২০

বুকড়ি চালের ভাত আর আগাছা ট্যাংরার ঝোল খেয়ে, অবেলা ওব্দি ক্লানত গুম ধেকে উঠে, দাওয়ায় বেরিয়ে যিশু দেখল, হাতল-আলা চেয়ারের পিছনের দু-পায়ায় ভর দিয়ে দোল খাচ্ছে ভবেশকা । কালো ভারিক্কি চশমা । বাঁ পায়ে ভয়ানক ঢেউ-খেলানো গোদ ।

ভবেশকার পায়ে গোদ ! ভাবা যায় ? লাফিয়ে উঠে যেত পুলিশের ভ্যানে । মিছিলের নেতৃত্বে হেঁটে চলে যেত  এসপ্ল্যানেড ইস্ট পর্যন্ত । একবার তো কলেজ স্ট্রিটে বাসের ছাদ থেকে রাস্তায় নেবেছিল লাফিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেরা দেখেছিল, অ্যালবার্ট হল কফিহাউসে বসে গল্প করেছিল বহুকাল ওব্দি । গোদের জন্যই বোধয় গেরুয়া আলখাল্লা । আলখাল্লার জন্যে সত্য সাইবাবা ।

জলেতে ভুরু ভাসিয়ে-রাখা কুমিরের মতন চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে চোখ তুলে নাকচ-করা দৃষ্টি মেলে, সর্দিগর্মিতে নাকবন্ধ গলায় ভবেশকা বলল, কী এখুনো আলুর রিপোর্ট ফাইনাল কত্তে পাল্লে না ? কী-ই বা আচে এতে ? আমি তো অ্যাক দিনে লিকে দিতে পাত্তুম ।

এরম অনেক মানুষ আছে । জানতে না চাইলেও নিজের বিষয়ে বলবে । গতবার তারকেশ্বর লোকালে, ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি ভিড়ে ওর, যিশুর, গায়ের ওপর দাঁড়িয়ে এনতার কথা বকছিল দুজন বউড়ি যুবতী । ছোট্টখাট্ট গোলগাল, অত্যধিক সিঁদুর । যিশু বসেছিল, আর ওর দিকে মুখ করে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে, ওর কাঁধের ওপর দিয়ে জাল আঁকড়ে । ওদের নির্ভেজাল অতিমাংসল বুকে যিশুর নিশ্বাস পড়ছিল নিশ্চয়ই । চানাচুর চিবোবার শব্দের মতন ওদের একজন বলে উঠেছিল, আমো তো অ্যাকদোম সেন্টটেন্ট মাকি না । যিশুর বিদেশি পারফিউমের প্রতি কটাক্ষ । দার্শনিক গাম্ভীর্যের আড়ালে যিশু বুঝতে পারছিল, এদের মাংসের ঘর্মাক্ত অকৃত্রিম গন্ধ যদিও ওর খারাপ লাগছে, তবু তা এক ঝটকায় বিপথগামী করে দিতে পারে । ওদের লাল ব্লাউজের আহ্বায়ক বাহুমূলের টানটান সাদা সুতোর সেলাই, যিশুকে চোখ বুজতে বাধ্য করেছিল ।

বউ দুটির তক্কাতক্কি, কার জামাইবাবু শালির পেটে বাচ্চা এনে ফেলেছিল, দোষ তিনজনের মধ্যে কার, এখুন কী করণীয়, তাই নিয়ে । কইকালার ঘরজামাই নিতাই সাহা । শালি, একমাত্র, কণা । বউটার নাম আলোচনায় আসেনি । ওদের গল্পের থুতুর ছিটে লাগছিল নিরুপায় যিশুর মুখে-হাতে-গলায় । হাওড়ায় নাবার সময়েও নিষ্পত্তি হয়নি কার আত্মহত্যা করা উচিত, তিন জনের মধ্যে কার । প্ল্যাটফর্মে পা দিয়ে, ওদের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে যিশু আলতো শুধিয়েছিল, দুজনকে দুপাশে নিয়ে শুক না নিতাই, ঘটেই যখন গেছে ব্যাপারটা ।

এখন, এই মুহূর্তে, ভবেশকার কথার কী উত্তর দেবে ? ভবেশকা বোধয় দুর্ব্যাবহারের সম্ভাবনা গড়া তোলার লোভে পড়েছে । কারণ, মনে হয়, আলু । একদা হুগলি জেলার কংরেসিরা বাজার থেকে আলু লোপাট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে আস্তিন গুটিয়ে বাসে-ট্রামে আগুন ধরিয়ে গুলিতে মরার জন্য রাজপথে নেবেছিল পরোয়াহীন যুবক ভবেশকা । আজ পায়ে গোদ, গেরুয়া, বাবরি চুল, আলখাল্লা, বুড়ো, মহাজন, ভূস্বামী, আঙুলে গ্রহরত্নের রুপোর আংটি, ধর্মগুরু, দলাদলি, ভবেশকার কিচ্ছু যায়-আসে না । হাজার-হাজার কুইন্টাল আলু পচলে, আলু-চাষি সর্বস্বান্ত হলে, আলুর দাম পাকা বাজারি-কাঁচাবাজারি দাঁওপ্যাঁচে নিম্নবিত্তের পক্ষে অসহনীয় হয়ে গেলেও কিচ্ছু যায়-আসে না । পচা আলু আসা আরম্ভ হয়ে গেছে শহরগঞ্জের বাজারে । চাষিরা গোর দিচ্ছে ।

নির্লিপ্ত নির্বিকার নৈর্ব্যক্তিক মহারাজ ভবেশকা বসে আছে প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকত্বের জাদু-সিংহাসনে, নাক ফুলিয়ে, হাসি নেই । জিভের ভাষায় আড় পর্যন্ত পালটে, করে ফেলেছে স্হানীয় । পায়ের গোদে হাত দিয়ে হিন্দুয়ানি প্রণাম করে যিশু বলল, প্রান্তিক চাষিদের সার আর সেচের চাহিদা-জোগানের ব্যাপারটা দেখিনি তখুন, আজকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নেব । তুমি ভালো আছ তো ? কথাগুলো বলতে-বলতে যিশু দেখল বারান্দায় ঘটি আর জলভরা বালতি রাখা রয়েছে । গোদ-ছোঁয়া হাতটা ধুয়ে নিতে হবে ।

আমি ? হঁ । আরে আমরাও তো সব কল্লুম, নইলে কোতায় থাগতে তোমরা আজগে ? তা ভেবে দেকেচো ? এই যে ধরনা, ঘেরাও, বয়কট, অবরোধ, ধীরে চলো, কর্মবিরতি, র‌্যালি, সমাবেশ, হরতাল, পথসভা, গেটসভা, এইসব ? এই সব গণতান্ত্রিক হাতিয়ার । এসব চাড্ডিখানি কতা নয় হে । নদী যেভাবে নিজের ঘোলাস্রোতে গা এলিয়ে দেয় বর্ষার বাজে কথায়, ভবেশকা, দরবেশ-পোশাক ভবেশকা, বলে যায় নিজের অভ্যস্ত গল্প । নিমের দাঁতনের মতন আতীতকে চিবিয়ে-চিবিয়ে ছিবড়ে বার করে ভবেশকা । দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, থামে হেলান দিয়ে শুনতে-শুনতে, খেই হারিয়ে ফেলে যিশু । ওর চারপাশে ওড়ে খোশমেজাজ বুদবুদ ।

আচমকা একটা কোকিল ডাকতে আরম্ভ করে । উত্তেজনার পর্যায়ে উঠে যায় পাখিটার ডাক । ভবেশকাকে বাধ্য করে রোমন্হন পালটাতে । তোমার জন্যে কামারপুকুরের বোঁদে আর সিঙুরের দই আনিয়ে দিয়েচে কৃপাসিন্ধু, জলখাবারে খেয়ে দেকো । আর খানাকুল থেকে কালাকাঁদ আনতে বলেচি বিষ্ণু সাঁবুইকে ।

যিশু ফিরে আসে সম্বিতে । মিষ্টিগুনোর নামের মধ্যে মিষ্টিগুনো আর নেই । শব্দের মানে ব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গে আজ মৃত্যুশয্যায় । ও, যিশু, দেখল, আর্কাজাতের করলার জন্যে টাঙানো তারের মাচার তলায় ঢুকে, বেলে-দোআঁশ মাটিতে বসানো হলুদ চারার কেয়ারি বাঁচিয়ে করলা লতার শুকনো পাতা ছাঁটাই করছে খুশিদি, কুঁজো বুড়িদের মতন ঝুঁকে । খুশিরানি মন্ডল । পনেরো থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বয়সের স্হিতিস্হাপকতাকে ইচ্ছেমতন নিয়ন্ত্রণ করে খুশিদি । বিশুদ্ধ আকর্ষণ ছাড়া বিশুদ্ধ যৌনতা হয় না । কীভাবে, কোথায়, মুলতুবি ছিল এই আকর্ষণ ? মস্তিষ্কে ? হবেওবা ।

আচ্ছা ভবেশকা, তুমি নিজেও বিয়ে করলে না, খুশিদিকেও আগলে-আগলে রাখলে, বিয়ে দিলে না । কেন বলো তো ? যিশুর অযাচিত প্রশ্নে আপ্রস্তুত ভবেশকার ্তচকিত চমক । যেন এই প্রশ্নের উত্তর আজীবন লুকোতে-লুকোতে নেশা ধরে গেছে কোনও গোলকধাঁধার আমোদে । হরিণের উৎকর্ণ মাথা নাড়িয়ে খুশিদি রান্নাবাড়ির দিকে চলে যায় ।

ভবেশকা দু-হাত সামান্য তুলে ঘোরায় । বলল, লোকে করলা, লাউ, কুমড়ো, চিচিঙে, ঝিঙে গাছে আজগাল ডিডিটি আর বিএচসি দিচ্চে, ভাবদে পারিস, অ্যাঁ ? দেকগিজা, দেকগিজা, আমার মাটিতে লেদা, চুঙি, পাতামোড়া, কুরনি, গণ্ডারে, কাঁটুই কোনও পোকা পাবি না তুই । হাতের তালুতে আগুনে-বাত হয়ে চামড়া উঠছে ভবেশকার , বলল, পানের চাষও করেছিলুম, বুজলি, আংরা দাগ ধরে বড্ডো, নইলে…

জবাজবদিহি চেপে রাখত চাইল না যিশু । আত্মতৃপ্ত প্রশান্তি থেকে নাড়া দিয়ে ভবেশকাকে টেনে বের করার চেষ্টায় নাছোড়, অস্বাভাবিক প্রত্যয়ের সঙ্গে জানতে চায়, কই বললে না তো, সংসার পাতলে না কেন ? সামান্য থেকে, সতর্কতা মিশিয়ে সন্তর্পণে যিশু বলল, খুশিদিরও বিয়ে দিলে না কেন ?

যিশুর দিকে না তাকিয়েই হাসল ভবেশ মণ্ডল । পরস্পরকে বিব্রত করার মতন কিছুক্ষণের স্তব্ধতা । থামে হেলান দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় যিশু । হাসনিহানার নিরিবিলি গন্ধের বিচ্ছুরণে দুজনেই টের পায়, সন্ধে নেবেছে বহুক্ষুণ । জুনিপোকার উড়ন্ত আলোয় ধুকপুক করছে অন্ধকার । নিষেকের পর করলা-ফুলের ডিম্বাশয় চুপচাপ রূপান্তরিত হচ্ছে ফলে ।

চেয়ার থেকে তার ক্যাঁঅ্যঅ্যঅ্যচ শব্দটা নিজের পাছার সঙ্গে তুলে নিয়ে ভবেশকা বলল, ভবিতব্য হে ভবিতব্য । যেন ভবি আর তব্য আলাদা-আলাদা ।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যিশু দেখতে পায় মশারির বাইরে খুশিদি । উঠে এসেছে নিজের ঘর থেকে । অনুচ্চস্বরে বলল, যিশকা, সরে শো, একটু জায়গা দে ।

এত অস্ত্রশস্ত্রের ঘরে কেন শুতে দিলে খুশিদি ? জিগ্যেস করেছিল যিশু, যখন যিশুকে করলা-ফুলের পরাগ মাখিয়ে আর নিজে কাকভোরের বাতাস মেখে চলে যাচ্ছে খুশিদি । আর খুশিদি বলেছিল, শিয়োরে লোহা নিয়ে শুলে ভুতপেত দূরে থাকে । তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল যিশু । ঘুম ভাঙলে শেনতে পায় খুশিদির একটানা কন্ঠস্বর:-

কোতায় আচো গো মাতা লক্ষ্মী দয়াবতী

কাতরে তোমার পায়ে করিগো মিনতি                                                                                           অ্যাকেতো অবলা মোরা তাতে ভক্তিহীন                                                                                         বিদ্যেবুদ্ধি শক্তিহীন সদা অতি দীন

না জানি করিতেস তুতি না জানি পুজোন                                                                                           কেমনে তোমারে মোরা করি আবাহন                                                                                               কেবলি ভরোসা মনে ইহা শূন্য আচে                                                                                                 যে তোমাকে ডাকে তুমি যাও তার কাচে                                                                                            নিজ গুণে কিপা করি বসিয়ে আসনে                                                                                                 কিপা দিষ্টি করো মাগো যতো ব্রতীজনে                                                                                             এই মাত্র বর তুমি দেও গো সবায়                                                                                                   সতত ভকোতি যেন থাকে তব পায়

লক্ষ্মীর রেফারেন্স রয়েছে যখন, তার মানে এটা বোধয় পাঁচালি, শুনে-শুনে মুখস্হ করে ফেলে থাকবে খুশিদি । এভাবে দিনের পর দিন মুখস্হ বলার কথাগুলোর কোনও মানে কি আর আছে খুশিদির কাছে ? যিশুর মনে হল এ যেন খুশিদিরই বন্দনা । আজানা কোনও কিছুর প্রতি খুশিদির এই প্রগাঢ় আত্মসমর্পণ আর বিশ্বাসের ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তার জন্যে হিংসে হয় যিশুর । কত লোক, হাজার-হাজার লোক, ইদের দিন নামাজ পড়ে । রবিবারের দিন চার্চে হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে বহুক্ষুণ নিঃশব্দ প্রার্থনা জানায় । মন্দিরের সিঁড়িতে বহুক্ষুণ যাবত মাথা ঠেকিয়ে থাকে । বিভোর হবার মতন ওই বীজ, খুসিদির সংস্পর্শে এসে, খুশিদির জন্যে, নিজের সত্তায় আবিষ্কার করে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল যিশুর ।

বিছানা ছেড়ে জামাকাপড় পরে যিশু বেরিয়ে পড়ে গাঁয়ের আঁদুল-কাঁদুল ঘুরতে । ফেলে-ছড়িয়ে রোদ উঠেছে । রোদ্দুরের ভয়ে বটগাছটার ছায়াসঙ্গিনী তখুনও ওর তলা থেকে বেরোয়নি । বুড়ো শিব ঢাকা পড়ে আছে শুকনো বটপাতায় । কিংবা এখুন পার্বনহীন অনাদরে শেষনাগ হয়ে আছে । পাতাগুনো ওপর থেকে কয়েকটা সরিয়ে দিল যিশু । পিঁপড়ের কাতার । সাতসকালে কেউ এসে চিনিগোলা দুধ ঢেলে থাকবে । গাছটার ডালে ডালে বুনো মউমাছির চাকগুনো থেকে একাধ কুইন্টাল মোম বেরোয় । কত লিটার মধু আছে কে জানে । বটগাছটা মধু চায় না ।

মন্দিরে পুজুরিটা একা । দেবতার সাজগোজ চলছে । মেলার দোকানপাট অগাধ ঘুমে । তালটিকুরির দিকটায় দার্শনিক উদাসীনতায় হাগতে বসেছে বুড়ো আর জোয়ান । যাত্রাদল আসছে মেলায় । মুনমুন সেন আর তাপস পালের গালফোলা পোস্টার । যাক, ভালোই, বিকেল থাকতেই পুরো তল্লাট ছেয়ে যাবে অচেনা গাদাগাদি ভিড়ে । লাঙল আর জোয়ালের কাঠ কিনতে আসে মেলাটায় দূরদূর থেকে চাষিরা । বেগমপুর আর গুপ্তিপাড়া থেকে সং আসে । ঘন্টাকয়েক পর থেকেই লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়ে যাবে মেলায় ।

ভোরের আলোর কুচিকুচি ঢেউ যিশুর চোখেমুখে ঠাণ্ডা হাওয়া মাখাচ্ছিল ।

চারিদিকে মূষিক প্রসবকারী গর্ত । সারোতা, গোপের হাট, খেমাপাড়া, তেঘাট যাবার ছক্করগাড়ি আর ভ্যান-রিকশা এই ভোর থেকেই । রাস্তা পার হচ্ছিল একজন বুড়ো চাষি । হাতে ধরা দড়িতে রোগাটে দিশি গাই , পেট ঢোকা, পাঁজর জিরজিরে । যিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, গোরুটার আওয়া হয়েচে, গুয়াবুড়ি শাগ খাওয়াতে নে যাচ্চি । রোগ আর তার ওষুধ, দুটোর কিছুই জানে না যিশু । কী বলবে ? রাস্তার পাশে হিলুয়ার ভূঁয়ে নেবে-পড়ে ফিতে-কিরমিতে ভোগা গতরের বৃদ্ধ আর তার গাই ।

রাস্তার দু’ধারে আলুর বস্তা, একের ওপর আরেক, গোটা বিশেক করে, পড়ে আছে হিল্লে হবার অপেক্ষায় । কবে কে জানে । পাহারা নেই । রাস্তার কিনার-বরাবর একের পিছনে আরেক চাষি বা খেতমজুর, লুঙ্গি-গেঞ্জিতে, সাইকেলে তিনটে বস্তা চাপিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে, ভারসাম্য বজায় রেখে । কে জানে কোথায় যাচ্ছে । মুখ খুলে কথা বললেই কাহিল হয়ে পড়বে লোকগুনো ।

মোড়ের ঝুপড়িতে বসে চা আর ভাণ্ডারহাটির রসগোল্লা খায় যিশু । মহানাদের খাজাও ছিল । তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে চমচম খেতে ভালোবাসত খুশিদি । ছবি বিশ্বাসের বাড়ির পাশেই ছিল ময়রার দোকানটা । খ্রিস্টান চরিত্রে অভিনয়ের খুঁটিনাটি জানার জন্যে বাবার কাছে এসেছিল কয়েকবার । এখানে ভবেশকার বাড়িতে চায়ের ব্যবস্হা নেই । এককালে চায়ের পর চা না হলে ভবেশকার গলায় বক্তৃতা আটকে যেত । ভবেশকাদের যুগের আগে এমন ছিল যে ফরসারা কালোদের, ঢ্যাঙারা বেঁটেদের, শহুরেরা গেঁয়োদের, সবর্ণরা অন্ত্যজদের, পয়সাঅলারা গরিবদের, ধোপদুরস্তরা নোংরাদের, টেরিকাটারা উস্কোখুস্কোদের, রাজনৈতিক বক্তৃতা দিত । এখনও আছে অনেকটা । অ্যাবং, অ্যাবং, অ্যাবঙের শিকলি জুড়ে-জুড়ে কজনই বা অবিরাম বকে যেতে পারে । বাংলাভাষাটা তো আর সব বাঙালির নয় । বেশিরভাগ লোক তো স্যাঙাত হয়ে ল্যাঙাত খায় ।

চা খেয়ে, গোপের হাটের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে, একটা পেঁপে বাগান দেখতে পেয়ে, গাছে-গাছে কুর্গ-হানিডিউ জাতের সোমথ্থ পেঁপে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যখুন মনে-মনে প্রশংসা করছিল যিশু, বাগানের ভেতর থেকে দোহারা যুবক, জিনস প্যান্টে গোঁজা হাতকাটা গেঞ্জি, শহুরে স্মার্ট চেহারা, ডাকে ওকে, আপনি তো স্যার ভবঠাকুরের আত্মীয়, শুনেছি, হিমঘর নিয়ে গবেষণা করছেন ।

যিশুর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে ভয় । মাত্র ক’দিনে লোকে ওর গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত । ভাগ্যিস মেলা আর যাত্রার ভিড় থাকবে, নইলে বিপদ অনিবার্য । গ্রামে আর ঘোরাঘুরি চলবে না । বহিরাগত সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা আর ঔৎসুক্য থাকবেই । যিশু বলল, দু-আড়াই কেজির ফল হয়, না ?

যুবক তার গাছের অস্মিতা ধার করে । আজ্ঞে স্যার তিন কেজি ওব্দি হয় । যিশু এর পর মাটি আংলানো, বীজে সেরেসার ড্রাই মাখানো, মাটি চৌরস, নুভাক্রন স্প্রে, হাওয়া-পরাগি ফুল, কত মাদিগাছের জন্যে কটা নরগাছ, তরুক্ষীরের পেপেন, লালমাকড়, কুটে রোগ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত প্রশ্নের সিরিজ সহযোগে যুবকের মনে শ্রদ্ধা তৈরি করলে, যুবক ওকে তাদের বাড়ি যেতে বলে । ওই তো, দেখা যাচ্ছে, স্যার আসুন না ।

আরেকদিন কখুনো, জানিয়ে, ফেরার রাস্তা ধরে যিশু । জানা রইল বাড়িটা, দরকারে কাজে লাগবে । কিন্তু ও খ্রিস্টান জানলে পুরোটা শ্রদ্ধা কি বজায় থাকত ? ভবেশকাই হয়তো সিংহাসনচ্যুত হয়ে যাবে, জানাজানি হলে । ভবেশকাও বলবে না কাউকে ।

ফিরে, যিশু দেখল, জাবেদালি এঁড়ে বাছুরটার লাফঝাঁপ সামলে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে । ভাগচাষিদের গ্রামীণ রাজনীতির বখরা দিয়ে বর্গা এড়াবার কায়দা করে ফেলেছে লোকে । ভবেশকার পরিবার বলতে কেবল ভাই-বোন । জাবেদালি ক্ষমতার বখরাটুকুতেই তৃপ্ত । অনেক জায়গায় তো ভাগচাষ এড়াতে লোকে এড়িয়ে যাচ্ছে চাষবাস, ইউকালিপটাস পুঁতে ফেলছে অথচ এখানেই পোলবা থানার হালসুই গ্রামে প্রথম বর্গা ক্যাম্প বসেছিল । হিমঘরের আলু পচিয়ে সেই পোলবা আজ জগদবিখ্যাত, সত্যিই জগদবিখ্যাত । পচা আলু থেকে চামড়ায় রোগ ধরেছে চাষিবউদের ; সারছে না ।

জাবেদালি জানালে, ভবঠাকুর হিমঘরে গেছে, যিশধ যেতে পারে যাবার থাগলে । হৃৎপিণ্ডে সমুদ্র চলকে ওঠে, শব্দ শোনা যায় । দাওয়ায় উঠে জুতো খুলে রেখে, তার পর নেবে হেঁসেলে ঢুকে যিশু দেখল, চাকা-চাকা আলু কাটছে খুশিদি । অত্যধিক ধেনো-টানা পথে পড়ে-থাকা মাতালের মতন একটা শোলমাছ বিলকিয়ে উঠছে থেকে-থেকে ঘরের কোণে ।  ধোঁয়াহীন চুলাটায় বোধয় প্রথম দিনের পর আর রান্না হয়নি । বাসনকোসন সবই কাঁসা আর পিতলের । এ-গ্রামে এখুনও স্টেনলেস স্টিল ঢোকেনি বোধয় । চালায়-ছাদে বুস্টার লাগানো অ্যান্টেনা দুতিনটে নেতাবাড়িতে নজরে পড়েছে গ্রামে । ভবেশকার নেই । কেবল-ও, পার্টির অনুমতি আর ট্যাক্স ছাড়া টানা যায় না ।

মেঝেয় বসে যিশু বলল, আমি তো বেজাত, মদ মাংস গোরু শুয়োর সব খাই ।

জানি তুই মেলেচ্ছো , ওই পিঁড়েটা নিয়ে বোস ।

তোমাকেও ম্লেচ্ছ করে তুলব ।

আমার কিন্তু বড্ডো ভয় করচে । আমি এমন অপয়া । অশথ্থগাছ তুলে পুঁতেছিলুম, তাই । অশথ্থগাছ ওপড়াতে নেই । নম্রতায় ঢাকা খুশিদির সত্যিকার আশঙ্কা ।

কুটনো কোটা হয়ে গেলে, তোলা উনুনের পাশে যখুন বঁটিটা মুড়ে রাখছে খুশিদি, যিশু বলল, ভবেশকাকে যদি বলি, আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি, বিয়ে করতে চাই, তাহলেও রাজি হবে না ভবেশকা ; কেন, আমি জানি ।

না না না না না না । প্রায় আঁৎকে ওঠে খুশিদি । অ্যাকদোম পাড়িসনি ওসব কতা । খুশিদির আতঙ্কিত মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে কয়েক দশক যাবৎ জমানো অন্তরঙ্গ উচ্ছ্বাসের রক্তিমাভ আকুতি । পারবি তো ? যিশকা ?

তোমাকে এভাবেই আগলে রেখে দেবে ওনার হিমসংসারে । কেন, আমি জানি । তার পর পচা আলুর মতন……

তুই আজ বাইরে-বাইরেই থাক । আকাশের মুকও আজ যা দেকচি, বিকেলে হয়তো কালবোশেখি আসবে, ভালোই হবে একদিক থেকে । ভাঙা গলায় বলল খুশিদি । যেন নিজেই নিজেকে পাহারা দিচ্ছে । পোড়াবাড়ির ডাকবাক্সে বহুদিন পড়ে-থাকা চিঠির মতন কেমন এক প্রাপকহীনতা ভর করে আছে । উঠে পড়ে যিশু । হিমঘর রওনা হয় মোজা-জুতো পরে ।

সকালের উদার শীতবাতাসকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে অন্তরীক্ষ । রোদের কণায় ঘষটানি খেয়ে দিনের আলো ক্রমশ ্য়ে উঠছে অনচ্ছ । অশোভন বৈশাখী গরম । কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করার আগে পাতাহীন মগডালে বসে আছে তরুণ শকুনেরা । নিজেরই অনন্যোপায়, আকাঙ্খার আক্ষেপ, খুশিদির জন্যে পুনর্জীবিত বয়ঃসন্ধি, হিমঘরের দিকে যেতে-যেতে, নিজেকে বোঝার চেষ্টা করছিল যিশু । আর কখুনও তো এরম হয়নি, কারুর জন্যে । লাফিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে নিজের ভেতর থেকে । ঢোলবাদকদের বাহুর দুপাশে বাঙ্ময় ডানা মেলে ছুটতে ইচ্ছে করছে আলের ওপর দিয়ে ।

হিমঘরে ভবেশকার দরবার বসেছে । চিন্তান্বিত ভবেশকা প্রৌঢ় আই-এ-এস আমলার ঢঙে কালো ফ্রেমের চশমা খুলতে গিয়ে হাত নেড়ে বলতে চাইছিল কিছু । চা ভরতি গেলাস টেবিলের ওপর থেকে পড়ে চুরমার । অস্বাচ্ছন্দ্যের তাৎক্ষণিক ঘোর থেকে চকিতে নির্মিত প্রসন্নতায় যেতে দেরি হয় না । এসো, এসো, পুলিন তুই টুলটায় বোস, যিশুকে বসতে দে ।

এক ডজন লোক হবে এখানে । একজন বিশাল-পাছা মহিলা, পঞ্চায়েত কি পার্টির উঠতি-নাবতি কেউ । যিশু কেবল কৃপাসিন্ধু আর শাসমলকে চেনে । পুরুষগুনোকে দেখে মনে ্চ্ছে এরা কেউ চান করে না, চুল আ#চড়ায় না, নিয়মিত দাড়ি কামায় না । একত্রত হলে গুজগুজ-ফিসফিস করে । বাঙালির রেনেসঁসের উত্তেজনায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী পূর্বপুরুষদের মাত্র চতুর্থ উত্তরপুরুষ ওব্দি পৌঁছে বাঙালি গ্রামসমাজে যিশু নিজেকে বেমানান পেল । এদের  দেখে কথাটা স্পষ্ট যে ধুতি পরার রেওয়াজ গ্রামেও শেষ হয়ে এল ।

শাসমল ঘড়াঞ্চি সিঁড়িতে বসে । কিছু বলার জন্যে হাঁ করেছিল । মুখ বন্ধ করে অক্ষরগুনোকে ফুসফুসে ফেরত পাঠিয়ে দিলে । ওর পাশে হাতলভাঙা চেয়ারে ময়লামতন বেঁটে, গালে দুদিনের নুন-গোলমরিচ দাড়ি, গেরুয়া পাঞ্জাবি, অভিব্যক্তিহীন অলস চাউনি মেলে বলল, সকালে পেঁপে দেখতে যেওয়া হয়েছিল ? লোক ভালো নয় স্বপন সামন্ত । জেলাসদরে মিধ্যে চিটি লিকেচে আমাদের হিমঘর নিয়ে । যেন আমরা সবাই চোর আর উনি হরিসচন্দোর । ওর বাপটা তো অতুল্লো ঘোসের চাকর ছিল । ল্যাঙোট কাচত । আর গেঁটে বজ্জাত দাদুটা পোফুল্ল সেনের দয়ায় আলুর ট্যাকায় জমিজমা করে নিলে ।

টেবিলের ওপর তবলাবাদকের আঙুল নকল করে একজন বৃহদায়তন নিতম্ব বলল, জহোর্লালের দ্যাকাদেকি যখুন সুবাস বোসকে হেয় করছিল ওই পোফুল্ল ঘোস, কিরনসংকর রায়, নলিন সর্কার, নিমল চন্দর, তখুন ওদের ল্যাংবোট ছিল ওর দাদু ।

লোকটাকে দেখতে-দেখতে যিশুর মনে পড়ে গেল সেই অডিটারদের চেহারা, যাদের কিছুদিন আগে পুরুলিয়া জেলা সমবায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিল । এই লোকগুনো বোধয় অন্যের জীবনকাহিনীতে তালাবন্ধ । বিপুলবপু লোকটা গ্রামের কিংবা ব্লকের কিংবা আরও বড়ো ভূখন্ডের সমসাময়িক রাজনীতিতে ভবেশকার চে উঁচুতে । চিৎকার করে মুণ্ডেশ্বরী নদীতে ঢেউ তোলে । নিজের কথাবার্তাকে বাকচাতুরীর আড়ালে কী উদ্দেশ্য দিতে চাইছে আঁচ করতে না পেরে, যিশির মনে হল, এরা সবাই পার্টিমণ্ডুক, ছদ্মবেশী বেকার, আর ও এদের একটা ওয়াক-ইন ইনটারভিউ দিচ্ছে ।

ও, যিশু বিবৃতির ঢঙে বলল, পেঁপেগুনো কিন্তু বিরাট-বিরাট ।

তা হবে না কেন ? ব্যাংকের লোন নিয়ে মহাজনি করা হয় । মহিলার মন্তব্য ।

তাই বুঝি ? যিশুর মনে হল, জগৎটা মিটমাটপন্হীদের । প্রত্যয়ও চাই আবার মিটমাটও চাই ।

আমাদের চাসিদের আতান্তরে ফ্যালেনি ? এই এনাদের জিগ্যেস করে দেকুন । রোগা, কালো, ময়লা-জামাকাপড় বৃদ্ধের উক্তি ।

আলু রপ্তানির নিষেদনামা তো উটে গ্যাচে । আফরিকায় দেসে-দেসে লোকে আলু খায় ভাতরুটির বদলে ।

টুলে-বসা পুলিন জ্ঞান দিলে ভবেশকা অবস্হা সামাল দ্যায় , আরে ওকে কী বোঝাচ্ছিস, ও নানা দেশ ঘুরেচে ।

এবার আমরা ওননো রাজ্যেও পাটাতে পারবো, বলল পাশের লোকটা, যার গা থেকে তিতকুটে গন্ধ বেরুচ্ছিল ।

পশ্চিমবঙ্গে শিষ্টভাষার নামে কলকাতায় যা আজ বাজারচালু, সেই লোকগুনোর কথা শুনে যিশুর মনে হচ্ছিল, দেশভাগ না হলে তা এক্কেবারে আলাদা হতো ।

আমাদের দোসে আলু পচেনি, আর বাড়তি আলু রাকিও না আমরা । গেরুয়া পাঞ্জাবি বক্তব্য পেশ করে । স্বপন সামন্ত যেসব চুগলি করেচে, সব মিথ্যে ।

ওফ, এরা এখুনও ভাবচে ও একজন আলুগোয়েন্দা । কেলেংকারি জড়ো করে-করে প্রতিবেদন লিখে কোনও অজানা ওপরঅলাকে পাঠিয়ে এদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ক্ষমতা সব নষ্ট করে দেবে । পশ্চিমবঙ্গে কেউ কি কোথাও সত্যিই আছে, যাকে ধরলে দুর্ভোগের প্রতিকার হয় ?  কাঙধ কাঙপিয়ে স্বাভাবিক হাসি হেসে ফ্যালে যিশু । বাইরে মুটিয়াগুনো এখনও পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে, আর শেডের তলায় রাখা আলুর বস্তার সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে । যিশু বেফাঁস বলে ফেলল, ওগুনো কী হবে ?

ওসব আড়তদার, ফড়ে, মহাজনদের মাল, নিয়ে যাবে । ভবেশকার খোলসা ।

স্বপন সামন্তের অভিযোগের কপি দেয়া হয়েচে নাকি আবনাকে ?

দেয়া হয়েচে, করা হয়েচে, শুনে আদিত্যর কথা মনে পড়ে গেল যিশুর । ওর জেরা করার কায়দা । ইংরেজ পুলিশ অফিসারদের কাছ থেকে অনুবাদ করে পেয়েছিল বাঙালি ঊর্ধ্বতনরা । দিয়ে গেছে অধস্তনদের, আদিত্যকে । সেদিন মোটরবাইকে উধাও হয়ে গেল আচমকা, অদ্ভুত । উপস্হিত লোকগুনোর মুখের ওপর চাউনি ঘোরাল যিশু, আর দেখতে-দেখতে মনে হল, মানহানি ব্যাপারটা সম্ভবত আর্থিক । আত্মিক নয় ।

না, তা ইমঘর নিয়ে ওনার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি আমার । উনি যে চিঠি-ফিটি লিখে কমপ্লেন করেছেন, তা-ই জানতুম না । কপিটা পেলে মন্দ হতো না । অবশ্য ওসব কমপ্লেন-ফমপ্লেনে কারুর কিছু হয় না আজকাল । গাজোয়ারি ছাড়া কিচ্ছু আর কাজে দ্যায় না ।

হুঁ ।

সকালে বেড়াতে-বেড়াতে দেখলুম অত বড়ো-বড়ো পেঁপে, তাই দাঁড়িয়ে পড়েছিলুম । মুখগুনোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল হতভম্ব যিশু, কেউ বিশ্বাস করছে না ওকে ।  কী বিপজ্জনক । বাড়িতে থাকলে সন্দেহ হতে পারে, আবার গ্রামে বেড়ানোটাও উদ্রেক করছে সন্দেহ । গত দশ-বিশ বছরে গ্রামে-গ্রামে, এমনকী কলকাতার সনাতন পাড়ায়-পাড়ায়, নতুন এক সন্দেহভিত্তিক বর্ণাশ্রম উদ্ভব হয়ে্ছে । নতুন তত্ত্বটার নাম শত্রুশিবির । তা থেকেই নতুন বর্ণ-বিভাজন । বাইরের লোক আর কোনও গ্রামে গিয়ে জমিজমা কিনে টিকতে পারবে না ।

চৌকাঠের কোণের গর্ত থেকে একটা গোবরিয়া বিছে বেরিয়ে বিবাদী বাগের রাস্তা পেরোবার মতন শুঁড় দিয়ে এদিক-ওদিক দেখে ঢুকে গেল বাইরে ছড়ানো-ছেটানো বাতিল আলুর ভেতর । রাস্তার ওপারে, আকন্দ গাছটার কাছে, খুলে কথা বলঅব মগ্ন শালিকদল । পশু-পাখি ছাড়া আর কেউ খুলে কথা বলে না পশ্চিমবাংলায় । পুঁটলি থেকে রামরোট রুটি, কাঁচা পেঁয়াজ, আলুমশলা নিয়ে, গামছা পেতে বসেছে চারজন মুটিয়া । বোধয় ব্রেকফাস্ট ।

টেবিলের ওদিকে কন্দর্প-ক্যাবলা ফরসা একজন কাগজ পড়ছিল, কালকের, হাঁইইইইহ আওয়াজ সহযোগে হাই তুলল । জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পূর্বতন মালিকের ইঁটজিরজিরে নোনা কবরের ওপর কাকেদের ভরা সংসার । গোড়ায় আপনা থেকে গজিয়েছে বুনো কনকনটে । কন্দর্প-ক্যাবলা জানায়, ডাবল সার্কিট লাইনের তার চুরি হয়ে কোলাঘাটের একটা ইউনিট বন্ধ, পুলিনদা ।

অ ।

সবাই চুপচাপ । ইন্টারভিউ নেবার প্রশ্ন বোধয় ফুরিয়ে গেছে ।

হঠাৎ জাবেদালি অফিসঘরে প্রবেশ করে । লুঙ্গি আর খালি গায়ে । ঘর্মাক্ত । দৌড়ে এসেছে । চোখমুখ থমথমে । হাঁপাচ্ছিল । উদবিগ্ন ঘোষণা করে, হালিক ধাড়া গলায় দড়ি দিয়েচে, পুলিশ এয়েচে লাশ নাবাতে ।

অন্ধকারের বিস্ফোরণ হয়, আর গুঁড়ো-গুঁড়ো কালো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে দরবারিদের চেহারায় । সবাই এমন কনকনে তাকায় যেন যিশুই খুনি । ওকে একা ফেলে রেখে সবাই ছিটকে বেরোয় অফিসঘর থেকে, আর মাঠ ভেঙে গ্রামের দিকে দৌড়োয়  । মহিলা সবার শেষে, পাছায় চেয়ারের হাতল আটকে গিয়েছিল বলে ।

তালা দিয়ে দি থালে । জাবেদালির ইশারায় উঠে পড়ে যিশু । ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন তোলে ।

ধারদেনা করে সাড়ে তিন বিঘে বুনেছিল । অবোসথা তো নিজের চোকেই দেকেচেন । বোরা বোনা আবার বারণ।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া সত্ত্বেও, পঞ্চাশ লক্ষ টন আলুর হিল্লে হবে না । হিমঘরেও জায়গা নেই । বিহার, উত্তরপ্রদেশে, অন্ধ্র, উড়িষ্যায় অনেক আলু হয়েছে । লুকিয়ে পাচার হবে নেপাল বাংলাদেশ বর্মায় । তার কিছু টাকা যাবে সুইস ব্যাংকে । গুজরাতের জমিতে তো জো নেই, তবু হয়েছে আলু । দুধ সমবায়ের জোরে সেখানে গোরু-মোষকে আলু খাওয়ানো যায় । যিশু জিগ্যেস করল, হালিক ধাড়া বন্ড পায়নি ?

জাবেদালি উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি এগোন ।

যিশু একটা সিগারেট ধরায় ।

জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে । মন্দিরের পাঁচিলের ওপর কয়েকটা চটুল কাক । মসজিদ বলতে এ-গ্রামে সবুজ-সবুজ চুড়ো-দেয়া মাঠের মাঝে একটা দেয়াল, ধবধবে সাদা । সুলতানি চারচালা বাঙালি মসজিদ আর হবে না । আরবদেশের মসজিদের নকল হবে কেবল । মন্দিরের বাইরে পুজোর উপাচার বিক্রির খাট পাতা । আকন্দফুলের মালা ঝোলানো খদ্দেরহীন দোকানটায় বুড়িটা ঢুলছে । একটা আলাপি কুকুর ল্যাজ নাড়ে । মদগর্বিত ষাঁড় । মদিরেক্ষণা মৌমাছি । ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিম্ত কলাগাছগুনোর ছেঁড়া পাতা । কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুনোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুরগাছ , গলায় খেজুরছড়ার মালা ।

দুপুর টাটিয়ে উঠেছে ক্রমশ, অথচ মেঘেদের ধূসর আনাগোনাও চলছে । বৃষ্টির ওপর আধিপত্য, দুঋতু আগে খর্ব হবার ফলে, নেতিয়ে পড়েছে ভেষজ সবুজ । মোরামপথ ধুলোয় জেরবার । প্রমেথিউসের নাট্যাভিনয়ে গুবরেপোকা । সকৌতুকে ফুটে আছে শেয়ালকাঁটার নরম ফুরফুরে হলুদ । কাঁঠালগাছে অজস্র এঁচোড়ের সঙ্গে ঝুলে আছে সুরাসক্ত মৌমাছিদের মোমভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্প । নীরবতা পালন করছে শোকমগ্ন শ্মশান । মেলার তোড়জোড় জানান দিচ্ছে বাচাল-প্রকৃতির লাউডস্পিকার । গাছের ছায়া থেকে কিশোর হিমসাগর বেরিয়ে লাফ দিয়েছে আলোয় ।

সারাটা দুপুর ফ্যা-ফ্যা কাটিয়ে, চুল না-ভিজিয়ে পুকুরে ক্লান্ত চান সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিল যিশু । ঘুম ভাঙে ভবেশকার চ্যাঁচামেচিতে । ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, খুশিদিকে বকছে । এই বয়সেও বকুনি ! কাছে গিয়ে ভবেশকাকে, কী হয়েছে গো, জিগ্যেস করায়, উলটে বকুনি খায় যিশু, তুমি মাঝখানে কতা বলতে এসো না ।

ক্ষুব্ধ যিশু বলল, আরে, এই বয়সে এমন বকা-ঝকা করছ কেন ? শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখবে ? বিষয়ী হওয়ার এতই দরকার নাকি তোমার ? আমি… । কথা সম্পূর্ণ করা উচিত হবে না মনে করে যিশু চুপ করে যায় ।

ভবেশকা বাঁপাশে হেলে, থপথপিয়ে দাওয়া থেকে নেবে বেড়ার আগল খুলে ক্রুদ্ধ বেরিয়ে গেলে খুশিদি স্কুলবালিকার মতন চোখ মুছে বলল, তুই খেয়ে নে । বাকসো গুচিয়ে রেকেচিস তো ? আমি এককাপড়ে চলে যাব । একদোম ভাল্লাগে না আর ।

হ্যাঁ। সন্ধে হলেই তুমি চলে যেও । মেলার ভিড় তো থাকবেই । কদম গাছতলায় অপেক্ষা কোরো, নইলে সোজা বাবলাডাঙায় গাড়িটার কাছে চলে যেও । ড্রাইভারটাকে বলা আছে । ভবেশকা একেবারে আউটডোর জীব হয়ে গেছে । কী হয়েছিল কী ? যে এত বকছিল তোমায় ?

মোদকের বউকে জলপড়া দেবে । জলপড়ার কাঁসার জামবাটিটা পাওয়া যাচ্চে না । বাবা তারকেশ্বরের ছোঁয়ানো বাটি । কোতায় রেকেচে নিজেই । গুষ্টির তো জিনিস । ভাল্লাগে না ।

জলপড়া ? ভবেশকা জলপড়া দেবে ? যিশুর মাথার ভেতরে শম্ভূ মিত্রের কন্ঠস্বরের অনুকরণে ডলবি ডিজিটাল বজ্রপাত হয় । জলপড়া !

হ্যাঁ । সেরে যায় তো । কানচোন মোদকের বউ বাচ্চা বিয়োবার আনজা রাকতে পারচে না ।

ভবেশকা সেই যে রেগেমেগে বেরিয়েছে, ফেরেনি । সন্ধে হয়ে গেল । লাইট চলে গেছে, সম্ভবত মেলার হুকিঙের অকথ্য শোষণে । যাত্রাদলের জেনারেটারের ক্ষীণ নিরবয়ব একটানা শব্দ । শুরু হয়ে গেছে ঝিঁঝিদের দেয়ালা-পারঙ্গম কানাঘুষা । কাতর আবেদনের মতন অন্ধকার । মাঝে-মাঝে স্পন্দিত হয়ে উঠছে শব্দহীন বিদ্যুচ্চমকের উদ্বেগ ।

আমি থালে এগুচ্চি, অন্ধকারে অনুচ্চ গলায় বলল খুশিদি, চাপা উত্তেজনায় কন্ঠস্বর রুদ্ধ । মুখে-মাখা স্নোক্রমের গ্রামীণ সুগন্ধকে ছাপিয়ে যাচ্ছে হাঁ-মুখের শঙ্কিত উৎকন্ঠার ভাপের গন্ধ । একপলক বিদ্যুচ্চমকে দেখা গেল থুতনির নিটোল টোল । পাটভাঙা, কাসুন্দি রঙের, ফুলফুল শাড়ি । হাত কাঁপছে । হাঁটার ধরনে স্পষ্ট যে ভয় আর উৎকন্ঠা নিয়ন্ত্রণ করছে খুশিদির শরীরকে, খনিগর্ভে আটকে-পড়া শ্রমিকের মতন ।

অ্যাতো ভয় কিসের খুশিদি । বুকে জড়িয়ে ধরে ভয় স্তিমিত করার চেষ্টা করে যিশু ।

জানি না কেন জিশকা, আমার খুব ভয় করচে । দাওয়া থেকে নেবে দ্রুত অন্ধকার বাগান পেরিয়ে চলে গেল খুশিদি ।

পেনটর্চ জ্বেলে যিশু নিজের বাকসো আরেকবার দেখে নিলে । খুশিদিকে ভরসা দিচ্ছিল অথচ ছোঁয়াচে উদ্বেগে চাবি লাগাতে ভুলে যায় ব্রিফকেসে । নৈঃশব্দে বসে থাকে কিছুক্ষণ । পা টিপে বেরোয় । আলতো খোলে বাঁশের বেড়া । চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখীর ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল । নেশাগ্রস্তের মতন  মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুনো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুঁড়িসুড়ি ঝোপ ।

ভবেশকার বাড়িটা যেন গাছে-ঘেরা দুর্গ । এখান থেকে মোচ্ছবতলার কদমগাছ অনেকটা পথ । ট্রান্সফরমার লোড নিতে পারেনি হয়তো, কখুন আলো আসবে অনিশ্চিত । এই ভেষজ অন্ধকারে সেঁদোতে আলোরও গা ছমছম করবে । বুড়ো শিবতলার বয়োবৃদ্ধ বটগাছটার একগাদা স্তম্ভমূল ঝুরিতে অন্ধকারকে এখানে ছোঁয়া যায় । টর্চটা ব্যবহার করা উচিত হবে না । সাপ বা শেয়াল একটা গেল বোধয় । যিশু দ্রুত হাঁটে শুকনো পাতার ওপর । শ্মশানের বিয়োগান্ত গন্ধ আসছে ওদিক থেকে । হালিক ধাড়ার নশ্বরতার প্রতি শেষ সম্ভাষণ হয়তো ।  মেঘ না থাকলে সন্ধ্যাতারার ঘনবসতিপূর্ণ আকাশভূমি  দেখা যেত । আলো ফোটাতে তলবিসভা ডাকছে ঝিঁঝিপোকারা । শুকনো পাতার ওপর বোধয় সাপ বা তক্ষকের বুকে হাঁটার আওয়াজ ।

উদ্বেগ কাটাতে সিগারেট ধরাবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল যিশু ।  হঠাৎ শুনতে পায় অনেকগুনো লোকের কন্ঠে ডাকাত ডাকাত ডাকাত চিৎকার । পেছন দিক থেকেই তো ছুটে আসছে । এরা ডাকাত ? টাকাকড়ি তো বিশেষ নেই  ওর কাছে । কাদের বাড়ি ডাকাতি করেই বা পালাচ্ছে ? ছোটাছুটির পদধ্বনি কাছাকাছি কোথাও । গাছের ডাল থেকে লাফাবার ধুপধাপ । ওর দিকেই আসছে মনে হয় ডাকাতের দলটা । যিশু দৌড়োয় ।

যিশুর মাথার ওপরে সজোরে বাড়ি পড়তে, হাতছাড়া ব্রিফকেস ছিটকে গিয়ে লাগে বটগাছের ঝুরিস্তম্ভে আর ডালা খুলে শুকনো পাতার ওপর ছড়িয়ে পড়ে শার্ট-প্যান্ট, কাগজপত্তর, টর্চ, টাকাকড়ি, ডটপেন, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোন, ক্রেডিট কার্ড, চেকবই, পাসপোর্ট, টাই, ঘড়ি, ডাকটিকিট, তুষলাব্রতর সরষে আর শুকনো মুলোফুল । টাল সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে, পিঠের ওপর লাঠির শব্দ ওঠে । তারপর পায়ে আর কাঁধে । তবু দাঁড়াবার চেষ্টা করে যিশু । মাথার ওপর আবার আঘাত । যিশুর পরিপাটি আঁচড়ানো দামি পরচুলা মাথা ধেকে খুলে বেরিয়ে গেলে, আবার আঘাত । সেই মুহূর্তে, যিশু দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে তখুনও, অন্তরীক্ষ থেকে পতনরত চকচকে রুপোলি কিলবিলে সাপটার ল্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টান দ্যায় বুড়োশিব । প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে কাছেই বজ্রপাত হল কোথাও । বজ্রপাতের কাঁপুনিতে, মৌমাছির চাক থেকে কয়েক ফোঁটা মধু ঝরে পড়ে যিশুর রক্তাক্ত মাথায় ।

শ্বাস দ্রুত আর হৃৎস্পন্দন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে যিশুর । ফুসফুসে ভাসমান রক্তের হেমোগ্লোবিনে অক্সিজেনের স্হান সংকুলানে ব্যাঘাত ঘটছে বলে মস্তিষ্কে পৌঁছোতে অসুবিধা হচ্ছে । কপালে, হাতের চেটোয়, ঘাম জমছে আর জুতোর মধ্যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুনো । আলজিভের চারিপাশ শুকিয়ে যাচ্ছে । ক্রমক্ষীয়মান অশরীরী হলুদ ও বেগুনি অন্ধকার-কণার অজস্র খুদে-খুদে ফুল ভাসছে অস্পষ্ট চরাচর জুড়ে ।

ব্রিফকেস থেকে পড়ে বহুকালের পোরোনো হলদে খড়খড়ে কাগজের পাতা উড়তে থাকে ইতিউতি । সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । প্রথম পৃষ্ঠায় তলার দিকে ডানকোণে ফুটফুটে আড়াই বছরের নাতনির ফোটোর তলায় তার হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন দিয়েছে দাদু মিনহাজুদ্দিন খান । মেয়েটির ডান কাঁধে জড়ুল । ডান চোখে তিল আছে । কাঁদলে থুতনিতে টোল পড়ে । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি ।