কী হল অরিন্দমদা, স্যাওড়াফুলি ইসটিশান থেকে হেঁটে এলে নাকি গো, অমন হাঁপ ছাড়চ ? জিভে জড়ানো উত্তর আগে জানিয়ে তার প্রশ্নটা পরে বলে সবচে ছোটো পিসতুতো ভাই পল্টু, থলথলে তাঁবাটে খালি গায়ে নেয়াপাতি ভুঁড়ির ওপর পৈতে, ডানবাহুতে রুপোর চেনে তাঁবার ডুগডুগি-মাদুলি, মুখের মধ্যে ভেটকি বৃদ্ধের লাশের ঝালঝাল টুকরো । সামনে কাঁচের গেলাসে মদের আদরে বিগলিত-চিত্ত বরফ-টুকরো । বলল, সময় লাগল বলতে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ক্লাস টু ফাইভ এইট, ওঃ, কত যে ধকল গেল, নাঃ, বুঝবে না তুমি ; আগে বিয়ে করো, ছেলেপুলে হোক । মাদুলির চেন বাজিয়ে এক চুমুকে শেষ করে । দাঁতে বরফ ভাঙার কড়মড় ।
পল্টুর বউটাই কেবল হাঁটুমুড়ে টিভিতে নাক ঠেকিয়ে হিন্দি মারপিটে উৎকর্ণ । ছাপাশাড়ি, এলোখোঁপা, ছোট্ট কপালে মেরুন টিপ, পায়ের কাছে ফাঁকা গেলাস । বাদবাকি ননদ ভাজ ভাসুর ননদাই মদের পলু থেকে কথার মাকড়সার ঘরকুনো জাল বুনছে । গোল হয়ে সবাই । সামনে একাধিক কাঁসার থালায় আস্ত পারসে ভাজা, আরামবাগি মুরগি-ঠ্যাঙের সুস্বাদু পাহাড়, হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার ভুষিমাল, দুফাঁক ডিমসেদ্ধ, মাছের ডিমের বড়া, শশা পেয়াজ গাজর । ভাইরা, জামাইরা, সবাই খালিগা, কারুর চেহারাই ব্যায়াম করা পেশল নয় । পায়জামার ওপর একটা করে বিশার তাঁবাটে কুমড়ো । বউরা, বোনরা মোটার ধাতে এগুচ্ছে । বোধয় মাঝে-মাঝেই হুইস্কির ক্যালরিতে তনু ভেজে ।
শতরঞ্চিতে বসে মাছের ডিমের একটা বড়া মুখে পুরে অরিন্দম যখুন চিবিয়ে অবাক ওর মধ্যেকার কাজু কিসমিস রসুনকোয়া সাদা-তিলের উপস্হিতিতে, বড়ো বউদি, যার আজকে জন্মদিন, ছেঁচিয়ে হুকুম জারি করে, এই অরিকেও একটা গেলাস দাও, দাও,দাও,দাও, কতদিন পরে আমাদের বাড়ি এল, তাও আবার রাত্তিবেলা ।
অরিন্দম স্পষ্টত বিচলিত । বলল, আরে না-না, আমি এসব খাই না, ককখুনো খাইনি ; সিগারেট ওব্দি খাই না ।
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফরসা ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে, আর বাঁহাতে অরিন্দমের গলা আঁকড়ে নিজের কানা-ভরা গেলাস দাঁতেদাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উল্টে দিলে । খাবিনে মানে ? তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী । বিশাল বুকের মাঝে অরিন্দমের মাথা ঠাসা ।
তোমার বুকে চেতল মাছের গন্ধ, বলতে, বড়ো বউদি চাপা গলায়, মাছটা কুরে রেখেছিলুম রে, হয়ে উঠল না । অরিন্দমের ফাঁস আলগা হয় না । জামা ভিজে গেছে । ফাঁসের দরুন কষ্ট হচ্ছে । আবার ভালোও লাগছে । নারীর বুকটুকুর এক পৃথক মাতৃত্ব আ্ছে মনে হয় ।
অ্যাই, দামি স্কচ বলে ভাবচ ওতে চান করলে নেশা হবে ? দুপাটি দাঁত ভিজছে গেলাসের হুইস্কিতে, ওয়ালরাসের হিলহিলে ঠোঁট নেড়ে বলল বড়ো জামাই । অরিন্দম, তার চে তুই বরং কিছু ভালগার জোক শোনা । গ্রামীণ বিকাশের অনুদান লোটা মাংসল জামাইয়ের কন্ঠস্বর ।
জাপটানো অবস্হাতেই বড়ো বউদির হুকুম, হ্যাঃ, তাই শোনাহ । বুজলি অরি, আমরা হলুমগে শান্ডিল্য গোত্রের মাতাল ; গোত্রের ভেতরেই শুঁড়িখানা । বিয়ের আগে তোর মতন ভারজিন কাশ্যপ গোত্র ছিলুম । নেশার কুয়াশায় ক্রমশ ঝিমোনো বউদির কন্ঠস্বর । জাপট আলগা হলেও অরিন্দম মাথা সরায় না । পাফ দিয়ে গুঁড়ো দুধ মাখানো বুক হলে ভালো হতো ।
আমি একটা বলছি । টিভি থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা করেছে ছোটো বউ । স্বতঃপ্রণোদিত মাতাল । একবার না, অ্যাঁ, হি-হি, একজন না, অ্যাঁ, রাস্তার ধারে নর্দমায় হিসি করছিল, হি-হি । অশ্লীল নয়, অশ্লীল নয়, অ্যাঁ, নালির ধারে তোমরা যেমন করো । লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের বোতাম লাগায়, অ্যাঁ, তখন জিপ ছিল না, বোতাম ছিল, বোতাম লাগিয়ে, অ্যাঁ, টের পেল ওর ঘাড় বেঁকে গেছে, হি-হি, একদম সোজা হচ্ছে না । ডাক্তারের কাছে গেলো, ওষুদ খেলো, মালিশ লাগাল, ইনজেকশান নিলে, অ্যাঁ, হি-হি, কিন্ত কিছুতেই কিছু হল না, ঘাড় সোজা হল না । মহাবিপদ । কী করে বেচারা । বেঁকা ঘাড় নিয়েই কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি গেল, বউকে বলল । বউ বললে, তা এই কতা, দাঁড়াও এক সেকেণ্ডে ঘাড় সোজা করে দিচ্চি । বলে, হি-হি, প্যান্টের বোতাম খুলে দিতেই ঘাড় সোজা হয়ে গেল । উউউউফ । লোকটা কোটের বোতাম প্যান্টের বোতামঘরে লাগিয়ে নিয়েছিল।
সবাই, মাতাল ভাজ ননদ ননদাই ভাসুর হাসবে বলে উদগ্রীব করে তুলেছিল নিজেদের, কিন্তু নিরুৎসাহিত হল । অরিন্দমের হাসি পেয়েছিল, ছোটোবউ তার স্বামীকে তির্যক আক্রমণটি করল অনুমান করে । কিন্তু হাসার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে গিয়ে টের পেল, বড়ো বউদি আবার জাপটকে আঁট করে ফেলেছে ; হয়তো নিজের চেয়ে বেশ ছোটো একজন যুবকের গ্রন্হিসুগন্ধের মাদকতা মদের সঙ্গে মিশে জরুরি আহ্লাদ এনে দিচ্ছে ।
নোংরা চুটকি না হলে কেউ হাসবে না রে, সেজো বউদির বিজ্ঞ মন্তব্য । নোংরা মানে সেক্স !
ছোটো জামাই তলানিটা চুমুক মারে । আঁচ্ছা আমারটা শোনো । তেমন নোংরা নয় যদিও । ওই সেক্স-টেক্স নিয়ে নয় । আমাদের রাজনীতিকদের নিয়ে । সো-সো । একজন মাঝারি নেতা, ভাষণ শেষ করে যখুন চেঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল, ওনি কোঁৎ করে নকল দাঁতের পাটি গিলে ফেলেছে । এক্সরে হল, সোনোগ্রাফি হল, গু পরীক্ষা হল, নিউক্লিয়ার মেডিসিন টেস্ট হল, দাঁতের পাটি-জোড়ার কোনো হদিস পাওয়া গেল না । একদোম যেন উবে গেচে । কলকাতায় কিছু হল না বলে ভেলোর, অ্যাপোলো, রামমনোহর লোহিয়া, হিন্দুজা, যশলোক, এ আই এম এস কত জায়গায় দেখালে, ব্রেন স্ক্যান হল, রাজনীতিক তো, হয়তো ব্রেনে চলে গিয়ে থাকবে দাঁত-জোড়া, এই ভেবে । দাঁত পাওয়া গেল না । শেষে বিদেশে নেতাদের একটা দল যাচ্ছিল মৌমাছির চাষ কী ভাবে করে দেখার জন্যে, তা একে-তাকে, মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকে ধরে প্রতিনিধি হয়ে ঢুকে গেল তাতে । উদ্দেশ্য হুসটনে গিয়ে রাষ্ট্রের খরচে ডাক্তার দেখাবে । দলটা আমেরিকায় পৌঁছোল । নানান পরীক্ষার পর যখুন ল্যাংটো উপুড় করে বডি চেক করছে, ডাক্তার অবাক । বললে, ইন্ডিয়ার রোপট্রিক শুনেছি বটে, কিন্তু এরকুম হাসিমুখ গুহ্যদ্বার এর আগে দেখিনি । ইন্ডিয়ার সব পলিটিশিয়ানদেরই কি এরকুম হাসি ? কয়েক মুহূর্ত ধেমে ছোটো জামাই বললে, হয়েছে কী, দুপাটি দাঁত ওইখানে গিয়ে আটকে গিয়েছিল ।
সমবেত হোঃ হোঃ হয় বটে তবে অভিপ্রেত অট্টহাস্য হয় না । অরিন্দম হাসতে পারে না । বড়ো বউদির ঢাউস বুকের মাঝে মাথা আটক । আসতে গেলে যদি আটক আলগা হয়ে যায় , তাই । সেজো বউদির মন্তব্য, নিজেকে ছাড়াচ্চিস না যে বড়ো ? অরিন্দম নিশ্চুপ, নিরাবেগ, নিরুত্তেজ ।
আঁচ্ছা, আমি একটা আসল অশ্লীল নোংরা অবসিন জোক বলছি । বড়ো জামায়ের প্রস্তাব সমর্থিত হবার মুহূর্তে অরিন্দম আঁৎকায়, জোকের জন্যে নয়, মহিলাদের সামনে অমন জোক শোনার অভিজ্ঞতা ওর নেই । না না না না, আমি তাহলে উঠে পড়ব, ধ্যাৎ ।
অরিন্দমের গলা আঁকড়ে রেখেই বড়ো বউদি, কেনওওওরে ? এখনও বে-থা করিসনি বলে ? কবে আর করবি ? আমার কাচে অনেক ছাত্রী-পাত্রী আচে । ফিগার-চটকে ভালো চাস ? না পড়াশুনোয় ? বলিস তো দেকি ।
মেজো বউদি : তোর সেই মাইকাটা শুদদুর প্রেমিকাটার কী হল রে ? আমাদের এদিকেও সব খবরাখবর আসে । খুব ঝুলোঝুলি করেছিলি নাকি বে করার জন্যে । তা কেঁচে গেল কেন ?
বড়ো জামাই : অশ্লীল অঙ্গ দুটো নেই বলে ।
সমবেত মহিলা আর পুরুষের অট্টহাস্যের দমবন্ধ দমকা বোমাটা এবার ফাটে । হেসেই সামলে নেয় সবাই, ভাই বোন ভাজ ভাসুর ভাদ্দরবউ দেওর জামাই ননদ শালা ননদাই । চোখাচুখিতে ঝটিতি ইশারা বদল হয় । সবাই জানে, পাটনায় থাকতে অরিন্দম ওর চেয়ে বিশি বয়সের বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর কিছুটা-খোলা হৃদয়ের গবাক্ষের নরম মাংসে করাঘাতের সাঁঝবিহান সম্পর্ক গড়ে তুলতে-তুলতে পাগল হয়ে চিকিৎসাধীন ছিল । পাড়াতুতো দিদিটার বর টাকা জমাবার ধান্দায় নিত্যিদিন ট্যুরে ।
কলকাতায় এসে ক্যানসারে এক-স্তন তুলি জোয়ারদারকে বিয়ে করার প্রস্তাবে, অরিন্দমের মায়ের, কিন্তু-কিন্তু বলতে যা বোঝায়, সে দুশ্চিন্তা ছিল । ছেলেটার আবার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে আধখ্যাঁচড়া মেয়ের পাল্লায় । তবু, অন্য কাউকে না করলে ওকেই করুক, কাউকে করুক, স্হির হোক জীবন । তুলি এগিয়ে এসে পিছিয়ে গিয়েছে, কেননা মৃত্যুর আহ্বান বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, উচিত সময়ে লজ্জাবশত চিকিৎসা না করাবার দরুণ । ছোটো ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে বলে বড়ো ভায়ের মা এখুন যাহোক একটা বউ চায় । এজাত বেজাত কালো ধলা কানা খোঁড়া মুখু বিধবা বর-পালানো বাচ্চাসুদ্দু যাকেই চাস আমি বাড়ির বউ করে আনব, গত দশ বছরে মা ওকে একা পেলেই বলেছে । কয়েকজন ঘটককেও বলে রেখেছে মা, যোটক-ফোটক কিচ্ছু চাই না, এককাপড়ে হলেও চলবে । ঘটকরা প্রতিদিন একজন-দুজন বিবাহযোগ্যাকে এনে ছুতোনাতায় বসিয়ে দিয়েছে ওর চেয়ারের সামনে, অফিসে এনে । ওফ, কী কেলেংকারি । চলকে ওঠার মতন নয়কো তারা কেউ । মেয়েগুলোরও অমন ডেসপারেট অবস্হা ? অপমান সহ্য করেও একজন স্বামী চাই । মেজোবউদি এক্ষুনি প্রতিশোধ নিল এগারো বছর আগে ওনার ছোটো বোনকে প্রশ্রয় দেয়নি বলে ।
আবার মেজবউদির খচানে উক্তি : মেয়েটা কিন জাতের রে ? কুলিকামিন ? নাকি ?
বড়দা সর্বাধিক চুর । বুড়ো আঙুলে সুতো-ছেঁড়া পৈতে জড়িয়ে তরলীকরণের সরলীকরণ করে । এতঃ ন শুদ্রং ব্রাহ্মণাদি জাতি বিশেষং ভবতি সিদ্ধং, সর্বে লোকা একজাতি নিবদ্ধাশ্চ সহজ মেবিতি ভবঃ ।
মোনতোর-টোনতোর নিয়েচেন নাকি বড়দা ? আমাকে জানাতেন যদি তো আমিও নিতুম । বড্ডো অশান্ত থাকে মনটা । কার মোনতোর ? অনুকুল ঠাকুর না রামঠাকুর ? অ্যাঁ ? নাকি বাবা লোকনাথ ? বালক ব্রহ্মচারীর জপ শুনিচি বেশ কাজে দ্যায় । বড়ো জামায়ের কন্ঠে অকৃত্রিম আপশোশ ।
সেজো বউদি : আরে বামুনরা আবার মোনতোর নেয় নাকি ? ওসব কায়েত সুদদুরদের ব্যাপার । বামুনদের তো গায়িৎরি মনতোর আচেই । তাই-ই জপ করুন না দুবেলা মন দিয়ে ।
বড়ো জামাই : অঅঅঅঅ । অরিন্দম ভাবছিল, জোয়ারদার কোনো জাত হয় ? কেটলিউলি কোন জাত ? জাতিপ্রথার জন্মের সময়ে তো চা খাবার ব্যাপার ছিল না । দেখতে কেমন ? নাম কী ? কোথায় থাকে ? একদিন গেলে হয় মহাকরণে । কিন্তু সেখানে তো অনেক কেটলিউলি আছে । চিনতে পারবে নিশ্চই ও । চলকে ওঠা থেকে ঠিক টের পেয়ে যাবে ।
প্রধানশিক্ষিকা নিজের পুরো সুরাসক্ত ওজন ঢেলে রেখেছিল অরিন্দমের ওপর । বড়দি, তোমার ব্লাউজের বোতাম খুলে অরির ঘাড়টা এবার সোজা হতে দাও । মেজোবউদির কথায় অরিন্দম ছাড়া পায় ।
আগে লোকে সমাজের চাপে বাড়ির বাইরে মদ খেত । এখুন সমাজের ভয়ে বাড়ির মধ্যে বাড়িসুদ্দু সবাই খায় । তার কারণ আগে সমাজ বলতে যা বোঝাত তা আর নেই । সবাই সবাইকে ভয় পায় আজকাল । অন্যে কী করছে-করবে সবাই আঁচ করে টের পায় । কেউ বিশ্বাস করে না অথচ গালভরা কথা বলে । আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল । বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি । কোনো বিশেষ তীর্থ নেই । কত গোঁড়া ছিল এই বাড়িটা, পিসিমা-পিসেমশায় বেঁচে থাকতে । মুরগির মাংস তো নিষিদ্ধ ছিলই, মুরগির ডিমেরও বাড়িতে প্রবেশাধিকার ছিল না । খেতে বসে গণ্ডুষ না করা অপরাধ ছিল ।
পিসেমশায়ের বাস্তুভিটে ছিল হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের ফুলতলা গ্রামে । সেসব ছেড়েছুড়ে বেচেবুচে এখন শ্যাওড়াফুলিতে । এই বাড়িটায় অরিন্দম যখুন শেষ এসেছিল, টালির চালের দুটো মাত্র ঘর ছিল, সামনে-পেছনে ফুলের উচ্ছৃঙ্খল জঙ্গল । বলাগড়ের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিল, মনে আছে । পিসেমশায় টাকমাথা, মোটা কাঁচের ভারিক্কি চশমা ।
ফুলতলার বসতবাড়ি, ভাগচাষ দেওয়া জমিজিরেত, সব ভেঙে-ভেঙে বিস্কুটের টুকরোর মতন তারিয়ে খেয়ে ফেলেছে গঙ্গা । কলকারখানার ফেনানো পাঁক আর পূণ্যার্থীর গু-মুত, গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে, বাঁকবদল ঘটেছিল নদীর । মাঝরাতে, চাঁদনি আলোর অগোচরে, কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে, ডাঙাজমিন, ভরাখেত, কুরেকুরে শেষ করেছে নদীটা । অরিন্দম গিয়েছিল স্কুলে পড়ার সময় । গঙ্গা বয়ে গেছে জিরাট, শ্রীপুর-বলাগড়, চরকৃষ্ণবাটি, গুপ্তিপাড়া, সোমড়া, খামারগাছি আর ডুমুরদহ-নিত্যানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর দিয়ে ।
সুলতাপুর, গুপ্তিপাড়া, রিফিউজিবাজার, ভরপাড়া, বেনালি, চররামপুর, গোঁসাইডাঙা, রসুলপুর, সুন্দরপুর, চাঁদরা, ভবানীপুর, চরখয়রামারি, রুবেশপুর, রামনগর গ্রামগুলোর অনেক ঘরদালান, রাস্তাঘাট, দেউড়িদেউল, দোকানবাজার, ইশকুল, শিবের থান, মেটে মসজিদ, ফকিরের কবর, রঙেশ্বরীর একচুড়ো গর্ভগৃহ, তিনফসলি জমি, সব সঅঅঅঅব, গিলেছে গঙ্গা । ইঁট আর শালবল্লা পুঁতে থামানো যায়নি নদীটার বেয়াড়াপনা । সেসব ইঁট-কাঠ নিজেদের বসতকে অহেতুক ঠেকনো দিতে যে যার তুলে নিয়ে গেছে । কারুর চেষ্টাই টেকেনি বেশিদিন । বাঁধাগাছি আর পালপাড়ার বামুনরা শ্যাওড়াফুলিতে চলে যাচ্ছে খবর পেয়ে পিসেমশায়ও কিনেছিল চারকাঠা জমি । ছেলেরা নিজেদের অবস্হামতন খুপরি তুলেছে ।
এই ঘরটা সর্বজনীন ।
ফুলতলায় থাকতে আলতাপাতার ব্যবসা ছিল পিসেমশায়ের । ওনার বাবার আরম্ভ করা ব্যবসা । অনেক ঘর রংবেনে মণিবণিক ছিল তল্লাটে । লাক্ষা গালা আলতার কাজ করত । রাসায়নিক আলতা বেরোবার পর দুবেলা দুমুঠোর ওপর চোট সামলাতে রংবণিকরা স্যাকরার কাজ ধরে একে-একে চলে গেল সুরাট, মুম্বাই, বাঙ্গালোর, কিংবা ঘড়িকোম্পানির জহুরি হয়ে গেল । পিসেমশায় রংবেনেদের কুলদেবতা রঙেশ্বরীদেবীর পার্টটাইম সেবাইত হয়ে চালিয়েছিল কিছুদিন । আজকে দেয়ালের খুঁতখুঁতে টিউবলাইটের তলায় ফ্যাকাসে রঙেশ্বরীদেবীর উদাসীন দৃষ্টিবলয়ে বসে নোংরা-নোংরা মোদো চুটকি চলছে ।
তোমরা কেউ আলতা পরো না ? বলে ফেলেছিল অরিন্দম ।
অ্যাই ছুটকি, তোর কাছে আলতা আছে তো ? নিয়ায় । ফ্লোর লিডার মেজবউদির গম্ভীর অনুচ্চস্বর আদেশে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় ছোটো বউ, এক রাশ চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে । অত চুল দেখে হঠাৎ ভয় করে ওঠে অরিন্দমের । অবাক হয় নিজেই । আজগে অরি আমাদের সবাইকে আলতা পরাবে । মেজবউদির দ্বিতীয় আদেশে ধাতস্হ হয় ।
ছুটকি দেয়াল, দরোজার কপাট, জানলার গ্রিল, বাকসোর থাক ধরে-ধরে নিজেকে সামলে ঘর থেকে বেরোয় আর ফিরে আসে বাঁ হাতে আলতার শিশি, তুলোকাঠি আর ছোট্ট কাঁসার বাটি নিয়ে । যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই মাতাল দেহবল্লরীকে সামাল দিয়ে । অরিন্দমের পাশে বসে । শাড়ি সামান্য তুলে পা বাড়িয়ে নিভৃত আবদার, আগে আমাকে পরাও । আলতাটা আমার বিয়ের ক’বছর যাবত পড়ে আছে । সময়ই হয় না । প্রফেসারির ঝকমারি, একটা তো মোটে রোব্বার, শাড়ি কেচে ইসতিরি করতেই সময় চলে যায় ।
ছুটকির বাঁ পা কোলের ওপর তুলে নিয়েছে অরিন্দম । প্রায় নিঃশব্দে বউটি বলে, তাড়াহুড়ো কোরো না, রয়ে-সয়ে সময় নিয়ে ভালো করে পরাও । অরিন্দম গলা নাবিয়ে বলল, তাহলে নেলকাটার আনো, নখ অনেক বেড়ে গেছে । নখ পালিশ লাগাও না বুঝি ? ছুটকি ঝটিতি উঠে দাঁড়াতে, মদ টলমল করে ওঠে ওর দেহ জুড়ে, বাতাসের ওপর দিয়ে হেঁটে নেলকাটার আর নখপালিশ আনে । কোলের ওপর পা তুলে নিয়ে অরিন্দম টের পায়, পা ধুয়ে মুছে এসেছে, আগের চে ঠাণ্ডা ।
মেয়েদের পা অপরিমেয় শ্রদ্ধার । তোমার পায়ে ছন্দ লেগে আছে । নখকাটার কুটকাট শব্দের চে আস্তে বলল অরিন্দম ।
ছন্দ ? কী ছন্দ ?
অরিন্দম বিপাকে পড়ে । উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ভাষাটা মন দিয়ে পড়েনি । দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে বলল, মুক্তক ।
যাঃ । ও তো বাংলা ।
হলেই বা । এই তো গোড়ালিতে তিল হয়ে লেগে রয়েছে অনুষ্টুপ ।
আবার সেই । না না । আমার পায়ে আছে আয়ামবাস, এই দ্যাখো, ট্রোকি ।
ওওওওও । ইংরেজি । ইংরেজি পড়াও ।
হ্যাঁ । ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলুম । ব্লেকের ম্যারেজ অব হেভেন অ্যান্ড হেল মুখস্ত । বুঝেছি । অমন বিয়েই করেছ । এখুন তো আর কিছু করার নেই ।
কে বললে ? সাহস থাকলে ভাসুরের কোলে পা তুলে সবায়ের সামনে বসা যায় । সাহস থাকলে, মরনিং আফটার ওষুধের জোরে, অনেক কিছু করা যায় । কটা বউ পারে ?
এখন তুমি মাতাল । মাতাল গৃহবধু । কী বলছ, না বলছ, তার হুঁশ নেই ।
মাতাল ? ঠিকাছে, আমি না হয় মাতাল । তোমার তো হুঁশ আছে । মুক্তক আর অনুষ্টুপ ছন্দে ঠোঁট রাখতে পারো? ছন্দ তো শুধু চরণেই থাকে না । থাকে সবখানে । ভালো করে চোখ মেলে দ্যাখো ।
বড়োবউদি শয়ে পড়েছিল । ওদের দিকে পাশ ফিরে । তোদের গুজগুজ ফিসফিস সঅঅঅব শুনতে পাচ্ছি আমি । অরিকে চেনো না । চুপচাপ জাল বিছিয়ে দেবে , টেরটি পাবে না । ভয়ংকর চিজ । অ্যাগবারে কাপালিক । ছু-মন্তর এড়াতে পারবি না । মাতন লেগে যাবে ।
ছুটকি বড়োবউদিকে, তুমি তো ওর জালে ছিলে এতক্ষুণ । এবার আমি না হয় থাকি । কাল থেকে তো আবার জাঁতা পেষা । তারপর অরিন্দমকে, কই দেখালে না কী রকম তোমার হুঁশ । আমি একজন স্বঘোষিত আদেখলে ।
শব্দবধির হওয়া সত্ত্বেও, সাপ যেভাবে তার চোয়ালের মাধ্যমে জমির সূক্ষ্ম স্পন্দন অনুভব করতে পারে, অনুভব করে শিকারের উষ্ণতার সংবাদ পায়, সেই গোপন অনুভুতি নিয়ে, বেশ যত্নে, নখপালিশ লাগায় আর আলতা পরায় অরিন্দম । এত কাছ থেকে, এভাবে কোনো যুবতীর কেবল পাটুকু এর আগে খুঁটিয়ে দেখেনি অরিন্দম । মুখ নিচু, ঠোঁটে ধূর্ত হাসি, ছুটকির চোরাস্রোত-চাউনি অরিন্দমের উদ্দেশে । ফিসফিস কন্ঠে অরিন্দম বলল, বেশ কয়েক বছর মদ খাচ্ছ তাহলে, অধ্যাপিকা ? মাথা নাড়ে ছুটকি, হ্যাঁ, এট্টুখানি, নমাসে-ছমাসে, ভাললাগে, এটারচে কোকাকোলার সঙ্গে রাম ভাল্লাগে, কিন্তু বড়ো আর সেজোর যে শুগার । স্নায়ুসুখে আপ্যায়িত দেহকে পাশ ফিরিয়ে, বাঁ পা নাবিয়ে, ডান পা অরিন্দমের কোলে তুলে দিলে ছুটকি ।
তোমার জামায় মদ, প্যান্টে আলতা, বাড়ি যাবে কী করে ?
এমনি করেই । আমার তো পায়ে কবকব নেই, ছন্দ নেই, লোকলজ্জার ভয় নেই ।
শুদুই বকবক। পথিক তুমি পথ হারাইতে ভুলিয়া গেছ । যাও, গিয়া দেয়ালে পোস্টার সাঁটো, ইনক্লাব-জিন্দাবাদ করো, কিন্তু প্রেমাপ্রেমি কোরো না ।
হুঁ।
রেখেছ বাঙালি করে, পুরুষ করোনি ।
হুঁ।
আচমকা ওপরতলা থেকে বিলিতি বাজনার তারস্বর আসে । ওপরেও ঘর আছে বুঝি ? জানতে চায় অরিন্দম, স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে । আগেরবার যখুন এসেছিল তখুন ছিল না ওপরতলায় কোনো ঘর । ফাঁকা ছাদ ছিল । আলসেতে গোলাপফুলের টব ।
এইটে যেমন আমাদের কমনরুম, ওপরেরটা বাচ্চাদের । ছাতের ওপর ওই একটাই ঘর । একটু থেমে, ছুটকি বলে, অরিভাসুর, প্রেম না থাকলে প্রাণটা বড্ডো খাঁ-খাঁ করে, না গো ? তোমার প্রেমের গল্প অনেক শুনেছি । প্রেম ছাড়া তুমি অসুস্হ হয়ে পড়ো, শুনেছি । তোমাকে আমার হিংসে হয় । জানাই হল না প্রেমে পাগল হওয়া কাকে বলে ।
ছুটকির পর গরমমশলার গন্ধের মতন স্বাস্হ্যবতী, ভূমিসংস্কার দপ্তরের করণিক সেজো বউদি এগিয়ে আসে পাছা ঘষে । হাঁটুর ওপর ওব্দি সাড়ি উঠিয়ে মেদনরম পা জোড়া তুলে দিলে অরিন্দমের কোলে । নে, সেবাযত্ন কর । শাড়ির পাড়ে আঁকা ফুলের গোছা ধরে পা ওব্দি নাবিয়ে এনে অরিন্দম বলল, অমন কোরো না, এখুনও অটুট আছ তুমি ; উলটে মাঝখান থেকে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে । শুনে, আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কেঁপে-কেঁপে হাসে সেজো বউদি । বলল, আমার পায়ের ওপর রাজহাঁস এঁকে দে, ছোটোবেলায় ঠাকমা একবার এঁকে দিসলো, আমি তখুন পানিশ্যাওলার ইসকুলে পড়তুম । তারপর তো বাবা বদ্যিবাটিতে চলে এলো ।
প্রতিদিন সবাই মিলে কলকাতা ঠ্যাঙাও, ওদিকেই ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনে নাও না কেন ?
কীইইই যে বলিস । এখেনে একসঙ্গে আছি সবাই, বিপদে-আপদে দেখি । এরম তো বসা হবে না আজগের মতন । কলকাতায় সবাইকে আলাদা-আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে, পুকুর-বাগান থাকবে না, দম বন্ধ হয়ে যাবে ।
অ্যাই, অরিকে আমাদের বাংড়ির জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা দিয়ে দিস । থালে ফি-মাসে আসতে পারবে । ছুটকির ঠেঙে নিয়ে নিস অরি । মনে পড়ে গেল, অরি, কালকে আমার আয়কর রিটার্নটা ভরে দিস । মদঘুমের জগতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে বড়োবউদির আদেশ । শতরঞ্চিতে মেদবহুল গতর এলিয়ে কৃতবিদ্য প্রধানশিক্ষিকা । অজস্র ছাত্রীর প্রণাম সংগ্রহকারী পদযুগল । শোয়া অবস্হাতেই মাতাল চরণে আলতা পরায় অরিন্দম । গোড়ালি ফাটা । নখ বড়ো হয়ে গেছে । বাড়িটার জীবননাট্যে বোধয় পারস্পরিক যত্নের সময় নেই । সবাই মগ্ন জীবিকায় । আর ফাঁক পেলেই এক চিলতে যৌথ সীমালঙ্ঘনের মৌতাত ।
তর্জনীতে গণ্ডারের শিঙের আংটি, ছোটো জামাই বলল, যেন মদের বুদবুদ ফেটে স্মৃতি ফিরে পেয়েছে, বলল, সেনসেক্স চারশো পয়েন্ট উঠেছে, বড়দা, তেমন-তেমন স্ক্রিপস থাকলে এই বেলা ঝেড়ে দাও ।
একে-একে বউদের, তারপর দুই ধুমড়ি বোনের নখ কাটে অরিন্দম, নখপালিশ লাগায়, আর আলতা পরিয়ে দেয় । ওদের পরানো শেষ হতে বড়দা আচমকা এগিয়ে দিয়েছে নিত্যযাত্রীর ট্রেনে ওঠায় রপ্ত হাড়প্যাংলা ঠ্যাং, শিরাপাকানো, যেভাবে পুরোনো শ্যাওলাধরা মন্দিরকে দুমড়ে জড়িয়ে থাকে অশ্বথ্থ গাছের শেকড় । অরি, আমাকেও লাগিয়ে দে দিকিনি, ভাবিসনে যে মাতাল হয়ে গেচি, আপিসে তো বুট জুতো পরে যাই । অরিন্দম তাকায় বাদামি কুয়াশামোড়া নতোদর প্রৌঢ়ের মুখের পানে । পুরসভার স্বাধিকারপ্রমত্ত অ্যাসেসমেন্ট ইন্সপেক্টর । বাঙালির, পশ্চিমবাংলার বাঙালির, স্বাধীনতা-উত্তর খাঁটি প্রতিনিধি । ছেলে মণিপুরে মোইরাঙে পোস্টেড । মোটা টাকা দিয়ে মণিপুর রেভলিউশানারি পিপলস ফ্রন্টের কাছ থেকে ইমিগ্র্যান্ট পারমিট নিতে হয়েছিল থাকার জন্যে । কালকে বিপ্লবীরা ওকে বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিয়েছে মোইরাঙ ছাড়ার জন্যে, উদ্বিগ্ন মুখে বললেন বড়দা । অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভের ভালো সরকারি চাকরি ছেড়ে ফিরে চলে আসছে । শত্রুতা না বাড়ালে বিপ্লব সফল হয় না । বিপ্লব ছাড়া বিদেশি অস্ত্র কারখানা লাভে চলবে না ।
বড়দার একপায়ে কাস্তে-হাতুড়ি, আরেক পায়ে পদ্মফুল আঁকে অরিন্দম ।
ছাদের ঘর থেকে আরেকবার ষাঁড়াষাঁড়ি ডেসিবল আচমকা এঘরের মদ সিগারেট মাংস মাছ চানাচুর ডিমসেদ্ধর মাথাভার বাতাসে কুচি-কুচি আছড়ে পড়তে, ছাদে যাবার সিঁড়িতে ওঠে অরিন্দম । এঘরে আর কেউ কথা কইবার অবস্হায় নেই । প্রশস্ত ছাদ । টবের গাছে ছোটো-ছোটো ফুলকপি ক্যাপসিকাম লংকা । আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে । অরিন্দমের মনে হল, অজানা কোনও কিছুর জন্যে ওর মর্মমূল ধ্বনিত হচ্ছে । ছন্দের বোধয় নিজস্ব ধর্ম হয় । চৈতন্যের পায়ে ছিল একরকুম, রামকৃষ্ণের আরেকরকুম । বুদ্ধের ছিল । যিশুখ্রিস্টের ছিল । কেটলিউলির আছে কি ?