয়া দিয়ে নিজেরাই মাল বের করায় । চাষিরা মাল ছাড়াতে এলে ওৎ পেতে থাকে ব্যাপারির লোক । হিমঘরে মাল রাখা বাবদ তিন থেকে পাঁচ শতাংশ শুকোবার জন্যে বাদ যায় ।ঔ তা নিয়েও নিত্যিদিন কিচাইন । নভেম্বরের পরেও হিমঘরে মাল পড়ে থাগলে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে । ডিসেম্বরে মেরামত, চালিবদল, ওভারহলিং, কনডেনসার পাইপ পোস্কারের কাজ । নতুন রঙের পোঁচ পড়ে ।

কী, তুমি খাচ্ছ না ? ভবেশকার কথায় নিঃশব্দ গলাখাঁকারি ছিল । চেতনার ঝটকায় জাঙ্গিপাড়া থেকে সোজা শেষপুকুরে পৌঁছে যায় যিশু । সারাতির শেষপুকুর গ্রামে ।

হ্যাঁ, ন্যাকোরচোকর করচিস । বলল খুশিদি ।

কী বলবে ভাবতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হল যিশুর । বলল, তোমরা না চাইলেও ঠিক খুঁজে বের করেছি তোমাদের । বের করতুমই একদিন ।

ময়ূরভঞ্জের রানির কুঠির কাছে ছিল না তোদের বাড়ি । এখুনও চোকে ভাসচে । মনে হচ্চে এই তো সেদিন । সবকিচু পালটে গেচে, না রে যিশকা ?

রানির বাড়ি এখুন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ । আমাদের বাড়িটা একটা কারখানা কে বেচে দিয়ে আমরা তো বহুকাল পার্কস্ট্রিট চলে গেছি ।

তা ভালো করেছ । পার্কস্ট্রিট তো দামি জায়গা, সোনার খনি । ভবেশকার বৈষয়িক মন্তব্য ।

থালা থেকে মুখ না তুলে একের পর এক পদ গিলছিল যিশু । সারা বাড়ি চুপচাপ । ভবেশকার পুঁইডাঁটা চেবানো দাঁতহীন শব্দ । খেয়ে উঠে, কালো রঙের কাঠের চেয়ারের হাতলে তোয়ালে । যিশুর জন্যেই তোয়ালেটা বেরিয়ে এসেছে কাপড়ের গাদা থেকে । মুখ মুছতে গিয়ে আলতো ঘ্রাণ টানে যিশু । হ্যাঁ, জলজ্যান্ত খুশিদির অমোঘ সুগন্ধ রয়েছে এতে, সংস্কৃতির কৃত্রিমতামুক্ত প্রকৃতির গন্ধ ।

তুমি একটু শুয়ে জিরিয়ে নাও । আমি দেখিগে, জালি বণ্ডের খবর পেয়েচি । বলতে-বলতে বাড়ির বাইরে বেরোয় ভবেশকা, খালি পায়ে, গোড়ালি ওব্দি ঝুলে আছে টেরিকটের গেরুয়া আলখাল্লা । পঞ্চায়েতের মাদারির খেল খেলতে যাচ্ছে বোধয় ।

কোনও ডুবন্ত জোতদারের থেকে কেনা, সাবেকি মেহগনি পালঙ্কে শুয়ে, কলকাতা থেকে তিরিশ বছর আগে ভবেশকা আর খুশিদির আচমকা হারিয়ে-যাওয়া আর আজকে তেমনিই হঠাৎ খুঁজে পাওয়ায়, যিশুর ভাবনায় অনির্বাণ আহ্লাদ খেলছিল । ব্যাটমে তোলা নেটের মশারি । শিমুলের ধবধবে বালিশ । এমব্রয়ডারি নেই । ছোট্ট মোটা কোলবালিশ, পা রাখার জন্যে । বারান্দায় টালির চাল । শালি-শুনা জমি ইঁটভাটার জন্যে ব্যবহার বারণ বলে টালির খোলা তো উঠেই গেছে বলতে গেলে । দেয়ালে পুরোনো আমলের লম্বাটে আয়না । পেরেকে চাবির গোছা ঝোলানো । সঙ্গেকার তাকে কাঁকুই । দেয়ালে ঝাঁকড়া হাসছে সত্য সাঁইবাবা । ভবেশকা বোধয় এ-ঘরেই শোয় । খুলনার বাড়িতে হুবহু এরকুম ঘরই ছিল হয়তো । গ্রামে লোকেরাও আজকাল এভাবে থাকে না । শহর তার রঙিন উস্হিতি জানাবেই । শহর মানেই তো দাপটের কেন্দ্র । খুশিদির ঘরটা কেমন কে জানে । ঘর তো বেশ কয়েকখানা । দুজন মোটে লোক ।

দেয়ালে-বসানো আলকাৎরা রঙের লোহার সিন্দুক, দিশি । কিছুক্ষূণ দ্বিধাগ্রস্ত থাকার পর আলতো পায়ে বিছানা থেকে নেবে, চাবির গোছাটা নিয়ে বারকয়েক কৌতুহলী চেষ্টা করতে খুলে যায় সিন্দুক । আলুর বণ্ডের বই, পাকিস্তানের পুরোনো একশো টাকার নোটের একটা বাণ্ডিল, উনিশশো পঞ্চাশ সালের হলদে খড়খড়ে পাকিস্তান অবজার্ভার আর দৈনিক আজাদ, দুটো একই মাসের । একটা ছবিসুদ্দু বিঞ্জাপন লাল কালিতে ঘেরা । লাল শালুর পাক খুলে শতচ্ছিন্ন বইটা, গীতা নয়, লুপ্ত সোভিয়েত দেসে ছাপানো ‘দাস কভাপিটাল’, এত বছর পরও মোষের খুরের শিরীষ -আঠার ভকভকে স্তালিনি গন্ধ । সংগ্রাহকের জন্যে গর্বাচভের সৌজন্যে বইটার সোভিয়েত সংস্করণ এখন দুষ্প্রাপ্য । সিন্দুক বন্ধ করে পালঙ্কে ফেরে যিশু ।

পাড়সুতোর নকশিকাঁথা চাপা দিয়ে, ভাতঘুমের অলস তন্দ্রায়, অতীতে ভাসছিল ও, যিশু । ষোলো বছর বয়সে কুড়ি বছরের খুশিদিকে ছোঁয়া, বাহু ধরা, চুলে নারকোল তেলের গন্ধ । স্মৃতির আলতো জলপোকা ।

কোথাও দুপুর-কোকিলের চোরা-কুহু । পশ্চিমের জানলায় থোকা-থোকা ফিকে হলুদ নোড়ফল ঝোলানো গাছটার পেছনে মঞ্চস্হ হচ্ছিল সূর্যাস্তের দ্বিপ্রাহরিক মহড়া ।

কাজের সময় কোকিল ডাকে, ভাল্লাগে না বাপু । কপালে খুশিদির স্পর্শ আর কন্ঠস্বরে অস্বস্তিকর অস্হিরতা । যিশুর তন্দ্রায় ঝনৎকার ঘটে । যিশুর শিরা-উপশিরা যা টানটান বাঁধা, ছিঁড়ে গেল, আর শ্বাসনালিকায় মোচড় দিয়ে ওঠে অদম্য বিষাদ ।

তোমার বরের কী হল খুশিদি ?

কেঁপে উঠেছে খুশিদির চোখের পাতা, মুখমণ্ডলে অবিশ্রান্ত ক্লান্তি , হৃৎপিণ্ডে অশ্রুপতনের টুপটাপ । বিয়ে আর হল কই ! চারটে মোটে শব্দ, অথচ, অথচ জ্যোৎস্নায় ডোবা ভুতুড়ে ঝিলের মতন নিষ্পন্দ । বর্ধমান জেলার ছুতোর গাঁ’র সহদেব মণ্ডলের বড়ো ছেলে এখানের উপসাসথো কেন্দ্রে কাজ করতো, আমাকে দেখতে পেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল একাত্তর সালে । দশঘরার পোড়ামাটির পরি বলেছিল আমাকে দেখে । পালটি ঘর ছিল, কাসসপ গোত্তর । খুন হয়ে গেল । ধড় পাওয়া গেসলো, মাথা পাওয়া যায়নি । সবাই বললে, নকশাল ছিল, তা-ই । দাদাও সে কথাই বলেছিল । দাদা কী করে জানবে বল ? নকশাল তো ছিল ছোটো ভাইটা । নকশাল করলে বিয়ে করতে চাইবে কেন, বল ? গোপের হাটের আড়তদার রামরতন মণ্ডলও বিয়ে করতে চেয়েছিল । পনেরো বছর আগের কতা । দোকানে আগুন লেগে জ্যান্ত পুড়ে মারা গেল সে । আমি খুব অপয়া । খুশিদির চোখের নাব্যতা হয়ে ওঠে অতল । তুই কেমন আচিস যিশকা । কতো বড়ো হয়ে গেচিস, লোক অ্যাগবারে ।

দশঘরা অঞ্চলের টেরাকোটা, মাটির তলায় পুঁতে, তার ওপর মাস ছয়েক জলছড়া দিয়ে, কয়েকশো বছরের প্রাচীন আর দুর্মূল্য করে তোলার খবর জানে যিশু । দেখেছে । সন্তর্পণে ও বলল, অজানা ইনোসেন্ট নারীজীবনে প্রবেশ করে নিজেকে পুনরুদ্ধারের অভিপ্রায়ে, আমার সঙ্গে যাবে খুশিদি ? আমার কাছে ? পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু । ওর কথার ঈষদুষ্ণ ভাপে, সালোকসংশ্লেষে অক্ষম স্বর্ণলতার মতন খুশিদি যখুন যিশুর কাঁধে মাথা রেখে, হ্যাঁ জানায়, রেশমগুটির মধ্যে তুঁতপোকার মতন ভাবাবেগের আরাধ্য পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছে ও, যিশু ।

আমার শরীর কেমন-কেমন করচে । বুক ধড়ফড় করচে । কিছু আবার হবে না তো । বলেছিল সন্ত্রস্ত খুশিদি, আর যিশু উত্তর দিয়েছে, হোক, হওয়া দরকার, এরপর আর সময় নেই ।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেচিস । ঠিক সময়ে পাকা ফসল তুলে না নিলে শুকনো সরষেও তো খেতে ঝরে যায়, বল ? তোর কিচু হবে না তো ? কাঁধ থেকে মাথা তুলে, চুলে নারকোল তেলের পরিচিত গন্ধ, যিশুর মুখের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চেয়েছে খুশিদি, আর তারপর বলেছে, আমার কাচে তুষলাব্রতর সরষে আর মুলোফুল আচে । তোর বাকসোয় রেকে নিস ।

তুমি ব্রত করো ? কী-কী ব্রত করো ? যিশু কাঁধ নাচিয়ে হেসেছিল, শব্দহীন, যাতে রাহু কেতু অশ্লেষা মঘা বসতে না পারে ওর গায়ে । ইউরোপ আমেরিকা এশিয়া আফরিকার বহু নারীর হার্দ্র সঙ্গ কাটিয়েছে ও, যিশু । কিন্তু এই প্রথম একজনকে মনে হল আধুনিকতার স্পর্শদোষ থেকে মুক্ত ; সমূল নিসর্গপ্রকৃতির অন্তর্গত ।

হাসচিস কি ! ব্রতর অনেক গুণ । এই তো শাবনমাসে মনসার ব্রত করেছিলুম । পান্তাভাত আর সজনে শাগের পেসাদ খেতে হয় তখুন । তারপর ভাদ্দরে চরাচরি ব্রত করি । চরাচরি পুজোয় সব রকুমের পিঠে ভাজা হয় । আশিন সংক্রান্তিতে পিঠে-পুলি খেয়ে খেতে নল দিতে হয় । ভাদ্দরে জল, আশিনে নল, ধান ফলে গলগল, শুনিসনি ? পোস মাসে পোসতলা ব্রত করি । শাঁক বাজিয়ে চাল দুধ ফল ফুল গোড়ায় দিয়ে পাঁচ গাচা ধান তুলতে হয় পোসতলায় । যখুন নতুন-নতুন এসছিলুম শেষপুকুরে, গাছতলায় বিলরান্না করতুম । আজগাল আর হয় না খ বডডো ঝগড়াঝাঁটি হয় গাঁয়ে । ঘেঁটুব্রতর গান জানতুম আগে । সবায়ের বে-থা ছেলেপুলে হয়ে গেল । কথা বলার সময়ে খুশিদির হাত নাড়া দেখে মনে হচ্ছিল বাতাসের তোশক সেলাই করছে ।

চাষবাস, গ্রামজীবন থেকে বঙ্গসংস্কৃতি এখুন গিয়ে পৌঁছেচে কলকাতা শহরের শেকড়হীন নাচাকোদা, বাজনা-থিয়েটারে । পশ্চিমবাংলার ভূজমিন থেকে আর সংস্কৃতির সত্য অঙ্কুরিত হয় না । তা নকল কায়দায় পয়দা হয় অকাদেমি, অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, পার্টি অফিসে । খুশিদিই হয়তো শেষ বাঙালিনি ।

একবার ভবেশকার সঙ্গে মিছিলে হাঁটার সময়ে গলা ঢেলে গান গেয়েছিলুম তোমায় শুনিয়ে, মনে আছে ?

মনে নেই আবার ? বাঙালদের মিছিলে গিসলি বলে পিটুনি খেয়েছিলি । খুশিদির চোখের কোলের অনিশ্চয়তার কালি কিছুটা কমে । চোখের কোলের কালির জন্যেও নারীকে ভালো দেখায়, আশ্চর্য । নৈকট্যার ঝাপটায় গড়ে ওঠে অজ্ঞাতসার । যিশু দুহাতে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে শেষতম বাঙালিনিকে । অ্যাই, কী হচ্ছে কী, পাগল নাকি, ভালোবাসা এমনি করেই জানাতে হয় বুঝি ?  ছাড়াবার চেষ্টা না করে, গলা নাবিয়ে বলল খুশিদি । প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলোয়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত । সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে, মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে । খুশিদির জৈব প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয় । থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি ; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা ।

যিশকা নামে ডাকার আর কেউ বেঁচে নেই । ডাক-নামের মৃত্যু মানুষের জীবনে জলবিভাজক । তার অস্তিত্বে যে যিশকা নামের কেউ একজন কখনও ছিল তা টের পেল যিশু, এতদিন পর । বহুকাল, বহুকাল, বহুকাল পর ।

খুশিদির কোমরলগ্ন যিশু, খুশিদির ঘরে, সেগুনকাঠের নিচু খাটের ওপর, খুশিদিকে আবরণমুক্তির সময়ে, খুশিদি বলল, পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, কেউ কখনও আদর করেনি আমায়, আদর করার মতন কিচু আচে কিনা তা-ও জানি না, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেএএএউ নয় । আমি খুবই অপয়া ।

উদোম স্বাস্হ্যবতী চাষি-প্রৌঢ়ার প্রগাঢ় চাউনির দিকে তাকিয়ে, ফুঁ দেবার মতন আলতো কন্ঠস্বরে যিশু বলেছে, ওসব বোলো না । জানি, পনেরই আগস্ট তোমার জন্মদিন করত ভবেশকা । তোমাদের কলোনিতে তা দেখে গালমন্দ করত অনেকে, আর ভবেশকা তাতে কান দিত না । এসো, আমি চোখ না বুজে তোমায় তিরিশ বছর পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি । শরীর জুড়ে ঠোঁট বোলায় যিশু আর প্রতিবার বলে তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা, তুমি অনন্যা । যিশু অস্ফুট বলতে থাকে, তোমার মুখের ভেতর থেকে রক্তচন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমার ঠোঁটে মধুপর্কের স্বাদগন্ধ, আম্রপল্লবের গন্ধ তোমার চোখের পাতায়, কানের লতিতে রক্তপদ্মের পাপড়ি, তোমার চুলে দুর্বাঘাসের সুবাস, তোমার এই হাতে কাঁচা ধানের সুগন্ধ । বেলপাতার সবুজ গন্ধ তোমার পায়ে, তোমার বুক থেকে ডাবের জলের গন্ধ পাচ্ছি । আআআআআআআঃ । কী মাখো তুমি ? অ্যাঁ ? কী মাখো ? কী মাখো ? কী মাখো ? আলো ? জল ? বাতাস ? সময় ? কী মাখো ?

চুপ করিসনি, তুই বলতে থাক রে, তুই বল । কিচ্ছু বুঝিনে তুই কী কইছিস, তবু তুই বল, বলতে থাক । আমু মুকখু । নাকতলায় তো তখুনই ইশকুল হয় । লেকাপড়া শেখায়নিকো । মুকখু, জানি আমি মুকখু । ঠোঁট দিয়ে খুশিদির চোখের কোল থেকে , অশ্রু পুঁছেছে যিশু । খুশিদির নাভি ঘিরে জেগে ওঠে নরম পরাগ-রোঁয়ার দল ।

বাইরের আমবাগানে চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেছে বাতাস । ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে রোদ্দুরের । চাপা উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে টুপ শব্দে মাটিতে পড়ল একাকী শিমুল । মাঝবয়েসি রোদের শেষ ফালিটুকু এসে পড়ে আছে বিছানার একপাশে । জানলার জংধরা শিকের বাইরে, নারকোল গাছের পাতায় বয়োবৃদ্ধ চিলকে ঘিরে গুটিকয় যুবা পাতিকাকের হাওয়া-সাঁতার হুড়দং । দক্ষিণের জানলায় পুরুষালী চেহারার ঝাঁকড়ামাথা খেজুরগাছ । তারপর থেকে, খুশিদির কাঁধের ওপর দিয়ে যতটা দেখা যায়, আলু খেতের সবুজ, খুপরি হাতে ময়লাটে রঙিন শাড়িতে আবছা কামিনেরা । ফড়িঙের ইচ্ছানুকূল স্পন্দন ছেয়ে ফেলছে চরাচর ।

মুখচোরা স্পর্শের আতিশয্যে খুশিদি এখুন প্রাণবন্ত পাথরে রূপান্তরিত , অন্তঃপুর নির্বাক, চোখের জলে গড়া মানবী । যিশু ওর দাঁত ঠোঁট মুখ দিয়ে খুশিদির চরণবন্দনা করে, জানুবন্দনা করে, স্তনবন্দনা করে, বাহুমূলবন্দনা করে, চোখবন্দনা করে । খুশিদি ফিরে যেতে থাকে তিরিশ বছর অতীতে প্রতিবেশী তরুণের শ্রেণি-নিষিদ্ধ সম্পর্কে, অপ্রত্যাবর্তনীয় সময়ে । অস্তিত্বের শীতাতপ আনাচকানাচ ভেসে যায় অবিরাম স্নিগ্ধতায় । জানা ছিল না এতকাল যে ওর নিজের শরীর এরকুম, যাকে এখুন দেহের আর মুখের ভাষায় যিশু করে তুলেছে পূজনীয়, অর্চনীয়, বন্দনীয়, আরাধনীয়, সাধনীয়, অহর্নীয়, উপাসনীয়, টের পায় যিশু । নিজের অর্চক, উপাসক, যাজক, জাপক, পূজক, সেবাইত, সাধক, আরাধককে সারা জীবনে প্রথমবার, পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম, সাহায্য করে খুশিদি নিজেকে অবাধ করে তুলতে । অস্ফূট উঃ, খুশিদির চোখবোজা, ক্রমাগত বলে চলেছে, কেউ ভালোবাসে না আমায়, কেউ চায় না আমায়, আমি মুকখু, আমি অপয়া । অবারিত যিশু, গড়ে তোলে স্বপ্নের দ্রুতশ্বাস সম্পখফ । তিরিশ বছর আগের না-মেটা আশ পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে । সুখানুভূতির অঢেল বখরায় মরা গাঙ প্লাবিত হয় ।

বাঁশের বেড়া খোলার ক্যাঁচোর শুনে উৎকর্ণ শঙ্কিত খুশিদি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত, পাক খেয়ে আনারদানা জামদানি জড়ায়, চোখের জল মোছে, হাত-খোঁপা বাঁধে, আর চাপা গলায়, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ, বাইরে যা, বাইরে যা, এখুন তো দাদার আসার সময় হয়নি । ব্লাউজের হাতায় বাহু ঢোকায় । টেপা-বোতামের পট-পট শব্দ ।

ভীতির গভীরতায় অবাক যিশু বাইরে দাওয়ায় বেরিয়ে খুশিদি আর আগন্তুকের উদ্দেশে গলা চড়ায় , জাবেদালি এসেছে গো খুশিদি । বিশ্বাসবাবুর জন্যে খাসি কাটালে ভবঠাকুর, তাই পাটিয়ে দিয়েচে, আর এই হরিপালের দই, জানায় জাবেদালি ঘরামি, হিমঘরে নজরদার, থলথলে কালচে চাহারা, গোঁফ নেই, দাড়ি আছে, কুচকুচে । হিমঘরের নাটবল্টু পেরেক আলপিন ওর মুখস্হ । অনেক বন্ড কিনেছে নিজের নামে, নাবালক ছেলের নামে । পদবির বিশ্বাস শব্দটাকে কারা বিকৃত করবে তা মুখের দিকে তাকিয়ে টের পাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে যিশু ।

যিশকা এখেনে কদিন থেকে যাক না দাদা, কদ্দিন বাদে দেকা, ওর তো মা-বাপ কেউ নেই এসংসারে, আমরা ওকে পুষ্যি নিতে পারিনে ? ভবেশকা ফিরলে অবাস্তব প্রস্তাব করেছিল খুশিদি ।

কিইইইই যে আবোল-তাবোল বলিস ; বিলেত-ঘোরা লোক ও, আপিসের কাজে এয়েচে । তা থাকতে চায় থাকুক না কদিন, কিন্তু ব্যাবসা আর গাঁয়ের গপ্পো করিসনি ওর সঙ্গে ।

রাত্তিরে, মাংস খাওয়ার সময়ে, এই অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে যিশুর, আবার মনে হল, অন্ত্যজ বাঙালি পরিবার মোগলাই রান্না রাঁধতে পারে না, অথচ সবর্ণদের তুলনায় নবাব-সুলতানদের কত কাছে ছিল । যে হিন্দুর বাড়িতে এককালে ছাগলের মাংস আর মুরগি নিষিদ্ধ ছিল, তারা কিন্তু আজকাল নানা মোগলাই পদ দিব্বি রাঁধতে পারে । অরিন্দমের ছোটো ভাইয়ের বউ কত ভালো মাংস-পরোটা খাইয়েছিল অরিন্দমের জন্মদিনে । অরিন্দমের ছোটো ভাইটা তো সব রকমের মাংসই খায় ।

কে কোন তপশীলিকে সরকারি ব্রাহ্মণ বলেছিল বলে অরিন্দমের অফিসে ইউনিয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে কত চেঁচামেচি করেছিল গৌরাঙ্গ নাগুরি, রমাপদ বাইন, জগৎ মান্না, সদানন্দ সাঁই, আর ঝাড়পিট ঘিরে নাট্যমোদীর কেরানিমঙ্গল । চাকরি-বাকরির চেয়ে নিজের বুদ্ধি বিক্রির ব্যবসা বরং ভালো, এর রাজনীতিতে তেমন হ্যাঙ্গাম নেই । খুশিদির সেগুনকাঠের পেল্লাই খাটে, রং-ওঠা নীল নেটের মশারির মধ্যে শুয়ে ভাবছিল যিশু ।

খুশিদির ঘরটা প্রায় ফাঁকা । একটা ড্রেসিং টেবিল অন্তত কিনে দিতে পারত ভবেশকা, একটা ট্রানজিস্টর বা টু ইন ওয়ান । নিদেনপক্ষে ছবি দেখার জন্যে সিনেমার ম্যাগাজিন । গ্রামপঞ্চায়ের এখানে কেবল টিভি নিষিদ্ধ করলেও, একটা টিভি তো রাখতে পারত সরকারি চ্যানেল দেখার জন্যে । খুশিদিকে ঠিক কোন শতকে আগলে রেখেছে ভবেশকা কে জানে । তালা-দেওয়া ঘরগুনোয় কী আছে জানতে অহেতুক আগ্রহ হয় ওর, যিশুর ।

ভেতরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরে খাটে কটনের মশারি টাঙিয়ে খুশিদি বাতি নেভাবার পর, যিশু আলতো পায়ে ওর পাশে গিয়ে শুলে, কন্ঠস্বর উদারায় তুলে খুশিদি বলল, সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়, কাল তো আবার আপিসের খাটনি আচে । আর গলা নাবিয়ে বলল, দুপুরে যা সব বলছিলি, সেগুনো আবার বল । পারবি ? ওমা তোর বুকে তো চুল নেই রে ।

যিশু প্রণয়ের প্রণয়ন করে ।

তোমাকে অনেক বলার আছে খুশিদি ; একই কথা বারবার কেন বলব ?

না, না, দুপুরেরটাই বল, তখুন যেমন-যেমন করেছিলি । নিজের অস্তিত্বে উত্তেজনার ভণিতা চেয়েছে খুশিদি ।

তোমাদের খুলনার ভাষা তোমরা দুজনেই ভুলে গেছ ?

তিরিশ বছরের ওপর রইচি এই গাঁয়ে । এই গাঁয়েরই হয়ে গেচি । আমি তো ছোটো ছিলুম, কিছুই মনে নেই । দাদা গপ্পো করে কখুনো-কখুনো ।

আমি তোমায় দেখে ভেবেছিলুম, বিধবা হয়ে ফিরে এসেছ । ভবেশকা যে কেন বিয়ে না দিয়ে আইবুড়ো করে রেখে দিয়েছে । অনেক ভালো পাত্র পেত তোমার জন্যে । নিজেও করেনি ।

দাদার তো চোপরদিন হিমঘর আর পারটি আর চাষবাস আর সভা । তুই করিসনি কেন ?

আমি ? পড়াশোনো আর পড়াশুনো । তারপর রোজগার আর রোজগার । উন্নতি আর উন্নতি । ব্যাস, বিয়ের বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল । আর তারপর বাবা-মা মারা গেল ।

তুই তো বেমমো, না রে ?

যিশুর বেশ ভাল্লাগে খুশিদির অকৃত্রিম মর্মসত্তা । বলল, না, আমরা খ্রিস্টান, ফ্রানসিসকান খ্রিস্টান । আমাদের জাতের বাঙালি খ্রিস্টান কলকাতায় আর নেই । কলকাতায় জেসুইট,কারমেলাইট, ডোমিনিকান, অগাস্টানিয়ান জাতের বাঙালি খ্রিস্টানও আর নেই । কলকাতা এখুন নানা ধর্মের ট্যাঁসদের শহর, বুঝলে । হিন্দু ট্যাঁস, মুসুলমান ট্যাঁস, খ্রিস্টান ট্যাঁস । কিন্তু ছোটোবেলায় কতদিন বড়োদিনের কেক খাইয়েছিলুম, ভুলে গেলে ? অবশ্য তিরিশ বছর আগের মতন কেক আর হয় না । কেকের ময়দা তো এখুন দুপা দিয়ে মাড়িয়ে-মাড়িয়ে মাখে কলকাতায় ।

অতশত বুঝিনে, মোচরমান না হলেই হল । খিশিদির অজ্ঞানতার আহ্লাদ, আরো গভীরে, জানায়, তা বেমমোও যা খ্রিস্টানও তাই । আমিও তাই, বল ? কিন্তু দুপুরবেলা তুই আমার জন্যে হিন্দুর মন্তর পড়লি যে বড়ো । শুয়ে শুয়েই, যিশু কাঁধ নাচিয়ে আহ্লাদিত ।

জানলায় ফিকে শীতের শ্রবণসুভগ শুক্লপক্ষের স্তব্ধতা । ভুলো মনের বাতাসে আওয়াজ নেই । যিশু ফিসফিসিয়ে, তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব আমি । আমার কাছে ক্যামেরা আছে , কাল ফোটো তুলব তোমার ।

খুশিদির বিষণ্ণ উক্তি, আমার কোনো ছবি নেই, কেউ তোলেনি আজ ওব্দি । ভোটের ছবি তুলেচে যেন শাঁকচুন্নি । তারপর বহুক্ষুণ নিরুত্তর থেকে, কিন্তু কী করে যাব, দাদা এক পা-ও যেতে দেবে না । চাদ্দিকে দাদার পঞ্চায়েত, কিসক সভা, হ্যানোত্যানো কমিটি, হিমঘর, সমবায়ের লোকে গিজগিজ করচে । কী করে এড়াব ? সবাই চেনে আমাকে ।

বৈশাখী পূর্ণিমার মেলা আসছে তো । গাঁয়ের মুখে তো বিরাট মেলা বসে শুনেছি । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কেউ খেয়াল করবে না । আমি কলকাতা থেকে টানা গাড়ি আনব ।

শরীর কেঁপে ওঠে খুশিদির । যিশুর মাথাকে চেপে ধরে উন্মুক্ত বুকে । যা ভালো বুঝিস, কর । কিচ্ছু ভাল্লাগে না আর । রাত্তিরেও চুল আঁচড়ে শুস ? এক লহমায় যিশু ফিরে গেছে মায়ের কোলে । চাঁদের আলোর ক্ষীণ স্বাদ ওর জিভে । রোমকূপের গোড়ায়-গোড়ায় পড়ে গেছে সাজো-সাজো রব । একত্রে অনোন্যোপায় হয়ে ওঠে দুজনে, অভিভূত, দিশেহারা, বিভোর, আচ্ছন্ন । অন্ধকারে তিরতির করে কাঁপতে থাকে অন্ধকার । চোরাবালির কেন্দ্র থেকে প্রসারিত হাতের অনুনয়ের মতন খুশিদির নিঃশ্বাস । একে আরেকের ব্রাহ্মমুহূর্ত গড়ে তোলে আর প্রশমিত করে পারস্পরিক স্পন্দন ।

প্রাকভোরে, শুক্লপক্ষ তখুনও কৃষ্ণপক্ষে ঢলে পড়ার জন্যে তৈরি হয়নি, ঘুম ভেঙে গেলে খুশিদি যিশুকে ঝাঁকায় । এখুনো ঘুমোসনি, নিজের বিছানায় যা, বিপদ হবে শেষকালে । যিশু যখুন মশারি তুলে বেরোতে যাচ্ছে, ওর বাঁ হাত ধরে, না যাসনে, আমার কাছে থাক । যৌবন ফুরোতে থাকা নারী-পুরুষ চুপচাপ পাশাপাশি শুয়ে নৈশব্দ্যের খাঁই মেটায় । চরাচরের অপার্থিব উম কনশিকাঁথার রূপ নিয়ে ঢেকে রেখেছে ওদের দুজনকে । বহুদূরে, কোনো পথকুকুরের খেদোক্তি শোনা যায় । এই এভাবে পরস্পর, একেই বোধয় শুশ্রুষা বলে, প্রাণ জুড়োনো বলে, মনে হচ্ছিল যিশুর ।

অ্যাতো জমিজিরেত প্রতিপত্তি কী করে করলে গো তোমরা ?

বিনময় করে । জানিস তো, বিনময় ? ওখেনে আমাদের খেতখামার ঘরদোরের বদলে এখেনে কে একজন ফরোজন্দো মোমেনিন ছিল, তার সঙ্গে অদল-বদল । তক্কে-তক্কে ছিল দাদা ।

ওঃ বিনিময় ! কখুনো তো টের পাইনি ?

তুই আবার কী টের পাবি ? তখুন কতই বা বয়েস তোর ।

গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে পেছনের ওসারায় এসে দাঁড়ায় যিশু । সকাল হয়ে এল । স্পষ্টবাক বিবাহযোগ্য কোকিল ডাকছে । সঙ্গে ফস্টিনষ্টি আরম্ভ করেছে ফাল্গুনের প্রেমানুভূতিময় কচি-কচি বাতাস । বেশ ভালো বাগান করেছে ভবেশকা । ঘষাকাঁচ কুয়াশা দেখা যাচ্ছে দূরের ঠান্ডা দোচালাগুলোকে ঘিরে । সজনেফুল আঁকড়ে সদ্যোজাত লিকলিকে সজনে ডাঁটারা বেরিয়ে এসেছে রোদ্দুরের উড়ন্ত উনকির সঙ্গে খেলবে বলে । কাঁটাকাঁটা সবুজ ছুনিফলের মুকুটে তালঢ্যাঙা রেড়িগাছ । পুকুরের পাড়ে মুখ তুলে পাতাহীন গাছে আমড়ার ফিকে সবুজ বউল । ছোটো-ছোটো প্রায়ান্ধকারে দোফলা গাছে পুরুষ্টু সফেদা । পাকা আর ডাঁসা অজস্র টোপাকুল, আলতো নাড়ালেই ঝরে পড়বে গোঁসা করে । গা ভরতি নানা মাপের সবুজ আঁচিল নিয়ে কাঁঠাল গাছ । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে মুখে পাউডার মেখে নার্সারি স্কুলের খোকাখুকুর মতন জামরুল ফুলের দলবদ্ধ কুঁড়ি । লালচে-সবুজ ছাই মেখে কচি খসখসে ফলসা পাতা । নরম তুলতুলে গুটিপোকাকে আলগোছে খেয়ে ফেলল ময়নাপাখি । কত রকুমের পাখির ডাক । বেলা হলে আর শোনা যায় না তো ! গলায় কোরালের মালা ঝুলিয়ে মোচা ফেলছে সুপুরিগাছের সারি । জীবনমুখী গায়কের দ্রুতলয় গিটারের মতন বাঁশের শুকনো ফ্যাকাশে গাঁটে কাঠঠোকরা ।

খালি গায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাতাস । বাতাসে ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । দানদিকের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নিচে খেলা করার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলটলে পুকুর । আঁশটে গন্ধের ঐতিহ্যলালিত কুচোপোনার ঝাঁক ভেসে আছে আলতো রোদে ভেজা প্ল্যাঙ্কটন-পোকা খাবে বলে । ঘাটের জলে কাঁসার এঁটো বাসন । স্হানীয় চোরেরা ভবেশকাকে বেশ ভয় পায় বোধয় ।

কত জল পুকুরটায় । কত্তো । কলকাতায় হরদম ফেরুল নোংরা, জলের পাইপ পাম্প করার ঝঞ্ঝাট, স্টপকক চুরি, ফি-দিন মেরামত । জলের জন্যে টেনশানের চূড়ান্ত । অথচ এই অজ পাড়াগাঁয় অগুনতি পুকুর । ভবেশকার পুকুর তিনটের মধ্যে এটা সবচে ছোটো । পুকুরের উত্তরে গোয়ালঘর । সঙ্কর গাই রয়েছে দুটো, জার্সি ।

কত কি করে ফেলেছে ভবেশকা । দেশভাগের দরুন তাহলে জোতদার বিনিময়ও হয়েছিল । এগাঁয়ের লিগি মুসুলমান গিয়ে ইস্তাহারি রাজনীতিতে দড় হিন্দু জোতদার এল। মূল্যবোধ যে কে সেই । খুঁটিগুনোর তেমন তফাত হয়নি । তিরিশ বছর আগের ভবেশকার স্লোগান লাঙল যার জমি তার আজ ফলে গেছে । হালবলদ, জোয়াল-লাঙল ভবেশকার, জমিও ভবেশকার । সমন্বিত গ্রামীণ বিকাশ, প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প, ডোকরা, সাক্ষরতা অভিযান, রক্তদান শিবির, মৎস্য উন্নয়ন, পঞ্চায়েতের বরাত, তাঁতিদের সুতো, ত্রাণ প্রকল্প, তপশিলি কল্যাণ, হ্যান-ত্যান কমিটি, সমবায় তাপবিদ্যুৎ, স্বাস্হ্যকেন্দ্র, লোন-দাদন, আলুর বন্ড, ক্লাব, পুজো, নাটকদল, মেলা, বায়োগ্যাস, ধোঁয়াহীন চুলো, প্রশিক্ষণ, মডেল শৌচাগার, সব ভবেশকার, ভবেশকাদের, সব, সব, সঅঅঅঅব ।

পাতালের আলু, মর্ত্যের গতিপ্রকৃতি আর স্বর্গের খুশিদি, সমস্তকিছু ভবেশকার কবজায় । শাসনে এত আলু যদি সংরক্ষণ করা না-ই যাবে, পড়ে-পড়ে নষ্ট হবে, হিমঘরে গিয়ে পচবে, যাহোক-তাহোক দামে বেচে দিতে হবে চাষিকে, তাহলে বিঘের পর বিঘে পরিশ্রম, টাকা আর সময়ের অপচয় কেন ? ব্লকের আর জেলার আধিকারিকরা করছিলটা কী ? কী করছিল ? অ্যাঁ ?

কোনো একটা অচেনা পাখির ডাকে চমকে উঠেছে যিশু । স্পষ্ট শুনেছিল পাখিটার গান । পরপর তিনবার পাখিটা বলল, ‘বাল ছিঁড়ছিল’।

তিন সত্যিই করেছিল পাখিটা । পরের বছর নিশ্চয় প্রচণ্ড দাম বাড়বে । তখুনও কৃষি আধিকারিকরা একই কাজ করবে । ওঃ । চার বছর আগে আলু হয়েছিল একান্ন লক্ষ টন, যখুন কিনা সারা পশ্চিমবঙ্গের হিমঘরে রাখার জায়গা ছিল বাইশ লাখ টন । এবছর হয়েছে সত্তর লাখ টন । রাখার জায়গা আটাশ লাখ ।

যিশু ভেবেছিল বুঝি কাঁচা ফাল্গুনের ঘাসে শিশির মাখতে বেরিয়েছে একজোড়া বেঁজি, তার আওয়াজ । পেছন ফিরে দেখল ভবেশকা, নিমডাল পাড়ছে নাবালক গাছ থেকে । বলল, এ নাও যিশু, নিমের দাঁতন করো । খ্রিশ্চানরা কি দাঁতন করে ? টুথব্রাস বেরোবার আগে কী করত সিরিল র‌্যাডক্লিফ ? আর কঘর বাঙালি খ্রিশ্চান রইল হে এদেশে ? চার্চ-টার্চ যাও ? নাকি সেসবও বাইরের লোকেরা হাতিয়ে নিয়েছে ? নাকতলায় ডালগিশ সায়েবের বাড়িটা আছে ? ডালগিশ তো তোমাদের জ্ঞাতি, না ? তারপর ডালগিশের বাটলার, আরদালি, বাবুর্চি, খাদিম অনেকঘর খ্রিশ্চান তো ছিল নাকতলা-বাঁশদ্রোণিতে ?

প্রশ্নাবলীর দাঁতন-বুলেটে যিশুর একাগ্রতা ছত্রভঙ্গ । অপ্রস্তুত, ও বলল, হ্যাঁ, ডালগিশ পরিবারে বাবার মাসির বিয়ে হয়েছিল । বাঙালি খ্রিস্টান বলতে গেলে আর নেই কলকাতায় । বাবা তো ওদিকের বাড়ি বেচে সেই আপনারা কলোনি ছাড়ার বছর দুয়েক পরেই পার্ক স্ট্রিটে ফ্ল্যাট কিনেছিল । সারা পশ্চিম বাংলায় আমিই শেষ বিশুদ্ধ বাঙালি খ্রিস্টান ।

হ্যাঁ, বলছিলে বটে । অত বড় বাগানবাড়ি ছেড়ে শেষে সেই ফ্ল্যাটে ! তা বেশ, বেশ । নাটকের চরিত্রের চিৎপুরি সংলাপের মহড়ার ঢঙে ভবেশকা । হিমঘরের লাইসেন্সটা আমরা শিগগিরই রিনিউ করিয়ে নেব । কোথায় আটকে আছে জানোই তো, অ্যাতো হিমঘর দেখেছো ঘুরে-ঘুরে । ড্রাই অ্যান্ড ওয়েট বাল্ব-থার্মোমিটারের অর্ডার দিয়ে রেখেছি ঠিকমতন তাপ মাপার জন্যে । পরিচালন সমিতির কার্যবিবরণীও এবার থেকে রেজিস্টারে লিখে রাখার ব্যবস্হা থাকবে, পরিচালকরা সই করবে তাতে । ডিফিউজানের বদলে বাঙ্কার পদ্ধতিতে পালটালে খর্চাখরচ কেমন পড়বে তার একটা তলবি-সভা হবে দিন-সাতেকের মধ্যে । বিজলির চেয়ে ডিজেলের খরচটা হয়তো কম, তাই আরকী । তারপর বিদ্যুৎ তো আজ আছে কাল নেই । দাঁতনের সঙ্গে চিবিয়ে-চিবিয়ে সেই প্রশ্নগুলোর একনাগাড় উত্তর দিয়ে গেল ভবেশকা যেগুলো মোমতাজ হিমঘরের কর্মীদের  করেছিল যিশু, অথচ তারা সঠিক জবাব দিতে পারেনি বা চায়নি ।

ওহ-হো, ভবেশকা আমি এখানে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে আসিনি, বলেছি তো তোমায় । রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা নাবার্ড কিংবা অমন কোনো ক্ষেত্রসমীক্ষক সংস্হার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই । আমি নিজের কনসালটেনসি খুলেছি তো । একসঙ্গে অনেক কাজ নিয়ে ফেলি, কুলোতে পারি না একলা । এই কাজটা মিৎসুবিশির জন্যে করছি । ওরা আলুর নানারকুম ব্যবসায় ঢোকার আগে জেনে নিতে চায় । আমি তো চাষবাসের ব্যাপার বিশেষ জানি না । তাই বাড়তি কথা জিগেস করে ফেলি ।

হ্যাঁল য়যোতাজপুরের মামুদ মাফুজ বলছিল, তুমি নাকি ওর বাপের কাছে জানতে চেয়েছিলে মাদার সিডের ব্রডকাস্টিং কখুন হয় । আমরা বলি বীজ আলু পাতা । আরেকটা কথা । তোমার রিপোর্টে লিখো যে আমি এই ব্লকে কাভুর জাতের লাভজনক ওল চাষে সফলতা পেয়েছি । কাভুর ওলে মুখি বিশেষ হয় না, গলা কুটকুট করে না, ছোটো-ছোটো টুকরো কেটে আলুর মতন বসানো যায় । তোমায় খাওয়াবো অখন, তা হলে টের পাবে । আগে এখেনে সবাই সাঁতরাগাছি ওল চাষ করত । সিঙুর, বলরামবাটি, বাসুবাটি, মির্জাপুর, ঝাঁকিপুর, বারুইপানা সবখানে এখন কাভুর বসাচ্ছে চাষিরা । পা#চশো গ্রাম বীজে দশ কেজি মতন ওল পাচ্ছি, বুঝলে । অনেকে তো ওলের সঙ্গে বাড়তি ফসল হিসেবে লাল শাগ কি নটে বুনছে । বকবকম ফুরোলে, নিম দাঁতনের সঙ্গে ওলের জ্ঞান-চেবানো কথাবার্তা একদলা থুতুতে পালটে থুক করে রজনীগন্ধার ঝাড়ে ফেলল ভবেশকা । শিউরে উঠল ফুলগুলো ।

ধবধবে ফুলগুলো শিউরে উঠছে, স্পষ্ট দেখতে পায় যিশু । এই সাতসকালে ওলের জ্ঞানে বিব্রত লাগে ওর । কেনই বা প্রসঙ্গটা, আর কী-ই বা উদ্দেশ্য, ঠা্র করতে পারে না ও । চন্দ্রমুখী ধেকে ওকে কাভুরে নাবাচ্ছে ভবেশকা । পরের বছর আলুর দাম তিনচারগুণ বেড়ে গেলে শ্রমিক-মজুরদের খোরাকিটা ওল দিয়ে সামলাবার জন্যে সম্ভবত নিজেকে আগাম তৈরি করছে পশ্চিমবাংলার বঙ্গসমাজ ।

ভবেশকা নিমজ্ঞান চেবানো বজায় রাখে । চোত-বোশেখে ওল লাগালে ভাদ্দর-আশ্বিনে ফি-একরে পঞ্চাশ কুইন্টাল মতন পাচ্চি, বুঝলে । আলু যাদের মার খেলো, ক্ষতি নেই, পুষিয়ে নেবে । বোরো থেকে পোষাবার উপায়নেই । চাষের জল নেই । আরেক-দলা থুতুর ছিবড়ে পড়ে রজনীগন্ধার জামাকাপড়ে । আচমকা প্রসঙ্গ পালটে যেতে শোনে যিশু । আমাদের পঞ্চায়েত বিদ্যুতের বিল বাকি রাখে না কখুনো, বুঝলে, একটা রেকর্ড সারা পশ্চিমবঙ্গে । আরেকবার থুতুর পর বকনা বাছুরটাকে আঙোই পেড়ে ডাকে ভবেশকা ।

জল তাহলে এক ভয়ংকর সমস্যা । এই তো মনে হচ্ছিল গাঁয়ে কত জল । মাটির তলাকার জল যাতে রাজ্যসরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাই ব্লকগুনোকে কালো, ধূসর, সাদা, তিনরকুম ভাবে ভাগ করতে বলেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক । কিন্তু কে কার কথা শোনে । চাষিকে বারণ করলেই অন্য পার্টিতে গিয়ে ঢুকবে । যার যেখানে ইচ্ছে শ্যালো বসাচ্ছে । সাদা ব্লক ধূসর হয়ে গেল । জল ফুরিয়ে ধূসর ব্লক হয়ে গেছে কালো । তারপর আর জল নেই । জল নেই তো জেলাশাসককে ঘিরে চেঁচাও । যেন কালেক্টর সায়েব মুতে-মুতে মাটির তলাটা আবার ভরিয়ে দেবে জলে । এরপর খাবার জলও জুটবে না । চাষের কীটনাশক চুয়ে-চুয়ে পাতালের জলও দূষিত হয়ে গেছে ।

কত নদীর বুকে, আজকাল, না, সাঁতার নয়, সাইকেল রেস হয় । নিজের চোখে দেখেছে যিশু । আর শুধু বোরো কেন ! ওই তো, বাঁকুড়ার মড়ার, বেলসুলিয়া, বাঁকদহতে রবি মরশুমে শ্যালো বসাতো না কেউ । উপচে পড়ত কংসাবতীর খালের জল । আচেরুদ্দি মল্লিক, আরেফ মণ্ডল জোড়া পাঞ্জাবি বলদ বিক্কিরি করে শ্যালো বসিয়েছিল খালের ধারেই । জল ওঠেনি । অক্টোবরে পাতা র‌্যাশন আলুর চারা বাঁচাতে গোরুর গাড়িতে ড্রামে করে ডিপ টিউকলের জল এনে ঢেলেছিল । বাঁচেনি । দিলশাদ বায়েন, আফিফ দালালদের চোপসানো চোখমুখ দেখে আগামী সংসারের দিনকাল আঁচ করেছিল যিশু ।

ওদিকে মেদিনীপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর, বাদলপুর, সাতমাইলের চাষিরা ভোগরাইতে গিয়ে উড়িষ্যা কোস্ট ক্যানালের লকগেট অপারেটারদের মোটা টাকা খাওয়ালে তবেই সেচের মিষ্টি জল জোটে। বাদলপুর পঞ্চায়েতের সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক দেবেন জানা নিজেই বলেছিল, নিজে । মাঝি-মালোরাও শংকরপুর মেছোঘাটায় ভুটভুটি নিয়ে যাবার জন্যে গাঁটের মালে হাসি ফোটায় অপারেটারবাবুদের মুখে । ফেরার পথে কিলো দশেক মাছ গচ্চা যায় । স্বাধীনতার আগে লোকে ওই খালে নৌকো বেয়ে কলকাতায় যেত, জানেন স্যার । বোরো তো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমসি হয়ে গেল । এবারে আর ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা হবে না, দেখে নেবেন, হবে জল নিয়ে ।

বহিরাগত, বহিরাগত, বহিরাগতর মতন এই হুগলি জেলার খানাকুল, মারোখানা, ডোঙ্গল, রামমোহন, চিংড়া, ধনেখালি, পাণ্ডুয়ায় দেখেছে যিশু, অশান্তির তোয়াক্কা করছে না চাষি । মুণ্ডেশ্বরী, শংকরী, দ্বারকেশ্বর নদী আছে । জল নেই । ডি ভি সি আছে । জল নেই । বড়োসায়েব জিপগাড়ি আছে । জল নেই । ভজহরি ভুঁইয়া সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল । ছোপছপে শংকরীর এখানে-সেখানে হাঁটু জলে বেআইনি বোরো বুনছে চাষি ।  মজা-যাওয়া কানা দামোদর আবার বর্ষায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় হুগলি-হাওড়ায় । ত্রাণবাবুদের ঢল নাবে ।

গড়চুমুকে আটান্ন কপাটের স্লুইসগেট কোন কাজেই বা এলো, বলুন দিকি ? যিশুকে সরকারি আধিকারিক ঠাউরে অভিযোগ করেছিল ক্ষুদিরাম ঢাং । বছর কুড়ির আগের বাণে দ্বারকেশ্বর রাস্তা পালটে সেঁদিয়ে গিসলো গোয়ালসারা, খিলগাঁ, চোটডাঙল, শ্যামবল্লভপুর, কৃষ্ণবল্লভপুর, কলাগাছিয়ায় । নদী তো শুধরে ফিরে গেল আগের খাতে । চাষের জমিতে ফেলে গেল এক মানুষ গভীর ধু-ধু দিগন্তের বালি । হাজার তিনেক জাতচাষি এখুন দিনমজুর । দিনমজুর হলেই তো আর কাজ জোটে না !

সেচ দপ্তর কী করে ? গ্রামোন্নয়ণ দপ্তর কী করে ?

অচেনা পাখির ডাকে, পর পর তিনবার, সোচ্চার জবাবে চমকে ওঠে যিশু । ভাবনা গুলিয়ে যায় ।

শেষবার থুতু ফ্যালে ভবেশকা । কী, এখুনও ছোটোবেলার মতন চমকাও নাকি ? ন্যাচুরোপ্যাথি করো না কেন ? আমার তো আলসার সেরে গেছে ।

কটা দাঁত আর আছে ভবেশকার যে নিমের ডাঁটাটা সজনে খাড়ার মতন চিবিয়ে ফেলেছে ? নকল দাঁত হলে দাঁতন কেন ?

নিমডালের কুচো-থুকথুক সেষে বলল, কালকে যখুন তোমার মা-বাবার দুর্ঘটনায় মারা যাবার খবরটা শুনলুম, মনটা বড্ডো খারাপ হয়ে গিসলো । ওঁয়ারা না থাকলে তো খুশিটা মানুষ হতো না । কত দুঃখের দিন গেছে । ঘাটে বসে পুকুর-কুলকুচো করে ভবেশকা ।

বাবা-মায়ের দুর্ঘটনার সূত্রেই আদিত্যর সঙ্গে যিশুর পরিচয় । বাগবাজারে গিসলো বাবা-মা, নয়ন সাহা লেনে ফাদার নরম্যানকে সেকেলে ধর্মান্তরিত বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের এখনকার হালহকিকতের তথ্য দিতে, অবহেলিত সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে । বিরল প্রজাতির এই ধর্মসম্প্রদায়ের নিশ্চিহ্ণ হবার কারণ গবেষণা করছেন ফোর্ড ফাউন্ডেশানের আওতায় । বাবা ছিলেন শেষ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে চাদর, পায়ে পাম্পশু খ্রিস্টান । ক্রিসমাসের দিন মা পরতেন গরদের শাড়ি । খাঁটি বাঙালি খ্রিস্টান মেয়ের সন্ধান করতে-করতে যিশুর বিয়ে দেওয়া হল না ।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে, ল্যাজ-ওড়ানো ঘোড়ায় বসা নেতাজির মতন দেখতে ব্রোঞ্জের মনীষীর চোখের সামনে, হাত উঁচিয়ে ট্যাক্সি ধরতে গেলে, তিন নম্বর রুটের প্যাঙপেঙে জবেদকা বাসের ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে রক্তাক্ত, মায়ের ডান হাত তখুনও  বাবার বাঁ হাতের মুঠোয় । রাস্তার লোকেরা প্রথমে বাসটাকে জ্বালিয়ে আর চালককে পিটিয়ে মেরে ফেলে, তারপর একটা পথচলতি প্রাইভেট গাড়িতে বাবা-মাকে চাপিয়ে নিয়ে গিসলো আর জি কর হাসপাতালে । পথেই মৃত্যু ।

মৃতদেহ অশনাক্ত অবস্হায় আর জি কর থেকে মাছি ভনভনে লাশগাড়িতে মেঝের ওপর দোল খেতে-খেতে চলে যায় নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে । সারারাত, পরের দিনও যিশু হন্যে হয়ে খুঁজেছে থানায়, চার্চগুলোয়, বাবার বন্ধু আর প্রাক্তন সহকর্মীদের বাসায়, হাসপাতালে । তৃতীয় দিন এন আর এস মর্গে পৌঁছে স্তম্ভিত । চাপা কান্না আর অসহায় ক্রোধে কন্ঠরুদ্ধ, ও আবিষ্কার করেছিল উদোম উলঙ্গ বাবা-মাকে । দুজনেরই বাঁ হাত আর কাঁধ থেঁতলে গেছে । ঘড়ি, চশমা, পার্স, আংটি, হার, চুড়ি তো নেই-ই, রক্তে ভেজা পোশাক আর অন্তর্বাস হাপিস। মা-বাবাই কেবল নয় । মর্গের টিমটিমে শীতের ইঁদুরমরা গন্ধে গাদাগাদি পড়ে আছে অনেক লাশ । উলঙ্গ । কাঠ। স্টার্ক নেকেড, ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে পড়ে আছে প্রত্যেকে । উদ্ভিন্ন কিশোরী, পীনোন্নত গৃহবধু, ঢাউস প্রৌঢ়া, হাড়গিলে বৃদ্ধার হাঁ-মুখ-খোলা চেয়ে-ধাকা মৃতদেহও রেয়াত পায়নি ।

মৃতদেহ খালাস করতে গেলে, কালু ডোমের স্পর্ধিত হাসির খিক-খিক সিগারেট টুসকি ভোলা যাবে না । এসট্যাবলিশমেন্টের নির্মম হাসিখানি । মহানগর কলকাতা আজ এইসব কালুয়া মুদ্দোফরাসের বজ্র-আঁটন মুঠোয় । ধর্মমঙ্গলের কালু ডোম এখুন পশ্চিমবাংলার নিখিল মর্গের যক্ষ । থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে সেখানে মুদ্দোফরাসের খিকখিকের বদলে পেটমোটা সরকারি হাসির খাকিরঙা গিগগিগ । পশ্চিমবঙ্গে হাসির সরকারিকরণ হয়ে গেছে । সোশাল অ্যাকশান ফোরামের শিশির ভট্টাচার্য, মানবাধিকার কমিশনের চিত্তোষ মুখোপাধ্যায়ও প্রতিষ্ঠানের উত্তরঔপনিবেশিক ডোমদের কাছে অসহায় । শেষে, একেবারে শেষে, ভেঙে পড়েছে যখুন, যখুন ওপরতলায় ধরাধরি ব্যর্থ, অরিন্দমের মাধ্যমে আদিত্য বারিকের কাছে পৌঁছেছিল যিশু । আদিত্যর দৌড়ঝাঁপে রেস্ত রফার পর খালাস করতে পেরেছিল মৃতদেহ ।

আদিত্য কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, এগুলো একটু-আধটু মেনে নিতে হয় যিশুদা । মন খারাপ করে লাভ কী ? স্বাধীনতার পর কত লোকের স্বজন যে অজান্তে পচেছে, কানের লতি নাকের পাটা চোখের পাতা খেয়ে ফেলেছে ইঁদুরে, মনে হয়েছিল যিশুর, ওফ, বীভৎস, বীভৎস ।

কী হল, কাঁদছ নাকি যিশু ? ভবেশকা বাঁ হাত রাখে ওর, যিশুর, কাঁথাঢাকা কাঁধে । লাল সুতো দিয়ে নকশা-করা একজোড়া উড়ন্ত প্রজাপতির ওপর রেখেছিল হাতটা । যিশু জানায়, না, আজকাল ভোরবেলা আমার চোখ দিয়ে জল পড়ে । ডাক্তার বলেছে কান্নার থলিটা চোখের তলা থেকে কেটে বাদ দিতে হবে ।

যিশি কিন্তু জানাল না যে ক্যরটেজে কফিনদুটো নিয়ে গিয়ে সমাধিস্হ করার দিন বিকেলেই, ও যখুন কমপিউটার টেবিলের সামনে অনাহারে ক্লান্ত ধানশীষের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছিল, দেয়ালে ভাসাই-এর সেকোয়েরার গড়া কাঠের বেদনাময় খ্রিস্ট, পার্ক স্ট্রিটের বাতিস্তম্ভে হ্যালোজেনের বিষাদে রবিবারের রাস্তা একদম একাকী, হৃদরোগের অতর্কিত আক্রমণে চেয়ার থেকে লুটিয়ে পড়েছিল সাদাকালো চৌখুপি মোজেকে । রক্তচাপ ছ্যাঁৎ করে পড়ে গিয়ে ওপরে সত্তর নিচে চল্লিশ, নাড়ি স্পন্দন কুড়ি । হুঁশাহুঁশহীন স্হানান্তরিত হয়েছিল, এত জায়গা থাকতে, কত জায়গায় খ্রিস্টানদের সুবিধে থাকতে, বাইপাসে একটা হাসপাতালে, যেখানে গেট থেকে ঢুকেই হিন্দু দেবতার মন্দির ডাক্তারদের দায়মুক্ত করার জন্য সদাজাগ্রত ।

যিশুর চব্বিশঘন্টা কাজের ছেলেটা, উত্তর দিনাজপুর ভাঙাপাড়া গ্রামে বাড়ি, পতিতপাবন কীর্টনীয়া, পুতু, যাকে কমপিউটার, ফ্যাক্স, ই-মেল, অডিও কনফারেনসিং, ইনটারনেট চালাতে শিখিয়ে দিয়েছে যিশু, সামনের ফ্ল্যাট থেকে অজয় ব্যানার্জিকে ডেকে আনতে, ওই অজয়ই ভরতি করিয়েছিল হাসপাতালটায়, চেনাজানা আছে বলে ।

নিজেই প্রচণ্ড টেনশনে ছিল অজয়, তবু অনেক করেছিল । ও তো নিজেও একলা থাকে ।  ওর দিদির হেনস্হার খবর সেদিনই বেরিয়েছিল খবরের কাগজে । যিশুকে ভরতি করে, পতিতপাবনকে ইনটেনসিভ কেয়ারের সামনে বারান্দায় বসিয়ে, বাগবাজারে নরম্যান সায়েবকে খবর দিয়ে, রাত্তিরের দূরপাল্লার ট্রেনে গিয়েছিল দিদির কাছে ।

কী হয়েছিল হে ? পুতু বলছিল নাকি অনেক নোংরামি ? বিছানায় শুয়ে, অজয় অসহায় ফিরে এলে, জানতে চেয়েছিল যিশু ।

কথা বলার আগেই ফুঁপিয়ে উঠেছিল অজয় । তারপর সরি বলে, ধাতস্হ হবার পর, যা বলল, তা শুনে, ওষুধগন্ধের পারদর্শী মশারির শীতাতপে শুয়ে, যিশুর মনে হয়েছিল, এসব স্বাধীনতা-উত্তর সমাজ আর দেশভাগোত্তর হিন্দুত্বের দোষ । খ্রিস্টান সমাজে এরকম ঘটনা অসম্ভব । কালু মুদ্দোফরাসের ইবলিস ঔরসে জন্মতে আরম্ভ করেছে বাঙালিরা ।

দিদি বেঙ্গলি কোলফিল্ড উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস । শুক্কুরবার ইশকুল খোলার সময় গেটের মুখে নানা বয়সের ছাত্রী আর তাদের বাবা-মা চাকর-চাকরানির সামনে একদল লোক কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে, শাড়ি-ব্লাউজ ছিঁড়ে দিয়েছে, তাদে মধ্যে মহিলাই ছিল বেশি । আসলে, একদল স্হানীয় নেতা ইশকুলের মধ্যেই জোর-জবরদস্তি দুটো ঘর জবরদখল করে আরেকটা ইশকুল চালাচ্ছিল বলে দিদি ওদের সেই কবে থেকে বলছিল সময়টা আরেকটু এগিয়ে নিতে, যাতে মাধ্যমিকের ক্লাস আরম্ভ হলে বাচ্চাদের চেঁচামেচি এড়ানো যায় । কথায় কান দেয়নি ওরা । দিদি তাই রেগে-মেগে জবরদখল করা দুটো ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল । তাইতে এই অবস্হা। ভেবে দেখুন একবারটি ।

সে আবার কী রে বাবা ! ইশকুলের মধ্যেই জবরদখল ইশকুল ? শুনিনি তো আগে । বলেছিল হতবাক যিশু । একদল ছত্রাক-প্রতিম বাঙালির কাছে জবরদখল একটা ভালো আর বৈধ মূল্যবোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে । ঘরবাড়ি জমিজমার জবরদখল ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে ও । ওদের নিজেদের ধানি জমি দখল হয়ে কলোনি হয়েছিল । তখনকার ওই অঞ্চলের মুসুলমান চাষিগুলোর জমি বসত দখল হয়ে পরের প্রজন্মে তো বলতে গেলে চাষবাস থেকে একেবারে উৎপাটিত । কিন্তু ইশকুল দখল করে ইশকুল ! নাঃ, ভাবা যায় না ।

হাসপাতালের সেবিকা মেনকা পাইক পাশে দাঁড়িয়ে গল্প গিলছিল । বলল, যাকগে, আর এসব শুনতে হবে না, মনিটর দেখুন হার্টবিট পঁচাশিতে চড়ে দপদপ করছে ।

হাসপাতালের কর্তারা এমন লোভী যে ভরতি হবার সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকিয়ে দিসলো ইনটেনসিভ কেয়ারে । তারপর টানা পনেরো দিন রেখে দিলে আই সি সি ইউতে, যিশু একজন মালদার রুগি টের পেয়ে । দরকার ছিল না, তবু দুবেলা ইসিজি, ইকো, রক্তের নানা পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান, অ্যানজিওগ্রাফি । তারপর বেলুন অ্যানজিওপ্লাসটি করে, কুঁচকির ওপর স্যান্ডব্যাগ চাপিয়ে, খাটের হাতলে পা বেঁধে রাখলে । মান্ধাতা আমলের সব চিকিৎসা পদ্ধতি । অনেক রুগি এদের খপ্পরে পড়েছে ঢাকা-চাটগাঁ থেকে এসে । যন্ত্রপাতি স্টেরিলাইজ করা ছিল না বলে যিশুর ডান দিকের উরু হাঁটু পর্যন্ত জোঁক লাগার মতন ছিট-ছিটে কালো ফোসকায় ভরে গিয়েছিল । ওফ, দুঃস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন । সরে উঠে ফেরার পর পুতু পুজো দিয়ে এসেছিল নবদ্বীপের মায়াপুরে, হিন্দুদের চার্চে ।

ইনটেনসিভ কেয়ারটা ছিল বিশৃঙ্খলা, অযত্ন, দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা আর অকর্মণ্যতার স্বর্গরাজ্য । ছোকরা ডাক্তার-ডাক্তারনিগুনো শোবার পোশাক পরে রাত্তিরে ঘুমুতে চলে যায় রুগিদের প্রতি খেয়াল রাখার বদলে । সেবিকা, নার্স আর ঝি-চাকরগুনো ঢুলতো পালা করে, নাকও ডাকত । মাঝেমধ্যে বকরবকর ফস্টিনষ্টি । হাঁসফাস রুগির উদ্দেশে ইয়ার্কি থামিয়ে ডাক্তারকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনতে-আনতে, দেখেছিল যিশু, শরীরে বারতিনেক খিঁচ ধরে সে টেঁসে গেল । রুগির মরে যাবার পর, বাইরে রাত-জাগা অভূক্ত দিশেহারা স্বজনকে ডেকে এনে, মৃতের দেহে লাগানো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চক্রাবক্রা সবুজ আলো দেখিয়ে, মুখে অভিনয়ের কাঁচু আর মাচু এনে বলেছে, পেশেন্টের অবস্হা খুব খারাপ, আমরা চেষ্টা করছি, ভগবানে ভরসা রাখুন । আত্মীয়রা বাইরে বেরিয়ে যেতেই ঊর্ধ্বতনরা অধস্তনদের নির্দেশ দিয়েছে, ডেডবডি এখন রিলিজ করিসনি, বিল সেকশান থেকে আগে পুরো পেমেন্টের কনফার্মেশান আসুক ।

শুনে-শুনে আর দেখে-দেখে, প্রতিদিন অন্তত একবার, মনে হয়েছিল যিশুর, ভগবান লোকটা হিন্দুদের অসাধারণ আবিষ্কার । তা না ঈশ্বর, না দেবতা ।

আত্মীয়স্বজনকে, মৃত অথচ জীবন্তের-অভিনয়রত রুগি দেখানো হয়ে যাবার পর, যন্ত্রপাতি অতিতৎপরতায় খুলে, খরচাপাতির কাগজ বানিয়ে, কমপিউটারে যোগফল মিলিয়ে, লাশকে সাদা চাদরে ঢেকে, স্ট্রেচারে চাপিয়ে, অপেক্ষারত ভগ্নহৃদয় আত্মীয়কে বলা হত, অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমরা, বাঁচানো গেল না । হোটেলের মতন, হাসপাতালটায় লাশেরও চেকআউট টাইম আছে । লাশ তো আর বলবে না যে সে অনেক আগেই চেকআউট করেছে, বিলটায় একদিনের বাড়তি খরচ দেখানো হয়েছে ।

দেখা করতে এসে সদ্য-পরিচিত আদিত্য বারিক বলেছিল, এসব মেনে নিতে হয় স্যার, সমাজ ব্যাপারটা তো চিরকাল এরকুমই ।

একজন পয়সাঅলা মারোয়াড়ি বুড়িকে অপারেশানের পর মেডিকাল চেয়ারে বসিয়ে, মুখের ওপর ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে, যাতে না ঘুমিয়ে পড়ে, লেডি অর্থোপেডিক সার্জেন হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে এসে দেখে, ইনটেনসিভের ইনচার্জ ডাক্তারটা, বুড়িটা যন্ত্রনায় চিৎকার করে প্রলাপ বকছিল বলে, কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশান দিয়ে অজ্ঞান করে নেতিয়ে রেখেছে । বুকের ওপর মাথা-ঝোলানো ধনী পরিবারের গৃহকর্ত্রীর সামনে, ইনটেনসিভের কাঁচঘরে আধমরা মানুষদের মাঝে দাঁড়িয়ে, দুই ডাক্তারের সে কী বাংলা-ইংরেজি খিস্তিখাস্তা । যিশুর মনে হচ্ছিল নিউইয়র্কের হার্লেমের ফুটপাতে শুয়ে গালাগাল শুনছে ।

কোনো রুগি প্রলাপ বকলে, ঝি-চাকরগুনো মাঝরাতেও তাকে নকল করে ভ্যাঙাত, যেন রাস্তার নির্মম চ্যাংড়ারা লেগেছে পাগলের পেছনে : মাঁ কোঁতায় গ্যাঁলে, জঁল খাঁবো জঁল খাঁবোঁ ডুঁডু খাঁবোঁ, ওঁরে আঁলোঁটা জ্বেঁলেদেঁ, যঁতীন কিঁ এঁলো, ওঁ মাঁ মঁরে গেঁলাঁম, ওঁহ আঁর কঁষ্ট সহ্য হঁয় নাঁ ঠাঁকুর, বাঁবাঁগোঁ আঁর পাঁরছি নাঁ, বাঁড়ি নিয়েঁ চঁল রেঁ, বাঁড়ি যাঁবোঁ, হেঃ হেঃ হেঃ, দাদু, সকালে পোঁদে ডুশ দেবো, আর চেঁচিও না । ভাষার নতুন কলোনাইজারদের বচননাট্য ।

শেষদিন তো কর্মীদের অতর্কিত স্ট্রাইকের ধাক্কায় বিজলিবাতিহীন ইনটেনসিভে একসঙ্গে তিনজন মরে গেল । আন্দোলনের কোল্যাটরাল ড্যামেজ ।

ভেলোর যাওয়া উচিত ছিল, বলেছিল ফাদার নরম্যান, বা কোনো খ্রিস্টান হাসপাতালে ।

হাসপাতালটায় কমবয়সী অগুন্তি নগণ্য মাস-মাইনের প্রশিক্ষার্থী নার্স । সবাই বলে সেবিকা । কলকাতায় শব্দের খেলায় বেশ্যারা যেমন যৌনকর্মী, মুটেরা যেমন শ্রমিক, ঝি-চাকররা যেমন কাজের লোক, তেমন ফালতু কাজের জন্য সেবিকা । শাসক তার শোষণপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেবার জন্য শব্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে রূপের প্রতিরূপ ।

শিশ্তথুতনি মেনকা পাইক মাছের কাঁটা বেছে, ভাত মেখে, যিশুর মুখে একগাল পুরে বলেছিল, কাকুদা, তোমায় তো শুয়ে-শুয়ে খেতে হবে এই কয়দিন । মুখের মধ্যে মেনকা পাইকের তর্জনী মধ্যমা অনামিকা যখন যিশুর অস্তিত্বকে স্পর্শ করেছে, মায়ের জন্যে অদম্য মন-কেমনের হাহাকারে আচমকা ফুঁপিয়ে উঠেছে ও, গোপনে । শোকের রক্তাভ শিহরণ কন্ঠকে রুদ্ধ করে ছড়িয়ে পড়েছিল ফুসফুসে ।

মেনকা নিজের নাম বলেছিল ম্যানকা । লেখা না বলে বলত ল্যাখা । জোড়াভুরু ছিপছিপে স্বাস্হ্যবতী, কালোর মধ্যে চটক, অতিসোনালি কানের দুল, প্যাতপেতে লালফুল ছাপাশাড়ি, মুখমণ্ডলে ঘামের ফসফরাস দ্যুতি, দুচোখে দুষ্টুবুদ্ধি বন্যের অদৃশ্য চোরাস্রোত, চকচকে কোঁকড়া চুল টানটান বাঁধা ।  আরেকজন, কিশোরী-থেকে-তরুণী মেবেকে সঙ্গে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একদিন ভিজিটিং আওয়ারে, আমার বুইন কাকুদা, মহাকরণে কাইজ করে ।

কোন বিভাগে ?

কুন ডিপাট রে তর ?

তিন তলায় ।

কৃষি আধিকারিক ডক্টর ত্রিবেদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিল যিশু, বাঁ হাতের আঙুলে ঝোলানো অনেকগুলো কাপ, ডান হাতে চায়ের কেটলি ।

ইশ রে, কাকুদা ! কেমন আছে তোমার শরীর ? একেবারে সেরে গেছে তো ? সম্ভাষণের আহ্লাদ উপভোগ করেছিল যিশু । চালু-চায়ের অনুকাপে চুমুক দিয়ে, বি-বা-দী বাগের আকাশে দেখেছিল, ছাইমাখা মেঘেদের সফরসূচি চূড়ান্ত করতে বেরিয়ে পড়েছে কালবৈশাখী ।

চলি রে কেটলি, একদিন তোদের দুজকে তাজ বেঙ্গলে লাঞ্চ খাওয়াব, মেনকাকে কথা দেয়া আছে । বলে, নিচে নেবে বেরোবার মুখে, দ্রুতগামী ট্রেনের নিশুতি শব্দের মতন বৃষ্টি । ওফুটে কারপার্কের মাকাল গাছে, ঠোঁটে খ্যাংরা নিয়ে ভিজছে স্হপতি কাকপুরুষ । আকাশচুম্বী হাওয়ায় প্রতিভাদীপ্ত বিদ্যুতের স্নায়ুপ্রদাহে, কাতরে ককিয়ে ওঠে কয়েকটা অল্পবয়সী মেঘ ।