ওঃ, মরে গেলুম হুজুর, আহ, আরেব্বাপ, অঁক, ছেড়ে দিন স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না স্যার, উঃ বাপরে, আঃ, বাবাগো, আআআআঃ ।

আদিত্যর জন্যে বহুক্ষুণ অপেক্ষারত অরিন্দম অসুস্হ বোধ করছিল ক্রমশ, লকাপ থেকে ছিটকে-আসা আর্তচিৎকারে । বমি-বমি আসছিল । অরিন্দমের কাহিল প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল টেবিলের ওদিকে মিটিমিটি তাগড়া ভুঁড়িদাস পুলিশ অফিসারটা, বোধয় ইন্সপেক্টার । অনেকবার এসেছে বলে মুখ-চেনা, বলল, আপনি বরং নিচে গিয়ে গেটের কাচে টাটকা হাওয়া নিন । আসলেই পাঠিয়ে দোবো ।

অরিন্দম উঠে পড়ল ব্রিফকেস নিয়ে । দশ কুড়ি পঞ্চাশ একশো টাকার প্যাকেট এনে দিতে বলেছিল অরিন্দমকে ওর অফিস থেকে । আদিত্যর বোনের বিয়ের যৌতুক । থোক টাকা থাকলে উঁচু জাতের ভালো চাকরে পাত্র পাওয়া সহজ, পাত্রী যে জাতেরই হোক না কেন । এই একগাদা টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে চায় না অরিন্দম । মা, ছোটো ভাই বা তার বউ জেনে ফেললে কেলেঙ্কারি । পাটনায় থাকতে হঠাৎই একবার ও মাসকতকের জন্যে পাগল হয়ে গিসলো বলে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল । পা ব্যথা করছিল । এই শহরের চতুর্দিকব্যাপী নিনাদে হারিয়ে যায় আর্তনাদ আর কাতরানির ছোট্টো-ছোট্টো শব্দকণা । আক্রমণ আর আত্মরক্ষার উপস্হিতি সারাটা শহরের চরাচর জুড়ে । পুরুষকর্মীদের চাউনি রুমার দিয়ে মুখের ওপর থেকে পুঁছতে-পুঁছতে বাড়ি ফিরছে আলগা চটকের গৃহবধু কেরানি । সঙ্গিনীর সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু গণেশঠাকুরের শুঁড় ডানদিকে শুভ না বাঁদিকে । ক্ষীণস্বাস্হ্য সরকারি বাস চলে গেল, নাগরিক বোঝাই, ফোঁটার মতন মানুষ ফেলতে-ফেলতে, জিরোবে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের জ্যামে । বাসে উঠলেই লোকে বসতে চায় এ শহরে, যুবকরাও, যাতে কাঁধে কাঁধ না মেলাতে হয় । দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অভ্যাসমতন পথচারিণীদের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল অপ্রস্তুত অরিন্দম । খিনখিনে ট্যাক্সির কাতার । ডিজেলের নাকজ্বালানো ধোঁয়া । ধোঁয়া-ধুলোয় মুখ ভার করে আছে আকাশ ।

অফিসে আবার এলেন কেন অরিন্দমদা ? পেছন ফিরে আদিত্যর থমথমে চেহারা দেখতে পেল অরিন্দম । মানুষকে নিজে হাতে পেটানোর আহ্লাদ থেকে, মুখের আনন্দময় প্রতিভা থেকেই  বেশ বোঝা যাচ্ছে, আর কোনও দিন মুক্তি পাবে না আদিত্য । প্রতিনিয়ত ওর দরকার পড়বে প্রহারযোগ্য দেহ, সারাজীবন । রিটায়ার করলে কী করবে ও ?

তোমায় তো বাড়িতে পাওয়া যায় না ।

তা নয় । এসব টাকাফাকা অফিসে রাখতে চাই না । দেখলেই তো হিংসে ।

কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও । ছুটি তো ? এখুন ?

কী যে বলেন না, এখুনও কবুলতি লেখানো হয়নি । চলুন ওফুটে চায়ের দোকানটায় একটা ছেলে আছে আমাদের গ্রামের । ওর হাতে পাঢিয়ে দেব । আদিত্য বিব্রত বোধ করে অরিন্দমের সারল্যে । নোটগুনো কোথা থেকে এলো, বড়ো মাপের নোট কেন, কিছুইকি সন্দেহ করে না অরিন্দমদা ? টিকে আছে কী ভাবে অমন অনর্থক বোকামি নিয়ে !

বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের ধর্মশিবপুর গাঁয়ে, অজয় নদের তীরে, আদিত্য বারিকের বাস্তুভিটে । ঝিলুট থেকে কাঁচা রাস্তা আছে গ্রামে যাবার, তৃণমূল-কংরেস-সিপিয়েম মকদ্দমাবাজিতে আধখ্যাঁচড়া । সপ্তম পাঁচসালায় রাস্তাটা হবার আগে গাঁয়ে ফুলপ্যান্ট পরে ঢোকা যেত না বর্ষাকালে । কাঁধে বেলবটম, বাঁহাতে জুতোজোড়া, আন্ডারওয়্যার পরে ঢুকতো কলকাতা-বর্ধমানের কুটুমরা । ওদের গ্রামটা বাদে আশপাশের গ্রামগুনো মুসুলমান চাষিদের । জোতদার বর্গাদার কামলা সবাই মুসুলমান । ধর্মশিবপুরে আজ যাদের বাস, সেসব শীল, কাঁসারি, বারিক, কর্মকার, সাহা, শূর, পাল, কুণ্ডু, দাঁ, সাঁপুই, বায়েন, গায়েন, সরদার, পোড়েল পরিবার এসেছিল গঙ্গারাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমের মন্ত্রী বিষ্ণু সিংহের রাঢ়দেশ অভিজানে সঙ্গী হয়ে । সেসব গৌড়ীয়দের প্লেস অব ডোমিসাইল এখন রাঢ় ।

র‌্যাদক্লিফ সায়েবের ভয়ে নেয়ামত মণ্ডল পালিয়েছিল পাকিস্তানে । পরে হাওয়া বুঝতে এলে নরহরি মণ্ডল নেয়ামতের একশো ছেচল্লিশ বিঘে জমি কিনে নিয়েছিল পচা আলুর দরে, মগফেজের দলিলে তারিখের গোলমাল করে । পাকা দলিল হয়নি, তাই রেজেস্ট্রি হয়নি । এর মধ্যে একশো বিঘে ছিল খোদখামার আর ওয়াকফ চিরাগি জমি, যা নরহরির ছেলে সত্যসাধনকে দিয়ে খাস লিখিয়েছিল ভূমিসংস্কার দপ্তর, আর যা রাঢ়ের লোক পায়নি । চাষবাস না করেও তার অনেকটা পেয়ে গেসলো সন্তোষ দাসের মামাতো ভাই । সন্তোষ দাস এ-তল্লাটে পার্টি করার জন্যে এসেছিল সত্তর সনে । বে-থা করে থেকে গেল । নিজেদের এখুন দাশ লেখে, বলে কায়েত ।

প্রথমে মুসুলমান গাঁয়ে-গাঁয়ে বকবক বকবক করে গান্ধির কোল থেকে মার্কসের কোলে চাষিগুনোকে তুলে নিয়ে গিসলো সন্তোষ জেঠু । মুসুলমানগুনো তো চালাক কম নয়, আগাম টের পায় । ওরা সদাসর্বদা শাসকের সঙ্গে আছে । কী লাটসায়েব, কী ফজলুল হক, কী নাজিমুদ্দিন, কী সুরাবর্দি, কী বিধান রায়, কী জ্যোতি বসু । হলে হবে কী ! কোথ্থেকে একদল কিশতিটুপি-পরা লিগি এসে ফিসফিস-গুজগুজ চালালে যে মুসুলমানগুনো আর সাউ সরদার নাইয়া ঘরামি পদবি রাখতে চায় না । মেটে মসজিদগুনোকে ওব্দি সবুজ তেলরঙে ছুপিয়ে ফেলেচে ।

প্রতিভা ছিল বটে সন্তোষ জেঠুর, বুঝলেন অরিন্দমদা, নইলে সহদেব মন্ডলের ছেলেটা নকশাল হয়ে ওর মুন্ডু কেটে লটকে দিত না, নিজের গ্রামর অরিন্দমকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল আদিত্য । শৈশবে দেখা সেই দৃশ্য আজও, সময় বুঝে, আদিত্যকে কাবু করে । বুঝলেন অরিন্দমদা, আমার মামার বাড়ি ছুতোর-গাঁ গ্রামের পরামাণিক শ্মশানসাধুরা মানুষের মুণ্ডু ঝুলিয়ে চোত সংক্রান্তির ভোরে যে নাচ দেখাত, তার চে ভয়ের দৃশ্য ছিল বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো সন্তোষ জেঠুর কাটামুণ্ডু । সারারাত শিশিরে-ভেজা জলজ্যান্ত মুণ্ডুটা চোখ রাঙাচ্ছিল, যে দেখতে গেছে তাকেই ।

সেই কবে, ছোটোবেলাকার কথা, পরের বছর শ্মশানসাধুদের হাতে ঝোলানো মুণ্ডুগুনোর মধ্যে দুটো ছিল সহদেব মণ্ডলের দুই ছেলের । ছোটোটা পূর্বস্হলী, ওই যে, গেছেন তো আপনি, ওখানে গুলি খেয়ে মরেছিল । বড়োটার ধড় পাওয়া গিসলো হুগলির শেষপুকুর গ্রামে । বুঝলেন অরিন্দমদা, সাধুরা অনেক দিন ধরে মাথাগুনো মাটিতে পুঁতে রেখেছিল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে, গাজনাতলায় নাচবে বলে । এখুন তো কাটামুণ্ডু বেআইনি হয়ে গেছে বলে সাধুরা কুলি দিয়ে কাজ চালায় , দুধের বদলে ঘোল, আর কি । তার ওপর নাপতেরা আর কেউ সাধু হতে চায়না । তার চেয়ে গেরুয়া পরে হিন্দু পলিটিক্স করলে তবু কিছু পয়সাকড়ি হয় । চলুন না মামার বাড়ি, ব্রামভোন অতিথি পেয়ে মামামামিদের আনন্দই হবে ।

আমার তো গায়ে পৈতে-ফৈতে নেই ।

আরে ও তো পুরুতমশাইকে সকালে অর্ডার দিলে বিকেলে সাপ্লাই দিয়ে দেবে । পুরুতটা আবার বিজেপি, আগে সিপিয়েম করত । সিপিয়েমের পুরুত আসে কালনা থেকে । লোকটা স্টেট ব্যাংকে সিকিউরিটি গার্ড । চলুন না, জিপের ব্যবস্হা করি থালে ।

চলো যাওয়া যাক, ওয়েস্ট বেঙ্গলের অত ইনটিরিয়রে যাইনি কখুনও ।

খড়্গেশ্বরী নদীর ধারে ছুতোর-গাঁ গ্রামে আদিত্যর মামার বাড়ি । ঈশানেশ্বরের খেসসা গান, ফোকলা দাঁতে, আদিত্যর দিদিমার উদ্ভাসিত কন্ঠে, পুলকিত করেছিল অরিন্দমকে । দুই মামা মিলে বর্ধমানে ফার্নিচারের দোকান খুলে, বেতাহাশা কাঁচা পয়সা করেছে, জমিজিরেত, ট্রলিট্র্যাক্টর, চারাকাটার যন্তর, বিলিতি গাই, দুটো শ্যালো, আড়াই  বিঘের পুকুর । আদিত্য যখুন বাবার কাঁধে চেপে মামার বাড়ি যেত, মামারা এত সচ্ছল ছিল না । কোচবিহার থেকে কাঠের টানামালের ব্যাবসা করে দিন ফিরিয়ে নিয়েছে । দহরম আর মহরম উঁচু মহলে । এফিডেভিট করে রায় পদবি নিয়েছে । মেয়েদের জন্যে ফরসা উদারচেতা বর পেয়েছে, মোটা টাকা যৌতুক দিয়ে।

বুঝলেন অরিন্দমদা, ছোটোমামা দৌড়ঝাঁপ না করলে, এ এস আয়ের ইনটারভিউটা গুবলেট হয়ে যেত । দুরাত্তির ওর মামারবাড়িতে থেকে, অরিন্দমের মনে হয়েছিল, আদিত্যর মামারবাড়ির সবায়ের গা থেকে র‌্যাঁদামারা কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরোয় । সত্যি । বড়োমামার শালকাঠ, বড়োমামির সেগুনকাঠ, ছোটোমামার নিমকাঠ, ছোটোমামির শিশুকাঠ । মাতুলালয় যেন ছালছাড়ানো গাছের জঙ্গল ।

কোচবিহারে তুফানগঞ্জে, মানসাই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তো মামাদের, মানে আমার মায়ের, মামাতো ভাই । একবারটি ওখানেও নিয়ে যাব আপনাকে । লুকিয়ে-লুকিয়ে আসাম থেকে কাঠ আসে । অবশ্য কাকেই বা লুকোনো । বনকর্মীরা ব্যবস্হা করে, মাস মাইনে পায় ।

তোমাদের শিডুল হপ্তা আর ওদের শিডুল মাস ?

বিক্কিরি বাবদ তোলা দিতে হয় আলফা আর বোড়োদের, সোনার বাংলা থেকে চিনের আর পাকিস্তানের বোমাবন্দুক আনার জন্যে । একটু ইদিক-উদিক হলেই ডুয়ার্সে এলেমজি চলে । কুমারগ্রাম, বকশির হাটে ছানবিন হয় । হাঃ হাঃ, পুলিশকেও তো দিতে হবে । ছোটোমামা নিজেকে টিম্বার মাফিয়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসে, কিন্তু কাঠের ব্যাপারিরা সে স্বীকৃতি দিতেই চায় না ।

কলকাতায় না থাকলে কোনো কিছুতেই স্বীকৃতি মেলে না ।

ছুতোর-গাঁ’র মুসুলমানগুনো ধর্মশিবপুরের মুসুলমানগুনোর চে ফরসা । করিম মুনশি আর ফরিদ মোল্লার বাড়ির সবাই ফরসা আর ঢ্যাঙা । দাদু বলে ওরা সব খাঁটি আর আমাদের গাঁয়ের কেলটেগুনো পাতি । ফরসা না হলে আমেদ মামুদ করিম জালাল নামগুলো ঠিক মানায় না । বুঝলেন অরিন্দমদা, ছুতোর-গাঁ’র নাম পালটে রায়গ্রাম রাখার দৌড়ঝাঁপ চলছে । বড়োমামা বলছিল, ছুতোর-গাঁ’র কুসুমেটে তেঁতুলে, দুলে, বাগদি, হাড়িয়া সব এফিডেভিট করে রায় হয়ে গেছে । মামাদের চে উঁচু পরিবার বলতে উগ্রক্ষত্রিয় মন্ডলরা আর ব্রামভোনরা ।

জমিদাররা যখুন ছিল, তখুন স্হাপত্য বলে একটা ব্যাপার ঢুকেছিল গ্রামগুনিয় । এখুন তো গ্রামে-গ্রামে তোমার মাম,আদের মতন পয়সাওলা লোক কম নয় । অথচ কোনো নতুন স্হাপত্য দেখা দিল না উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের পল্লিসমাজে । গরিব সাজাটাই এখুন গ্রামবাংলার স্হাপত্য ।

ভাগ্যিস অর্ডার দেওয়া পৈতেটা পরেছিল অরিন্দম । আদিত্যর দিদিমা-মাইমা-ছোটো বউদির কাছে ওটার জন্যে অনাস্বাদিত খাতির চলছে । অরিন্দমের চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো ওর দিদিমা আর মামিরা চান সেরে এসে হঠাৎ পায়ের কাছে মেঝেয় ঢিপ-ঢিপ । এই জন্যেই গ্রামে যেতে অস্বস্তি হয় । জাতিপ্রথা বেশ জেঁকে টিকে আছে ভেতরে-ভেতরে , নানা জাতের মানুষ এখুনও এক সারিতে খেতে বসতে চায় না, বামপন্হী রাজনীতির শেকড়ের ফ্যাঁকড়া ছড়ালেও  । অবশ্য ছোটো ভায়ের বিয়ের সময়েও পরতে হয়েছিল রেডিমেড পৈতে ।

তোমার বড়ো মামার ছেলে-বউকে দেখলুম না ?

বড়দা-বউদি ফিবছর পুজোয় চাইবাসায় শ্বশুরবাড়ি চলে যায় । ওখানে দশজন জামাই মিলে খুব হইহল্লা হয় । সত্যি, আরে স্ট্রাইক করেনি আগে । পনেরো বছর বিয়ে হয়েছে বড়দার, কিন্তু কোনও বার পুজোয় নিজের মা-বাপের কাছে থাকেনি ।

তুমি বিয়ে করে কী করো দেখা যাক ।

পুলিশে কাজ করে বিয়ে করার ঝামেলা আছে । আপনি করে ফেলুন না বিয়েটা । ব্রামভোন বাড়িতে কুচ্ছিত মেয়েরও রূপ থাকে । ছুতোর-গাঁয়ে ব্রামভোনরা সব ঈশানেশ্বরের পুজুরি, বুঝলেন তো । স্বাধীনতার পর সব মন্দিরের দখল নিয়ে নিয়েছে ব্রামভোনরা । দুলেদের ধর্মরাজের মন্দিরটা নিয়েছে । দেয়াসি তাঁতিরা বুড়ো-গাছতলায় কালাচাঁদ মন্দিরের সেবায়েত ছিল ; তাদের হটিয়ে সেটাও হাতিয়েছে । ব্রামভোনগুনোই দেশটাকে ডোবাল । জহোর্লাল তো ব্রামভোন ছিল, তাই না ?

একটা মন্দিরের মধ্যেই অতগুলো পুতুল ডাঁই করে রাখা দেখলুম । ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে নাকি ? শ্রীহীন দেবতাদে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অবশিষ্টাংশ !

আপনাদের আজগালকার ব্রামভোনদের ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে বড্ডো অচ্ছেদ্দা । ওগুনো ধর্মঠাকুরের মূর্তি । মামারবাড়ির এদিকটায় অনেক-অনেক মন্দির ছিল আগে । এখন আর কে দেখাশোনা করবে বলুন ? সেসব ঠাকুরের থান থেকে এনে রেখেছে ওই মন্দিরে । কত মূর্তি তো চুরি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেল  । অবশ্য বিদেশে গিয়ে যত্ন-আত্তি পায় মূর্তিগুনো, সেও তো একরকুম পুজোই, বলতে গেলে । সেবায়েতরা আজগাল দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমানে রিকশা চালায়, হকারি করে । বর্ধমানে দেখলেন তো, ঠেলায় চাউমেন বেচছে, আমায় যে দাকলে, ও ছেলেটা তাঁতি বাড়ির ।

আমাদের ধর্মশিবপুর গাঁয়ের অনেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রানিগঞ্জ, আসানসোল, নিরসা, গোবিন্দপুর, ধানবাদ গিয়ে দুপুরুষ কয়লাখনিতে কুলিগিরি করছে । এমন সাতবাষ্টে হাড়গিলে চেহারা করে ফেলেছে, যে দেখলে টের পাবেন না বাঙালি না বিহারি, হিন্দু না মুসুলমান । আমরা তো ঠাকুদ্দার জন্যে পার পেয়ে গেলুম, নইলে কী দশা যে হতো । তল্লাটের মুসুলমানগুনো তো সোশালিস্ট ছেড়ে মুসলিম লিগে ঢুকে পড়েছিল, বুঝলেন, তার মধ্যেই ঠাকুদ্দার দৌলতে আমাদের ফ্যামিলির নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ভেদিয়া বেরাণ্ডা ছাড়িয়ে নিগন কৈচর উজানি কোগ্রাম ওব্দি । ঠাকুদ্দা তো বাবাকে ওয়ার্ধা আশ্রমে নিয়ে গিসলো । জহোর্লালের কোলে-বসা বাবার ফোটো আছে । তখনও টাক পড়েনি জহোর্লালের । সেসব এখন বাক্সবন্দি । আর বোধয় বেরুবে না ।

তোমার পুলিশে চাকরি এবার অন্যরকুম ইজ্জত এনে দিয়েছে, কী বলো ?

ধুৎ, ইজ্জত-টিজ্জত নয় । ভয় পায় লোকে । বেশ ভাল্লাগে লোকেদের ভয় পাওয়াটা । শ্রদ্ধার ভালোলাগার থেকে ভয়ের ভালোলাগাটা সুপিরিয়র । হাঃ হাঃ ।

তুমি ছুতোর-গাঁ, ধর্মশিবপুর, মঙ্গলকোটের অ্যাতো গল্প জানলে কোথ্থেকে ? ঠাকুদ্দার কাছে ?

না-না । ইশকুলে আসলাম স্যারের কাছে । ভুগোল পড়াতে-পড়াতে লোকাল ইতিহাস পড়িয়ে দিত । নিজেকে বলত রাঢ়ীশ্রেণি পাঠান । পূর্বপুরুষ কে একজন মোহম্মদ শামিম খান নাকি আলিবর্দি খাঁর সেনাদের সঙ্গে আরবি ঘোড়ায় চেপে বর্গিদের তাড়াতে-তাড়াতে এসে পৌঁছেছিল কাটোয়ায় । গঙ্গারাম নামে একজন কবি ছিল আগেকার  কালে, তার লেখা মহারাষ্ট্রপুরাণে আছে নাকি গল্পটা । আসলাম স্যার তো কুচকুচে কালো । আর ঘোড়াটার টাট্টু বংশধররা এখন মন্তেশ্বর কিংবা দাঁইহাটে এক্কা টানে ।  হাঃ হাঃ, এক্কাও উঠে গিয়ে চাদ্দিকে ভ্যান রিকশা অটো ম্যাক্সি-ট্যাক্সি চলছে । আসলাম স্যার আজও ভূগোলের ক্লাসে ইতিহাস পড়ায় । ইতিহাস তো গপপো, বানিয়ে নিলেই হল । ভূগোল তো তা নয় ।

এখুনও পড়াচ্ছেন ? স্কুলমাস্টাররা তো শুনি রিটায়ার করে পাঁচসাত বছর ওব্দি পেনসন পাচ্ছে না ।

টাকের ওপর টুপি পরে আঙুল দিয়ে সাদা ধবধবে দাড়ি আঁচড়ায় আর দুপুরে ছেঁড়া আসন পেতে দেয়ালমুখো নামাজ পড়ে টিচার্স রুমে । এখুন তো টিচার্স রুম বলতে পশ্চিমের নোনা ইঁটের স্যাঁতসেঁতে ঘরটা, প্রায়ই ঠান্ডা খড়ামারা মেঝের ওপর দিয়ে গোখরো সাপ এদিক থেকে ওদিক নিশ্চিন্তি মনে চলে যায় । ছাত দিয়ে জল পড়ে । এখুন তো একটাও ক্লাসঘরে দরোজা-জানলার আড়কপাট নেই ।

আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল অরিন্দম । নিজেকে ঘিরে গ্রেটনেসের বুদবুদ তৈরি করতে চাইছে ও, আদিত্য । সবাই, ওর চেয়ে ছোটো, দরিদ্র, নিকৃষ্ট, দুস্হ, শ্রীহীন, অবহেলিত । অনেক মানুষ প্রেমহীনতাকে ভালোবাসে । অরিন্দম বলল, তুমি তো নিজেই স্কুলে  মাস্টারির চেষ্টা করেছিলে, বলেছিলে একবার।

ওঃ, সে এক কেলো হয়েছিল বটে । মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া হাইস্কুলে গিসলুম ইন্টারভিউ দিতে । এগারোজন প্রার্থী ছিল, বুঝলেন । চৈতন্য খামরুই বলে এক প্রার্থীর তো পাঞ্জাবির তলায় ছেঁড়া গেঞ্জি ওব্দি দেখা যাচ্ছিল । কুন্তু গুজগুজ ফিসফিস হাসাহাসি থেকে দশ মিনিটেই আমরা টের পেয়ে গিসলুম যে স্কুল কমিটি ওই পদের জন্যে আগে থাকতেই লোক ঠিক করে ফেলেছে । ইন্টারভিউটা লোকদেখানে ।

আমরা তো ইন্টারভিউ না দিয়ে বাস ধরার জন্যে ফিরে গিয়ে গ্যাঁজাচ্ছিলুম রাস্তার ধারে । হঠাৎ না, হইহই করতে-করতে তিরিশ চল্লিশজন লোক এসে ঘিরে ধরে কিল চড় লাথি থাপ্পড় কঞ্চিপেটা আরম্ভ করে দিলে । আমি ভাবলুম আমাদের ডাকাত ভেবে গণপ্রহার আরম্ভ হল বুঝি । আজগাল গ্রামে শত্রুপেটানোর এটা সবচে সহজ আর সস্তা কায়দা বেরিয়েছে । ভাবলুম আর বোধয় বাঁচার উপায় নেই । সব তো পাঁচ ফিটের গাঁইয়া বাঁটকুল । তিনটেকে দিলুম একটা করে পাঞ্চ, বুঝলেন । কেঁউয়ে কুকুর হয়ে কাৎ ।

তখুন ওদের নেতামতন লোকটা হুকুম ঝাড়লে যে ইন্টারভিউ না দিয়ে ফেরত যেতে পারবে না কেউ । ঘাড় ধরে হিড় হিড় করে, জামা খামচে, পেছন থেকে ঠেলে, স্কুল ওব্দি ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে নিয়ে গিসলো আমাদের , পেছন-পেছন গ্রামের প্রায় একশো হাফল্যাংটো কচিকাঁচার দল, নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ, একদল পাতি হাঁস গোঁতা খেয়ে নেবে গেল পুকুরে, তাইতে তিন-চারটে রুই-কাতলা লাফিয়ে উঠল, উড়িসশালা, সে অভিজ্ঞতা ভোলা যাবে না । কয়েকজন চাষি বউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিল । ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউ কিসসু নয় । হেডমাস্টারের ঘরে একটা রেজিস্টারে সবাইকে দিয়ে সই করিয়ে নিলে । ইন্টারভিউ না দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেলে তো শিক্ষক বাছাই বাতিল হয়ে যেত । তাই অমন হেনস্হা । কয়েকটা লোকের মুখ মনে রেখেছি । কখনও যদি পেয়ে যাই কলকাতায় কোথাও তো পোঁদের চামড়া তুলে নেব ।

এক্ষুনি লকাপে সেই কাজটা করছিলে বুঝি ?  কী করে পারো ? আমার তো গলা শুকিয়ে বুক ধড়ফড় করতে লাগল বলে বেরিয়ে এলুম । তোমার সঙ্গে এবার বোধয় আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে । বলার পর, অরিন্দমের খেয়াল হল যে এই কমবয়সি আদিত্য ছাড়া ওর আর বন্ধু নেই কোনও ; এমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে বসর গল্প করা যায় । নানারকুমের গোলমালে আক্রান্ত হয়ে উঠেছে অপরিহার্য ।

আরে, এই ক্রিমিনালগুলোকে আপনি জানেন না । মহাফেজখানা থেকে কিছু গুণ্ডা ফাইল বের করিয়ে দেবো আপনাকে পড়তে, তাহলে টের পাবেন । আদিত্যর মুখময় ঘুরঘুর করছিল বিমূর্ত অভিভাবকত্বের গর্ব । তাস যেভাবে তার তুরুপ লুকিয়ে রাখে, সেভাবে হাসির মৃদুতা ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রেখেছিল আদিত্য ।

অরিন্দম যেন হেমন্তের স্মৃতিভারাক্রান্ত কাঠফড়িং । বলল, জবাবদিহির সুরেই বলল, করেছে কী লোকটা ? শুনি।

তিলজলার গোলাম জিলানি খান রোডের নাম শুনেছেন ? গেছেন ওদিকে কখনও ? র‌্যাফ নেবেছে । দুটি পাইপগান, রামদা, আর একগাদা বোমা পাওয়া গেছে । পুলিশের ওপর বোমা চালিয়েছে, অ্যাতো বুকের পাটা । কন্সটেবল গোপাল দাসকে তো চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে । শঙ্কর ঘোষ, কুমার দত্ত, এরশাদ খান, শঙ্করনারায়ণ পাণ্ডে, ওদেরও অল্পবিস্তর চোট লেগেছে । আসল দুটো খুনে হাওয়া হয়ে গেছে বোমার ধোঁয়ায় । চারটে হারামজাদাকে ধরেছি আমরা ।

তিলজলা ? অরিন্দমের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত ।

কেন ? তিলজলায় আবার কী আছে ?

তিলজলায় একজন থাকে । আমি তাকে কখুনও দেখিনি । তার বিষয়ে জানিও না কিছু । এমনকী নামও জানি না । আমি তাকে বিয়ে করতে চাই ।  মনের ভেতর প্রেমের ফাঁকা জায়গাটায় বসিয়ে রেখেছি তাকে ।

আদিত্য স্তম্ভিত । রেশ কাটলে বলল, আপনাদের এইসব ন্যাকান্যাকা পারভারটেড কথাবাত্রা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায় ।

Leave a comment