১৭

পুকুরের জলে টলটলে রোদের গুঁড়ো মাখতে-মাখতে জলের মধ্যে মাথা গুঁজে পাক খৈয়ে কুচোপোনা তুলে আনছে পানকৌড়ি । মাথা ডুবিয়ে পাক খায় আর রুপোলি মাছ তোলে । উড়ে গিয়ে ঘনসবুজ চিকচিকে নারকোল পাতার ওপর বসে সূর্যের দিকে পিঠ করে । স্নানশেষে যুবতীদের মাথা ঝাঁকিয়ে এলোচুল ঝাড়ার মতন গা কাঁপায় । কালো-কালো পালকের নিখুঁত ছুরি শুকোবার জন্যে জাপানি হাতপাখার মতন ডানা খোলে ।

পুকুরের এদিকটায় অপলক শালুকের আবরুর মধ্যে মাথা গুঁজে মিষ্টিমদ গিলছে তিরতিরে কাঠফড়িং । বাঁদিকের নারকোল গাছটার পাতার ওপর ভজনালয় খুলেছে দাঁড়কাকের দল । সমগ্র পুকুরটা উঠে এসেছে রাত্তিরের অবগাহন থেকে । তোলা উনুনের ধোঁয়াপাকানো তঞ্জেবকাশিদা মসলিনের মতন কুয়াশায় ঢাকা কলাগাছের ডানার পিছনে খোড়ো একচালা । গোলাপি পায়ে পুকুরের জলতলকে চিরে ধবধবে পাতিহাঁস কুলবধুরা গ্রীবা উঁচু করে বেরিয়েছে পাড়া বেড়াতে । ওই বড়ো গাছটায়, কী গাছ কে জানে, পনেরো-কুড়িটা ওড়নশেয়াল জাতের বাদুড় ঝুলছে ।

কলকাতা থেকে টানা ভাড়াগাড়িতে, চাঁপাডাঙা-বলরামপুর রোডে, মুণ্ডেশ্বরী নদীর পোলটার মুখে, রাস্তার ওপর পুকুরের ধারের ছাপ্পর-ছাওয়া ভেটেরাখানায় দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চা খাচ্ছিল যিশু আর ড্রাইভার । ট্র্যাভেল এজেন্সির শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি । পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় যিশু ঘুরেছে ওদের গাড়িতে । চেনা । শেষপুকুর যাবার জন্যে যেখান থেকে কাঁচা রাস্তায় বাঁক নিতে হয়, সেই গোপের হাট জায়গাটা দেখিয়ে দেবে ড্রাইভারকে । গাড়ি তো আর নজর বাঁচিয়ে দেড় দিন পার্ক করে রাখা যাবে না । অলসের অনুসন্ধিৎসা সর্বাধিক । কাল সন্ধ্যায় আবার আনবে গাড়িটা । মোচ্ছবতলা আর তালটিকুরির মদ্যিখান দিয়ে গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে বাবলাডাঙার ঢিপির গোড়ায় থাকবে গাড়িটা । আলের ওপর দিয়ে এলে তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যায় বাবলাডাঙায় । ওই গাড়িতেই ফিরবে যিশু । যিশু আর খুশিদি । বৈশাখী পূর্ণিমার মেলার জন্যে প্রচণ্ড ভিড় থাকবে সেদিন, চেঁচামেচি, নাগরদোলা, যাত্রাদল, হট্টগোল, চোঙার বাজনা, গুড়-বেসনের মেঠাই । হুকিং-করা জগমগে ঝিকিমিকি আলোর রোশনাই । মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছেলের মতন হারিয়ে যাবে দুজনে কোথাও । এত বিশাল পৃথিবী ।

ধুলোয় পড়া ভাঙা ভাঁড়ে সকালবেলাকার ভোমরালি মাছি । পচা আলুতে প্রতিপালিত স্বাস্হ্যবান মাছির রাজত্ব এই শুরু হল । বেলে মাছি, নীল মাছি, দিশি মাছি আর ডোরোসেফিলা মেলানোগ্যাসটার, যে মাছিগুনো আলুর পচাই খেয়ে মাতলামো করে ।

চায়ের দোকানের ওগলা-বেড়ার পিচনে তেতো-নাজনের পাতাহীন গাছে শুকিয়ে আমসি তিন-গতরি ডাঁটা । কয়েকটা নাজে-খাড়া তিনফলা নোঙরের মতন তিন পাশ ধেকে ওপরমুখো ঝুলছে । ধূসর ডালে তিড়িকনাচন খেলছে নালবুলবুলি আর ছাতারে পাখি । পিচপথ থেকে নেবে যাওয়া দুপাশের ঢালে কালবৈশাখীর বৃষ্টির প্রশ্রয়ে উৎফুল্ল মুজঘাস, চোরকাঁটকি, কাঁটাকারির হাঁটু-ঝোপ । তারপর কালচে-সবুজ হোগলাবন, একটা ঘোড়া নিমের গাছ । কোঁড়া-বেরোনো বাঁশঝাড়ের তলায় বাঁথা সৌম্যকান্তি রামছাগলটার বোটকা গন্ধ এতটা দূরে এসেও ভলক মারছে । তালকি তাড়ির হাঁড়ি আর মাটির ভাঁড় নিয়ে রাস্তার ধারে ধুলোয় উবু বসে খদ্দের সামলাচ্ছে, এই সক্কালবেলায়, শুঁড়িবাড়ির বুড়ি । আর কহপ্তা পরেই তো তালশাঁস । ঢাল থেকে নেবেই খেতের সবুজ প্রগলভতা । তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন । শ্যালো ঘিরে বোরো । ঠিকুলকাঠির টঙে চোখমুখ আঁকা রাজনীতিক-ঋঢ়িতুল্য কালো হাঁড়ি ।

টাট্টুটানা একটা ছক্করগাড়ি চলে গেল আলুর বস্তা নিয়ে । শিল পড়ে রয়ে-রয়ে মার খায়েচে গো, ইমঘরে জায়গা নেই, মহাজনও নেবেনে । যিশু জানতে না চাইলেও ওকে উদ্দেশ্য করে বলল বস্তার ওপর বসে-থাকা চাষি । তারপর লোকটার নিশপিশে স্বগতোক্তি, দেকি, চাঁপাডাঙায়, নইলে ফেলদোবো, উপায় নেই উপায় নেই, পচতে নেগেচে ।

শিলাবৃষ্টি ? আরে ! ছাঁৎ করে ওঠে । লক্ষ করেনি এতক্ষুণ । খেতের ফসল কি মাথা নত করে আছে ? তার মানে পেঁয়াজ আর রসুনের গোড়ায় তো জল জমে গেছে । কী ভয়াবহ । একে আলু পচছে, তার ওপর এই । বিঘে প্রতি দেড় কুইন্টাল সুস্বাদু সুখসাগর পেঁয়াজ হয় এই জেলায় । আগেরবারেই তো হামজানপুর, বড়াল, জ্যামোর, ব্যাপসাগড়, চণ্ডীগাছা, দুয়ারপাড়া মৌজায় গিয়েছিল যিশু । পেঁয়াজ সংরক্ষণের সরকারি চাড়ও তথৈবচ । সিজকামালপুরে পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারে কথা চলছে তো আজ কয়েক বছর হয়ে গেল স্যার, পেঁয়াজের আড়তদার তীর্থ পৈতাণ্ডি বলেছিল ।

শিলাবৃষ্টি হয়েছে পর পর গত তিন দিন । তাইজন্যেই আসার সময়ে কাঁচা বাড়িগুনোর গোলটালির ছাউনি আর মেটেগরের দেয়াল অমন মনমরা লাগছিল । গোলপাতার আর শনের ঝুপড়ি ফর্দাফাঁই । সকালের নবোঢ়া বাতাসের শীতল আদরে খেয়াল করেনি কিছুই । ভালোলাগায় অতর্কিতে বিষণ্ণতার ছোঁয়াচ ধরে ।

শেষপুকুরেও চাষিরা অসহায় স্নায়ুচাপে আর দুঃখে আক্রান্ত হয়েছে নিশ্চই , ভবেশকার রাজনৈতিক ওল উৎপাদন সত্ত্বেও । দিন-খাওয়া চাষিবাড়ির ভেতরে পরিবেশটা কেমন ? আগের বছর হিমঘরের আলু পচেছিল সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে । চাষিরা ক্ষতিপূরণ পায়নি । পাবেও না । এবছর আলু রাখার জায়গা নেই হিমঘরে, গুদামে, আড়তে । বৈশাখী পূর্ণিমার মেলাও তাহলে হবে নির্জীব । চোদ্দ কাঠার বাশি খাস বিলি হয় না । বর্গাদার খাবে কী? কর্জ চোকাবে কোথ্থেকে ? আর গাঁয়ে গাঁয়ে তেভাগা ফসল হয়ে এখন ফসলের এক ভাগ জমির মালিকের, দ্বিতীয়ভাগ নথিকরা বর্গাদারের, তৃতীয়ভাগ যে কামলাটা আসলে চাষ করে, তার । পাঁচ সাক্ষ্যে মানুষ বর্গাদার হয় । কালীদাস গরাই বলেছিল, কেউ মরে বিল সেঁচে, কেউ খায় কই ।

পুকুর-পাড়ের কলাগাছের আড়াল থেকে একটা ভিকিরিকে আসতে দেখে গাড়িতে গিয়ে বসল যিশু । কাছে এলে সানফিল্ম লাগানো কাচ তুলে দেবে । নিশ্চিন্দি । ভিকিরিরা হাত বাড়ালে বেশ বিব্রত বোধ করে ও । পার্স খুলে হয়তো দেখবে খুচরো নেই । নোট দেওয়া যায় , কিন্তু অন্য লোকেদের তাতে গোঁসা হয় । অ, বড়োলোকমি । ড্রাইভারের দ্বিতীয় ভাঁড় শেষ হয়নি । নয়তো ভিকিরিটা এসে পৌঁছোবার আগেই কেটে পড়া যেত ।

লোকটা কাছে এলে, দেখল যিশু, বাউল আর ভিকিরি মেশানো এক তৃতীয় সম্প্রদায় । আধুনিকতা এদের এখুনও নামকরণ করেনি । শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা এদের চায় না । পৌষ মেলার জন্য পেডিগ্রি দরকার হয় কী ? কে জানে ! পশ্চিমবাংলায় এরা বোধয় উত্তরাধুনিক প্রাণী । গৃহবধু পকেটমারিনীদের মতন । বাউলের পদাবনতি হলে জাতভিকিরি হয় । ভিকিরিরা নিজের পদোন্নতি ঘটিয়ে নিজেদের আধা বাউল কিংবা নববাউল করে ফেলেছে । ক্লাবঘরের ফেকলুরা যেমন আঁতেল ।

কাছে এসে ঝুঁকে, জানালার কাচে মুণ্ডু এনে, না, ভিক্কে চায় না লোকটা, বলে, একটা চা খাওয়াও না কত্তা ; আর যিশুর দোনামনা শেষ হবার আগেই, দোকানদারকে বলে, নে রে মদনা, একটা চা আর লেড়ো দে দিকিনি, বড়ো সায়েব দিচ্চে, বড়ো সায়েবের সংসার ভরে উটুক নাতি-নাতজামায়ে ।

যিশু খুঁটিয়ে দেখছিল বছর পঁয়তাল্লিশের কালোবরণ দাড়িপাকানো গড়নের লোকটাকে । গায়ের খসখসে চামড়ায় ছিৎরে পড়েছে বয়েস ।  দুরঙের হাওয়াই চপ্পল দুপায়ে । সবুজটা শনের ধাগায় বাঁধা । তাঁবাটে পায়ের দরানি-পড়া গোছে লাউডগা-সাপ শিরা । কাছা মেরে পরা ধুলোট হাফলুঙ্গি । বোতামহীন কমবয়েসি বুশশার্টের ফাঁকে চ্যাটালো পেটের ওপর পাঁজর দেখা যাচ্ছে । নানা রঙের তাপ্পি-মারা তেলচিটে ঝোলা কাঁধে । ওষুধ বা মনিহারি জিনিসের টিনের একতারা । তাঁবার টান-টান ইলেকট্রিক তার । দাড়িতে বিশেষ চুল নেই লোকটার । কিন্তু মাথার কনকজটা নেবেছে কাঁধ পর্যন্ত । জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা-নেঙড়ানো একদা-আদল আন্দাজ  করতে পারে যিশু ।

বড়ো সায়েবকে তোমার গান শোনাও না ক্যানে । ক্ষমা করে দেবার অপত্য কায়দায় হুকুম করে খালি-গা চা-দোকানি, ডেকচিতে চাপানো আলুর তরকারিতে খুন্তি নাড়তে-নাড়তে । তারপর মৃদু হেসে যিশুকে, ও অনেক গান জানে স্যার, হাফু গান । শুনেচেন নিকি, হাফু ? বাপ-চোদ্দোপুরুষের গান আমাদের এই  হুগলি জেলার, তা হাফু তো উটেই গেল ।

হাফু ? শুনিনি তো !

লোকে গাইতে-গাইতে হাঁপিয়ে যায় তো, তাই হাফু । এগবার ধল্লে আবনি না বললে আর থামবেনে । ওতোরপাড়ার মুকুজ্জে রাজারা ভালোবাসত ।

না, শুনিনি কখুনও ।

সোনেন্নিকো ? বাউল-ভিকিরির কন্ঠস্বরে ভর্ৎসনা । গলা কাঁপিয়ে, একতারায়, নাকি তোতারায়, ড়িং ড়াং বুগ বুগ । মাছ ভাজার তেল ছেটাবার শব্দ ওঠে গুপিযন্ত্রে । সোনেন কত্তা, মন দিয়া সোনেন,

ওগো কলিমালুর জোড়া

তোমার পচা বেগুনপোড়া

ল্যাং খেয়ে তোর চাগরি গেল

বুজলিরে মুকপোড়া…

ড্রাইভারটা সশব্দে হেসে ওঠে আচমকা । ভাঁড়ের চা ফুলপ্যান্টে পড়লে হাসি চুপসে যায় ।

কিন্তু সে লোক তো কবেই পালটে গেছে । এখুন তো ওন্নোলোক । তোমার হাফু পালটায়নি কেন ? ঠোঁটে মুচকি এনে যিশির প্রশ্রয় । গায়কের হাঁপানি রোগে ওর কন্ঠে সব গানই হাফু ।

পরবর্তী ড়িং ড়াং বুগ বুগ ধরে লোকটা,

সুবাস বোসের নাম ডুবোলি অণ্ডকোষের জামাই

ঠেককেদারি তুরাই পেলি লেইকো চুরির কামাই

তুদের সমাজবদল হ্যাঁ লা, ন্যাড় জোলাবার খ্যালা

থালে কেনরে এতো জুলুস-মিছিল

কেনরে ধানাই পানাই

হায় রে তুদের গোডিম ভাঙে নাই,

তুদের গোডিম ভাঙে নাই…

গান বোধয় শেষ হয়নি, হাফু গান যখন । বাউল-ভিকিরি থেমে গেল চা-দোকানির কথায় । আগে ও পার্টি করত স্যার । মাধ্যমিক ওব্দি পড়েছেল । সোনাওনে সেই গানটে, সেই যে…

বাউল ভিকিরির সুরহীন ড়িং ড়াং আরম্ভ হয় আবার । বলল, ম্যাট্রিক আর দেয়া হল কই । আলুর আর চালের আকাল করে দিলে পোফুল্লবাবু ; চলে গেলুম চাঁপাডাঙা ইসটিশান পোড়াতে । সে আগুন আর নিববেনে কত্তা । রাবণের মুকে আগুন বলে কতা ।

গোটা পনেরো দশ-বারো বছরের খালি-গা বালক জড়ি হয়ে গেছে এরই মধ্যে । সারা পশ্চিমবঙ্গ ভরে গেছে এরকম লৈকাপড়াহীন-কাজহীন কিশোর-কিসোরীতে । মাঠ আর পথ বেয়ে অমন আরও বালক-বালিকা আসছে । গ্রামে কিছু একটা হলেই এরা জড়ো হয়ে যায় ।

সেই ইংরিজি গানটে সোনাও না বড়ো সায়েবকে ।

ইংরিজি গান ? তুমি বেঁধেছ ? শোনাও দেখি ।

সোনেন সোনেন:

দিনে মিটিং রাতে মেটিং

এই তো হোলো বাংলাদেস

আসে যায় মাইনে পায়

রাঁড়ের পো-রা রয়েচে বেস

কলঙ্কে গড়া রাজনীতিকদের গল্প আরও অশ্লীল হয়ে উঠতে পারে আঁচ করে, গাড়ি থেকে নেবে দোকানির পাওনা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে বাউল-ভিকিরিটাকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে, লোকটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ড়িং ড়াং পাক খায় । বলে, শেষপুকুরের মেলায় যাবার ভাড়াটা দেলেন বড়ো সায়েব, তেনার নাতিপুতিরা সুখে থাকুক । তারপর গেয়ে ওঠে প্রকৃত হাফু গান,

মাছ ধরা হল না গো সই

দোটো পায়লা লেগেছে জালে

সই যে পাতালে

সব দেখে যা লে…

কী সবটা লে

যম না চিতিলে

যাকে খেলে লে…

ময়না ধানের খয় না

ছেলে কেন আমার হয় না

মক্কাশ্বর যাবি

তবে খোকা পাবি

তেঁতুল খেলে গা জ্বলে

আমড়া কেলে ব্যাং হলে

মাছ ধরা হল না গো সই…..

গানের মাঝেই ছেড়ে দিল গাড়ি । গাড়িতে জুত করে বসে, ঘন্টায় আশি কিলোমিটার বেগের আরামে, দুটো কাঠি নষ্ট করার পর, তৃতীয়টায় ধরাতে সফল হয় যিশু । হাফু গানের দুর্গতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওর মনে হচ্ছিল, কাউকে অপমান করলে, এমনকী গানের মাধ্যমেও, তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা বোধয় দুটো ভালো-কথা বলা সম্পর্কের চেয়ে গাঢ় । গাঁয়ে-গাঁয়ে, পাড়ায়-পাড়ায়, এত যে আড়াআড়ি আর খাড়াখাড়ি বিভাজনের খেয়োখেয়ি আর দলাদলি, যার কোনো মাথা নেই মুন্ডু নেই, হয়তো সেকারণে ।

গা-ছাড়া রাস্তার দুধারে, শনাক্তকরণ প্যারেডের মতন ভাটাম, চটকা, ইউক্যালিপটাস, বাবলা, শিরিষ । সবুজের ফাঁকে-ফাঁকে সকালের বলদর্পী আলোর ব্যাটন । উবড়ো-খাবড়া পথ, গতিকে গোরুর গাড়ির বেগে এনে ফেলেছে । পথের হাল স্হানীয় বিধায়কের ক্ষমতা বা জোচ্চুরি ফাঁস করে ।

বেশ ভোর রাত্তিরে উঠতে হয়েছিল বলে তন্দ্রার আমেজ কাটাতে পারছিল না যিশু । চা-সিগারেট-হাফুর পরও । ওর খেয়াল হল গাড়ি থেমে রয়েছে আর চিৎকার চেঁচামেচির রেশ আসছে । কী ব্যাপার ? ড্রাইভারকে জিগ্যেস করল ও ।

অবরোধ করতাসে পাবলিক !

অবরোধ ? সে কী ? আচমকা উদ্বেগের রক্ত ছড়িয়ে পড়ল যিশুর মুখমণ্ডলে । হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয় । পৌঁছোতে আমাকে হবেই ।  তুমি হর্ন না বাজিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাও ।

গাইড়িরে ড্যামেজ কইরা দিবে স্যার !

না-না, তা করবার হলে লোকগুনো ছুটে আসত এতক্ষুণে । ওদের তো আমাদের সম্পর্কে আগ্রহ দেখচি না । ওই তো, ওদিক থেকে গাড়ি আর বাস আসছে তো ভিড় কাটিয়ে ।

জমায়েতের কাছাকাছি পৌঁছে যিশু দেখল রাস্তার পাশে রাখা কাঁচাবাঁশের মাচানবাঁধা দুটো মধ্যবয়স মৃতদেহ । পুরুষ আর চাষি বউয়ের । তুমুল চিৎকার করে কাঁদছে, বুক চাপড়াচ্ছে কয়েকজন । এভাবে শোকপ্রকাশ কলকাতায় আর দেখা যায় না । ওফ, দ্যাখা যায় না এসব দৃশ্য । গলার কাছে শ্লেষ্মা এসে গেছে । একসঙ্গে দুজনের মৃত্যু । গ্রামবাসীদের মধ্যে মৃত্যুজনিত প্রাণচাঞ্চল্য । সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে ও, যিশু । অচলাবস্হা গড়ে উঠতে পারে এদের আবেগের চাপে । তার আগেই দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া দরকার । কী হয়েছে গো ? একজনকে জিগ্যেস করল যিশু ।

মাল তুলেছে আজ দুবচ্ছর অথচ তাঁতি সমবায়ের ট্যাকা দ্যায়নে পান্না মাঝি । তাঁতিরা তাই চাষের ওষুদ খেয়ে মরচে । মহাজন দিয়েছেল সুতো । তা কী আর করবে । আগে পেটটা ভরাতে হবে তো । সুতো বেচে খেয়ে ফেলেচে ।

ওওওও । এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল যিশু । ড্রাইভারকে বলল, চলো চলো । উদ্বেগে রক্তচাপ বেড়েছে নির্ঘাত । তন্তুজ আর কী করবে ! তাঁতিদের শীর্ষ সংস্হা । নিজেই তো এর কাছে ধার করে ওকে শোধ দ্যায় । তাঁত সমবায়ের পাওনা মেটাবে কোথ্থেকে । টঙে-টঙে পার্টির লোক । দুবছর কেন, অনেক তাঁত সমবায়ের পাঁচ বছরের পাওনা মেটাতে পারেনি । যেখানেই বাঙালি আমলা সেখানেই রক্তচোষার দিগ্বিজয় । পার্টির প্রতি প্রভূভক্ত আমলা । মুসুলমান তাঁতি বউরা আজকাল বিড়ি বাঁধছে । মরদরা যাচ্ছে মাছ ধরতে । হিন্দু পরিবারের সদস্যরা হেস্তনেস্ত করে উঠতে পারছে না এখুনও । শীর্ষ সমবায় যেসব গামছা লুঙ্গি ধুতি শাড়ি তুলেছে, তাঁত সমবায়গুনোর কাছ থেকে সেগুনো আদপে বিক্কিরি হবে কি না ঠিক নেই । ওদের দোকানগুলো সময়মতন খোলে না, আর বন্ধ হয়ে যায় সন্ধের আগেই । সরকারি কর্মী ওরা; ওদের দোষ দেয়া যায় না, দশটা-পাঁচটার চাকরি । তাঁতজিনিসটাই বোধয় দশ বছরে নিপাত্তা হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গে ।

দু-দুজন আত্মহতভঅ করেছে । পুলিশ পৌঁছোবে সৎকারের পর । সবাই তো আদিত্যর জাতভাই । কাঁচ তুলে এসি চালিয়ে দিতে বলল যিশু । ঘুম পাচ্ছে ।

Leave a comment