১৫

তপসিয়া সাউথ রোড, বাইপাস, তিলজলা রোড, দিলখুশা স্ট্রিট, পার্কসার্কাসের মোড়ে পাক খেয়ে পার্ক স্ট্রিটে যিশুকে নাবাবার পর আউটরাম রোডে বাঁক নিয়ে ক্যাসুরিনা অ্যাভেনিউতে পড়ে গাড়ি । সদ্য-পরিচিতির আগল ভাঙার আগের নিশ্চুপ মুহূর্ত । কে কী কথা বলবে । আবার অভিব্যক্তির সমস্যা হয় অরিন্দমের ।

দু’পাশ জুড়ে পান্নাসবুজ । পিঠের ওপর থেকে রোদ্দুরকে ঘাসে ফেলে দিয়ে ছায়ায় দাঁড়ায় অরিন্দমের অ্যামবাসাডর গাড়ি । টুলবক্স খুলে একটা ছোট্ট হলুদ বই কেটলিউলির দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার স্টার্ট দেয় গাড়িতে । ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ি বেগবান ।

পাতা উলটিয়ে ঘুড়ার ছবিগুনো দ্যাখে মেয়েটি । দেখে, রেসের বইটা রেখে দ্যায় টুলবক্সে । শরীর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে নিঃশব্দে । উপভোগ করে নিজের হাসি ।

অরিন্দমের মনে হল, শরীর থিরকিয়ে এই যে হাসি, এভাবে দেহময় প্রতিভাদীপ্ত হয়ে ওঠা হাসি, দেহকে দেহাতীত করে দিচ্ছে, ভরসন্ধ্যার মতো  আহামরি জোনাকিরা অন্ধকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঝরে-ঝরে পড়ছে । ও, অরিন্দম, বলল, কী হল ? ঘোড়া পছন্দ করো ।

পড়তে জানি না ।

কেন ? ইশকুলে ইংরেজি শেখায়নি ?

বাংলাও পড়তে পারি না । কুনো ইশকুলে পড়ি নাই গো । আমি লিখাপড়া জানি না ।

অরিন্দম টের পায় ও সজোরে গাড়িতে ব্রেক মেরেছে । কিঁইইইচ । হসপিটাল রোডে ঘাসের কিনারে থামে গাড়ি । ভীত শঙ্কিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, অ আ হসসোই দিরঘোই কিচ্ছু জানো না ?

মায়েটি আলতো মাথা নাড়ায় ।

দিকে-দিকে সাক্ষরতার এতো গল্প, গ্রাম-শহরের দেয়ালে-দেয়ালে সাক্ষরতা সফল হবার ছড়া, অথচ কলকাতা শহরে একজন তরতাজা তরুণীর সঙ্গে বাংলা অক্ষরের পরিচয় হয়নি । শিলেট-পেনসিল নিয়ে কেউ সঙ্গে বসেনি কোনওদিন । হাতেখড়ি হয়নি । হাজার -হাজার বাংলা শব্দের মানেই জানে না । অবিশ্বাস্য । টেরাকোটা রঙের ওই পুরু ঠোঁট উচ্চারণ করেনি আজ ওব্দি কোনো লিখিত অক্ষর । অবহেলা অনাদর অভাবে স্ফূরিত অজ্ঞান নিরক্ষর ঠোঁট ।

কী দেখছ গো ?

তোমার কানের লতি পাটিসাপটার মতন তুলতুলে ।

লিখাপড়া শিখে নিবো ।

আমার মাও লেখাপড়া জানত না । পরে শিখেছে ।

আজকা একটা সিনেমা দেকবো, কেমন ? বালকুনিতে ?

আমাদের বাড়িতে টিভি-ভিসিআর আছে । বাড়িতে বসে যত ইচ্ছে সিনেমা দেখতে পারবে ।

অরন্দম দেখল, ওর সামনের দুটো চোখের জলাশয়ের ওপর জোনাকি উড়ছে । গাড়ির কাচে সানফিল্ম লাগানো ; পিছনের দরোজাদুটোর কাচ তোলা ছিল । ড্রাইভারের দিকের কাচ দ্রুত তুলে দিয়ে অনুসন্ধিৎসু মেয়েটির দিকে নিষ্পলক তাকায় অরিন্দম । সামনের দিক থেকে যে গাড়িটা আসছে, সেটা এখুনও অনেক দূরে । ছোট্ট পুরু ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট একবার আলতো ছুঁইয়ে নিয়েছে অরিন্দম । কিন্তু মেয়েটি চোখ বুজে জড়িয়ে ধরেছে ওকে, আর বলে উঠেছে, আমার আচকা লজ্জা হয় ।

অরিন্দমের কনুই লেগে হর্ন বেজে ওঠে । বাতাসের পরতে লুকিয়ে-থাকা অদৃশ্য প্রতিধ্বনিরা হর্নের শব্দে কেঁপে ওঠে আচমকা । মেয়েটির হাঁ-মুখ থেকে বিকিরিত খুদের জাউয়ের পান্তার সোঁদা গন্ধে অরিন্দম মুগ্ধ, সন্মোহিত । শি্রণ চাউর হয় রোঁয়ায়-রোঁয়ায় ।

স্টার্ট দেয় গাড়ি । গাছের ফাঁকে-ফাঁকে দৃশ্যমান আকাশে সপারিষদ উড়ছে চিলপুরুষ ।

রেসকোর্সে পৌঁছে, গাড়ি থেকে নাবার আগে, রেসের গাইডবইটা আবার বের করে টুকিটাকি পরিচয় করায় অরিন্দম । ফিলি, জকি, ঘোড়ার মালিক, দূরত্ব, চাম্পয়ান কাপ, ট্রেবল, টানালা, জ্যাকপট, আউটার সাউন্ড । মাদি ঘোড়াগুনোকে ট্রেনিং দিয়েছে কারা । ঘোড়ার জাত । ঘোড়ার বংশতালিকা । কেটলিউলি হতবাক ।

দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরে বারোশো মিটার জিতেছে, এই ঘোড়াটার নাম জ্বলন্ত চুমু ।

হি-হি ।

এর নাম তোপের গোলা, ঘোড়সওয়ার রুবেন, ওজন ষাট কেজি, কলকাতায় চোদ্দোশো মিটার জিতেছে । সব নামই রেজিস্ট্রি-করা, অন্য কেউ দৌড়ের ঘোড়াকে এই নাম দিতে পারবে না । অনেক ঘোড়া আছে, নাম শোনো । ক্লাসিক অ্যাফেয়ার, অ্যাপোলোনিও, হার্ডিলা, ডানসিং কুইন, ইয়েনা, ফ্ল্যাশ গর্ডন, সান শ্যাক, অলস্টার, জেরিজ ফ্লেম, ওকহিল, সানফ্ল্যাগ, কিং র‌্যাট, টলারেন্স, কোপাকাবানা, কার্নিশ প্রিন্স । কোন ঘোড়াটার টিকিট কিনব ?

আমি কী জানি ! বাংলা ঘুড়া নাই ?

ওদের পাশে একটা ঠাসাঠাসি ট্যাক্সি এসে থামে । তর্করত পাঁচজন জুয়াড়ির কথা শোনা যায় । মফসসল থেকে বোধয় । শ্যালদায় নেবেই ট্যাক্সি ধরেছে । হয়তো ফিহপ্তা ট্রিপ মারে । মোটা লোকটার হাতে রেসের বই । রেসুড়েদের চেহারাটা তেলচোয়াড়ে হয় কেন কে জানে ! নিজেকে এদের সমগোত্রীয় ভেবে বিসদৃশ লাগল অরিন্দমের ।

প্রথম জুয়াড়ি: অ্যাপোলোনিয়ারের মা ব্রিটিশ । ডার্বি জিতেছিল, জানেন তো গোরাদা ।

দ্বিতীয় জুয়াড়ি: তোদের বাঞ্চোৎ মা-বাপের সদবংশে না হলে চলে না, না রে শশী ? জুয়া হল একটা জীবনদর্শন, বুজলি । জেতার ঘোড়ার শ্রেণিই আলাদা । এ তোর পার্টিবাজির শ্রেণি নয়, বুজলি । আমি শালা হেরো হতে চাই না । জিদবো, তবে ছাড়বো ।

তৃতীয় জুয়াড়ি : আসার সময়ে প্রতাপবাবু এই অ্যাপোলোনিয়ারের টিপস দিয়েছে সুখেনকে । গৌরাঙ্গ, অমরনাথ, কুমুদবাবু, বিরেন সিংহি সবাই একটা কতা বারবার করে বলে দিয়েচে । ঘোড়াটার আঁত্তা একেবারে ঝড় দিয়ে গড়া । সালা যেন জেলাধিপতি । মাথা বাঁয়ে কিন্তু দেকচে সামনেদিকে ।

চতুর্থ জুয়াড়ি : অমর প্রেম জকির সিক্স টু ওয়ান যাচ্চে, জানিস তো ব্রহ্মানন্দ ।

পঞ্চম জুয়াড়ি :  সবাই আলাদা-আলাদা ঘোড়ায় লাগাই, সেইটেই ভালো, যারটা লাগে লাগবে । কে যে জিদবে বলা যায় না ।

লোকগুনো চলে গেলে, গাইডবই খুলে অরিন্দম বলল, হ্যাঁ, জকি অমর প্রেমের ঘোড়াটার নাম অ্যাপোলোনিয়ো । আরও সব জকি আছে । ব্রিজশা, কুমার, আলি, কামিল, প্রসাদ, রাবানি, যাদব, সুনীল সিং, খান, শ্রফ, প্যাটেল, রাজ্জাক, আলফ্রেড । তোমার কোন ঘোড়সওয়ার পছন্দ ?

কে জেতে গো ? ঘুড়া, না ঘুড়ার পিঠে যে বসে ?

জিতি আমরা, যারা খেলতে এসেছি ।

আমরাদের কুন ঘুড়া?

তুমি তো বললে না । তুমি গাড়িতে বোসথাকো, আমি বুকির ঠেঙে টিকিট আনছি ।

না না না না । একলা-একলা থাকবো না ।

কাচ তুলে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিচ্ছি, ভয়ের কী !

রেসুড়েদের নমুনা দেখে কেটলিউলির এখানে আসা সম্পর্কে যে দ্বিধা জেগেছে তা উপভোগ করতে-করতে অরিন্দম প্রথম রেসের সবকটা ঘোড়ার টিকিট কাটে । ঘোড়েল বুকিক্লার্ক ওর দিকে অভিসন্ধির হাসি হাসে । প্রেমিকার সঙ্গে প্রথমবার ? নাকি হনিমুন লাক-ট্রাই ?

ফিরে এসে, গাড়ি খুলে, বন্ধ করে, কেটলিউলির ঘর্মাক্ত হাত ধরে ও, অরিন্দম । বন্ধ গাড়িতে ঘেমেছে । দিনভর কেটলি বয়ে-বয়ে কড়া পড়ে গেছে হাতে । বলে, আমার হাত ছেড়ো না, ঠেলাঠেলিতে হারিয়ে যাবে । অরিন্দমের মনে হল, হাত ধরে না থাকলে কোনও মহাকরণবাসী বিরক্ত করতে পারে । ভাববে আস্পদ্দা তো কম নয় । স্রেফ হাত ধরে থেকেও তো শ্রেণিবদল ঘটানো যাচ্ছে । সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ে চাপা স্বরে বলল ও, অরিন্দম, আমিও খেলিনি কখুনো, আজ প্রথমবার, প্রথম জুয়ায় সবাই জেতে ।

জুয়া ?

জুয়াই তো ।

ভিড়ের মধয়ে ওর অফিসের প্রোটোকল আধিকারিক রাঘব সান্যালকে দেখতে পেল অরিন্দম । শুনল, ওর বউ রমাকে বলছে, অরিটা ঝি-চাকরানিদেরও ছাড়চে না আজগাল, শালা বিয়ে কল্লে না কেন আজ ওব্দি কে জানে । রমার কষ্টার্জিত মুখাবয়বে প্রত্যুত্তর ফোটে না । পাটনায় থাকতে, রাঘব যখন অফিসে কেয়ারটেকার আর অরিন্দম মামুলি কেরানি, টেলিফোন অপারেটর রমার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকটা এগিয়েছিল অভিসন্ধির অনুপযুক্ত অরিন্দম । জিতে-জিততে দান ছেড়ে দিয়েছিল, কেননা পাশের ফ্ল্যাটের অতসি বউঠানের মধ্যদুপুর বুকের সুরভিত স্নিগ্ধতা তখুন অফিস পালাতে উৎসাহিত করছে অনভিজ্ঞ অরিন্দমকে । সমাজের আজ্ঞায় অসফল প্রেমিকের গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক ।

প্রথম খেলার ঘোষণা হয় । ভ্যানিলার গন্ধ হারিয়ে গেছে এখানকার নারীদের দামি আর বিদেশি সুগন্ধে । কেটলিউলি দৃশ্যত কুন্ঠিত । ঘোষিত হয় ঘোড়াগুনোর পরিচয়, জকিদের পরিচয়, ঘোড়া-মালিকের পরিচয় । জেতবার চাপা উত্তেজনা সবায়ের চোখে-মুখে ।

আমরাদের কুন ঘুড়া ?

যে ঘোড়া ওড়ে কিন্তু ডানা নেই ।

পুলরুম থেকে এসে দাঁড়িয়েছে ঘোড়ারা । হালকানীল জিনস-পরা নাশপাতি-নিতম্ব একজন মহিলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে । কিলবিলে আনন্দে স্পন্দমান তার গেঞ্জিঢাকা বুক । পাকাচুল সঙ্গীর মুখে অনুমোদনের হাসি । রেসুড়ে ধনীদুহিতারা তাদের যৌবন ধরে রাখে বহুকাল । কেটলিউলির পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ভ্যানিলা । এতকালের সংস্পর্শে শরীরের গ্রন্হি থেকেই হয়তো নির্গত হয় ভ্যানিলা, ইচ্ছামতন ।

ভ্যানিলা কী করে হয় জানো । মাথা নাবিয়ে উড়ন্ত চূর্ণকুন্তলকে জিগেস করে অরিন্দম ।

কী করে ? অপলক জানতে চায় মেয়েটি ।

আলকাতরা থেকে ।

ইশ রে । তোমায় বলেছে ।

হ্যাঁ সত্যি । আলকাতরা থেকে পাওয়া যায় এথিল ভ্যানিলিন নামে একটা রস । স্টোক মেশিনে পরিষ্কার করে ভ্যানিলা হয় । সে ভ্যানিলা আমরা খাই ।

কেটলিউলির চোখে অবিশ্বাস আর শ্রদ্ধা ।

অরিন্দম শুনতে পায় চরাচর জুড়ে ধামসা, মাদল, ঝাঁঝ, শিঙা, চ্যাড়াপেটি, মদনভেরি, বাঁশি বাজছে । কলরোল তুলেছে হেঁতাল, গবান, গর্জন, গেঁওয়া, গোলপাতা, রাইন, পশুল, খলসি গাছের দল । ছাড়া পেয়েই ছুটতে আরম্ভ করেছে ঘোড়াগুনো, ছোটাচ্ছে ঘোড়সওয়ার, রঠিন টুপি, চকরা-বকরা পোশাক । দাঁড়িয়ে পড়েছে দর্শকরা, কয়েকজনের চোখে দূরবিন, নিজের ঘোড়াকে ইংরেজি ভাষায় উৎসাহিত করতে থাকে । বাতাসের ছোটো-ছোটো বাদামি টুকরোর ওপর লাগাম হাতে অর্ধেক উবু হয়ে বসে আছে ঘোড়সওয়ার । দর্শকরা নিজের গ্রীবাকে দীর্ঘ, দীর্ঘতর করছে, চ্যাঁচাচ্ছে । সবুজ ঘাসের ওপর ছুটছে ঘোড়াগুনো । হাওয়ার দুর্গপ্রাকার ডিঙোবে বলে ছুটছে । খুরের ডুগডুগি বাজিয়ে ছিৎরে দিচ্ছে আধভেজা ঘাস । ছুটছে গা ঘেঁষাঘেঁষি । রোদ্দুরের চিলতেকে এক মুহূর্তের জন্যেও বসতে দিচ্ছে না চামড়ায় । স্বমহিমায় উজ্জ্বল একের পর এক বাদামি ঢেউ উঠছে আর নাবছে । ঢেউগুনোর ওপর রঙিন পলকা ঘোড়সওয়ার । সাংগীতিক মূর্ছনায় খুরধ্বনির শব্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর । ছুটছে ঘোড়াগুনো । ছুটছে ঘোড়াগুনো । ঝুরো ঝুরো হয়ে ভেঙে পড়ছে অদৃশ্য বাতাসের গমগমে প্রতিরোধ।

ছুটছে ঘোড়াগুনো । অজস্র মানুষের দ্রুতশ্বাস চিৎকারের অনধিগম্য প্রতিধ্বনি চিরে কালোবরণ বিদ্যুৎ। পৃথিবীতে যেন অর্গল বলে কিছু নেই । ওরা ছুটছে । ভাসমান বেতারকণার সঙ্গে সংঘর্ষে দেদীপ্যমান সূর্যলোক চলকে পড়ছে ওদের ঝকমকে বেগবান পেশি থেকে । চারটে পায়ের কোনোটা মাটিতে পড়ার আগেই বাতাস ওদের টেনে নিচ্ছে সামনে । গ্রীবা প্রসারিত । ছুটছে রূপসীরা । রঙিন পালকে গড়া ওজনহীন ঘোড়সওয়ার, লাল-নীল, চৌখুপি জামা, হলুদ ডেনিম-টুপি, বাঁধভাঙা ঝরনার ধাক্কায় ছিটকে এগোচ্ছে, কালচে-বাদামি নদীতে রূপান্তরিত ঘোড়াগুনো বাঁক নিচ্ছে । দেখা যাচ্ছে না ওদের দ্রুত ধাবমান পা । ছুটচে ঘোড়াগুনো । কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব  কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব……

সবকটা ঘোড়া একাকার হয়ে বিশাল একটিমাত্র ঘোড়া হয়ে গেছে । উড়ে যেতে চাইছে আকাশে । বাদামি কুয়াশায় পালটে গেছে বিশাল ঘোড়াটার আদল । এদিকে আসার জন্য বাঁক নিচ্ছে উড়ন্ত নদীটা । স্পষ্ট কুচি-কুচি খুরধ্বনি । অমোঘ উদবেগের দিকে ধেয়ে আসছে । অজস্র পায়ের বিশাল ঘোড়াটা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে অনেক ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে । পারস্পরিক স্পর্শের পেশল বিদ্যুৎ বাঁচিয়ে ছিটকে চলে আসছে ঘোড়াগুনো । সামনে ঝুঁকে রয়েছে দোমড়ানো-পিঠ লাল নীল সবুজ ঘোড়সওয়ার । ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার একটিমাত্র ঝড়ের টুকরো । এগিয়ে আসছে । এগিয়ে আসছে ।

পুরুষ আর মহিলা জুয়াড়িদের উন্মত্ত বাহবায় দৌড়ে এগিয়ে আসছে একের পর আরেক ঘোড়া । যত জোরে চ্যাঁচাতে পারে উত্তেজিত অগুন্তি মানুষ-মানিষি, উৎসাহিত করছে বাজিধরা ঘোড়াকে । শেষতম ঘোড়া আর তার ঘোড়সওয়ারের নাম করেও লোকে চিৎকার করছে, বাকাপ, বাকাপ,বাকাআআআপ । অরবিটিনো, বাকাপ, শলিশ গোল্ড, বাকাপ, বাকাআআপ, লরেনজো, চাং ফা, অ্যাকোয়া মেরিন, কানসাই, স্যান্ড ডান্সার, বাকাপ, বাকাপ, মডেস্টি ব্লেজ, শিনজুকু, টিকোরিয়া, গোল্ড লাইট, বাকাপ, বাকাপ, বাকাপ, বাকাআআপ, অ্যাপোলোনিয়ো, জোরে, আরও জোরে, অ্যাপোলোনিও, অ্যাপোলোনিও…ও…ওওওও….

চিৎকারের ঢেউ স্তিমিত হয়ে ফোঁপানি আর অট্টহাসিতে পালটে যেতে থাকে । হাততালি ক্ষীণবল । বিজয়ী ঘোড়ার নাম ঘোষিত হচ্ছে । অরিন্দম অ্যাপোলোনোয়োর টিকিটটা গোছা থেকে আলাদা করেছে । দ্বিতীয় সলিড গোল্ড । সেটাও আলাদা করে । জ্যাকপট ঘোষিত হয় আর প্রথমটিকিটটার নম্বর মিলিয়ে অরিন্দম স্তম্ভিত, তলপেট থেকে জলোচ্ছ্বাস উঠে কন্ঠরুদ্ধ করে ।

কুন ঘুড়া ? অরিন্দমের কবজি-খেমচানো তরুণী-আঙুল আলগা হয় ।

যেটা জিতল ।

সত্যি ?

সত্যি ।

সত্যি বলছ ?

সত্যি ।

বলো না, সত্যি কিনা। কেটলিউলির কন্ঠস্বরে কিশোরী ।

সত্যি । ড্যাবড্যাবে অবিশ্বাস আর উতলা বিশ্বাসে আক্রান্ত দ্বিধাগ্রস্ত মেয়েটির তাকলাগা ঘোরের দিকে তাকিয়ে অরিন্দমের আশ্বাস। কবজি ধরে থাকা আলগা আঙুলগুনো সজোড়ে আঁকড়ে ধরে আবার । মেয়েটির কোমরে হাতের বেড় দেবার আবেগ সামলাল অরিন্দম । এই মেয়েটা ওর থেকে বয়সে অনেক ছোটো । যত তাড়াতাড়ি হোক বিয়ে করে নিতে হবে । আজ হলে আজই । এর আগে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অথচ ব্যাখ্যাহীন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ।

ছোটোভাই আর ওর বউটা বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে রেখেছে, কনে আর কনের বাবার নাম ফাঁকা রেখে । অরিন্দম জুয়াড়িদের ওই ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মেয়েটির উদ্দেশে বলল, আজই আমরা বিয়ে করব ।

বাড়ি গিয়া বাবাকে খবর দিব আর জামাকাপড় গুছিয়ে নিবো ।

না-না । আর বাড়ি যাবার দরকার নেই । সোজা আমার বাড়ি যাব ।

সিনেমার মতন ?

খুব সিনেমা দ্যাখো ? ম্যানকার সঙ্গে ?

হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা ।

চলো, টাকাটা নিয়ে নিই । ভিড় হবে কাউন্টারে ।

দামি বেদেশি সুগন্ধ একেবারে মিইয়ে গেছে উত্তেজিত সুন্দরীদের দেহগ্রন্হির বিলোড়িত গন্ধে । পার্স থেকে ছোটো স্প্রে বের করে সুগন্ধের নবীকরণ করে নিচ্ছে কেউ-কেউ পরবর্তী ঘোড়দৌড়ের আগে । কাউন্টার থেকে টাকাগুনো সংগ্রহে সময় লাগে । নতুন নোটের প্যাকেটগুনোর রোদে প্রতিফলিত আলোয় উদ্ভাসিত ওদের মুখমন্ডল । এটাই ব্যাধি, এটাই ওষুধ । বিব্রত হলে হাসে মানুষ । আগাম আশঙ্কায় হাসে ।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেসকর্মী বকশিশ প্রার্থনা করলে, কয়েকটা নোট দিয়ে দিলে অরিন্দম, নিজের উপশমের জন্যে । অ্যাতো টাকা দিয়ে দিলে ? কথা না বলে বলল মেয়েটি । ক্ষতের কষ্টের মতন গোপন আনন্দ পায় আরিন্দম ।

গাড়ি স্টার্ট করে অরিন্দম বলল, এবার জুতো খুলে পা তুলে বোসো । কেটলিউলি তা-ই করে। আয়নিত বিকিরণ-মাখানো পায়ের তলা থেকে আভাসিত হচ্ছে ধানচারা রোয়ার হিমেল গরিমা । নিঃশঙ্কচিত্ত তকতকে গোড়ালি । প্রতিদিন, কেকের ময়দামাখার সময়ে, ভ্যানিলা-সুগন্ধের অভিনন্দন পায় এই পা জোড়া । আমলা, কেরানি, পিয়োনরা, হয়তো মন্ত্রীও, সেই অভিনন্দনের স্বাদ পায় । দিনের বেলাতেও নৈশভোজের আলো লেগে আছে আঙুলগুলোয় । শাড়ির ফলের সেলাই খুলে গেছে । ধুলো-ময়লার কালচে কিনার শুকোয়নি এখুনও ।

ল্যাজধরা মরা ইঁদুরের মতন দু আঙুলে প্লাস্টিকের কালো জুতো জোড়া তুলে গাড়ির বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল অরিন্দম । ওই পায়ের জন্যে এই জুতো নয়, অন্য জুতো কিনব চৌরঙ্গি থেকে । তরুণী অবাক হয় না । অধিকারে শিকড় অস্তিত্বের অতল ওব্দি চারিয়ে দিচ্ছে অরিন্দম । শিরশির করে ওঠে আর্জি । মুখের ওপর এসে পড়েছে সোমথ্থ দুপুরের হিমসিম রোদ ।

অ।। কেটলি ।

কে।। অ্যাঁ ।

অ।। এই নামে সাড়া দিতে তোমার ভাল্লাগে, তাই না ?

কে।। আমার কাজই তো তাই । এই দ্যাখো, কড়া পড়ে গেছে হাতে ।

অ।। জানি । এখন আমরা পিয়ারলেস ইন-এ যাব ।

কে।। তুমিও পিয়ারলেস করো ?

অ।। না-না । ওটা একটা হোটেল । সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের বিয়ের আইবুড়ো-ভাত খাব । কলাপাতায় ।

কে।। আইবুড়া কেমুন ভাত গো ? সিদ্ধ না আতপ ?

অ।। আইবুড়ো চালের নাম নয় । বিয়ের আগে আমার আর তোমার নাম ।

কে।। হি-হি…আমি আই আর তুমি বুড়া ।

অ।। আমরা খাব আতপচালের ভাত, শুক্তো, পটলের ঝালসাজ, হিঞ্চেশাকের বড়া, ভাজামুগের ডাল, রুই মাছের কালিয়া, দইতে রাঁধা মুরগি, পাঁপড়া, শশা-আঙুরের চাটনি, মিষ্টি দই, ছানার পায়েস, কালাকাঁদ । হাতপাখার বাতাস । চাবিবাঁধা আঁচল কাঁধে ফেলে পানের খিলি এগিয়ে দেবে হোটেলের ওয়েটার বউদি । কেমন ?

কে।। অত খাবার ? সব একই দিনে খেয়ে নিবো কেন ? আমরাদের জন্য রেখে দিবো । আজ ডাল খাবো, কাল শোক্তো খাবো, পরশু মাছ খাবো, তাপপরদিন মাংস খাবো । ছানার পায়েস কেমুন হয়গো ? বড়ো খিদা পেয়েছে আমার । নিমবেগুন হয় না ? নিমবেগুন খাওয়া ভালো । আমি সঅঅঅঅব শাগ ভাজতে জানি । কলমি, কুলাখাড়া, সেপুন্না, নিসিন্দা, পুঁই, নটে, কুমড়া, বাথুয়া, লাউ সব সব সব সব পারি ।

অ।। মাংস ?

কে।। জানি। কলকাতায় পাখির মাংস নাই । ময়ূরের মাংস নাই । বয়লার আর বয়লার । তারচে বাবা ডালভাত ভালো ।

মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন, মনে হচ্ছিল অরিন্দমের । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামলিনী । অত্যন্ত সাদামাঠা । কালো মেয়েদের সুশ্রী বলতে যা বোঝায়, এর তেমন কিছুই নেই । এর প্রাণশক্তির জোরের বখরাটুকু আজীবন চায়, আজীবন চায় অরিন্দম । হঠা্ৎ-ই, এই ভেবে যে মেয়েটা নাবালিকা নয়তো, ধ্বক করে ওঠে হৃৎপিন্ড । সব চুরমার হয়ে যেতে পারে তাহলে ।

তুমি এবার ভোট দিয়েছিলে ? কেটলিউলির অন্তস্হালের দখল নিতে জিগেস করে অরিন্দম ।

হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা । এবার আবার একটা সাদা আর একটা গোলাপি দুটা-দুটা ভোট ছিল । ঞ্যানকা বলছিল লোকগুলার মাথা খারাপ । অন্যবার তো একটাই কাগজ হয় । আমি বলেছি, এবার আমি ভোট দিলুম কিনা, তাই আমার জন্য দুটা-দুটা। হি-হি ।

কেন্দ্র সরকারের নির্বাচন, রাজ্যসরকারের নির্বাচন, এসমস্ত আলোচনা অবান্তর । সাদা আর গোলাপি কাগজ থেকে পাওয়া রাজনীতিহীন আহ্লাদটুকুই যথেষ্ট । মেয়েটির দুচোখে ধানখেতের সবুজ অতিশয়োক্তি অরিন্দমকে আশ্বস্ত করে । হৃৎপিণ্ডে, বর্ষারাতের ঝিলমিলে মেরুণ অন্ধকার, কানে আসে আনন্দের অঙ্কুরোদ্গমের রিনরিন।

আরেকটা জিনিস রাঁধতে জানি । বলব ? কাসুন্দির সুন্দি ছাড়া, পাঁঠার পা, লবঙ্গর বঙ্গ ছাড়া, কিনে আনগে তা । বলো তো কী ?

মহোল্লাস ছেঁকে ধরে অরিন্দমকে কাঁটা দ্যায় গায়ে । বলবার ছিল কাঁঠাল, বলল এঁচোড় ।

হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা । হ্যাঁ শব্দের রণন হতে থাকে অরিন্দমের মস্তিষ্কে । বলবার মতন ধাঁধা বা ছড়া মনে করার চেষ্টা করে । মাথায় আসে না । বোধহয় জানেই না আদপে কোনও ।

হসপিটাল রোড থেকে ক্যাসুরিনা অ্যাভেনিউতে গাড়ি বাঁক নিলে কেটলিউলি সজোরে বলে ওঠে, আবার ওই রাস্তায়, ইদিকে কাকুদা বলছিল তুমি ভালোলোক । আর মটোর থামাবে না কিন্তু । মেয়েটির মুখাবয়াবে শঙ্কা ।

পথের দুধারে  গাচের ফাঁকে-ফাঁকে রোদ্দুরের সবুজ ঠাঠা । ব্রিটিশ আমল থেকে নিজের গায়ে রোদ বসতে দিচ্ছে না ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল । কিন্তু স্বাধীনতারপর সরকারি বাসের ভেজাল-দেয়া পোড়া ডিজেলের ভাসমান গুঁড়োর দাঁত জোরজবরদস্তি বসে যাচ্ছে ওর মার্বেলে । কলকাতার এই ডিজেলগুঁড়োর আতঙ্ক ছাদে আলসেতে বারান্দায় বড়ি শুকোবার রেওয়াজ উঠে গেছে । তুলি জোয়ারদার শনিবার অফিস ছুটির মধ্যাহ্ণে অরিন্দমের সঙ্গে এখানে এসে এখানের ঘাসে বসে থাকতে ভালোবাসত । এই মেয়েটি,কেটলিউলি সম্পর্কে আরও জানতে ইচ্ছে করে অরিন্দমের ।

প্রশ্ন।। অত দূর থেকে রোজ কেমন করে যাও ?

উত্তর।। কুথায় ? আমার আপিসে ?

প্রশ্ন।। হ্যাঁ, কী ভাবে মহাকরণে পৌঁছোও ?

উত্তর।। বাইপাস গিয়া এসপালানেড যাই । তাপপর ওইটুকু হাঁটা দেই । আর ডালাউসির বাস পেলে তাতে যাই । বড়ো আঁইশটানি গন্ধ ওই ঠিন, আমরাদের পাড়ায় ।

প্রশ্ন।। সারাদিন বড়ো বেশি কাজ, না ? দুতলা-তিনতলা ?

উত্তর।। লোকগুলা বড়ো আগলটাপড়া ।

মেয়েটার কথাগুনো চিনচিন করে ।

অন্যান্য বছর চৈত্রাকাশে রাগ পুষে রাখে সূর্য । এবছর রোদ্দুরের হাবভাব নিরুত্তাপ । জহোর্লাল নেহেরু রোডে লাল রঙের শতছিন্ন বাস ধুঁকছে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে । হয়তো জহোর্লালের প্রথম কি দ্বিতীয় পাঁচসালা ফেবিয়ানি আমলে হাসিমুখে চশমা পরে কিনেছিলেন বিধান রায় । দুপুরের রাজপথে বাতাসের বুকে থেকে-থেকে হাঁপানির টান । ফুটপাতের কিনারে কয়েকটা দেশোয়ালি দাঁড়কাক, দেশোয়ালি পথ-হোটেলের ফেলে-দায়া হলদেটে ভাত খুটছে তিড়িক-তিড়িক । এ-অঞ্চলে, চৌরঙ্গিতে, জীবনের অবলম্বন বলতে বোঝায় জীবিকা । কেজো চোয়ালের হন্তদন্ত যুবকেরা বেতনভূক ভিড়ের স্বাধীনতা-উত্তর আলস্যকে বাঁ-হাতে একপাশে ঠেলে-ঠেলে এগোচ্ছে ।

পার্কিঙের জায়গা খুঁজছিল অরিন্দম । শাড়ি আর একজোড়া জুতো কিনতে হবে । বাটা, উডল্যান্ডস, মেসকো রয়েছে ওফুটে । দামি জুতো কেনা দরকার । জুতো দেখে লোকে চরিত্র নির্ণয় করে । গোড়তোলা ডার্কট্যান ব্যালেরিনা ? স্ট্র্যাপ-দেয়া  গ্রিক স্যানডাল ? শাড়ি কোনটা ? তাঁতের । হালকা নীল বা ফিকে বেগুনি জমি । বেগমবাহার বা কটকি হলে কেমন মানাবে । সিল্ক বোধয় এই গরুমে অচল । নয়তো কাতান বা তাঞ্চোই । নাঃ, সুতির ফিকে সবুজ ভয়েল কেমন ? দোকানের কাউন্টারে যে মেয়েগুলো থাকে, তারাই বলতে পারবে, কেননা ম্যাচিং ব্লাউজ, শায়া চাই ; ওরাই সাহায্য করবে নিশ্চই ।

পাপহীনতার আঁচে-মোড়া মেয়েটির বাঁ পায়ের তলায় একটা তিল জনরে পড়ে । অরিন্দমের আছে ডানপায়ে । বার্ধক্যে বেড়াতে যাবে অনেক জায়গায় । চতুর্দিক জুড়ে নিঃশব্দ রাগসঙ্গীত লাউডগার সবুজ ঘুঙুরালি শুঁড়ের মতন গজিয়ে উঠতে থাকে অরিন্দমের চারিপাশে । সিন্ধু ভৈরবী, আহিরললিত, গান্ধারি-টোড়ি, শুক্লবিলাওল, মধুমাধবী সারং, বারোয়াঁ, পলাশকাফি, তিলকশ্যাম, পটকঞ্জরি, চাঁদনিকেদার, শিবরঞ্জনী, হংসকিংকিনি, জয়ন্তীমল্লার, দুর্গাবাহার, মধুমাধবী । ভালোলাগার এই মনস্হিতির বর্ণনা নেই ।

ওই দ্যাখো । তেলেঙ্গি, না ?

মোটাসোটা বউ আর ব্লাউজ-শায়া পরা মেয়ের সঙ্গে, বোধয় কেরালার, সাদা লুঙ্গি শার্ট-পরা লোকটা হকারের সাথে দরদস্তুরে ব্যস্ত । তেলেগু নয়, বলল অরিন্দম । এখন তো অন্ধ্রের উগাদি উৎসব হয় । হতেও পারে । চৈত্রমাসেই তো হয় উগাদি । অন্ধ্রের একজন মুসুলমান অফিসার কাজ করত পাটনায় আমার সঙ্গে । ওর মা আর দিদি ঘাগরা আর ফতুয়া-ব্লাউজ পরত বলে, লজ্জা পেত ওর বাড়ি গেলে । সজনেপাতা দিয়ে মাংস রাঁধত ।

আমিও সজিনাপাতা রাঁধতে পারি । তোমার ডিপাটে তেলেঙ্গি আছে ? কুন আপিস ?

ওই যে, তোমার অফিসের পাশে, এসকালেটার আছে ।

কাটা ট্যাকার ব্যবসা ?

হ্যাঁ, নোটের আর পয়সার ব্যবসা আমাদের । নোট ছাপি, করকরে নোট বাজারে ছাড়ি, নোংরা পচা নোট গুঁড়ো করে কাগজ বানাই । পাঁচ কিলো দশ কিলো ওজন করে ব্যাগভর্তি পয়সা বেচি ।

ইশরে । অনেকঅনেক পাওনা পাও । আমার আপিসে লরির কাগজ বের করতে পাওনা লাগে, বাইরের লোকজন অগুন্তি আসে সারাদিন, কাগজ বের করার জন্য বোসথাকে, দাঁড়িয়ে থাকে একঠায় , গেলাস গেলাস চা খায় ।

জানে অরিন্দম । পায়ে-মাখা ময়দার কেক খায় । বহুদূর শহর-গঞ্জ থেকে এসে খেয়ে যায় চরণামৃত । কিছুদিন আগে বেশ হইচই হয়েছিল দশ কোটি টাকার ব্যাংক ড্রাফ্ট আর এক কোটি টাকার পোস্টাল অর্ডার ওই বিভাগের আলমারিতে গুঁজড়ে রাখা ছিল বলে । সরকারি তহবিলে জমা করার জন্যে পাঙানো হয়নি । বচরের পর বছর পড়ে-পড়ে খড়খড়ে, রং-ওঠা, দোমড়ানো, ওগুনোর কথা মনে ছিল না কারুর, আশ্চর্য । কাজই করতে চায় না কেউ । অলস শুক্রকীটের ফসল বলে কিছু হয় কি ? ওই নির্মম হৃদয়হীন পরিবেশে মেয়েটা কাপ আর কেটলি ঝুলিয়ে কতবার এঘর-ওঘর পাক খায় কে জানে !

অরিন্দম দেখতে পেল, ওফুটের কিনারে, বাটার দোকানের সামনে কেরালার নাম্বারপ্লেট লাগানো হলুদ মারুতি জেন গাড়িকে টো করে থানায় নিয়ে যাবার জন্যে পুলিশের লালরঙা রেকারট্রাক থেকে কয়েকজন নাবল। গাড়িটার তলায় ঢুকল একজন । গিয়ারকে নিউট্রাল করে ক্রেনে ঝোলাবে ।

ওরেব্বাপ । এখানে পার্ক করলে ওই গাড়িটার দশা হবে । আগেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে অরিন্দমের । সেটুকুই যথেষ্ট । প্রথম পনেরো মিনিটে বভাটারি আর ওয়াইপার লোপাট । তারপর এক-এক করে স্টেপনি, কার্বুরেটার, রেডিয়েটার, ফিউজ বক্স, স্টিয়ারিং বক্স, প্রপেলার শ্যাফ্ট আর তার কদিন পরে তো মেশিনটাই হাপিস । ব্যাস । শ্যাশিটাকে ঠ্যালায় চাপিয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাও । আদিত্য তো বলেই দিয়েছে, এসব ব্যাপারে ও নাচার ।

রেকার-লরির পেছনে নিজের প্রিয় গাড়ির উর্ধ্বমুখী দুরবস্হা দেখে কেরালীয় লোকটা, ওর থপথপে বউ আর শায়া-ব্লাউজ পরা ঢ্যাঙা মেয়ে, তিনজনই দুহাত ওপরে তুলে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে দৌড় লাগায় ধাবমান রেকারের দিকে ।

কেটলিউলির কি হাসি কি হাসি । মেয়েটির দিকে নয়, অরিন্দম তাকিয়ে থাকে ওর হাসির দিকে । অপার্থিব, অপার্থিব,অপার্থিব । দ্রুতগামী যানের মাঝে পড়ে রাস্তা পেরোতে পারছে না মালায়ালি পরিবারটা, আর তা দেখে হাসছে তো হাসছেই মেয়েটা । বিদ্যুৎবাহী হাসির অদৃশ্য প্রজাপতিরা উড়ছে গাড়ির মধ্যে । অরিন্দমের মাথা থেকে পায়ের আঙুল ওব্দি বইতে থাকে মহাজাগতিক রশ্মিতরঙ্গ ।

রাস্তা পেরোতে থাকা পরিবারটিকে বাঁচিয়ে, পাশ কাটিয়ে বেরোতে গিয়ে, দ্রুতবেগে ছুটে-আসা আলুর বস্তা বোঝাই হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার মিনি ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারল অরিন্দমের গাড়ির পেছনে । প্রচণ্ড অট্টহাস্য করে ওঠে ধাতব সংঘর্ষ ।  আলুর চটের বস্তা ছিঁড়ে রাস্তাময় গড়ায় এলা-মাটি মাখা আলু । আরম্ভ হয় জনগণের আলু কুড়োবার উৎসব । হকার-ভিকিরি-কেরানি-দোকানি-গৃহবধু-দারোয়ান-পকেটমার-ট্যাক্সিচালক সবাই মেতে ওঠে আধ-পচা আলু সংগ্রহে ।

তীব্র ধাক্কা খেয়ে অরিন্দমের গাড়ি ওদের দুজনকে সুদ্দু কিছুটা ছুটে গিয়ে রাস্তায় পড়ে-থাকা পাথরে তুলে দিয়েছে বাঁ দিকের চাকা, আর তারপরেই কাৎ হয়ে উলটে গেল । আকাশের দিকে চারটে ঘুরন্ত চাকা । গুবরে পোকার মতন দুবার পাক খেয়ে আগুন ধরে গেল গাড়িটায় । সশব্দে বিদীর্ণ হয় ডিজেল ট্যাঙ্ক আর গাড়িটা আগাপাশতলা ঢাকা পড়ে যায় তরল দগদগে আগুনে । আগুনের টোপর পরে ওলটানো গাড়ির ওপর নাচতে থাকে শিখা ।

Leave a comment