১০

বাড়ি ফিরলেও অশান্তি । ছোটো ভাইটার বউ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে কেরানি । অ্যামবাসাডরে পাশে বসিয়ে, সুপর্ণাকে ওর অফিসে নাবিয়ে, অরিন্দম চলে যায় বি-বা-দী বাগে নিজের দপ্তরে । তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে ভয় করে । ভাইয়ের অনুযোগ যে, ইচ্ছে করে গাড়ি আস্তে চালায় অরিন্দম । জ্যামহীন হরিশ মুখার্জি দিয়ে যাবার বদলে সিগনালের অজস্র ব্যারিকেড-বাধা গাড়িকন্টকিত আশুতোষ-শ্যামাপ্রসাদ দিয়ে যায় । বাসে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি । চলন্ত গাড়িতে হাসাহাসি করে ভাসুর ভাদ্দরবউ । অনেকে নিজের চোখে দেখেছে । পাড়ার বেকার ফুটপাতবাজরা পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছে ওদের হাসির আদান-প্রদানে, ছি ছি । পাড়া কমিটির উদবাস্তু নেত্রী অঞ্জনা হাজরার একমাত্র মেয়ে বলে খাপ খোলে না কেউ । কই, বাড়ি ফিরে তো হাসাহাসি হয় না ।

কী ঘোর বিপদ অরিন্দমের ।  হঠাৎ কী করেই বা বলবে, এই সুপর্ণা, কাল থেকে তুই বাসে যাস । ঘড়ির ব্যাপারে পাগলামি আছে সুপর্ণার । টেবিলে-টেবিলে, প্রতিটি ঘরের দেয়ালে-দেয়ালে, বিভিন্ন বাজনার গোল লম্বাটে চারকোণা ছকোণা ঘড়ি ঝুলিয়েছে । বৈঠকখানার দেয়ালে টাঙিয়েছে ্রিণ-শিং বিদেশি ঘড়ি, আধঘন্টা অন্তর পাখি বেরিয়ে ডাকে । একঘন্টা অন্তর সমস্ত ঘড়িগুনো বাজতে থাকলে নিভৃত আ্‌লাদ হয় অরিন্দমের । অবশ্য সব ঘযিগুলোই দিনের বেলায় বাজে ; অন্ধকার হলেই তারা বোবা । সাতদিনের জন্যে অরিন্দম ওকে সাতরঙা ঘড়ি কিনে দিয়েছে বলেও উষ্মা ।

ভাদ্রবধুর অফিসে প্রশ্নফাঁস, জাল মার্কশিট, ফেলকে পাশ করানো, নম্বর বাড়ানো কেলেংকারির দরুন সেদিন অরিন্দমের টেবিলের সামনে বসে হিঁয়াঃ হিঁয়াঃ হিঃ হিঃ হিঃ খিক খিক হিঁয়াঃ ইঁয়াঃ করে হাত-পা-মাথা নাড়িয়ে-নাচিয়ে হাসি উপহার দিয়ে গেল পাটনা অফিসের মহাত্যাঁদোড় নোটপরীক্ষক মোহন রাজবংশী, যেন ওসব নোংরামির জন্যে অরিন্দমই দায়ি । ব্যাটা তো কোনও কাজ করে না অফিসে । নোটের প্যাকেট গোনার বদলে বাঁ পাশ থেকে ডানপাশে নিয়ে সই মেরে দিত । তারপর সারাদিন কোনো অফিসারের চেলেমেয়েকে কোথায় ভরতি করাবে, ডোনেশানের দরদস্তুর, পরীক্ষায় ভালো নকল চেলেকে বসানো, ইনভিজিলেটারের সঙ্গে রফা, এইসব সমাজসেবা করে বেড়ায়, আর তার জন্যে কমিশন খায় । পাটনায় থাকতে একবার প্রচ্ছন্ন টিটকিরি মেরেছিল অরিন্দম । তার প্রতিশোধ নিয়ে গেল ।

অরিন্দম ভাবছিল যে ওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সবায়ের সমস্যা । সেই ছাত্রজীবন থেকে একের-পর-এক প্রেমাস্পদার সঙ্গে ও সম্পর্ক গড়েছে আর তা ভেঙে গেছে । গড়া-ভাঙার মাঝখানটা ঘিরে একটা করে দূষিত গল্প ছড়ায় । বিশ্বাসযোগ্যতায় দূষণ ঘটে । শেষ গল্পটা তুলি জোয়ারদারকে নিয়ে । যারা কখুনও প্রেম করেনি, তারা মনে করে  প্রেমের জন্যে বুঝি মেয়েমানুষটাই সবকিছু । তা তো নয় । নেসায় যেমন নেশাটাই মুখ্য, ড্রাগটা তো গৌণ । ম্যানিলায় একবছর ট্রেনিঙে ছিল বলে, নারীসঙ্গ বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কথা ও কাহিনি ছড়িয়েছে অফিসে । ডলার বাঁচিয়ে হংকং আর ব্যাংককের লাল-আলো এলাকার সুমসৃণ মোঙ্গল-ত্বক আদর করার উত্তেজক জিভ-ভেজা গল্প । ছোটোভাইটাও অরিন্দমের নানা গল্পগাছায় ছোটোবেলা থেকে প্রতিপালিত । তার কাছে বিশ্বাস্য হয়ে ওঠা অসম্ভব ।

শ্যাওড়াফুলি লোকালে উদ্দেশ্যহীন উঠে পড়েছিল অরিন্দম । কোন্নোগরে নাবল না, ছোটোকাকার শ্রাদ্ধে যাওয়া হয়নি । হিন্দমোটরে নাবল না, অ্যাতো রাতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়বে মেজোকাকা । স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এমন সমস্ত কেউটে গোখরো লাউডগা অজগর শঙ্খচূড় কিরাইত চিতি চন্দ্রবোড়া কানড় ময়াল বের করে-করে কামড় খেতে থাকবে যে রাতভর ঘুমুতে দেবে না । প্রতিটি কামড়ের আগে বলবে, গল্পটা হল এই ; অথচ তা গল্প নয়, তাঁর জীবনের দুঃখকষ্টের চিলতে ।

লাটের পর লাট ঘামে পচা নিত্যযাত্রী উঠছে-নাবছে, কোথাও না কোথাও যাবে । তীর্থযাত্রীর মতন একটা ইদ্দেশ্যময় নির্ধারিত গন্তব্য তো আছে । বাড়ি, পরিবার, দিনানুদিনের যৌনতা, রুটিনবদ্ধ কর্মসূচি । এটাই তো সুখপ্রদ আধুনিক জীবন ।

ট্রেনটার শেষ স্টেশান শ্যাওড়াফুলিতে, নেবে পড়ল অরিন্দম । মাকে টেলিফোন করে দিল, পিসিমার বাড়ি যাচ্ছে, পরশু অফিস হয়ে ফিরবে । অন্ধকারের অন্ধিসন্ধিতে পঁকপঁক তুলে এগোয় রিকশা । খোঁদল-কানা টিমটিমে রাস্তায় বৃষ্টির আবেগ-মাখা কাদা । দুপাশের হামলে-পড়া দোকানদারিতে নোনাডাঙা রোডটা অনোন্যপায় । বৃষস্কন্ধ ট্রাক চোখ বুজে র‌্যাশান পাচার করাচ্ছে । পাঁঠার শিড়িঙে মরদেহের অবশিষ্টাংশ ঝুলে আছে একাকী উদাসীন কসায়ের চ্যাঁচারি-চিলমনের আবডালে । শহুরে বর্ষার অকাল-ছপছপে গলিতে রিকশা থামল । ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যতটা চোখ মেলা যায়, থিতু হয়ে জিরোচ্ছে কৃষ্ণপক্ষের সজল মেঘ ।

পিসিমা যে পাঁচ বছর আগে মারা গেছে তা পৌঁছে টের পেল অরিন্দম । পিসতুতো ছয় ভাই, ইঁটের অর্থেক তৈরি দাঁত-বেরোনো বাড়িতে ঢুকে দেখল ও, আলাদা-আলাদা মিনি সংসার বানিয়ে ফেলেছে যে-যার ছাদ-পেটানো নানান মাপের খুপরি-ঘর ফ্ল্যাটে । আজকে বড়ো বউদির জন্মের সুবর্ণজয়ন্তীতে, ওদের একত্রে মদ খেতে বসার দরুন, স্কচ হুইস্কির ভরাযৌবন বোতলদুটো পিসিমা-পিসেমশায়ের উপস্হিতির কাজ করল । নয়তো অরিন্দম ঠিক কোন ভায়ের অতিথি, সে সমসয়া এক অপ্রস্তুত ঝামেলায় ফেলে দিত এই বাদলা রাত্তিরে । দুই বোন আর তাদের স্বামীসন্ততিও হাজির । গ্রামীণ প্রকৃতি-পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন প্রতিটি পরিবার নিজের বাড়ির মধ্যেই মেলা বসাচ্ছে এ-যুগে । পাঁঠাবলির বিকল্প ব্রয়লার । নাগরদোলা আর ফকির-বাউলের বদলে ভিসিপি-ভিসিআর এনে বা কমপিউটারে হিন্দি সিনেমার জগঝম্প । একান্নবর্তী এ-যুগে একবোতলবর্তী ।

সত্যিকারের বাউল-ফকিররা বোথয় আর টিকবে না বেশিদিন । লালন থাকবে ইশকুল-কলেজের পুঁথিপত্তরে । টিভি আর নাটক-মাচানে থাকবে পূর্ণদাস বাউল । অফিসের কাজে একবার মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল অরিন্দম । তাঁতিদের কীভাবে সাহায্য করা যায় যাতে মুর্শিদাবাদি সিল্কের শাড়ি কর্ণাটক আর তামিলনাডুর শাড়ির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারে তা খতিয়ে দেখতে ধরমপুর, কুমিরদহ, ছয়ঘড়ি, নতুন হাসানপুর, দুর্লভপুর, গুধিয়া, হাসানপুর, হরিহরপাড়া, বাগড়ি, আলিনগর অঞ্চলে ঘোরাঘুরির সময় ফকির-বাউলের হেনস্তার অভিযোগ পেয়েছিল অরিন্দম ।

বোঝলেন বাবু, আমরা নাকি কাফের, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদা করি না বলে আমরা নাকি আল্লার বান্দা নয়, আমাদের গানবাজনা নাকি হারাম, রোজা রাখি না বলে ইন্তেকালের পর জান্নাতে আমাদের জায়গা নেই । বলেছিল সিরাজ ফকির । আড়াই হাজার ট্যাকা দিতে হয়েচে গান করি বলে । কংরেস সিপিয়েম ফরোড ব্লক তৃণমূল কেউ বাঁচাতে আসলেনে ।

স্বাধীন বাংলাদেশ হলে কী হবে, পাকিসতানি জামাত আছে সেখানে লুক্যে । কুষ্টিয়া রাজশাহি পাবনা থিক্যা আসসা বুল্যে যায় ফকির যেন কাফেরের মতন দোল না খ্যাল্যে, যেন নুন না খায় কাফেরের ভোজে । পরামাণিক ঘরামি কলু মোহন্ত মাঝি পদবি বাদ না দিল্যা তার ঘর‌্যে সাদি-নিকা বন্ধ করা হব্যে । বিয়া আকিকা ইদ বকরিদে লালনের গান গাইবা না । কাজেম মোহন্তর মেয়্যের সোহরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি আর তার আবার বিয়া কাফেরদের মতন দিল্যা, তাই লবণচল বন্ধ । রইসুদ্দি ফকির, একবাল হোসেন, কাজেমালি দোতারা নিয়্যা নেচেছিল । তেনাদের হুমকি দিয়্যা গেছে ওপারের তবলিগ । পাসপোট-ভিসা লাগ্যে নাই তবলিগঅলাদের । আমরা আল্লার বান্দা না পাকিস্তানের বান্দা বল্যেন আপনে । জানতে চেয়েছিল ফজলু ফকির ।

এমন অবস্হায় বালুচরি শাড়িকে ঢাকার বাজারে আর প্রবাসী ধনী বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় করা শক্ত । বাঁকুড়া জেলায় বিষ্ণুপুর মহকুমার মাধবগঞ্জে মহাজন আর তাঁতিরা গোঁ ধরে আছে যে হিন্দু মোটিফ পালটাবে না । মুর্শিদাবাদি তাঁতিকে বালুচরি বোনা শিখতে হলে প্রথমে মাধবগঞ্জের মোটিফ শিখতে হবে । চাঁদ তারা উট তাঁবু খেজুরগাছ মিনার এসবের নকশা জ্যাকার্ডে তুলে যে সরকারি কম্পিউটারবিদ বিষ্ণুপুরে প্রচার করতে গিসলো তাকে তাঁতিরা আর মহাজনরা প্রচণ্ড মার দিয়েছিল । অরিন্দমের মনে হয়েছে এ তো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অতীত এক দুর্বোধ্য সমাজ , এর জট পাকাতে-পাকাতে দড়ির মুখ খোঁজাকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে । অথচ মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামেই জন্মেছিল বালুচরি ।

হতভম্ব অরিন্দম বলেছিল, কিন্তু জেলা সদরে যে শুনলুম বাউল ফকির সংঘের সভাপতি শক্তিনাথ ঝা, তারপর কলকাতার সব গণ্যমান্য লোকেরা, মহাশ্বেতা দেবী, আবুল বাশার, প্রকাশ কর্মকার, মনোজ মিত্র, আজিজুল হক, কবির সুমন, সুজাত ভদ্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ওনারা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দরবার করেছেন ।

সিরাজ ফকির : ওই কলকাতায় গান-গপপো-থেটার করেন, তেনারা ?

অরিন্দম : হ্যাঁ হ্যাঁ ।

সিরাজ ফকির : তা তেনারা থাকে কলকাতায় আর নাসিরুদ্দি ছায়েব ভোটে জেতে হেথায় ।

অরিন্দম : ওহ ।

সিরাজ ফকির : খেতে জল দিচ্ছিল জব্বার ফকির । ওর পাম্প তুলে নে গিয়ে রেখে দিলে পঞ্চায়েতের ছইফুদ্দি সরকারের বাড়ি । যে-ই জব্বারের জন্যে তদবির করেছে সে-ই জরিমানা দিয়েছে । তুঁত খেত আর পলু চাষ লাটে উতেচে গো । আর আপনে এসেচে মুরসিদাবাদি সাড়ি বাঁচাতে ।

অরিন্দম দেখেছে, বাহকরাও বলেছে, মহাকরণে মন্ত্রী আর সচিবরাও জানে, চিন আর কোরিয়ার উন্নতমানের রেশমসোতো চোরাপথে আসচে মালদা মুর্শিদাবাদ নদিয়া বাঁকুড়ায় । আহা, করে খাচ্চে গরিব মুটেরা । বড্ডো দুঃখুগো কুষ্টিয়া কোটচাঁদপুর কুমিল্লায় । বিদেশি সাম্যবাদী দেশের সরকার তাই স্মাগলিঙে নিয়োজিত । বাঁকুড়ায় দেখেছিল অরিন্দম, তাঁতি আর মহাজনের আড়ংধোলাই-খাওয়া কম্পিউটারবিদ দেখিয়েছিল, বালুচরি শাড়ির মফসসলি দিকটা এদেশি রেশম, আর শাড়িটার  সদর পিঠে কোরিয়ার সিল্ক ।

এখানের রেশমচাষিরা পড়ে-পড়ে মার খাচ্চে । দিনকতক পর দড়িদঙ্কা হয়ে মরবে । আমাদের কিছু করার নেই স্যার ল আমরা স্মঅঅঅঅল ফ্রাই ।  হ্যান্ডলুম অফিসার, নস্যি-নাকি হুতাশ জানিয়েছিল অনুকুলচন্দ্র বসাক । আর তুঁত-চাষি হাজি ইসরাইল বলেছিল, পাশের মালদা জেলায় অবস্হা আরও খারাপ । আমরা লাভজনক দাম পাই না । ভালো জাতের ডিমও পাই না আজ্ঞে । কাজের সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না । সেচের জল বাড়ন্ত । সারের দাম বেড়েই চলেছে । আমাদের কতা কেউ ভাবে না । আমাদের দেখার কেউ নেই । এই আপনারা কলকাতা থেকে আসেন, লিখে নিয়ে চলে যান । বিহিত হয় না । এই অ্যাতোক্ষুণ আপনার সঙ্গে কতা বলে কত সময় নষ্ট করলুম । আজকে হাটবার ছিল । আগে আমরা বছরে চারবার পলুপোকা পুষতুম । এখুন একবার পোষা দায় ।

আছেরুদ্দি মহাজন, দাড়িপাকা, গোঁফকামানো, বললে, বাঁ পা চেয়ারের হাতলে তুলে পায়জামা নাবিয়ে হাঁটু চুলকোতে-চুলকোতে, সরকার তো পাওয়ারলুম বসাতে দিতে চায় না  যাও বা রেশমসুতো হয়, তার বেশিটা নিয়ে চলে যাচ্ছে ভাগলপুর বেনারস মোবারকপুরের ফড়ে । অঙ্গুলিহেলন জানেন তো ? আপনাদের কলকাতার বড়োবাজার সুতোর দাম বেঁধে দিচ্ছে ষড় করে । অঙ্গুলিহেলন-কমরেডদের সঙ্গে ষড় করে । সঅঅঅঅব সমস্যা কলকাতার তৈরি । মুর্শিদাবাদি রেশমশাড়ির দিনকার ফুরুল ।

Leave a comment