১৮.

বাবলাডাঙায় বাবলাগাছ আর নেই । রয়েছে অর্জুনগাছ, বয়োবৃদ্ধ । মোচ্ছবতলায় আর কোনও মহোৎসব হয় না । গোপের হাটে হাট আর বসে না, গোপরাও থাকে না । তালটিকুরিতে তালগাছ আর নেই । স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর, নামের মধ্যে জিনিসটা বা ব্যাপারটা আর থাকে না, নেই । মানে একেবারে নিশ্চিহ্ণ । যেমন স্বাধীনতা, যেমন গণতন্ত্র, যেমন নাগরিকতা, যেমন ন্যায়, যেমন দায়দায়িত্ব, যেমন সত্য, যেমন কর্তব্য । ভাবছিল যিশু । বাবলাডাঙায় গাড়ি থেকে নেবে ড্রাইভারকে অর্জুনগাছটা দেখিয়ে দিল যিশু , যার তলায় কাল, বৈশাখী পূর্ণিমার সন্ধ্যায়, চাঁদের আলো মেখে অপেক্ষা করবে এই গাড়িটা বা ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম আঁকা অন্য যে-কোনও গাড়ি ।

পাঁচটা নাগাদ পোঁছে যেও কিন্তু ।

হঅঅঅ । আমাদের দ্যাখসেন নাকি ডিউটি ফেল করসি ?

মোচ্ছবতলায় কদমগাছের নিচে দাঁত বেরোনো ইঁটের চবুতরার ওপরে বসে গ্যাঁজাচ্ছে হাফবুড়োরা । কয়েকজনকে চিনতে পারল ও, যিশু । হিরু পাকড়ে । মন্দিরে ওকে রামচাকি বাজাতে দেখেছে । সুনীল মালিক, বাদল কোঁড়া, মানিক সাঁতরা, বদরুদ্দি খোনকার, সবাই বর্গাদার ; গত বছর এদের সমস্ত আলু পচেছিল হিমঘরে । আর ওই লোকটা তো জগৎ বাইন । আলুতে সারের ব্যবহার সম্পর্কে জিগ্যেস করতে গেয়ে উঠেছিল, বেনফেডের সার দিলি কনফেডের জামা, ধুতির নামে গামছা দিলি, ত্রাণের নামে মামা । রসিক লোকেরা, সত্যি, অদম্য ; নিজের দুঃখকষ্টকেও অলঙ্কারে মুড়ে তোলে ।

ওর, যিশুর, পদবি, বিশ্বাস, সেটাও কেউ ঠিকমতন উচ্চারণ করতে চায় না । কেউ বলে, বিসসেস, কেউ বিসাস, কেউ বিহহাহ, কেউ বিষশ্বাস ; যার যা ইচ্ছে । চব্বিশ পরগণার বিরাট ঝিয়ের দল প্রতিদিন কলকাতায় কাজ করতে আসে । সবাই মুসুলমান । অনেকে বাংলাদেশি । আসল নামে কাজ পাওয়া অনেক সময়ে মুশকিল বলে বউগুনো সরস্বতী, আরতি, সন্ধ্যা, কামিনী, অর্চনা নাম দিয়ে রাখে । যারা কাজ দেয় তারাও জানে । ইন্দু হলে নাম হতো খেন্তি, পেঁচি, পুঁটি ধরণের । আত্মপরিচয় ব্যাপারটা বায়বীয় বোধয় । বাবলাডাঙায় বাবলাগাছ আর নেই । বাবলাগাছেদের নামও আর নেই । বনবিভাগ গাছে-গাছে সংখ্যাচিহ্ণ এঁকে রাখে । যিশু অন্য দিকে তাকাল।

বারবার ব্যাখ্যা করা সত্ত্বেও ওকে এই লোকগুনো সরকারি প্রতিনিধি মনে করে । অভোযোগের কান্না আরম্ভ করবে এক্ষুনি । যিশু বলে, আরে বাবা, আমি সে-লোক নই ; ওরা ভুরু কোঁচকাবে, থালে থাতবাকসো  কেন, লাল কালি সবুজ কালির কলম কেন, ফাইল-কাগজ কেন, ইংরিজি লেকালিকি কেন !

মোচ্ছবতলার এই চবুতরায় কখুনো নাকি শ্যামানন্দ শ্রীজীব গোস্বামী বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের জন্যে এসে বসেছিলেন । পাশবালিশের মতন গোল ভগ্নাবশেষটা হয়তো চাঁদনির ইমারতি থাম । অথচ কোনও বৈষ্ণবের দেখা পায়নি যিশু এ-তল্লাটে । অষ্টসাত্ত্বিকভাব বলতে নতুন চন্দ্রমুখী আলুর রাঙাপানা ত্বক ।

তালটিকুরি আর মেলাতলা পেরোয় যিশু । দরমা, হোগলা, চ্যাঁচারি, চট, তেরপলের দোকানপাট । নাগরদোলা, ম্যাজিক, যাত্রা-অভিনয়ের মঞ্চ, সব জোগাড়যন্তর পুরো । হুকিংও । হুকিং করে বিদ্যুৎ না নিলে আর মেলা জমে না । রোশনাই-এর খরচ তো আর মেলা-দর্শকরা জোগাবে না । শনি, শেতলা, মনসা, শিব, ধর্মঠাকুর, সমস্ত মন্দিরের অধিষ্ঠাতারা হুকিং করে নিজেদের আলোকিত করে রাখে পশ্চিমবঙ্গে । ইষ্টদেবতা বলে কিছু আর নেই । সব সার্বজনীন ।

মন্দিরে লোকজন নেই । যিশু দেখেছিল ঢুকে আগেরবার এসে । কে আর টের পাচ্ছে যে ও খ্রিস্টান । কলকাতার কালীঘাটেও ঢুকেছে । পাকা তাল আর জবাফুল হাতে শাঁখারুলি বধুদের প্যাচপেচে কিউ । ঢুকেছে দক্ষিণেশ্বরেও । মুলো হাতে দর্শনার্থীদের ময়ালসাপ লাইন । বিহারের লোকেরা কবজা করে ফেলেছে মন্দিরগুনো । ইশকুলে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঢুঁ মেরেছিল । তাল আর মুলোর চল তখন ছিল না । এরকুম সাংস্কৃতিক রদবদল বোধয় দেশভাগের দরুন। চার্চগুনোও তো কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়কার প্রতিভা হারিয়ে ফেলেছে ।

মন্দিরের দক্ষিণে বিশাল বটগাছটা । বটগাছে যে এরকুম গাদা-গাদা বুনো মৌমাছির চাক ঝুলে থাকে, শেষপুকুরে আসার আগে দেখেনি যিশু । কিসের মধু এরা জোগাড় করে কে জানে । আলুফুলের মধু হয় ? মন্দিরের পেছনে তো বিরাট দামপুকুর, যার নামে এই গ্রাম । পুকুর খোঁড়ার সময়ে সেষনাগের প্রতিমা পেয়েছিল গোপেরা । বটতলার অজস্র ঝুরির সোঁদা অন্ধকারে আধা-অবহেলিত সেই পাথরটার নাম আজ বুড়ো শিব । পূঞ্জীভূত সময়ের বিরামহীনতাকে ধরে রেখেছে দিনেমারের সময়কার এই বট গাছটার সুকোমল অন্ধকার । মৌমাছিদের ডানাগুঞ্জনের ঝিরিঝিরি সুগন্ধ ।

ভবেশকার বাড়ি যাবার কোনও নির্দিষ্ট পথ নেই । রাজনৈতিক দলাদলির মামলা আর পালটা মামলায় কাঁচা রাস্তাটা বছর দশেক থেকে আধখ্যাঁচড়া । আদালতের স্হগিতাদেশ উঠতে-উঠতে কোনোদিন এটুকুও ভেসে যাবে ঠিকেদারদের প্রার্থনায় প্রীত মুন্ডেশ্বরীর বদরাগি জলে । বাঁশঝাড়ের অধোবদন সবুজ বাতাসে জিরোবার জন্যে ঝরাপাতার ওপর ব্রিফকেস রেখে সিগারেট ধরাল যিশু ।  চারিদিকে নিস্পন্দ আলোড়নের ছায়াছন্ন তরিবাতময়তা ।

এখুন আগে বরং হিমঘরে গিয়ে এখানে আসার ন্যায্যতা প্রমাণ করা যাক, ভাবল ও, যিশু । হিমঘর আর বিদ্যুৎ সাবস্টেশানটা তো দেখাই যাচ্ছে । বিদ্যুতের হুকিঙের লোড হিমঘরটা নিতে পারবে কিনা আঁচ করা কঠিন । আলুগুনো আবার হয়তো দমবন্ধ হয়ে মরবে । আলের ওপর দিয়ে হেঁটে, পরিত্যক্ত উপস্বাস্হ্যকেন্দ্রের পেছনের আমবাগানের পাশ দিয়ে, পিচ রাস্তার ওপর পোঁছল যিশু । এই উপস্বাস্হ্যকেন্দ্রটা যখুন স্বাস্হ্যবান ছিল, তখুন এখানে কাজ করত খুশিদির যুবক পাণিপ্রার্থী । দরোজা, জানলা, মায় ইঁটও উপড়ে নিয়ে গেছে স্বাবলম্বী মানুষ ।

ইমঘরের ক্যাশিয়ার জয়দেব শাসমল আসছিল ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর সাইকেলে । যিশুকে দেখে নেবে পড়ে । কেঁদো থপথপে হাঁটুনি । এগিয়ে আসে মুচকি মুখে । প্রথমদিন এই লোকটা ভেবেছিল যিশু বুঝি সরকারি আধিকারিক, চুরিচামারি ধরতে এয়েচে । তাই সুনিয়ে-সুনিয়ে জিভ-গোটানো মন্তব্য করেছিল, লিকতে দে, লিকতে দে, বাবারও বাবা আচে । গ্রামে গেলে, লোকে নিজের ভয় অনুযায়ী যিশুকে কিছু-একটা ভেবে নেয় । বিদ্যুৎ পষহদের লোক, হুকিং ধরবে । ব্যাঙ্কের লোক, ঋণখেলাপি উশুল করতে এয়েচে, পালাও । স্বাস্হ্য দপতরের লোক, টিকে দিতে, ওষুদ গেলাতে, এয়েচে । গ্রামীণ বিকাশের, মেলা বক্তিমে ঝাড়বে ।

দেকেচেন নাকি ? কাগোচে ? ধুতির খুঁট পকেট থেকে টেনে মুখ পুঁছে জানতে চায় শাসমল । নিজেই খোলসা করে । বারাসাত হিমঘরের ইউনিট ম্যানেজার শান্তি চাটুজ্যে নাকি গা ঢাকা দিয়েচে, হেঁ হেঁ, বন্ডের বই ভুলে গিয়ে বাড়ি নে গেসলো । বলেচে জেলাশাসকের নির্দেশ মানিনে, হেঁ হেঁ ।

ক্লান্ত যিশু চাইছিল কোথাও গিয়ে একটু বসে , এক গ্লাস জল খায় । আপাতত শাসমলের কথায় দেখনসই সায় দেয়া প্রয়োজন মনে করে হাঁসল কাঁধ নাচিয়ে । শাসমল প্রশ্রয় পায়, আরেকবার মুখ পোঁছে চল্লিশোর্ধ ভুঁড়িদাস । বলে, আমডাঙা, বারাসাত, দেগঙ্গা ব্লকের চাষিদের আলু তো এই বোসেখ মাসেও হিমঘরের মাটে পড়ে আচে, হেঁ হেঁ ।

মানুষ অন্যের অবমাননায় বা তাকে হেয় করার জন্যে যখুন হাসে, মনে হল যিশুর, তখুন হাসিতে ক্যারদানি ফলায় । এক-একজন এক-একরকুম । ঠিঁউউউ। হ্যাঁহ হ্যাঁহ হ্যাঁহ । হা হা হা হা । ফিঃ ফিঃ ফিঃ ফিঃ । ইয়াহ ইয়াহ ইয়াহ । খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক । খিক খিক খিক । হুমফ হুমফ হুমফ । ওঃ হোঃ হোঃ ।

শাসমলের কাঁধে হাত রেখে আরেকটু প্রশ্রয় দিলে যিশু । এই লোকটা বুঝতে পারে না কনসালট্যান্ট কাকে বলে । ভাবে উপদেষ্টার আবার কী দরকার । উপদেষ্টার উপদেশের দরদাম শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে এর । আলু, ক্যাশিয়ারকে জমিদারি দিয়েছে, নায়েবি ফলাবার জন্যে । চলুন না, আপনার হিমঘরেই যাই , একটু বসা যাক, আরও একাধটা ব্যাপার জানবার ছিল, আপনার মতো অভিজ্ঞ লোক তো বড়ো একটা দেখলুম না এলাইনে, বলল যিশু । তারপর শাসমলের ইতস্তত দেখে স্তো দেয়, আমি তো সরকারি লোক নই, জানেনই তো আপনি, জাপানি কোম্পানিতে কাজ করি, জাপানি মেশিন কত ভালো হয়, জানেন তো ।

বারাসাতের আলু ঘোটালার কথা ভালোই জানে যিশু । এ আর নতুন কী । প্রথম ট্রাম-পোড়া ছাইমাখা সাধুসন্ত আজ সর্বত্র । সত্তর হাজার বস্তা রাখার জায়গায় রাখা হয়েছিল এক লাখ কুড়ি হাজার । প#ত্রিশ হাজার বস্তার তবু জায়গা হয়নি, বাইরে পড়ে-পড়ে নষ্ট হয়েছিল । সিলাবৃষ্টির মার খেয়ে এলিয়ে পড়েছিল বস্তাগুলো । কালোবাজারে পাঁচগুণ দামে বন্ড কেটেছে ইউনিট ম্যানেজারের চোখের সামনে । পিয়োনটা গ্রুপ থিয়েটার করে । ওদের দলটার নাম প্রতিবাদী সভা । আকাদেমিতে নীলদর্পণ-এ ভালো অভিনয় করেছিল, ক্লাস ।

ওই অঞ্চলে, বারাসাতের ওদিকটায়, হিমঘরের ভরসাতেই অত আলু চাষ হয়েছিল, অথচ ঠাঁই পেল মহাজনের আলু । সব বামপন্হী আর রামপন্হী দলে চেয়ার আছে মহাজনদের । তারা তো আর আজকের লোক নয় । মেহনতি চাষি যে সত্যি-সত্যি এমনতর মেহনত করে ফেলতে পারে, মাটির উমে ঘাপটি মেরে আলুগুনো নিজেরাই টের পায়নি, আমলা-গামলা তো কোন ছার । বর্গা আইন পাস করলেই যেন সব হয়ে গেল, ব্যাস, ভূমিসংস্কার শেষ ! খেতে-মাঠে যা ফলছে তার কী হবে ? তার তো হিল্লে করতে হবে । মেয়ের বিয়ে দিতে তো ট্যাকা চাই । চাষির বুক চাপড়াবার শব্দ পৌঁছোয়নি কোথাও ।

মন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশান দিয়েছিল চাষিরা । ম্যানেজিং ডিরেক্টার বেংকটরমণ এক-খেপ পরিদর্শন করেছিল । জেলাশাসক অরুণ মিশ্র বিভাগীয় ব্যবস্হা নেবার জন্যে প্রতিবেদন দিয়েছিল সরকারকে । পঞ্চায়েত সমিতির পৃথ্বীশ দে আর ব্লক আধিকারিক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট দৌড়ঝাঁপ করেছিল । অচলায়তন ভেঙে মুক্তধারা বেরোয়নি । জমিদারি উঠে গেছে, জমিদার ওঠেনি । হয়ত কোনও দিন উঠবে না ।

বুজলেন বিসসেসবাবু, হিমঘরের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বলল শাসমল, আমাদের এখেনে ট্রান্সফরমারের পোরসিলিন চুরি হয়ে দুদিন লাইট আসেনে, হেঁ হেঁ ।

রাজনৈতিক ঋণমেলার ঠেলায় গ্রামীণ ঋণ বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বব্যাঙ্ক । মেলার মজা লুটল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র । নয়তো ঠিক সময়ে আরও কটা হিমঘর দাঁড়িয়ে যেত পশ্চিমবঙ্গে । এখটা হিমঘর বসাতে তিন কোটির মতন টাকা দরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ।

হিমঘরে পৌঁছে যিশু দেখল, শেডে এখনও শ’দেড়েক বস্তা পড়ে আছে । গোটা দশেক হাফল্যাংটো মুটিয়া ঘুমোচ্ছে । ওদের ঠোঁট থেকে শেষ তাড়িটুকু শুষে নিচ্ছে বেলে মাছির দঙ্গল । এলা মাটির ডাঁই । বাতিল আলু ছড়ানো-ছিটোনো চাদ্দিকময় । তার ওপর দিয়েই হেঁটে অফিসঘরে যেতে হল যিশুকে । একটা থনঝোলা সাদাকালো ছাগল শুকে বেড়াচ্ছে বাতিল আলু, খাচ্ছে না ।

লোক লাগিয়ে নিজেরাই হয়ত ট্রান্সফরমার খারাপ করিয়ে রাখে । আলু পচলে বিদ্যুৎ পর্ষদের ঘাড়ে দোষ চাপাবার সুযোগ থাকবে । একশো বত্রিশের তেত্রিশ কেভির ক্ষমতাসম্পন্ন । সোজা কথা নয় ।

আপনাদের তো জেনারেটর আছে ? অনেক হিমঘরে দেখেচি বিদ্যুতের চে ডিজেল সস্তা বলে অষ্টপ্রহর জেনারেটর চলছে, বলল যিশু ।

স্টোরকিপার কৃপাসিন্ধু আশ এসে দাঁড়িয়েছিল । বলল, আঁগগে ডিজেল ছেল না । রসুলপুর থেকে নিয়েলুম । আআআর বলেন কেন । তা ওইটুকুন শীত ইমঘরে ধরা থাকে । খেতি হয় না ।

শাসমল পৈতেতে বাঁধা চাবি দিয়ে ক্যাশিয়ারের ঘরের তালা খোলে । শাসমলরা কি বামুন যে পৈতে পরে আছে ? কে জানে, হবেও-বা । আদিত্য ভালো বলতে পারত । পলিশহীন আমকাঠের চেয়ার-টেবিল এলা মাটির ধুলোয় গেরুয়া । দেয়ালে সত্য সাইবাবার হাসিমুখ ঝাঁকড়াচুল ছবি । কোণে, মেঝেতে, স্টোভ । চা ফোটানোর অ্যালুমিনিয়াম ডেকচি । তলানিপড়া তিনটে খুদে মাপের কাচের গেলাস । মাছি অধ্যুষিত । প্লাসটিক বয়ামে চিনি, চা, গুঁড়ো দুধ ।

চা খাবেন নাকি ?

নাঃ । মুন্ডেশ্বরী পোলের আগে খেয়েছিলুম আসার সময়ে । এখুন বরং এক গেলাস জল খাওয়ান ।

কুঁজোর ওপর ঢাকা দেওয়া স্টিলের গেলাসে জল গড়িয়ে শাসমল বলল, অঅঅঅঅ । হরেন পাইকের ছেলের দোকানে । ভালো চা করে । ময়দার পরোটা আর আলুর দমটাও ভালো করে । হরেন পাইকের হাফু গান শুনলেন নাকি ? হেঁ হেঁ ।

যিশু স্তম্ভিত । হরেন পাইক ? বাউল ভিকিরিটা চা-দোকানির বাবা । বাবা-ছেলের সম্পর্ক এমন স্তরেও পৌঁছোয় । মাই গড । বলল, হ্যাঁ, হাফু কিনা জানি না, নিজেই গান বেঁধেছে মনে হয় । একতারাটাও হাফুছাপ ।

ওওওই যখন যা খবর হয় আর কী । শেষপুকুরে মেলা বসলেই আসে ফিবছর । থাকচেন তো, কাল, মেলায় ? মেলাটা এবার জমবে না বোধয় ।

কেন ?

মহাজনের সঙ্গে দেকাদেকির ভয়ে চাষিরা আবার আসে কিনা দেকুন । ব্যাঙ্কের বাবুরাও তো একটা ঘর নিয়েচে ।

শেষপুকুরে আসবার ন্যায্যতা প্রমাণের জন্যে, শাসমলের আর কৃপাসিন্ধুর কাছে যিশু যখুন আবোল-তাবোল আগডুম-বাগডুম ফাঁদছে,পিয়োন মুরার প্রামাণিক, শালপ্রাংশু ষাঁড়ের মতন নজরকাড়া ছাতি, বলল, আবনার সেই আলোজ্বলা ল্যাপটু টাইপযন্তরটা আনেননি এবার ?

ল্যাপটপ ? ওটা তো কমপিউটার । না, আনিনি । বলল যিশু । ল্যাপটপে খুশিদির ফোটো লোড করেছে ; এদের সামনে খোলা যাবে না আপাতত ।

লেকালিকি সব হয়ে গেচে ? বই হয়ে বেরোবে তো, না ?

এই সামান্য কিছু বাকি । তাই তো এলুম আপনাদের কাছে । তারপর প্রশ্নমালার লাটাই থেকে সুতো ঢিলে করতে থাকে যিশু । উত্তরদাতাদের ঋতুবন্ধ খুলে যাবার আহ্লাদ ।

এবার সবাই রাধাপদ্ম চাষের কথা ভাবচে ।

রাধাপদ্ম ? জানা নেই বলে ক্ষুণ্ণ হয় যিশু ।

ও ওই সুযযোমুখি ফুল, বলল কৃপাসিন্ধু । তারপর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে প্রায় স্বগতোক্তি, আলুর বুক এমন টাটিয়ে উডলো গেলোবছর । আবনি হলেন গে রায়রাঁয়া লোক, দেকুন যদি চাষিদের কিচু উবগার হয় । কৃপাসিন্ধুর মুখে গরম বালিতে চাল ভাজার গন্ধ । শাসমল পান্তা ব্রেকফাস্টের হাঁইইইই হাঁইইইই হাঁ-মুখ খুলে সুরেলা হাই তুলে যাচ্ছে কিছুক্ষুন অন্তর । ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা আলুর মধ্যে মুটিয়াগুনো সম্পর্কে উদাসীন একটা ডেঁপো ইঁদুর চষে বেড়াচ্ছে । আমোদে উ৮ড়ছে দুচারটে শুকনো আমপাতা ।

গোগ্রাসে ছুটন্ত একটা রাতকানা ট্রাক চলে গেল । হাম্প ডিঙিয়ে, ডিগুম ডিগুম তুলে ।

সবশেষে, আদপে যেটা জানতে চায় যিশু, সেই প্রশ্ন করে । আচ্ছা ভবেশকা কি বাড়িতে আছেন ?

অ্যাই দ্যাকো অ্যাগবারটি । আগে বাড়ি যাননি ? ভবঠাকুর তো আরামবাগ গ্যাচে খড়ের ছাতু কিনতে । ওই যে মাশরুম চাষের বীজ, তাই আনতে । তারোপোর পার্টির কাজ তো আচেই । ফিরতে সেই সোনধে । মুরারি প্রামাণিকের মিছিল-চনমনে উত্তর ।

জবাবের আঘাতে টলে যায় যিশু । ওফ । গাড়িটা না ছাড়লেই হত । আজই ফিরে যেতে পারত । অনুশোচনার সর্পাঘাতে আক্ষেপের বিষ ছড়িয়ে পড়ে অস্তিত্বে । হিমঘর অফিসের দোরগোড়ায় কূট প্রশ্নের মতন শেয়ালকাঁটা । গেটের বাইরে রাস্তার ওপারে দুলছে অর্কমন্দারের জংলি ডালপালা । বকুলপাখিদের উচ্চবাচ্যে মুখরিত ।

এরকম একটা জায়গায় রাস্তার ওপর স্পিডব্রেকারের হাম্প ! না আছে কাছে ইশকুল, না আছে জনবসতি । তোলা আদায়ের নতুন ধাঁচের জমিদারি খাজনা আদায় । হয়তো ভবেশকাই প্রথম তোলা আবিষ্কার করেছিল । তোলা আদায়ের খরচ মেটাতে পরিবার পিছু এক পয়সা । তাঁবার পয়সা চালু ছিল তখন । আর এখুন গতিকে স্তিমিত করা আর রুদ্ধ করার নাম প্রগতি ।

আত্মপ্রসাদে ভেজা কন্ঠস্বরে শাসমল বলল, চলুন না পৌঁছে দিই ; সাইকেলের পেচনের সিটে বসতে পারেন তো ? বাকসোটাকে কোলে ধরে নেবেন, যা অগনিশর্মা চড়চড়ে রোদ ।

সন্ধিক্ষণ । এ-ই তো  সন্ধিক্ষণ । ভবেশকা নেই । সময়ের সম্রাজ্ঞী এখন খুশিদি ।  ওর পক্ষে অত্যন্ত হাস্যকর, সিটে বসে যেতে তক্ষুনি রাজি হয়ে যায় যিশু । কন্ঠের গোড়ায় লুকিয়ে থাকা আওয়াজহীন ঢক্কানিনাদ ঢিপ-ঢিপ করে ধাপে-ধাপে নেবে যাচ্ছে বুকের মধ্যে । জ্ঞান তো ক্ষমতার বনেদ । যে আবাদ করবে, সে-ই জানবে কেবল ।

প্রকাস করা যায় না এমন ত্রব্র আবেগের ধাক্কায় সারাটা পথ প্যাঙপেঙে সাইকেলের পিছনের সিটে চুপচাপ বসে থাকে ও, যিশু। আগে এরকুম কখুনও হয়নি । যৌনতা নয় । যৌনতা তো তৃপ্তির বাজারে অঢেল । ওর মাথার কাছে সঙ্গী এক হলুদ বোলতার বুঁবুঁবুঁ বুঁবুঁবুঁ সত্ত্বেও বসে থাকে কথাহীন উদ্বেগে । বুজলেন যিশুবাবু, আমার মতন টাকমাতা লোকের আপনার অমন একরাশ চুল দেকে হিংসে হচ্ছিল, সেইটেই জানান দিচ্চে বোলতাটা । যিশু বলল, বোলতাটা চুলের গোপন তথ্য জানতে পেরেছে বোধয় !

দুপুরের রোদ এপাশ-ওপাশ আরম্ভ করেছে । হাসাহাসি করতে-করতে ইশকুল যাচ্ছে একদল ছেলেমেয়ে, খাতাপত্তর হাতে, ইশকুলই হবে, প্রাইমারি । জলতেষ্টায় দীর্ঘশ্বাস গেলে যিশু ।

পাতাঅলা ফণীমনসার ঝাড়ের কাছে, মাটিতে বাঁ আর প্যাডেলে ডান পা, রোদের উষ্মা বাঁচাতে মাথায় ধুতির খুঁট, শাসমল বলল,  ওই কলাবাগানে, ওই যে, গোলাপি-গোলাপি করমচা হয়ে রয়েচে, ওর পাশ দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই ভবঠাকুরের নাচদুয়োর ।

পথার ধারে কচুরিপানা গিজগিজে জলায়, সংসার চিন্তায় এক পায়ে ঠায়মগ্ন মেচোবক । গঙ্গাফড়িঙের ঝিমুনির খাতিরে হাতের পাতা মেলে আছে জলকলমি ।

ঠিকাছে, কাল সকালে একবার আসব । ভুরুর ওপর বাঁহাতের ছায়া ফেলে,ক্যাসিয়ারের কাছ থেকে মুক্ত হল যিশু । শর্টকাটের বদলে ঘুরপথের মুখে ছেড়ে দিয়ে গেল লোকটা । এর চে তো একা গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেত আলের ওপর দিয়ে ।

হাঁটছিল যিশু । কলাবাগান । রকমারি কলা । তেউড়ের ব্যবসা নিশ্চই । বেহুলা, মন্দিরা, বাতিসা, জাঁতিকোল, মালভোগ, কানাইবাঁশি, চিনিচাঁপা, জাহাজি, মনুয়া, ডয়বাকলা । একজন আইধোইরা তেউড় চাপাচ্ছিল ভ্যান রিকশায়, জানতে চাইল, কটা বেজেছে এখুন । যিশু বাঁহাত নাড়িয়ে দেখায় ঘড়ি নেই । কাজ আরম্ভ করার মুহূর্ত থেকেই অনেকে চায় তা তক্ষুনি শেষ হোক । করমচা গাছের পর বড়ো-বড়ো পাটিগাছ । কুচবিহারের মাথাভাঙায় এর শেতলপাটি হয় ।

পাটিগাছের লাগোয়া দরমার বেড়ার ওপর সার বেঁধে ছড়ানিটিকার সংলাপ বলছিল ফালতা পায়রাদের ভ্রাম্যমাণ দল । ফটফটিয়ে উড়াল দিলে অচেনা লোক যিশুকে দেখে । দরমার বেড়ার ভয়াবহ স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে পারেননি ভবেশকা । কী ভয়ংকর এলাকা ছিল দরমার অভিশপ্ত কলোনিগুলো । খাস কলকাতার লোকে যেতে চাইত না ভয়ে । সন্ধে হলেই ময়ূরভঞ্জের রানির বাড়ি থেকে গোড়ে ওব্দি ওৎপাতা আতঙ্ক । মুসুলমান ফুলচাষিগুনো গোড়ে গ্রাম থেকে পালাবার সময়ে গ্রামের নামটা নিয়ে পালিয়েছিল, গোড়ের মালার সঙ্গে-সঙ্গে । সেই গোড়ে এখন নোংরা ঘিঞ্জি গড়িয়া । ভাবা যায় না ।

পরপর তিনটে ধানের মরাই পেরোয় যিশু । অব্যবহৃত পোর্টেবল শৌচাগার । ছায়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাটির খয়াটে প্রতিমার ভিড় , কয়েক বছরের খড় বেরোনো, আঁচ করে যিশু , বোধয় শনি, শেতলা, বিশ্বকর্মার, রক্তাল্পতায় জ্ঞান হারিয়ে নিমতলায় অপেক্ষা করছে প্রকৃতির দাপটের জন্য । তাদের ঘিরে কংরেস ঘাস । বকফুলের গাছ । কত্তো ফিকে সবুজ বকফুল । আশশ্যাওড়া, হিমচাঁপা, কোকিলাক্ষ করবী, বেগনে রঙের কলকে । পায়ের কাছে ফুরফুরে সুসনি । পুকুরে চান করতে নেবেছে খুশিরানি মন্ডল ।

Leave a comment