লোহার ভারি কালো চপারটা রোগা লোকটার ঘাড়ের ওপর পেছন থেকে সজোরে পড়তেই, চার ইঞ্চির আঘাতের রেখা-বরাবর, ময়লা চামড়ার তলা থেকে উথলে ওঠে সাদা গোলাপি নরম মাংস, টুটসি সমর সেনার হাসির ঠোঁতের মতন দুফাঁক কাটা জায়গাটা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে গলগলে গরম তাজা রক্তের নিটোল ছররা । বাতাসের ছোঁয়ায় গলে গড়িয়ে পড়ে ছররাগুনো । আক্রান্ত রোগা প্রৌঢ়ের শ্বাসনালিকায় প্রশ্বাস মোচড় দিয়ে ওঠে, বাঁদিকে হেলে পড়ে মাথা, আর দুলদুলে ঘাড় নিয়ে জীবনে শেষ দ্রুততম দৌড়ের নিশিডাক ওকে পেয়ে বসে।

শ্বাস-ফুরন্ত লোকটা দৌড়োয়, সামান্য ঝুঁকে ভীত রাজহাঁসের মতন পা ফেলে পা ফেলে, সাদা টেরিকটের শার্ট জবজবে লাল, দৌড়োয়, দৌড়োতে থাকে, ছোটে, ছুটতে থাকে, পালাতে থাকে । পারে না আর । মৃগি রুগির মতন পড়ে যায় ভোটবাগানে জয়বিবি রোডের ধুলোর ওপর, চিৎ, হাত-পা ছড়িয়ে, সসব্দে, মাঝপথের প্রাচীন ধুলো উড়িয়ে । মুখে ছিট কাপড়ের রুমালবাঁধা আরও দুজন আক্রমণকারী, অপেক্ষারত, বাজারের নাইলন-থলে থেকে বের করে আরও ভারি, কালো, হাড়কাটার চপার । লোকটার ধূসর ট্রাউজার-পরা ঠ্যাং-ছেতরানো দেহে খিঁচুনি উঠে স্হির হয়ে যেতে, রক্ত-চিটচিটে চপার থলের মধ্যে পুরে, তিন দিকে পালাল স্বাস্হ্যবান যুবক খুনিরা ।

কয়েক মুহূর্তের দর্শক, শ্লথ পথচারীরা, প্রথমটায় থ, বিমূঢ়, তারপর ঘটনাস্হল থেকে পালাতে শুরু করে আতঙ্কে । সবাই মুক্ত হতে চাইছিল ঘটনা থেকে খ ঘটনা থেকে বিচ্যূত হবার আরামপ্রদ স্মৃতিতে ফিরে যাবে গলির নাগরিক । এই খুনের চেয়েও তারা ভীত হত্যা-পরবর্তী রাষ্ট্রযন্ত্রের আস্ফালন-নকশায় । ঠেকগুলোর ঝাঁপ বন্ধ করার উদ্বিগ্ন তাড়াহুড়ো, দোকানগুলোর শাটার নাবাবার ঘড়ঘড়, পথের কিনারা থেকে ভিকিরিদের পয়সা তুলে দৌড়ুবার সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলায় ফাঁকা হয়ে যায় জয়বিবি রোড । শুনশান লাশ, একা, চিৎ, পড়ে আছে । হাওয়ায় ফুরফুর করছিল ওর কোঁকড়া কাঁচাপাকা চুল ।

অপঘাতে মরার সময়টাতে মানুষের একা অসহায় দেহ কেমন ন্যালবেলে, হেলে সাপের মতন হয়ে যায়, নিজের চোখে তা দেখল অরিন্দম, অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, দেখল হত্যা, আততায়ী, আক্রান্তকে, চাক্ষুষ, আর গা গুলিয়ে তলপেট থেকে শ্বাসহীনতার ঘূর্ণিবাতাস পেঁচিয়ে উঠে এল কন্ঠনালি ওব্দি, কিন্তু বমি হল না । হাতের চেটোয়, কপালে, ঘাম । অথচ ওই লোকগুলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ওর, অরিন্দমের । ঘটনাটার এ এক জবরদস্তি ।

বছর পঁয়তাল্লিশের সদ্যখুন দড়ি-পাকানো লোকটা , ওইখানে, জয়বিবি রোডে, রক্তেভেজা, ধুলোর ওপরে যে এখুন  হাত-পা ছড়িয়ে স্হির পড়ে আছে, হাঁ-মুখ আর দুচোখ খোলা, অরিন্দমের সামনে দিয়েই একটু আগে টেলিফোন বুথটায় ঢুকতে যাচ্ছিল, দেয়ালে সাইকেল দাঁড় করিয়ে, ঠিক তখুনই, ওফ, লোকটার গলা আর ঘাড়ের মাঝে পেছন দিক থেকে সজোরে কোপ মেরেছিল সবুজ টিশার্ট পরা ষণ্ডা ছেলেটা । চপারের ওপরে ওঠা, বাতাস ভেদ করে নাবা, গদ আওয়াজ, নরম তাঁবাটে চামড়া কেটে মাংসে ঢুকে যাওয়া আর উথলে বেরিয়ে আসা রক্তের ভলক, থমথমে দৃশ্যের ভয়াবহতা, ঘিরে ধরে ওকে । অননুভেদ্য জোঁকেরা ছড়িয়ে পড়ে মর্মস্নায়ুর রক্তজালিকায় ।

সবুজ টিশার্টের বুকে সাদা হরফে লেখা স্লোগানটাও, আততায়ী যখুন চপার হাতে এদিকে ফিরেছিল, দেখে ফেলেছিল অরিন্দম : ‘ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে’।

ওর কবজিতে টান পড়তে, চমকে উঠল অরিন্দম । হুঁশ ফিরে এলো যখুন আদিত্য বারিক ওর হাতে টান মেরে দৌড়ুতে-দৌড়ুতে দাঁতে দাঁত যত আস্তে সম্ভব চেঁচিয়ে জানায়, এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয় অরিন্দমদা, চলুন চলুন, ওই ভদ্দরলোক বালি পুরসভার কমিশনার শামিম মহম্মদ খান । তখুনই আদিত্যের নির্দেশের গুরুত্ব টের পায় অরিন্দম । পর পর চারটে বোমা ফাটার শব্দ হল আর পেছন ফিরে দেখতে পেল অরিন্দম, গন্ধকের নীলাভ-ধূসর ধোঁয়ায় জয়বিবি রোড ধোঁয়াক্কার, আকাশ থেকে বারুদের গন্ধ মেখে নেবে এসেছে ভীতির মশারি । পাঁচ মিনিট আগের গ্যাঞ্জাম রাস্তাটা, অকালপ্রয়াত নদীর মতন উষর । বালি থানার অধীন দুপুরের রোদ্দুর ততক্ষুনে, ওইটুকু সময়ের মধ্যে, সরে গেছে উত্তরপাড়া থানার এলাকায় ।

ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায় হনহনিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা, আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় মিশে যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর ফাঁকে ডান দিকে, এস কে চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, দেখতে পেল গোটা  তিরিশেক লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলেছে ঝাড়পিটের তুমুল । ভিড় চিরে বছর আঠারোর রক্তাক্ত সুঠাম তরুণ ছিটকে বেরোয়, ওদেরচ দুজনের পাশ কাটিয়ে কয়েকপা এগোয় গণপ্রহারে থ্যাঁতলানো দেহ বজায় রেখে, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাস্তার ওপর ।

থ্যাঁতলানো তরুণকে অনুসরণকারী নাগরিকরা, তরোয়াল, ভোজালি, লাঠি, রড, শেকল, বর্শা হাতে ওদের দিকে ছুটে আসতে দেখে, ওরা দুজনে শাটার-বন্ধ  দোকানের সিঁড়িতে উঠে পড়ে । সশস্ত্র নাগরিকরা ওদের সামনে দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মাটিতে কাতরাতে থাকা ছোকরার কাছে । ঝুঁকে দাঁড়ানো মানুষের কালো-কালো মাথার ওদিকে, লাঠি আর তরোয়াল উঠছে-নাবছে দেখতে পায় অরিন্দম । হিন্দি গালাগাল । অরিন্দমের হাতের তালু ঠাণ্ডা আর কপালে বিনবিনিয়ে ঘান ফিরে আসছে । অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতন অনুভূতি হয়, কিন্তু গা গুলিয়ে ঢলে পড়া থেকে ওকে সামলায় আদিত্য । ছেলেটা মরে গেছে নিশ্চই । তবু ওকে পিটিয়ে যাচ্ছে । মৃতদেহকে পিটিয়ে তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা খুঁজছে লোকগুনো । অরিন্দম পড়ে গেছে সেই ভাষার সন্ত্রাসের খপ্পরে ।

তরুণের ন্যালবেলে দেহটা ধরে টানতে-টানতে ওদের সামনে দিয়ে নিয়ে যায় লোকগুনো । পেট ধেকে নাড়িভুঁড়ি ঝুলে বেরিয়ে আছে । এখুনও বোধয় প্রাণ আছে খিঁচোতে থাকা নাড়িভুঁড়িতে । আদিত্য যখুন বলল, এর নাম শেখ হিরা, শামিম খানের বিরোধী দলটার গুণ্ডা, তখুনও অরিন্দম শরীরের অসুস্হতা কাটিয়ে ওঠেনি । ঠোঁটের ওপর থেকে নিজের ম্লান হাসিটুকু জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে জানায়, ইউটোপিয়ার স্বপ্ন বিক্কিরির জন্যে দুর্বৃত্তের দরকার হয়।

বড়ো রাস্তার বাসস্টপে পৌঁছে, বাসে চেপে, বসার জায়গা মিনিট পনেরো পরে পেয়ে, বি-বা-দী বাগে নাবার পরও, অরিন্দমের গলায় শ্লেষ্মার দুঃস্বপ্ন আটকে ছিল । অফিস পাড়ার রাষ্ট্রীয় অভয়দানকারী বহুতলগুলোর ছায়ানম্র চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে, বেশ কিছুক্ষুণ দাঁড়িয়ে, স্বাভাবিকতার আভাস অনুভূত হলে আদিত্যকে বলল অরিন্দম, তুমি পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টার হয়ে পালালে ? তোমার কাজ তো আইন বজায় রাখা, প্রতিরোধ করা, নাগরিকদের আগলানো । ছ্যাঃ, অন্তত কাছাকাছি থানাটাকে খবর দেওয়া উচিত ছিল ।

অরিন্দমদা আপনি তো পুলিশে চাকরি করেন না, তাই উপদেশ ঝাড়াটা সোজা । বিজ্ঞের ধাতস্হ মন্তব্য আদিত্যর । চাকরির এই ক’বছরেই সরকারি অভিজ্ঞতা ওকে মনুষ্যজনোচিত যুক্তিবাদীতে পালটে ফেলেছে । এরকুম হলেও বোধয় একজন লোক মানুষ থেকে ঞানব হয়ে যায় । মানব সন্তান । কলকাতা শহরটা দেশভাগের পর মানব উৎপাদনের কারখানা হয়ে গেছে ।

অভিজ্ঞতা এক ভয়ঙ্কর চিজ, গলার স্বর বদল করে বলল আদিত্য, যত নষ্টের গোড়া ।

ছ-ফিট, দোহারা ময়লা, থ্যাবড়া, আদিত্য বারিকের সঙ্গে অরিন্দমের পরিচয় পাটনা থেকে কলকাতায় অরিন্দমের বদলি হয়ে আসার পর । সাম্প্রতিক জলবসন্তে ওর, আদিত্যর, চেহারা এখুনও খানাখন্দময় । মাদার ডেয়ারির দুধের সরের মতন একপোঁচ হাসি লেগে থাকে পুরুষ্টু ঠোঁটে । গুঁড়ো দুধের জলগোলা হাসি, কথা বলার সময় । ময়লা হলেও জানে আদিত্য, ওর দিদি আর ছোটোবোন ওর গায়ের রঙকে ঈর্ষা করে । অরিন্দমের অফিসে আগে কাজ করত আদিত্য, ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে, আরও শ’চারেক কর্মীর মতন কয়েক নোট এগজামিনার । শুনতেই যা রমরমে । আসলে মজুর আর কেরানি মেশানো দোআঁশলা চাকরি । কলারের বাঁদিকটা নীল, ডান দিকটা সাদা । সে চাকরিতে বেশি মাইনে কম কাজ সত্ত্বেও, আত্মসন্মানবোধের পরিসর, ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ, আর জীবনকে উদ্দেশ্যহীন করা কাঁচা টাকার তাড়ার গাঁট উপরি হিসাবে পাবার সুযোগ-সুলুক না থাকায়, সুযোগ পেতেই আদিত্য পালিয়েছে মনের মতন চাকরির আশ্রয়ে, পুলিশে । ওর আদর্শ রুণু গুহনিয়োগী নামে এক প্রাক্তন অফিসার, যদিও তাঁর সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় নেই, কিংবদন্তি শুনেছে, কাগজে পড়েছে, আদালতে গিয়ে দেখেছে সহকর্মীদের সঙ্গে, জয়ধ্বনি করেছে, যখুন অযথা বিচার চলছিল নায়কোচিত লোকটার । কর্মজীবি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার সক্ষম পায়ের দিকে ।

কয়েন-নোট এগজামিনারের চাকরিতে ওর কাজ ছিল খুচরো ্জন করানো, চটের নানান মাপের বস্তার প্যাকেট তৈরি, থলের মুখ বেঁধে গরম গালার সিলমোহর । চটের রোঁয়া অস্বাস্হ্যকর, নোংরা আর দাম বেশি বলে মোটা পলিথিন চাদরের স্বচ্ছ থলে পরে-পরে চটের জায়গা নিয়েছিল । কেউ যদি পাঁচ-দশ হাজার টাকার এক টাকা বা পঞ্চাশ পয়সা চায়, দিন কাবার হয়ে যাবে গুনে দিতে-দিতে । তাই ওজন করে আগে থাকতে গাঁটরি বেঁধে রাখার ব্যবস্হা । দু-পয়সা পাঁচ-পয়সা উঠে গিয়ে নিশ্চিন্দি । হালকা পয়সাগুনোর জন্যে বড়ো-বড়ো থলেতে একশো টাকা করে খুচরো ভরে রাখতে হতো । অনেজক খদ্দের বাড়ি নিয়ে গিয়ে একটা-একটা করে গুনে ফিরে এসে চেঁচাত, চারটে কম, সাতটা কম, তিনটে কম, আর তাই নিয়ে ফয়সালাহীন নিত্যিদিনের খিস্তি খেউড় । যে রেটে টাকার দাম পড়ছে, দশ কুড়ি পঁচিশ পয়সা আর এক দুই পাঁচ টাকার কয়েন তুলে দিতে হবে বছরকতক পর । হলদে কুড়ি পয়সা তো পাবলিক গলিয়ে অন্য কাজে লাগিয়ে ফেললে । কুড়ি পয়সার কয়েনটাই এক টাকায় বিকোতো । সময় ব্যাপারটা যথেষ্ট হিসেবি ।

কাগজ আর ছাপার খরচ বেড়ে যাওয়ায়, এক দুই পাঁচ টাকার নোট বন্ধ করে ছাড়া হয়েছে কয়েন । কয়েন নেবার পাবলিকের ভিড় তাই এদান্তি বেড়ে গেছে কাউন্টারে । পাবলিকের চাকর হওয়া আর সরকারের চাকর হওয়া যে দুটো এক্কেবারে আলাদা ব্যাপার, তা জেনেছিল আগের খুচরো-গোনার চাকরিতে । তার ওপর প্রথম দিকে চটের রোঁয়ায় কফের, আর পরে পলিথিনের জন্যে চামড়ায়, রোগের অ্যালার্জি হয়ে গিয়েছিল দোহারা আদিত্যর । দিনের পর দিন পাঁচমিশালি-অ্যালুমিনিয়াম মুদ্রার পর্ণমোচী জঙ্গলে ধাতব গন্ধের মাঝে হাঁপিয়ে উঠেছিল ওই চাকরিতে । মাখা ভাতে ওব্দি দোআঁশ ধাতুর অম্লকষায় স্বাদ চারিয়ে যেত হাতের তালু থেকে । যখুন ওই চাকরিতে ঢুকেছিল, তখুন সত্যিসত্যি বিশাল ওজনপাল্লায় কিলি-দশকিলোর বাটখারা চাপিয়ে মাপা হতো কয়েনের থলে । পরে এসেছিল ওজনের ইলেকট্রনিক মেশিন । আদিত্যর মনে হতো, অর্থনীতিতে স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম । অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করাবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর-প্রাপক স্নাতক । অসাধারণ স্হাপত্যের বহুতলগুনোয়, সারা দেশজুড়ে, স্নাতকরা এমনতর মাশুল গুনে যাচ্ছে পড়াশুনোয় ভালো বা অন্ত্যজ হবার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে । ইশকুল-কলেজের জ্ঞান বোধয় কারুরই বিশেষ কাজে লাগে না ।

কয়েন বিভাগে কাজ করার আগে নোট বিভাগেও কিছুকাল ছিল আদিত্য । সে আরও ভয়ঙ্কর । মাথা-খারাপ হবার যোগাড় । কাজ ছিল টাটকা নোট আর পচা নোট আলাদা করার, একশোটা ভালো আর একশোটা পচা নোটের প্যাকেট তৈরি, দশ প্যাকেটের বাণ্ডিল, ভালোর আলাদা পচার আলাদা, পচা নোটে গোল-গোল চাকতির মতন মেশিনে ফেলে কয়েকটা ছ্যাঁদা করানো, ভালো নোটগুনোকে জনগণের ব্যবহারের জন্যে আবার পাঠানো, আর ছ্যাঁদা করা নোট চটের বস্তায় সিলবন্দি করে চুল্লিতে পোড়াবার জন্যে তুলে রাখা । পরে অবশ্য নোট কুচোবার আর তা থেকে মণ্ড বানাবার যন্ত্র এসেছিল বিদেশ থেকে । এক-দুই-পাঁচ টাকার নোট উঠে গিয়ে রেহাই হয়েছে । ওফ, ওই ছোটো নোংরা হিলহিলে স্যাঁতসেতে ছাতাপড়া নোট গোনা, শেষই হতে চাইত না ।

একটা পচা নোট কাছে থাকলে সেটা লোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি পেতে চায় । যাহোক-তাহোক খরচ করে ফেলতে চায় । দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক নষ্ট করে । দেশের যে অঞ্চল যত গরিব, সে অঞ্চলে চলে তত পচা নোট, নানা কায়দায় জোড়া নোট । কেমন নোট চলছে দেখে একটা অঞ্চলের আর্থিক অবস্হা টের পাওয়া যায় । অর্থনীতির সিলেবাসে পড়ানো হয়নি এসব । অভিজ্ঞতার লাথি খেয়ে শিখেছে ।

সেরকম অজস্র নোটের মাঝে বসে যৌবন খরচের চাকরি । আকাশে তখুন হয়তো বসন্ত ঋতুর স্নেহভাজন বকদম্পতিরা বেরিয়ে পড়েছে বাৎসরিক আমোদের জোড়ে-জোড়ে ; লালদিঘিতে পরকীয়া জলে ভাসছে বংশ-গৌরবহীন মাছ-যুবক, বা মহাকরণের চূড়োয় রাগতস্বরে আরম্ভ হয়ে গেছে বৃষ্টি, ছাড়া পেয়েছে ক্রিকেটশেষ ইডেনের সবজান্তা গড্ডলিকা, কিংবা গাড়ি পার্ক করার এলাকায় চলছে ঝড়ে গাছেদের হাওয়ার সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি, কিংবা কাঠকয়লার আঁচের পাশে ঞাঝে-মাঝে টুসকি বাজিয়ে ফেলছে তাম্রশ্মশ্রু ভুট্টা । প্রকৃতি সুযোগ পেলেই শহরকে গপঅমে পালটে ফেলতে চায় । চারশো যুবক-যুবতির দেখা হয় না কিছুই ।

ওই বিভাগে বয়স্ক কাউকে দেখেনিকো আদিত্য । সবাই তরতাজা যুবক-যুবতি । পচা, হিলহিলে, স্যাঁতসেতে, ছাতাপড়া, তেলচিটে, নোংরা নোট গুনে চলেছে আনকোরা ধোপদোরস্ত যুবক-যুবতি, সুদর্শন ও সুশ্রি যুবক-যুবতি, মাথা নিচু করে, প্রাব চুপচাপ, দিনের পর দিন, দুপুরের পর দুপুর । আর কোনো কাজ নেই তাদের । ঘাড় গুঁজে নোটের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাওয়া, ধান রোয়ার মতন । একটা বিরাট অট্টালিকার মধ্যে তারা হাসি মুখে টিফিনের ডিবে হাতে প্রায় নাচতে-নাচতে ঢুকছে, নোট গুনছে বাণ্ডিলের পর বাণ্ডিল, বেরিয়ে আসছে গোমড়া কীটদষ্ট চেহারায়, বাড়ি যাচ্ছে কালকে আবার একই ঘানিতে পাক খাবে বলে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-ভালো সব স্নাতক । ইশকুলে অনেকে প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছিল রাত জেগে, বাড়ি থেকে জ্যোতি ছড়িয়ে হয়তো আহ্লাদিত করেছিল সারাটা পাড়া ।

এখুন তারা কেবল গণছোঁয়ায় বিরক্ত নোট মুখ বুজে গুনে যায় । মাঝে-সাঝে নিশি পাওয়া অবস্হায় তারা বেরিয়ে পড়ে দলবেঁধে পথসভা গেটসভা ঘেরাও ধর্না হরতাল ধিরেচলো বয়কট কর্মবিরতি অবস্হান অবরোধের ডাকে । প্রশ্ন তোলার জাগরুকতা আর নেই । পরের দিন থেকে ফিরে গেছে তারা স্বয়ংক্রিয় কাজে । পুরো ব্যাপারটা আদিত্যর মনে হয়েছিল ভুতুড়ে । ভালো মাইনে দিয়ে ভুত বানাবার কারখানা ।

পচা ছ্যাতলা-পড়া নোটের বদগন্ধের কী রমরমা । যত কম টাকার নোট, তত তার বদগন্ধ । পৃথিবীতে এরকুম গন্ধ যে জন্মাতে পারে, মানুষের হাতে-হাতে ঘুরে-ঘুরে যোগাড়-করা দুর্গন্ধ, অমন চাকরি না করলে অজানা থেকে যেত । একটা পচা নোট আলাদা করে শুঁকলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায় না । অথচ কয়েক হাজার পচা নোট একজোট হলেই প্রকাশিত হয়, দেশটার পীড়ার অভিব্যক্তি, হেমন্তের শুকনো পাতার সঙ্গে মেশানো গুয়ের গন্ধ । দেশটার সংস্কৃতি কতটা পচেছে তা বোধয় ওই গন্ধ থেকে টের পাওয়া যায় । মুমূর্ষ গন্ধটা থেকে ছাড়ান পাবার জন্যে আদিত্য তখুন বুশশার্টের বগলে বিদেশি পারফিউম লাগাত ।

আড়াই লক্ষ স্নাতকের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আদিত্যকে নিয়ে আরও উনিশজন ওই চাকরিটার পরীক্ষায় সফল হয়েছিল । অথচ সেই চাকরিতে তিতিবিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে ও । শালা বেনের আড়তে চাল ডাল গম আটা ওজন করার মতন ভারি-ভারি বাটখারা চাপিয়ে চকচকে মুদ্রা ওজন করানোর চাকরি । প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিদিন রোজরোজ রোজরোজ রোজরোজ, ছ্যাঃ । এখুন না হয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রে ওজন হয় । কিন্তু তখুন তো ঝুল-চাকরিতে জান একেবারে শ্মশানকয়লা হয়ে গিয়েছিল ।

অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টারের চাকরি পেয়ে নিজেকে সুগন্ধিত করে তোলার অভ্যাসে কিছুটা রদবদল করেছে ও, আদিত্য ।  এখুন ও জনসনের বেবি পাউডার, বাচ্চাদের সাবান-শ্যাম্পু, শিশুদের ক্রিম আর অলিভ অয়েল ব্যবহার করে । আগেকার এক আই জি, এখুন অবসরপ্রাপ্ত, দুটো কারখানার মালিক, শিখিয়েছিলেন জীবনদর্শনটা । নিষ্পাপ থাকার নিজস্ব গন্ধ আছে, বুঝলে হে, পুলিশ অফিসারের উচিত সেই গন্ধটাকে সবচে আগে দখল করা । ফি-বছর পুজোয় অধস্তন অফিসারদের জন্যে শিশুদের ব্যবহার্য সাবান পাউডার ক্রিম শ্যাম্পুর সারা বছরের কোটা উপহার পাবার ব্যবস্হা করে দিতেন উনি । ওঁর বাবা তো এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে, কিন্তু কত উন্নতি করেছেন । রিজেন্ট পার্কে জবরদখল-করা জমিতে প্রোমোটারকে দিয়ে কী পেল্লাই এক-একখানা ফ্ল্যাট পেয়েছেন ওনারা তিন ভাই । প্রায় সব উদ্বাস্তু নেতারাই আজ কোটিপতি । উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, এই এলেম বেচেই লালে লাল হয়ে গেল কত লোক । তারা কেবল টাটকা করকরে নোট গুনছে । আসল উদ্বাস্তুগুনো ফুটপাতে হকারি করছে আজও ।

আদিত্যর এখনকার উপরি-দামি চাকরিটা মাঙনায় হয়নি । দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল । বাড়ি বয়ে একজন প্যাংলা ডাকমাস্টার জানিয়ে গিসলো কার সঙ্গে কখুন কোথায় দেখা করলে চাকরিটা হবে । ডাকমাস্টারহীন বাঙালিসমাজ ভাবা যায় না । এরা থানার জন্যে টাকা তোলার অঞ্চলভিত্তিক ঠিকেদারি নেয় । পুলিশে ঢোকার আগে জানতই না আদিত্য যে তথ্য আর সংস্কৃতির এরা বাঙালি জীবনের চাবিকাঠি ।

সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টের রাত্তির বারোটার পর থেকে খর্চাখরচ না করলে, এমন কী ক্ষমতাধারী স্বজনজ্ঞাতি থাকলেও, সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন । তারপর ফি-বছর বেড়েছে খর্চাখরচের হার । আর আদিত্য তো জন্মেছে তার পঁচিশ বছর পর, রজতজয়ন্তীর রাত্তিরে, বর্ধমান জেলার মামার বাড়িতে । কর্মসংস্হান কেন্দ্র থেকে নাম সুপারিশ করাতে লেগেছিল হাজার পাঁচেক, পার্টির তদবির সত্ত্বেও, নইলে বেশি লাগত আরও । ডেসপ্যাচের কেরানিকে কিছু না দিলে চিঠি ছাড়ে না, কিংবা পাঠিয়ে দেয় ভুল ঠিকানায় । কর্মসংস্হান কেন্দ্রের চিঠি দেখে পোস্ট অফিসে দেরি করে সরটিং করবে । আদিত্য প্রতিটি ধাপকে মসৃণ রেখেছিল, করকরে তাজা নতুন নোট দিয়ে, যার আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে প্রাপকের মুখ । অপার বৈভব গড়ে তুলতে চায় ও, আদিত্য । নইলে ওর মতনই, ওর ছেলেপুলে নাতিদের, বনেদি ঘরের ছেলে বলে স্বীকৃতি দেবে না কেউ ।

আদিত্যর ঠাকুদ্দার জন্ম উনিশশো পাঁচ সালের ষোলুই অক্টোবর । সেদিন কিছু একটা হয়েছিল বলে পরিবারের স্মৃতিতে ঢুকে আছে তারিখটা । সবরমতী আশ্রমের দরোজা-জানলা বানাবার জন্যে ঠাকুদ্দা গিসলো নিজের বাবার সঙ্গে । অনেক যত্নে বানিয়েছিল দরোজাগুনো । গান্ধি মহারাজ নিজে বলে দিয়েছিলেন যে দরোজাগুনো এমন হবে যে কেউ খুললেই ক্যাঁচোওওওর আওয়াজ হবে, যাতে কেউ ঢুকলেই টের পাওয়া যায় । গল্পটা আদিত্যদের পারিবারিক সম্পত্তি । গান্ধি ইয়েরভাদা জেলে গেলে, নিজের গ্রাম ধর্মশিবপুরে ফিরে এসেছিল ঠাকুদ্দা। উনিশশো উনত্রিশের জানিয়ারিতে বাবার জন্ম ।

আওয়াজঅলা দরোজা বানাবার দরুন বাবু জগজীবন রাম ঠাকুদ্দার জন্যে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মাসোহারার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন । লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিল, এরকমটাই লেখা ছিল প্রমাণপত্রে । আদিত্যরা তো ছুতোর, তত নিচু জাত তো আর নয়, তাই জগজীবন রামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে হয়েছিল । আজকাল অমন প্রণামে কোনও কাজ হয়না । প্রণামী চায় সবাই, আদিত্যও চায় ।

লেখাপড়া শেখেনি ঠাকুদ্দা । কংরেস সভাপতি ভূপেন বোস পাঠিয়েছিলেন সবরমতীতে ছুতোরের কাজে । ঠাকুদ্দা কিন্তু দূরদর্শী ছিল বলতে হবে । স্বাধীনতা সংগ্রামীর মাসোহারার টাকায় নিজের আর একমাত্র নাতি আদিত্যর নামে যৌথ রেকারিং ডিপোজিট খুলেছিল । পুলিশে চাকরির শুভ কাজে লেগে গেল চক্রবৃদ্ধি । নয়তো অত থোক টাকা একলপ্তে কয়েক বিঘে জমি বেচলেও উঠত না । গান্ধির সঙ্গের লোকজনদের পায়ের কাছাকাছি থেকে, ঠাকুদ্দা বোধয় টের পেয়ে গিসলো অনেক আগেই, যে দেশটা ভাগ হবে, আর তার দরুন বাঙালিরা এক ধাঁচের বামপন্হী হবে । তাই জন্যেই হয়তো বাবাকে ইনডিয়ান প্রলেটারিয়ান রিভলিউশানারি পার্টির বিজয় মোদকের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটার কাজে লাগিয়েছিল দশ বছর বয়সে ।  অত বড়ো-বড়ো মানুষের চোপরদিনের গুজগুজ-ফিসফিসের কাছাকাছি থাকার চাপে ওদের পরিবারটা ভদ্দরলোক হতে পেরেছে আর ছুতোর শ্রমিক বদনামটা ঘুচেছে ।

নোট গোনা আর কয়েন ওজন করার চাকরিতে, মনে হত আদিত্যর, রোজ কিছু-কিছু সরিয়ে গড়ে ফেলা যাক ধনী হবার তহবিল । কিন্তু ধরা পড়ার কেলেঙ্কারির গ্রাম্য ভয়ে, আর যারা অমন কাজ করে ধরা পড়েছে তাদের এনস্হা দেখে, বাতিল করেছে সে ভাবনা । তাছাড়া তাতে লেগে যেত অনেককাল । রোজ দুটো-চারটে একশো-পাঁচশো টাকার নোট সরালেও বহু বছর লেগে যেত ভৈভবশালী হতে । শুধু টাকা হলেই তো হয় না, সেটাকে খাটিয়ে-খাটিয়ে ফাঁপাতে হয় । এ এস আই এর চাকরিটা ধর্মঠাকুরের পাঠানো । টাকাও আপনা থেকে আসতে শুরু করেছে তাঁর কৃপায় । ধর্মরাজের কৃপায় একদিন-না একদিন রুণু গুহনিয়োগীর মতন প্রভাব-প্রতিপত্তি লোকবল ঐশ্বর্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর গণমাধ্যমের আদরযত্ন পাবে । বাসের সিটে বসে হাতজোড় করে আদিত্য । কপালে ঠেকায় ।

সত্যি, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ ছাড়া আর গতি নেই, যেভাবে চালাচ্ছিল গাড়িটা, বলতে-বলতে বাস থেকে নাবলেন ফর্সা মোটা গলদঘর্ম গৃহবধু কেরানি । সওদাগরি অফিসে এত বেলায় হাজিরে দিলে চাকরি চলে যাবে । নির্ঘাৎ কোনও জনসেবা বিভাগের ।

ওঃ, মরে গেলুম হুজুর, আহ, আরেব্বাপ, অঁক, ছেড়ে দিন স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না স্যার, উঃ বাপরে, আঃ, বাবাগো, আআআআঃ ।

আদিত্যর জন্যে বহুক্ষুণ অপেক্ষারত অরিন্দম অসুস্হ বোধ করছিল ক্রমশ, লকাপ থেকে ছিটকে-আসা আর্তচিৎকারে । বমি-বমি আসছিল । অরিন্দমের কাহিল প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল টেবিলের ওদিকে মিটিমিটি তাগড়া ভুঁড়িদাস পুলিশ অফিসারটা, বোধয় ইন্সপেক্টার । অনেকবার এসেছে বলে মুখ-চেনা, বলল, আপনি বরং নিচে গিয়ে গেটের কাচে টাটকা হাওয়া নিন । আসলেই পাঠিয়ে দোবো ।

অরিন্দম উঠে পড়ল ব্রিফকেস নিয়ে । দশ কুড়ি পঞ্চাশ একশো টাকার প্যাকেট এনে দিতে বলেছিল অরিন্দমকে ওর অফিস থেকে । আদিত্যর বোনের বিয়ের যৌতুক । থোক টাকা থাকলে উঁচু জাতের ভালো চাকরে পাত্র পাওয়া সহজ, পাত্রী যে জাতেরই হোক না কেন । এই একগাদা টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে চায় না অরিন্দম । মা, ছোটো ভাই বা তার বউ জেনে ফেললে কেলেঙ্কারি । পাটনায় থাকতে হঠাৎই একবার ও মাসকতকের জন্যে পাগল হয়ে গিসলো বলে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল । পা ব্যথা করছিল । এই শহরের চতুর্দিকব্যাপী নিনাদে হারিয়ে যায় আর্তনাদ আর কাতরানির ছোট্টো-ছোট্টো শব্দকণা । আক্রমণ আর আত্মরক্ষার উপস্হিতি সারাটা শহরের চরাচর জুড়ে । পুরুষকর্মীদের চাউনি রুমার দিয়ে মুখের ওপর থেকে পুঁছতে-পুঁছতে বাড়ি ফিরছে আলগা চটকের গৃহবধু কেরানি । সঙ্গিনীর সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু গণেশঠাকুরের শুঁড় ডানদিকে শুভ না বাঁদিকে । ক্ষীণস্বাস্হ্য সরকারি বাস চলে গেল, নাগরিক বোঝাই, ফোঁটার মতন মানুষ ফেলতে-ফেলতে, জিরোবে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের জ্যামে । বাসে উঠলেই লোকে বসতে চায় এ শহরে, যুবকরাও, যাতে কাঁধে কাঁধ না মেলাতে হয় । দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অভ্যাসমতন পথচারিণীদের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল অপ্রস্তুত অরিন্দম । খিনখিনে ট্যাক্সির কাতার । ডিজেলের নাকজ্বালানো ধোঁয়া । ধোঁয়া-ধুলোয় মুখ ভার করে আছে আকাশ ।

অফিসে আবার এলেন কেন অরিন্দমদা ? পেছন ফিরে আদিত্যর থমথমে চেহারা দেখতে পেল অরিন্দম । মানুষকে নিজে হাতে পেটানোর আহ্লাদ থেকে, মুখের আনন্দময় প্রতিভা থেকেই  বেশ বোঝা যাচ্ছে, আর কোনও দিন মুক্তি পাবে না আদিত্য । প্রতিনিয়ত ওর দরকার পড়বে প্রহারযোগ্য দেহ, সারাজীবন । রিটায়ার করলে কী করবে ও ?

তোমায় তো বাড়িতে পাওয়া যায় না ।

তা নয় । এসব টাকাফাকা অফিসে রাখতে চাই না । দেখলেই তো হিংসে ।

কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও । ছুটি তো ? এখুন ?

কী যে বলেন না, এখুনও কবুলতি লেখানো হয়নি । চলুন ওফুটে চায়ের দোকানটায় একটা ছেলে আছে আমাদের গ্রামের । ওর হাতে পাঢিয়ে দেব । আদিত্য বিব্রত বোধ করে অরিন্দমের সারল্যে । নোটগুনো কোথা থেকে এলো, বড়ো মাপের নোট কেন, কিছুইকি সন্দেহ করে না অরিন্দমদা ? টিকে আছে কী ভাবে অমন অনর্থক বোকামি নিয়ে !

বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের ধর্মশিবপুর গাঁয়ে, অজয় নদের তীরে, আদিত্য বারিকের বাস্তুভিটে । ঝিলুট থেকে কাঁচা রাস্তা আছে গ্রামে যাবার, তৃণমূল-কংরেস-সিপিয়েম মকদ্দমাবাজিতে আধখ্যাঁচড়া । সপ্তম পাঁচসালায় রাস্তাটা হবার আগে গাঁয়ে ফুলপ্যান্ট পরে ঢোকা যেত না বর্ষাকালে । কাঁধে বেলবটম, বাঁহাতে জুতোজোড়া, আন্ডারওয়্যার পরে ঢুকতো কলকাতা-বর্ধমানের কুটুমরা । ওদের গ্রামটা বাদে আশপাশের গ্রামগুনো মুসুলমান চাষিদের । জোতদার বর্গাদার কামলা সবাই মুসুলমান । ধর্মশিবপুরে আজ যাদের বাস, সেসব শীল, কাঁসারি, বারিক, কর্মকার, সাহা, শূর, পাল, কুণ্ডু, দাঁ, সাঁপুই, বায়েন, গায়েন, সরদার, পোড়েল পরিবার এসেছিল গঙ্গারাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমের মন্ত্রী বিষ্ণু সিংহের রাঢ়দেশ অভিজানে সঙ্গী হয়ে । সেসব গৌড়ীয়দের প্লেস অব ডোমিসাইল এখন রাঢ় ।

র‌্যাদক্লিফ সায়েবের ভয়ে নেয়ামত মণ্ডল পালিয়েছিল পাকিস্তানে । পরে হাওয়া বুঝতে এলে নরহরি মণ্ডল নেয়ামতের একশো ছেচল্লিশ বিঘে জমি কিনে নিয়েছিল পচা আলুর দরে, মগফেজের দলিলে তারিখের গোলমাল করে । পাকা দলিল হয়নি, তাই রেজেস্ট্রি হয়নি । এর মধ্যে একশো বিঘে ছিল খোদখামার আর ওয়াকফ চিরাগি জমি, যা নরহরির ছেলে সত্যসাধনকে দিয়ে খাস লিখিয়েছিল ভূমিসংস্কার দপ্তর, আর যা রাঢ়ের লোক পায়নি । চাষবাস না করেও তার অনেকটা পেয়ে গেসলো সন্তোষ দাসের মামাতো ভাই । সন্তোষ দাস এ-তল্লাটে পার্টি করার জন্যে এসেছিল সত্তর সনে । বে-থা করে থেকে গেল । নিজেদের এখুন দাশ লেখে, বলে কায়েত ।

প্রথমে মুসুলমান গাঁয়ে-গাঁয়ে বকবক বকবক করে গান্ধির কোল থেকে মার্কসের কোলে চাষিগুনোকে তুলে নিয়ে গিসলো সন্তোষ জেঠু । মুসুলমানগুনো তো চালাক কম নয়, আগাম টের পায় । ওরা সদাসর্বদা শাসকের সঙ্গে আছে । কী লাটসায়েব, কী ফজলুল হক, কী নাজিমুদ্দিন, কী সুরাবর্দি, কী বিধান রায়, কী জ্যোতি বসু । হলে হবে কী ! কোথ্থেকে একদল কিশতিটুপি-পরা লিগি এসে ফিসফিস-গুজগুজ চালালে যে মুসুলমানগুনো আর সাউ সরদার নাইয়া ঘরামি পদবি রাখতে চায় না । মেটে মসজিদগুনোকে ওব্দি সবুজ তেলরঙে ছুপিয়ে ফেলেচে ।

প্রতিভা ছিল বটে সন্তোষ জেঠুর, বুঝলেন অরিন্দমদা, নইলে সহদেব মন্ডলের ছেলেটা নকশাল হয়ে ওর মুন্ডু কেটে লটকে দিত না, নিজের গ্রামর অরিন্দমকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল আদিত্য । শৈশবে দেখা সেই দৃশ্য আজও, সময় বুঝে, আদিত্যকে কাবু করে । বুঝলেন অরিন্দমদা, আমার মামার বাড়ি ছুতোর-গাঁ গ্রামের পরামাণিক শ্মশানসাধুরা মানুষের মুণ্ডু ঝুলিয়ে চোত সংক্রান্তির ভোরে যে নাচ দেখাত, তার চে ভয়ের দৃশ্য ছিল বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো সন্তোষ জেঠুর কাটামুণ্ডু । সারারাত শিশিরে-ভেজা জলজ্যান্ত মুণ্ডুটা চোখ রাঙাচ্ছিল, যে দেখতে গেছে তাকেই ।

সেই কবে, ছোটোবেলাকার কথা, পরের বছর শ্মশানসাধুদের হাতে ঝোলানো মুণ্ডুগুনোর মধ্যে দুটো ছিল সহদেব মণ্ডলের দুই ছেলের । ছোটোটা পূর্বস্হলী, ওই যে, গেছেন তো আপনি, ওখানে গুলি খেয়ে মরেছিল । বড়োটার ধড় পাওয়া গিসলো হুগলির শেষপুকুর গ্রামে । বুঝলেন অরিন্দমদা, সাধুরা অনেক দিন ধরে মাথাগুনো মাটিতে পুঁতে রেখেছিল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে, গাজনাতলায় নাচবে বলে । এখুন তো কাটামুণ্ডু বেআইনি হয়ে গেছে বলে সাধুরা কুলি দিয়ে কাজ চালায় , দুধের বদলে ঘোল, আর কি । তার ওপর নাপতেরা আর কেউ সাধু হতে চায়না । তার চেয়ে গেরুয়া পরে হিন্দু পলিটিক্স করলে তবু কিছু পয়সাকড়ি হয় । চলুন না মামার বাড়ি, ব্রামভোন অতিথি পেয়ে মামামামিদের আনন্দই হবে ।

আমার তো গায়ে পৈতে-ফৈতে নেই ।

আরে ও তো পুরুতমশাইকে সকালে অর্ডার দিলে বিকেলে সাপ্লাই দিয়ে দেবে । পুরুতটা আবার বিজেপি, আগে সিপিয়েম করত । সিপিয়েমের পুরুত আসে কালনা থেকে । লোকটা স্টেট ব্যাংকে সিকিউরিটি গার্ড । চলুন না, জিপের ব্যবস্হা করি থালে ।

চলো যাওয়া যাক, ওয়েস্ট বেঙ্গলের অত ইনটিরিয়রে যাইনি কখুনও ।

খড়্গেশ্বরী নদীর ধারে ছুতোর-গাঁ গ্রামে আদিত্যর মামার বাড়ি । ঈশানেশ্বরের খেসসা গান, ফোকলা দাঁতে, আদিত্যর দিদিমার উদ্ভাসিত কন্ঠে, পুলকিত করেছিল অরিন্দমকে । দুই মামা মিলে বর্ধমানে ফার্নিচারের দোকান খুলে, বেতাহাশা কাঁচা পয়সা করেছে, জমিজিরেত, ট্রলিট্র্যাক্টর, চারাকাটার যন্তর, বিলিতি গাই, দুটো শ্যালো, আড়াই  বিঘের পুকুর । আদিত্য যখুন বাবার কাঁধে চেপে মামার বাড়ি যেত, মামারা এত সচ্ছল ছিল না । কোচবিহার থেকে কাঠের টানামালের ব্যাবসা করে দিন ফিরিয়ে নিয়েছে । দহরম আর মহরম উঁচু মহলে । এফিডেভিট করে রায় পদবি নিয়েছে । মেয়েদের জন্যে ফরসা উদারচেতা বর পেয়েছে, মোটা টাকা যৌতুক দিয়ে।

বুঝলেন অরিন্দমদা, ছোটোমামা দৌড়ঝাঁপ না করলে, এ এস আয়ের ইনটারভিউটা গুবলেট হয়ে যেত । দুরাত্তির ওর মামারবাড়িতে থেকে, অরিন্দমের মনে হয়েছিল, আদিত্যর মামারবাড়ির সবায়ের গা থেকে র‌্যাঁদামারা কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরোয় । সত্যি । বড়োমামার শালকাঠ, বড়োমামির সেগুনকাঠ, ছোটোমামার নিমকাঠ, ছোটোমামির শিশুকাঠ । মাতুলালয় যেন ছালছাড়ানো গাছের জঙ্গল ।

কোচবিহারে তুফানগঞ্জে, মানসাই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তো মামাদের, মানে আমার মায়ের, মামাতো ভাই । একবারটি ওখানেও নিয়ে যাব আপনাকে । লুকিয়ে-লুকিয়ে আসাম থেকে কাঠ আসে । অবশ্য কাকেই বা লুকোনো । বনকর্মীরা ব্যবস্হা করে, মাস মাইনে পায় ।

তোমাদের শিডুল হপ্তা আর ওদের শিডুল মাস ?

বিক্কিরি বাবদ তোলা দিতে হয় আলফা আর বোড়োদের, সোনার বাংলা থেকে চিনের আর পাকিস্তানের বোমাবন্দুক আনার জন্যে । একটু ইদিক-উদিক হলেই ডুয়ার্সে এলেমজি চলে । কুমারগ্রাম, বকশির হাটে ছানবিন হয় । হাঃ হাঃ, পুলিশকেও তো দিতে হবে । ছোটোমামা নিজেকে টিম্বার মাফিয়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসে, কিন্তু কাঠের ব্যাপারিরা সে স্বীকৃতি দিতেই চায় না ।

কলকাতায় না থাকলে কোনো কিছুতেই স্বীকৃতি মেলে না ।

ছুতোর-গাঁ’র মুসুলমানগুনো ধর্মশিবপুরের মুসুলমানগুনোর চে ফরসা । করিম মুনশি আর ফরিদ মোল্লার বাড়ির সবাই ফরসা আর ঢ্যাঙা । দাদু বলে ওরা সব খাঁটি আর আমাদের গাঁয়ের কেলটেগুনো পাতি । ফরসা না হলে আমেদ মামুদ করিম জালাল নামগুলো ঠিক মানায় না । বুঝলেন অরিন্দমদা, ছুতোর-গাঁ’র নাম পালটে রায়গ্রাম রাখার দৌড়ঝাঁপ চলছে । বড়োমামা বলছিল, ছুতোর-গাঁ’র কুসুমেটে তেঁতুলে, দুলে, বাগদি, হাড়িয়া সব এফিডেভিট করে রায় হয়ে গেছে । মামাদের চে উঁচু পরিবার বলতে উগ্রক্ষত্রিয় মন্ডলরা আর ব্রামভোনরা ।

জমিদাররা যখুন ছিল, তখুন স্হাপত্য বলে একটা ব্যাপার ঢুকেছিল গ্রামগুনিয় । এখুন তো গ্রামে-গ্রামে তোমার মাম,আদের মতন পয়সাওলা লোক কম নয় । অথচ কোনো নতুন স্হাপত্য দেখা দিল না উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের পল্লিসমাজে । গরিব সাজাটাই এখুন গ্রামবাংলার স্হাপত্য ।

ভাগ্যিস অর্ডার দেওয়া পৈতেটা পরেছিল অরিন্দম । আদিত্যর দিদিমা-মাইমা-ছোটো বউদির কাছে ওটার জন্যে অনাস্বাদিত খাতির চলছে । অরিন্দমের চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো ওর দিদিমা আর মামিরা চান সেরে এসে হঠাৎ পায়ের কাছে মেঝেয় ঢিপ-ঢিপ । এই জন্যেই গ্রামে যেতে অস্বস্তি হয় । জাতিপ্রথা বেশ জেঁকে টিকে আছে ভেতরে-ভেতরে , নানা জাতের মানুষ এখুনও এক সারিতে খেতে বসতে চায় না, বামপন্হী রাজনীতির শেকড়ের ফ্যাঁকড়া ছড়ালেও  । অবশ্য ছোটো ভায়ের বিয়ের সময়েও পরতে হয়েছিল রেডিমেড পৈতে ।

তোমার বড়ো মামার ছেলে-বউকে দেখলুম না ?

বড়দা-বউদি ফিবছর পুজোয় চাইবাসায় শ্বশুরবাড়ি চলে যায় । ওখানে দশজন জামাই মিলে খুব হইহল্লা হয় । সত্যি, আরে স্ট্রাইক করেনি আগে । পনেরো বছর বিয়ে হয়েছে বড়দার, কিন্তু কোনও বার পুজোয় নিজের মা-বাপের কাছে থাকেনি ।

তুমি বিয়ে করে কী করো দেখা যাক ।

পুলিশে কাজ করে বিয়ে করার ঝামেলা আছে । আপনি করে ফেলুন না বিয়েটা । ব্রামভোন বাড়িতে কুচ্ছিত মেয়েরও রূপ থাকে । ছুতোর-গাঁয়ে ব্রামভোনরা সব ঈশানেশ্বরের পুজুরি, বুঝলেন তো । স্বাধীনতার পর সব মন্দিরের দখল নিয়ে নিয়েছে ব্রামভোনরা । দুলেদের ধর্মরাজের মন্দিরটা নিয়েছে । দেয়াসি তাঁতিরা বুড়ো-গাছতলায় কালাচাঁদ মন্দিরের সেবায়েত ছিল ; তাদের হটিয়ে সেটাও হাতিয়েছে । ব্রামভোনগুনোই দেশটাকে ডোবাল । জহোর্লাল তো ব্রামভোন ছিল, তাই না ?

একটা মন্দিরের মধ্যেই অতগুলো পুতুল ডাঁই করে রাখা দেখলুম । ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে নাকি ? শ্রীহীন দেবতাদে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অবশিষ্টাংশ !

আপনাদের আজগালকার ব্রামভোনদের ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে বড্ডো অচ্ছেদ্দা । ওগুনো ধর্মঠাকুরের মূর্তি । মামারবাড়ির এদিকটায় অনেক-অনেক মন্দির ছিল আগে । এখন আর কে দেখাশোনা করবে বলুন ? সেসব ঠাকুরের থান থেকে এনে রেখেছে ওই মন্দিরে । কত মূর্তি তো চুরি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেল  । অবশ্য বিদেশে গিয়ে যত্ন-আত্তি পায় মূর্তিগুনো, সেও তো একরকুম পুজোই, বলতে গেলে । সেবায়েতরা আজগাল দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমানে রিকশা চালায়, হকারি করে । বর্ধমানে দেখলেন তো, ঠেলায় চাউমেন বেচছে, আমায় যে দাকলে, ও ছেলেটা তাঁতি বাড়ির ।

আমাদের ধর্মশিবপুর গাঁয়ের অনেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রানিগঞ্জ, আসানসোল, নিরসা, গোবিন্দপুর, ধানবাদ গিয়ে দুপুরুষ কয়লাখনিতে কুলিগিরি করছে । এমন সাতবাষ্টে হাড়গিলে চেহারা করে ফেলেছে, যে দেখলে টের পাবেন না বাঙালি না বিহারি, হিন্দু না মুসুলমান । আমরা তো ঠাকুদ্দার জন্যে পার পেয়ে গেলুম, নইলে কী দশা যে হতো । তল্লাটের মুসুলমানগুনো তো সোশালিস্ট ছেড়ে মুসলিম লিগে ঢুকে পড়েছিল, বুঝলেন, তার মধ্যেই ঠাকুদ্দার দৌলতে আমাদের ফ্যামিলির নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ভেদিয়া বেরাণ্ডা ছাড়িয়ে নিগন কৈচর উজানি কোগ্রাম ওব্দি । ঠাকুদ্দা তো বাবাকে ওয়ার্ধা আশ্রমে নিয়ে গিসলো । জহোর্লালের কোলে-বসা বাবার ফোটো আছে । তখনও টাক পড়েনি জহোর্লালের । সেসব এখন বাক্সবন্দি । আর বোধয় বেরুবে না ।

তোমার পুলিশে চাকরি এবার অন্যরকুম ইজ্জত এনে দিয়েছে, কী বলো ?

ধুৎ, ইজ্জত-টিজ্জত নয় । ভয় পায় লোকে । বেশ ভাল্লাগে লোকেদের ভয় পাওয়াটা । শ্রদ্ধার ভালোলাগার থেকে ভয়ের ভালোলাগাটা সুপিরিয়র । হাঃ হাঃ ।

তুমি ছুতোর-গাঁ, ধর্মশিবপুর, মঙ্গলকোটের অ্যাতো গল্প জানলে কোথ্থেকে ? ঠাকুদ্দার কাছে ?

না-না । ইশকুলে আসলাম স্যারের কাছে । ভুগোল পড়াতে-পড়াতে লোকাল ইতিহাস পড়িয়ে দিত । নিজেকে বলত রাঢ়ীশ্রেণি পাঠান । পূর্বপুরুষ কে একজন মোহম্মদ শামিম খান নাকি আলিবর্দি খাঁর সেনাদের সঙ্গে আরবি ঘোড়ায় চেপে বর্গিদের তাড়াতে-তাড়াতে এসে পৌঁছেছিল কাটোয়ায় । গঙ্গারাম নামে একজন কবি ছিল আগেকার  কালে, তার লেখা মহারাষ্ট্রপুরাণে আছে নাকি গল্পটা । আসলাম স্যার তো কুচকুচে কালো । আর ঘোড়াটার টাট্টু বংশধররা এখন মন্তেশ্বর কিংবা দাঁইহাটে এক্কা টানে ।  হাঃ হাঃ, এক্কাও উঠে গিয়ে চাদ্দিকে ভ্যান রিকশা অটো ম্যাক্সি-ট্যাক্সি চলছে । আসলাম স্যার আজও ভূগোলের ক্লাসে ইতিহাস পড়ায় । ইতিহাস তো গপপো, বানিয়ে নিলেই হল । ভূগোল তো তা নয় ।

এখুনও পড়াচ্ছেন ? স্কুলমাস্টাররা তো শুনি রিটায়ার করে পাঁচসাত বছর ওব্দি পেনসন পাচ্ছে না ।

টাকের ওপর টুপি পরে আঙুল দিয়ে সাদা ধবধবে দাড়ি আঁচড়ায় আর দুপুরে ছেঁড়া আসন পেতে দেয়ালমুখো নামাজ পড়ে টিচার্স রুমে । এখুন তো টিচার্স রুম বলতে পশ্চিমের নোনা ইঁটের স্যাঁতসেঁতে ঘরটা, প্রায়ই ঠান্ডা খড়ামারা মেঝের ওপর দিয়ে গোখরো সাপ এদিক থেকে ওদিক নিশ্চিন্তি মনে চলে যায় । ছাত দিয়ে জল পড়ে । এখুন তো একটাও ক্লাসঘরে দরোজা-জানলার আড়কপাট নেই ।

আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল অরিন্দম । নিজেকে ঘিরে গ্রেটনেসের বুদবুদ তৈরি করতে চাইছে ও, আদিত্য । সবাই, ওর চেয়ে ছোটো, দরিদ্র, নিকৃষ্ট, দুস্হ, শ্রীহীন, অবহেলিত । অনেক মানুষ প্রেমহীনতাকে ভালোবাসে । অরিন্দম বলল, তুমি তো নিজেই স্কুলে  মাস্টারির চেষ্টা করেছিলে, বলেছিলে একবার।

ওঃ, সে এক কেলো হয়েছিল বটে । মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া হাইস্কুলে গিসলুম ইন্টারভিউ দিতে । এগারোজন প্রার্থী ছিল, বুঝলেন । চৈতন্য খামরুই বলে এক প্রার্থীর তো পাঞ্জাবির তলায় ছেঁড়া গেঞ্জি ওব্দি দেখা যাচ্ছিল । কুন্তু গুজগুজ ফিসফিস হাসাহাসি থেকে দশ মিনিটেই আমরা টের পেয়ে গিসলুম যে স্কুল কমিটি ওই পদের জন্যে আগে থাকতেই লোক ঠিক করে ফেলেছে । ইন্টারভিউটা লোকদেখানে ।

আমরা তো ইন্টারভিউ না দিয়ে বাস ধরার জন্যে ফিরে গিয়ে গ্যাঁজাচ্ছিলুম রাস্তার ধারে । হঠাৎ না, হইহই করতে-করতে তিরিশ চল্লিশজন লোক এসে ঘিরে ধরে কিল চড় লাথি থাপ্পড় কঞ্চিপেটা আরম্ভ করে দিলে । আমি ভাবলুম আমাদের ডাকাত ভেবে গণপ্রহার আরম্ভ হল বুঝি । আজগাল গ্রামে শত্রুপেটানোর এটা সবচে সহজ আর সস্তা কায়দা বেরিয়েছে । ভাবলুম আর বোধয় বাঁচার উপায় নেই । সব তো পাঁচ ফিটের গাঁইয়া বাঁটকুল । তিনটেকে দিলুম একটা করে পাঞ্চ, বুঝলেন । কেঁউয়ে কুকুর হয়ে কাৎ ।

তখুন ওদের নেতামতন লোকটা হুকুম ঝাড়লে যে ইন্টারভিউ না দিয়ে ফেরত যেতে পারবে না কেউ । ঘাড় ধরে হিড় হিড় করে, জামা খামচে, পেছন থেকে ঠেলে, স্কুল ওব্দি ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে নিয়ে গিসলো আমাদের , পেছন-পেছন গ্রামের প্রায় একশো হাফল্যাংটো কচিকাঁচার দল, নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ, একদল পাতি হাঁস গোঁতা খেয়ে নেবে গেল পুকুরে, তাইতে তিন-চারটে রুই-কাতলা লাফিয়ে উঠল, উড়িসশালা, সে অভিজ্ঞতা ভোলা যাবে না । কয়েকজন চাষি বউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিল । ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউ কিসসু নয় । হেডমাস্টারের ঘরে একটা রেজিস্টারে সবাইকে দিয়ে সই করিয়ে নিলে । ইন্টারভিউ না দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেলে তো শিক্ষক বাছাই বাতিল হয়ে যেত । তাই অমন হেনস্হা । কয়েকটা লোকের মুখ মনে রেখেছি । কখনও যদি পেয়ে যাই কলকাতায় কোথাও তো পোঁদের চামড়া তুলে নেব ।

এক্ষুনি লকাপে সেই কাজটা করছিলে বুঝি ?  কী করে পারো ? আমার তো গলা শুকিয়ে বুক ধড়ফড় করতে লাগল বলে বেরিয়ে এলুম । তোমার সঙ্গে এবার বোধয় আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে । বলার পর, অরিন্দমের খেয়াল হল যে এই কমবয়সি আদিত্য ছাড়া ওর আর বন্ধু নেই কোনও ; এমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে বসর গল্প করা যায় । নানারকুমের গোলমালে আক্রান্ত হয়ে উঠেছে অপরিহার্য ।

আরে, এই ক্রিমিনালগুলোকে আপনি জানেন না । মহাফেজখানা থেকে কিছু গুণ্ডা ফাইল বের করিয়ে দেবো আপনাকে পড়তে, তাহলে টের পাবেন । আদিত্যর মুখময় ঘুরঘুর করছিল বিমূর্ত অভিভাবকত্বের গর্ব । তাস যেভাবে তার তুরুপ লুকিয়ে রাখে, সেভাবে হাসির মৃদুতা ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রেখেছিল আদিত্য ।

অরিন্দম যেন হেমন্তের স্মৃতিভারাক্রান্ত কাঠফড়িং । বলল, জবাবদিহির সুরেই বলল, করেছে কী লোকটা ? শুনি।

তিলজলার গোলাম জিলানি খান রোডের নাম শুনেছেন ? গেছেন ওদিকে কখনও ? র‌্যাফ নেবেছে । দুটি পাইপগান, রামদা, আর একগাদা বোমা পাওয়া গেছে । পুলিশের ওপর বোমা চালিয়েছে, অ্যাতো বুকের পাটা । কন্সটেবল গোপাল দাসকে তো চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে । শঙ্কর ঘোষ, কুমার দত্ত, এরশাদ খান, শঙ্করনারায়ণ পাণ্ডে, ওদেরও অল্পবিস্তর চোট লেগেছে । আসল দুটো খুনে হাওয়া হয়ে গেছে বোমার ধোঁয়ায় । চারটে হারামজাদাকে ধরেছি আমরা ।

তিলজলা ? অরিন্দমের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত ।

কেন ? তিলজলায় আবার কী আছে ?

তিলজলায় একজন থাকে । আমি তাকে কখুনও দেখিনি । তার বিষয়ে জানিও না কিছু । এমনকী নামও জানি না । আমি তাকে বিয়ে করতে চাই ।  মনের ভেতর প্রেমের ফাঁকা জায়গাটায় বসিয়ে রেখেছি তাকে ।

আদিত্য স্তম্ভিত । রেশ কাটলে বলল, আপনাদের এইসব ন্যাকান্যাকা পারভারটেড কথাবাত্রা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায় ।