১৪

অভিনয়ের অ আ ক খ শিখছে এমন এক নিরক্ষর নোংরা আজীবন চান করেনি নাকে পোঁটা খয়েরি-চুল বালিকা ওদের দিকে নখপালিশ-ওঠা হাত বাড়িয়ে আনুনাসিক প্রার্থনা জানাতে আরম্ভ করলে, অরিন্দমের হুঁশ হয়, আবোল-তাবোল ভাবছিল ও, ছি-ছি !

আমরা কি তাহলে মাঝপথে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্ব পাতানোর অনুষ্ঠান করব ? যিশুর কথায় অরিন্দম বিব্রত । কেটলিউলি নিজের থুতনি একবার বাঁ-কাঁধে আরেকবার ডান-কাঁধে ঠেকায় ।

পাশ দিয়ে চটাং-চটাং কথা বলতে-বলতে একজোড়া হাওয়াই চপ্পল চলে যায় । সামনের দোকানটায় ন্যাতানো জিলিপির ওপর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ভিমরুল পরিবারের বালক-বালিকা । শালপাতার ওপর মাছি-সমাজের ভনভন গ্রাম পঞ্চায়েতের বখরা নিয়ে ঝগড়া । একটা সাদা-বাদামি কুকুর আস্তাকুঁড়ে চর্বিত চর্বনে একাগ্র । সাদা লংক্লথে জড়ানো শিশু আর গোটানো শীতলপাটিসহ গোটা তিরিশেক উদাসীন টুপি-লুঙ্গি দল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে অরিন্দমের কোমরে ডান বেড় আর কেটলির হাত বাঁ-হাতে নিয়ে পার্ক-করা গাড়ির দিকে এগোয় যিশু ।

মুসুলমানদের নীরব শবযাত্রার শোক বড্ড ছোঁয়াচে । আর শবযাত্রায় নেতৃত্ব সব সময়ে এক মৃতদেহের । মৃত্যুর কি যাত্রা সম্ভব ? আমাদের এই কালখণ্ডটা শবযাত্রার । দাদু-ঠাকুমার কাল ছিল তীর্থযাত্রার । আমরা মডার্ন হবার যোগ্য নই । ওদের দুজনকে নিয়ে যেতে-যেতে ভাবছিল যিশু ।

ধুৎ, ভাললাগেনা । কেটলিউলির কথাগুলো কাঁপে থরথর । ঝটকায় হাত ছাড়ায় ।

পায়ের কাছ থেকে জিলিপি-ভেজা ঠোঙা তুলে নিয়ে যায় কাগজ-কুড়ানিয়া বাতাস । মেয়েটির উক্তিতে অরিন্দম একশা, হকচকায় । বাচনভঙ্গীর সঙ্গে মানানসই পুরু তাঁবাটে ঠোঁট । ওপরের ঠোঁটের ওপর, নাকের তলায়, কয়েক ফোঁটা ঘাম । হয়তো কেকের ময়দা ঠাসার পরিশ্রম ।

ভ্যানিলার ভারাতুর গন্ধের আদর কাটিয়ে, গাড়ির ডিকি তুলে জুতো-মোজা খুলে ঢোকায় অরিন্দম আর কোলহাপুরি বের করে পরে । রাস্তার কলে ও হাত-পা ধুতে গেলে, কেটলিকে যিশুর ফিসফিস । কী ভাবছে, বলতো, অরিন্দমটা । নির্ঘাত চটবে আমার ওপর । তোর কথা শুনেই এসেছে ও । বলছি তো, ওর মতন লোক আজকাল দেখা যায় না । তুই-ও অনেক লক্ষ্মী মেয়ে, বলেছি ওকে ।

ভালো লোক বললে চরিত্রের ওপর অসহ্য চাপ পড়া । অরিন্দম নীল বর্ডার দেয়া ধবধবে রুমালে হাত মুছতে-মুছতে এসে, ওদের কাছ-ঘেঁসে দাঁড়াতে, কেটলিউলি অরিন্দমের মুখে কনকনে চাউনি ফেলে জানতে চায়, কেনই বা যাব তোমার সঙ্গে ?

কথাগুলো একযোগে অরিন্দমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরে ফেলতে চায় ওর সযত্নলালিত সততাকে । দৃষ্টি স্হির রাখে অরিন্দম । সরাসরি তাকায় ।  একবারও পড়তে দেয় না চোখের পাতা । ওদের দুজনকে তো বটেই, নিজেকেও স্তম্ভিত করে ওর অনুচ্চস্বর ঘোষণা: তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই ।

কেটলিউলি ভাবার সময় নেয় না । যেন প্রস্তাবের উত্তর আগে থাকতে নির্ণীত । কিংবা চিন্তার দ্বারা কলুষিত হবার আগেই প্রশ্ন তোলে । কুতো দিনের জন্য ?

অরিন্দমের কানে কালো, মসৃণ-ডানা, ঝিঁঝির অদৃশ্য কলতান আটকে যায় । ওকে চাপা না দিয়ে একটা বেসরকারি বাস চলে গেল পাশ কাটিয়ে । টের পায় মগজের মঞ্চে অস্হিরতার ঝিঁকা নাচ । ফুসফুসের মধ্যে কোথাও নিজের ডাকের পুনরুক্তি দিয়ে আবহকে উত্তেজিত করছে কোকিল । স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ও, অরিন্দম, বাতাসের অদৃশ্য মৃগশিশুরা দুধ খেতে নাবছে কেটলিউলির সদ্যোদ্ভিন্ন হৃদ্যতায় । ওর মনে হল, কেটলিউলির মেরুতে বার্তা পৌঁছে দেবার ভাষা ওর আয়ত্বে নেই । হিন্দি আর বাংলা সিনেমা-ও কেটলিউলির কাছে প্রেম-ভালোবাসাকে হাস্যকর আর ফালতু করে দিয়ে থাকবে । প্রেমের সমস্ত অভিব্যক্তিকে ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে আধুনিকতা ।

ওই অশথ্থ গাছটা যতদিন বাঁচবে, বলল ও, অরিন্দম, মেরুন-সবুজ স্বচ্ছ নৃত্যপটিয়সী অশথ্থপাতায় খেলতে-থাকা নিরুচ্চার রোদ্দুরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল ও, আমি আজকে, এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই, বলল ও, বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই, বলল ও, আমি যে-কোনো প্রথায় বিয়ে করতে রাজি, বলল ও, আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তেই এসব কথা বলছি, বলল ও, আমি সব রকম ঝড়ঝাপটা পোয়াতে তৈরি, বলল ও, আমাদের বাড়িতে কেউই আপত্তি করবে না, বলল ও, মায়ের বরং আনন্দই হবে, বলল ও, তুমি তোমার মহাকরণের কাজ ইচ্ছে করলে বজায় রাখতে পারো, বলল অরিন্দম ।

যিশু থ, বোধয় মুগ্ধ । যৌন সম্পর্কের শ্রেণিবিভাজন কি সত্যিই মুছে ফেলা যায় ? আবেগকে এতকাল বারংবার অবজ্ঞা করার দরুন ওর নিজের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণয়গুলো মুলতুবি থেকে গেছে, তামাদি হয়ে গেছে । অরিন্দমের এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই আর কেটলিউলির কুতো দিনের জন্য, আত্মসমর্পনের এই আঘাত-প্রত্যাঘাত ওকে তীব্র চোট দিয়েছে । কপালে বরফের থান ইঁটের মতন । প্রতিভা তো সকলেরই থাকে, কিন্তু যে নির্বোধ অজানার আহ্লাদে টেনে নিয়ে গিয়ে মানুষের টুঁটি চেপে ধরতে চায় তার প্রতিভা, সেখানে একা ঢোকার সাহস, সবায়ের হয় না ।

গটগটিয়ে গাড়িতে বসতে গিয়ে দরোজা বন্ধ পায় কেটলিউলি । বিড়ম্বিত মুখশ্রী দেখে অরিন্দম দ্রুত তালা খুলে সামনের সিটে বসতে আ্‌বান জানায় দুজনকে । কেটলিউলি বসেছে চালক অরিন্দমের পাশে । যিশু বলল, আমি পেছনে বসছি। অরিন্দম গাড়ি ঘোরায় ।

বাবুরা দিনদুপুরে চললেন পিগনিগ কত্তে, শালা মটোরগাড়ির রোয়াব দেকাচ্চে । মন্তব্য ঝাড়ে রোগাটে কালচে ধুতি-পাঞ্জাবি, কটমট। যিশু বলল, ইনিও গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো ইশকুলের সদস্য । অরিন্দম পালটা মন্তব্য করে কলকাতায় গাড়ি থাকাটা গণশত্রুতা ।

যিশু: আমরা কি তাহলে এখুন বিয়ে কত্তে যাবো ?

কেটলি : হ্যাঁঅ্যাঅ্যঅ্যা । কুথায় যাবো ?

যিশু : খ্রিস্টান হলে আমি আজই চার্চে ব্যবস্হা করে ফেলতুম । ব্যাপটাইজ করতেও সময় দরকার । রেজেস্ট্রি করতে চাইলেও তো নোটিশ দিতে হবে । যাবার পথে না হয় নোটিশটা দিয়ে যাওয়া যাক, কী বলো ? তোমার হিন্দু মতে তো পাঁজি-পুরুতের ঝক্কি । মহারাষ্ট্র মণ্ডল কিংবা তামিল সমাজমকে খর্চা-খরচ দিলে ওরা ইন্সট্যান্ট ব্যবস্হা করে শুনেছি । তোমার মুসুলমান বা বৌদ্ধ বন্ধুবান্ধবদের নক করে দেখা যেতে পারে । তার চেয়ে আমিই না হয় পুরুত হয়ে যাই, এক সঙ্গে বাঁচা নিয়ে তো কথা । ও, না, আজকে অনেক কাজ আছে আমার পরশু আমার কার্ডামম রিপোর্টের প্রেজেন্টেশান । গিয়ে ইকুইপমেন্টগুলো চেক করে রাখতে হবে ।

যিশুর ফ্ল্যাটে ছোটো ঘরটায় টেবিলে আর দেয়ালে বসানো আছে নানা যন্ত্রপাতি, দেখেছে অরিন্দম । বাঙালি কর্মীদের চেয়ে যন্ত্রপাতিকে বেশি বিশ্বাস করে ও । ঘরটায় একা বসে নিজের রিপোর্টের বিশ্লেষণ করে শোনায় জাপান বা আমেরিকার কোনো কোম্পানির বোর্ড সদস্যদের, যারা কাজটার ঠিকে দিয়েছে । তারা প্রশ্ন তোলে । যিশু উত্তর দেয় । প্রকল্প বা প্রস্তাব তক্ষুনি অনুমোদিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়, কিংবা আবার বাড়তি তথ্য যোগাড়ে বেরোতে হয়, নতুনভাবে অনুমোদনের জন্যে । হলে ওর মোটা লাভ । না হলে মন খারাপ ।  প্রচণ্ড খাটে । নিয়ন্ত্রণ না করলে কাজ সবসময় দক্ষের দিকে, মানুষের দক্ষযজ্ঞের সক্ষমতার দিকে আকৃষ্ট হয়ে মানুষকে ঘিরে রাখে । যারা নিকৃষ্ট আর ফাঁকিবাজ তারা তাদের অক্ষমতার কর্মসংস্কৃতি গড়ে তোলে আর ক্রমশ রূপান্তরিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠে ।

অ।। আমি তো ধর্মহীন আস্তিক ।

যি।। কেটলি তুই কী বলিস ?

কে।। ঘুড়ার দৌড় দেখতে যাবো ।

যি।। তুই দৌড় দেখতে চাস, না রেস খেলতে চাস ? মাঠে না গিয়েই রেস খেলা যায় রাসেল স্ট্রিটে টার্ফ ক্লাবের কাউন্টারে ।

কে।। ঘুড়াও দেখে নিবো, রেসও খেলে নিবো ।

যি।। আমাকে তাহলে পার্কস্ট্রিটে নাবিয়ে দাও অরিন্দম । পার্ক সার্কাস বা ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে ঢোকার সময় আছে এখনও । টাইমে পৌঁছোতে পারলে কাজ হয় । নইলে সেই আবার ঘুরপথে চৌরঙ্গি দিয়ে ঢুকতে হবে ।

কে।। চলো না কাকুদা, আমরাদের সঙ্গে । খেলা জিতে নিবো আর চলে যাবো শশুরবাড়ি । হি-হি।

যি।। আগে তো জিতগে যা । আজকে আমার সত্যই অনেক কাজ আছে । তার ওপর আমার ম্যান ফ্রাইডেটা বাড়ি যাচ্ছে । ওদের গ্রামে টেনশান শুরু হয়েছে আবার । বেচারা কীর্তনিয়া ।

অ।। সেই বাঙাল ছেলেটা ? কী হল ওর ? এইজন্যেই আপনার পুরোদস্তুর অফিস খোলা উচিত ছিল । ক্লার্ক, অ্যাকাউন্টেন্ট, ডাটা এনট্রি অপারেটর এসব রেখে । অঢেল টাকা তো রোজগার করেন ।

কিছুক্ষণ থম মেরে যায় যিশু । তারপর আরম্ভ করে পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতাউত্তর পল্লিসমাজের অকথ্য রূপকথা । শোনার জন্যে গাড়ির গতি কমায় অরিন্দম ।

উত্তর দিনাজপুরের অন্ত্যজ উদবাস্তু গ্রাম ভাঙাপাড়ায় ওর বাড়ি । উত্তরবঙ্গের গ্রামগুনোর নামও স্ট্রেঞ্জ । ভাঙাপাড়া, মাথাভাঙা, ফাটাপুকুর, রাজাভাতখাওয়া । ওদের গ্রাম থেকে আমিই এনেছিলুম ছেলেটাকে । একদম রঅঅঅ । এখুন তো ও আর থাকতে পারে না গ্রামে গিয়ে । গ্রামটা একেবারে অজ পাড়াগাঁ, অলমোস্ট এইটিন্হ সেঞ্চুরিতে । পার্টির দলাদলি ছাড়া অন্য কোনও রকম আধুনিকতা নেই ।

গত বছর ওদের গ্রামের চালকলটায় আর সেখানকার শদেড়েক কুঁড়েঘরে আগুন ধরিয়ে আটজনকে পিটিয়ে গলাকেটে খুন করেছিল পাশের টুনিভিটা গ্রামের মাহাতোরা ।  পাঁচশো মাহাতো, হাতে মশাল নিয়ে দৌড়ে আসছে, কী ভয়াবহ । তোমাদের বিহারের খুনোখুনি তো এর কাছে নস্যি । পাঁআআআচ শোওওও লোক হাতে মশাল নিয়ে চ্যাঁচ্যাতে-চ্যাঁচাতে এগোচ্ছে একটা গ্রামের দিকে, ভাবতে পারো ?  শরৎ চাটুজ্জে তো এই সিনারিও নিয়ে এপিক লিখে ফেলতেন, একশট আফিম মেরে । বিগ বাজেট হিন্দি ফিল্মও হতে পারে; পাঁচশো গব্বর সিং দাঁত বের করে ছুটে আসছে ।

বুঝলে ? একটা কোলের বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আগুনে । পড়পড় করে পুড়ে ঝামসে কালো হয়ে গেল জলজ্যান্ত তুলতুলে বাচ্চাটা । বুঝলে ? টুনিভিটার মহাজন সুরেন মাহাতোর লাশ আগের দিন পাওয়া গিসলো ভাঙাপাড়া গ্রামে । গ্রামে-গ্রামে ব্যাংক খুলে মহাজনদের খুব সুবিধে হয়েছে । কী বলছিলুম ? হ্যাঁ । অজিত বালা নামে একজন চালকল মালিকের কাছে মোটা টাকা পাওনা ছিল সুরেনের ।

আমার কাজের ছেলেটার বাবা-মা আর বোন এসে ছিল আমার ফ্ল্যাটে । বিহারের বলরামপুর থেকে লাঠিয়াল এনেছিল মাহাতোরা । তাদের হাতে লাঠি, বল্লম, সড়কি, টাঙি, বাঁশ, শাবল, জেরিক্যানে পেটরল । ওই সমস্ত অস্ত্র নিয়ে পাঁচশো লোক, ছুটে আসছে, হই-হই করতে-করতে, বুঝলে ? জাস্ট ভিজুয়ালাইজ । ভাঙাপাড়ার জোতদার বুধন মাহাতোর হাজার খানেক বিঘে জমির বেশিটাই খাস হয়ে গিসলো । ভাঙাপাড়ার রিফিউজিরা কেউ-কেউ পাট্টা পেয়েছিল । গোলমালের পাণ্ডা ওই বুধনটাই । ওর ছেলে ব্রহ্মদেবকে ধরেছিল পুলিশ । আরে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তো সব আদিত্যর কার্বন কপি ।

ভাঙাপাড়ার পরিবারগুনো ধান থেকে চাল বানিয়ে বিক্কিরি করে । ধান কোটে বলে ওদের বলে কুটনি । মহাজনদের কাছ থেকে দাদন ছাড়া ওদের চলে না ।  কবে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, পঞ্চাশ বছর আগে । অনেক কুটনির অবস্হা সামান্য ফিরেছে । অনেকে আবার রয়ে গেছে উদবাস্তু, অলমোস্ট কাঙালি । এদিকে জমির দামও বেড়েছে তরতর করে । মাহাতোরা তো ব্রিটিশ আমলের জোতদার । ধার দিয়ে, লোভে ফেলে, ভয় দেখিয়ে, আবার হাতাবার তালে ছিল জমিজমা । মাহাতোদের দলে ভিড়েছিল পলিয়া জাতের লোকেরা, ওরাও ল্যান্ডেড ক্লাস । এরা ঝাড়খণ্ডিদের মতন উপজাতি নয় । ভাঙাপাড়ার উদবাস্তুদের চেয়ে উঁচু জাতের লোক এই চাষাগুনো।

জমিদারি আমলের মতন ধার-দাদনের কাগজে টিপছাপ আজও চলছে । পঞ্চায়েতেও তো জোতদার, মহাজন, মাহাতোদের দখলে । খুনোখুনির পর ব্রহ্মদেবটা তো হাওয়া হয়ে গেসলো । আর ধরাটরা পড়েনি বোধয় । ওদিকে সমবায়-টমবায় বলে কিছু নেই । মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়ার মতন সমবায় ব্যাপারটা মাটি পায়নি উত্তরবঙ্গে । এনজিও নেই বলেই মনে হয়, জেলা সদরে যা জেনেছি । এনজিও গঠন করতে গেলেই খুন হবে, আসামে মাজুলি দ্বীপে সঞ্জয় ঘোষের মতন । বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাবুদের কথা তোমায় আর কী বলব । তোমরা তো ওদের মালিক । লাইসেন্স দাও, ইন্সপেক্ট করো ।

দেশভাগের পর বামুন, কায়েত, বদ্যি যারা এসছিল, কেউ আর পড়ে নেই । সব্বাই দিব্বি গুছিয়ে নিয়েছে । উদবাস্তুদের নেতা হয়েছে । রাজনীতিরও দখল নিয়েছে । কিন্তু মার খেয়ে গেল অন্ত্যজরা । উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চলে তো ওদের জমিজমা সব শিখ সরদাররা হাতিয়ে নিয়েছে ; আন্দামানে গিয়েও উপনিবেশ গড়তে দেয়া হয়নি ।

আচমকা ওদের সঙ্গিনী জিগ্যেস করে ফ্যালে, কুন দেশ গো ?

এই নিষ্পাপ অজ্ঞানতা বজায় থাকুক । আধুনিকতার কলুষমুক্ত থাকুক, ভেবে, অরিন্দম বলল, কোন দেশ আবার, তোমার দেশ ।

না-না, আমরাদের দেশ নয় । আমরা ঝগড়া করি না । মেয়েটির দুচোখে ড্যাবড্যাবে গরিমা ।

তাই জন্যে তোর বিয়ে দিচ্ছি অরিন্দমের সঙ্গে, ও-ও মহাক্যাবলা, ঝগড়া-ফগড়া করতে পারে না, বলল যিশু, প্যাকেটে সিগারেট ঠুকতে-ঠুকতে ।

তুমি সিগ্রেট খাও না ? অরিন্দমের কাছে জানতে চায় বাগদত্তা ।

না, আমি পান সিগারেট মদ গাঁজা কিচ্ছু খাই না ।

ঠিক, তুমি বোকা । অরিন্দম সম্পর্কে বাগদত্তার মূল্যায়ন ।

যিশু ওর পল্লিকথার পরবর্তী পর্ব শুরু করে ।

গ্রামটায় থেকেছি আমি । প্রাইমারি ডাটাবেসের লোভ আমি সামলাতে পারি না , জানোই । কুটনিদের পুরো তথ্য আছে আমার কাছে । আনবিলিভেবলি গরিব এই লোকগুনো । একচালা, হোগলা, চ্যাঁচারি, ডিগডিগে, ক্যাঁতরা-কানি, লালচাল, জলেতে তেলের গন্ধ, পানাপুকুরে চন, নোংরা ছোটোছোটো মাছ আর শাকশেকড় । আমার তো পেট খারাপ হয়ে গিসলো । বুঝলে ! তাও আবার পায়খানা নেই । মাঠে হাগতে যাও ।

হি-হি।

এই, হাসিসনি ।

লোকাল রাজনীতিকরা মাথা গলায়নি ? জানতে চেয়েছিল অরিন্দম ।

আরে তা আর বলতে । প্রান্তিকের সংঘর্ষ মানেই রাজনীতি, আই মিন পার্টি-পলিটিক্স । সিটুর কুটনি ইউনিয়ানের বিবেকানন্দ কীর্তনিয়া বলেছিল, গণহত্যার পুরো ছকটা সিপিয়েম নেতা হরেরাম মাহাতোর । সিপিয়ের সাংসদ সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিল, হরেরাম নির্দোষ, আসলে জোতদাররা জমি কাড়তে চাইছে । জেলা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বীরেশ্বর লাহিড়ি বলেছিল, জোতদার-মহাজনদের কথায় ওঠবোস করি না আমরা । বিজেপির শ্রীধর মল্লিক বলেছিল, পেটরল এসেছে মাহাতোদের চালকল থেকে । কলকাতায় কংরেসের মানস ভুঁইয়া বলেছিল, যারা খুন হয়েছে তারা সবাই কংরেসের । আরেসপির জেলা সম্পাদক জ্যোতিষ সরকার বলেছিল, আরেসপির প্রভাবশালী নেতা ছিল টুনিভিটা গ্রামের সুরেন মাহাতো । কারামন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরি ভাঙাপাড়ায় গণশ্রাদ্ধের দিন বলেছিল, পুনর্বাসনের ব্যবস্হা করা হচ্ছে । ব্লক আধিকারিক অশোক সাহা বলেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুনোর জন্যে তেরপল আর কাপড় কেনা হচ্ছে । দিনাজপুর-মালদা রেঞ্জের ডি আই জি অশোক সেন বলেছিল, হত্যাকারীদের খোঁজ চলছে । জেলার পুলিশ সুপার দেবেন্দ্র সুকুল বলেছিল, অবস্হা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে । জেলাশাসক পবন আগরওয়াল বলেছিল, গ্রামবাসীদের মাথাপিছু ষাট টাকা নগদ, শুকনো খাবার আর জামাকাপড় দেয়া হবে । প্রতিমন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিল, শোকমিছিল বার করলে অশান্তি হবে । আরেসপির স্হানীয় নেতা রমণীচন্দ্র ঘোষ বলেছিল, বুধনের ছেলে ব্রহ্মদেব তো কংরেসের লোক….

তুমি কী বলেছিলে ? সঙ্গিনীর রাগি প্রশ্নে দুজনেই স্তম্ভিত ।

যাক বাবা, আমার বাড়ি এসে গেল । জবাব এড়াবার সুযোগ পেয়ে সত্যিই প্রীত হয় যিশু । দোর খুলে, বাঁ পা বাড়িয়ে, চুলের টেরি বাঁচিয়ে নাবে । নেবে, সামনের জানালায় ঝুঁকে, মেয়েটি ওর কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারবে না জেনেও বলে, বুঝলি, আমরা সাধারণ লোকেরা মহলায় প্রক্সি দিই, কিন্তু আসল নাটকটা করে অন্য লোকেরা । আমাদের এই পাড়ায়, পার্ক স্ট্রিটে, বুঝলি,  সক্কালবেলা একজন লোক কাক আর কুকুরদের আও আও আও আও, কানি আও, লেংড়ি আও, ডাক পেড়ে-পেড়ে রুটির গোছা খাওয়ায় ।

হি-হি।

একদঙ্গল মেট্রোপলিটান কিশোরী রাস্তা দিয়ে ঢলঢলে বুক ফুলিয়ে যেতে-যেতে, হাই আংকল, চেঁচিয়ে হাত নাড়ায় যিশুকে । নজর ওদের কেটলিউলির দিকে ।

অরিন্দম : আমিও কাল থেকে আপনাকে কাকুদা বলে ডাকব ।

যিশু : কালকে কেন ? এখন থেকেই বলো ।

অরিন্দম : আগে বিয়েটা করি ।

যিশু : সত্যি ? না খাঁটি সত্যি ? কোনটা ? আচ্ছা চলি ।

গাড়ি থেকে নেবে, শনিবারে প্রাক-দুপুরে, সওদাগরি পাড়ায়, হঠাৎই দরাজ হয় যিশুর গলা । মোন মোর উড়াং বইরং করে রেএএএএ….। উত্তর দিনাজপুরে শোনা ।

ইশ রে, আবার গান !

Leave a comment