শেষপুকুরের হিমঘর কখনও মুসুলমান মালিকের ছিল । শাজাহানের তাজমহলের মতন হিমঘরটাকে দ্বিতীয় বেগমের স্মৃতিমন্দির করেছিল । হিমঘরের পেছনের মাঠে স্বামী-স্ত্রীর কবর, ইঁটের দাঁত-বেরোনো, ছাগলছানারা ওটায় চড়ে লাফ খেতে শেখে । লোকটার ছেলে দেশত্যাগের কাটাকাটির সময়ে গায়ে হাতে পায়ে ছোরাছুরির চোট নিয়ে পাকিস্তানে ভৈরব নদীর ধারে পালিয়েছিল । ভবেশকার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা ভবেশকার নাছোড় অধ্যাবসায়ের ফসল ।

বর্ধমান থেকে আরামবাগ হয়ে সারাতি পৌঁছেছিল যিশু । আসার দিনই দেখেছিল, তারকেশ্বর-আরামবাগ রোডে চারটে করে আলুর বস্তা সাইকেলে চাপিয়ে সার বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্যাংলা গলদঘর্ম ছেঁড়ালুঙ্গি খালি-গা চাষিরা । চাষির কাছ থেকে ফ্যালনা দামেও আলু কেনার লোক নেই । চাষি ধারে বেচবে ছোটো আড়তদারকে, ছোটো আড়তদার বড়ো আড়তদারকে, বড়ো আড়তদার শ্যালদার কাঁচাবাজার কিংবা বড়োবাজারের পাকাবাজারকে । চাষিরা আর ছোটো আড়তদাররা কবে যে টাকা পাবে ঠিক নেই ।  আলুর চেয়ে খড়ের আশি আঁটির দাম বরং ভালো । আলু বিকোচ্ছে না । এদিকে খড়ের দাম চড়ছে । আলু বিকোয়নি বলে চাষিরা বীজ আলুর ঋণ শোধ করতে পারেনি । ছোটো আড়তদাররা বীজ আলুর টাকা আদায় করতে না পেয়ে অসহায় । ধরট নিতে চাইলেও এগিয়ে আসছে না কেউ ।

প্রশ্ন তুলে উত্তরটা লিখে নিতে দেখলে, কুন্ঠিত-সঙ্কুচিত হয় গাঁয়ের লোক । লেখালিখিকে সন্দেহ করে সবাই ।  বুকপকেটে একটা ছোটো টেপ রেখেছে যিশু যাতে কেউ টের না পায় । যারা অভিযোগ জানাতে চায়, তাদের জিগেস করতে হয় । কোন চাষির দুঃখের বোতাম কোথায়, আঁচ করে টিপলেই, গল-গল করে বেরোতে থাকে ক্রোধ কষ্ট দুর্দশা হতাশা গ্লানি অভিশাপ । চাষির অভিশাপ একদিন ফলবেই, চাষিরাই বলে সেকথা ।

বড়োতাজপুরের মামুদ মাফুজ । আগে তো লোডিঙের সময় থেকেই আলুর দর চড়ত । বণ্ডের ব্যামো ধরিয়ে দর কমিয়ে দিলে । আমরা কিচু বুঝিনে ? ঘোড়ার ঘাস খাই ? ওই তো, আলু চাষের জন্যে ঋণ নেয়নি শ্বেতলেশ্বর গাঁয়ের সমবায় সমিতি । তাদের সদস্যরা বণ্ড পেলে কী করে ? হাঃ । আমাদের কাচ থেকে সংরক্ষণ বাবদ বাড়তি ট্যাকা আদায় হচ্ছে । অথচ মহাজন আর ফড়িয়া দালালরা চাষি সেজে বণ্ড পেয়ে গেল । ভক্তিপদ কুণ্ডুর চার হাজার প্যাকেট ঢোকানো হয়েচে, ইদিকে এক ডেসিমাল জমিও নেই । হাতে-পায়ে কুঠ হয়ে মরবে যত বেজন্মার দল, এই আমি বলে রাকচি ।

খিলগাঁয়ের ক্ষুদিরাম ঢাং । এবছর শীত পড়েছিল টানা, না কী গো ? বিষ্টিবাদলা ঝড়ঝাপটা হয়নে । হাওয়াটাও শুগনো ছিল এবার । তা বোরো চাস তো হবে নে । আর গেল বছর আলুর দাম উটেছিল ভালো । ভেবেছিলুম, আলু তুলে সব ধার-দেনা মিটিয়ে দিতে পারব এবার, ওই যে দেকুন না, ওই চালটাও সারিয়ে নিতুম, মেজো মেয়্যাটার বিয়ের জন্যিও জমাতে পারব কিছু ট্যাকা । কিচ্ছু হল নে । আমাদের দেকার কেউ নেই । আমাদের কতা শোনার কেউ নেই । কীটনাশক খেয়ে মরতেও ভয় করে গো বাবু ।

বেলসলিয়ার আচেরুদ্দি মল্লিক । দেখেন না কেন, বাড়িতে সকাল থেগে উটে কাজ হয়েচে পচা আলু আর ভালো আলু আলাদা করার । নিত্যি দিন । আলুর তো পাহাড় জমে গেচে ।পচা বাছতে বেলা হয়ে যায় , তাপপর দাগ ধরলিই কেটে-কেটে গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্চি । গরুগুনোও আর আলু খেতে চায় না । আগে তো টানের সময়ে  দাগি আলুও কাঁচাবাজারের মহাজন নিয়ে যেত । রাত্তিরে আলুর পাহারাও হয়েচে ঝকমারি । ছেলে দুটোর রাত জেগে-জেগে শরীর বরগতিক হয়ে গেল । ওর মায়ের হাত দুটো দেকুন । দেকাও হাত দুটো, দেকাও, দেকাও না, লজ্জাশরমের কী, উনি তো হালিম-কালিমের চেয়েও ছোটো । দেকুন, পচা বেছে-বেছে হাতময় দানা বেরিয়ে গেচে।

হালিম মল্লিক । আমাদের গাঁয়ে পচা আলুর নাম হয়েচে কলিমালু, নেতার নামে । আলুর গোলমালের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী  ওনাকে ওননো বিভাগে পাটাচ্চেন শুনলুম ।

বাদলাপুরের দেবেন জানা । চল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের বিজনবাড়িতে আলুর ধসা রোগ হয়েছিল, বুঝলেন বিশ্বাসদা । কেন্দ্র সরকার তখুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেছলো । তা সে অর্ডার তোলবার কারুর খেয়াল হল না অ্যাদ্দিনেও । তেনারা পোঁদে তেল দে ঘুমুচ্চেন । ইদিকে অন্ধ্র উড়িষ্যা থেকে তো ফি বছর আলো এসছে এখানের বাজারে । এখান থেকে নুকিয়ে-নুকিয়ে গেছে সিকিম ভুটান আসাম । লাগ-লাগ টন আলু পচার পর এখুন অর্ডার তোলার কাগজ বেরুচ্চে বলে শুনিচি । কেন্দ্র সরকারে জহোর্লালের টাইম থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের লোক নেই । জহোর্লাল দিনকতকের জন্যে চারু বিশ্বাসকে মন্ত্রী করেছিল, তাও ফ্যালনা । নেতাগুনোর বাপের দুটো করে বিয়ে । তাই বিমাতা-বিমাতা করে নাকে কাঁদে ।

খাগড়াপাড়ার সত্যনারায়ণ সামান্ত । আমি স্যার দিসি উপায় করিচি । এই বটগাছতলায়, ওই যে, ওখেনটায়, আড়াই ফুট গত্তো খুঁড়ে প্রথমে বালি, তার ওপর কীটনাশক ছড়িয়ে আট কুইন্টালটাক আলু রেকিচি । তার ওপর আড়াআড়ি-লম্বালম্বি খড় বিছিয়ে আবার ওষুদ ছড়িয়ে দিইচি । ওই ইঁটের পাঁজা চাপিয়ে ঢেকে দিইচি । তিনচার মাস তো অন্তত থাগবে । তারপর কপাল । ঠাকুরের যা ইচ্ছে তাই হবে । কত দৌড়োদৌড়ি কল্লুম । এক প্যাকেট মতনও জায়গা পেলুম না । পঞ্চায়েতের কোটাও পেলুম না, সরকারি কোটাও পেলুম না । আর কত দাম ধরে মালিকের কোটা নিতে গেলে আমাদের মতন চাষির পুষোবে না । জেলাসদরে বল্লে, মন্ত্রীর ঠেঙে চিটি আনো, থালে সরকারি কোটা পাবে । কাকে ধরি ? বলেন । তাই এই উপায় করিচি । ইদিকে সেলসিয়াস আবার চল্লিশে চড়তে চলেচে ।

গুপ্তিপুরের বুড়ি । আলু-পচা আন্ত্রিকে নাতি মারা গেচে । নিববংসো হবে, অ্যাই বলে রাগলুম । যমে নেবে, যমে নেবে ।

খড়ি নদীতে জোড়া-নৌকোর মাচানে দাঁড়িয়ে কুতিরডাঙার অক্ষয় ঘোষাল । আলু পুরটসুন্দরদ্যুতি কদম্ব সন্দীপিতঃ সদ্য পকেটকন্দরে স্ফূরতুবঃ হিমঘরনন্দনঃ ।

বড়োপলাশনের শ্যামদাস প্রামাণিক । দশ প্যাকেট আলুর জন্যে মাসে এক প্যাকেট সুদ । অতিষ্টো করে মাল্লে । পাপের ভোগান ভুগতিই হবে ।

ষাটপলনের কেষ্ট দেবনাথ । দাদা সিপিয়েম করে, আমি ফরোড ব্লক করি । আমি না পেলে দাদা । দাদা না পেলে আমি । কেউ তো বন্ড পাবো । তাছাড়া কৃষি বিপণন আর সমবায় তো আম,আদের দলের হাতে । আমাদের অসুবিধা তেমন হয় না ।

জমিরাগাছির অনন্ত কুণ্ডু । আপনি একবার ভেবে দেখুন স্যার । ধান আর গমের বেলায় সংগ্রহমূল্য  বছর-বছর বাড়িয়ে দিলে বলোরাম জাখড় । আলু কি জাখড়ের অ্যাঁড়, অ্যাঁ ? তা কেন সংগ্রহ করবে না সরকার ? তার কেন সংগ্রহমূল্য হবে না ? বলুন আপনি । আলুও তো ক্যাশ ক্রপ । আসলে পঞ্জাব আর হরিয়ানার বেলায় দরোজা হাটকরে খোলা । আমাদের বেলায় পোঙায় লাতি ।

এর আগে অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে যিশু । কত কারখানা আর ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিতে সাহায্য করেছে মোদি গোয়েঙ্কা মল্ল ভারুচা খান্না খৈতান লালওয়ানি কেশওয়ানি মাহিন্দ্রা শিল্পপতিদের । বিদেশি বিনিয়োগকারীদের । স্রেফ মগজ খাটিয়ে । এরকুম অভিজ্ঞতা হয়নি আগে । পেরু না বোলিভিয়া কোথ্থেকে এসে বাঙালি জীবনে ঢুকে পড়েছে নির্বিকল্প আলু ।

আলুহীন পৃথিবী ভাবাই যায় না । বেলে কিংবা পলি দোআঁশ অল্প-টোকো জমিতে মখমল মাটির লেপ চাপা দিয়ে কেমন ডিম্বাশয় গোলগাল, তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে গভীর আয়ত চোখে ভূমিষ্ঠ হয় চন্দ্রমুখী আলু । ভূমিষ্ঠ হয় জ্যোতি অলঙ্কার কুন্দন সিঁদুরি নবীন সফেদ কুমার বংশের খোকাখুকু যুবকযুবতি । এদের অনেকে চন্দ্রমুখীর সদবংশের নামে পৌঁছোয় বাজারে । ভিজে হাওয়া আর কুয়াশা সহ্য হয় না ওদের । নাবি, ধসা, ভুষা, সাঙ্কোষপোরা রোগে ধরে । বড্ডো সুখী ওরা, তাই উই পোকা, পিঁপড়ে, কাটুই পোকা, লাল বিটল, জাব পোকা, থিপস, সাদা গ্রাব, সুতলি পোকার দলবল সুযোগ পেলেই ওদের শীতের রাত্তিরে জাপটে ধরে । ওদের আঃ উঃ লক্ষ্মীটি পায়ে পড়ি, প্রাণে মেরো না, বাঁচাও-বাঁচাও নিঃশব্দ চিৎকার মাঝরাতে মাটিতে কান পেতে শুনতে পায় আলমপুর গ্রামের কাশীনাথ মাইতি । টাকার মতন আলুও বহুবল্লভা ।

সে আলু, পচলে যে আটদশ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের দখল নিয়ে নেবে, নানা রকুমার মাছি আর উনকিকে দূরদূর দেশ থেকে ডেকে আনবে সোহাগ পেতে, সে অসহ্য দুর্গন্ধের সঙ্গে গতবছর বৈশাখে পরিচিত হল যিশু, পরপর কয়েকটা হিমঘরের তথ্য যোগাড় করতে গিয়ে । ওফ, নরক,  নরক ।

শীতযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল পোলবা দাদপুরের বালিকুখাড়ি সমবায় হিমঘরে । পচে জল হয়ে গেল আলু । পাঁচ হাজার চাষি পরিবার সর্বস্বান্ত, রিপিট, সর্বস্বান্ত , লিখে রেখেছে যিশু । চাষিরা হিমঘরের সামনে গিয়ে ধরনা দিচ্ছিল বলে একশো চুয়াল্লিশ জারি হল । একদিকে হিমঘরের লোকেরা আরেক দিকে চাষিরা । সে কী হাতাহাতি মারামারি লাথালাথি । চুঁচড়ো থেকে বিরাট পুলিশপার্টি গিয়ে লাঠিপেটা করে বাগে এনেছিল । দিনদুপুরে মশারির মধ্যে বসে ল্যাপটপ খুলেছিল, অ্যাতো মাছির ঝাঁক । না খেয়ে ছিল বারোঘন্টা, নিরম্বু । তারপর পালিয়েছে । কত জনের যে হাঁপানি ধরে গেল কে জানে । চারটে চাষির বাড়িতে সাতটা বাচ্চা মরেছিল আন্ত্রিকে । অনেকের গা-ময় দাগড়া দাগ বেরিয়েছে । দুর্গন্ধ সৃষ্টি করায় মানুষের জুড়ি নেই । যত উন্নতি, তত আবর্জনা, তত নোংরামি, তত দুর্গন্ধ ।

গোস্বামীমালপাড়ার হিমঘরে সাতষট্টি হাজার প্যাকেট নষ্ট হয়েছিল । গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য হালিম মাজেদ ছিল জেলাশাসকের আপিসে, কোনো কাজে । বললে, বিমার টাকা উশুল করেও হিমঘর সমিতি বিমা করায়নি । চোত মাসে  বিমা কোম্পানির লোক এসেছিল, কিন্তু কম ভোল্টেজে যন্তর বিকল হয়ে আলু পচার ভয়ে বিমায় রাজি হয়নি । বেলমুড়ি থেকে বিজলি আসে টিমটিম করে । দুটো জেনারেটর , তা দুটোই পড়ে আচে ভেঙে । হিমঘরের সহসভাপতি মহম্মদ জাকারিয়া বলেছিল, কিচু আলু বাঁচানো যাবে । তা বাঁচানো যায়নে কিচুই । নির্বাচন এসে পড়েছিল বলে মজুর-কামলা-মুটিয়া পাওয়া যায়নে । এলেকশান এলে কিচু পয়সার মুখ দেখতে পায় ওরা ।

পচে হালুয়া হয়ে গিসলো আলু । অমন সুন্দরী চন্দ্রমুখী কন্দ নিজেরা পচেছে, থলেগুলোকেও পচিয়েছে । আলুর পাহাড় থেকে আগ্নেয়গিরির পচা লাভাস্রোত । আশপাশের ভাদিলপুর, দেপুর, কেয়োলপার গাঁয়ের লোকেদের পাতলা পায়খানা আর ভেদবমি থামতেই চায় না । প্রাণ একেবারে অস্হির, আইঢাই, কাহিল । সরকারি স্বাস্হ্যকেন্দ্র এই আলুপচা রোগ সারাতে বিফল । হিমঘরের বাইরে পচা আলুর কাই কেঁখে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়েছিল । দুর্গন্ধ আর একরোখা মাছি যায়নি তবু । পচা আলুর গ্যাস বের করতে ছেঁদা করা হয়েছে দেয়াল । তবু হিমঘরে গুমরে মরছে পচা আলুর শবের বদগন্ধ । কলকাতায় তখুন বিদেশি সিনেমার উৎসব চলছে ।

আর যেটুক বেরোতে পেরেচে, বলেছিল বালিকুখাড়ির লুৎফর রহমান, এমনভাবে চাষিবাড়ির ছেল্যামেয়্যার পেচনে লেগেচে বাবু, যে ওঝা ডেকেও ছাড়চেনে । বিষ্টি পড়লে আর দেকতে হবেনে । আলুর গুয়ের বান ডাকবে । নিমাই ঢোলের মিষ্টির দোকান একমাস বনদো ।

কালনার বংশীধর হিমঘরে বীজ আলু পচে গেছে । হিমঘরের ভাড়া জমা দিয়ে গেটপাস পাবার পরও বীজ আলু দিলে না । অ্যাতোটা পথ এসে চোপোররাত হয়রানি । একদিন তো চারঘন্টা রাস্তা অবরোধ হল । হয় বীজ দাও নইলে দাম দাও । হিমঘরের চাকরে বাবুরা গণপিটুনির ভয়ে টেবিলে খোলা কলম ফেলে হাওয়া । শয়ে-শয়ে চাষি জড়ো হচ্ছে আর গলার শিরা ফোলাচ্চে । ভবভূতি কপালি জমি তৈরি করে, ছেলেকে বীজ আনতে পাঠিয়েছিল । শক্তি সরকার পাওয়ার টিলার ভাড়া নিয়ে, জমিকে দিন দশবারো পতিত রেখে, জল কমপোস্ট রেড়ির খোল নিমের খোল দিয়ে, জো বুঝে মাটি ভেঙে আলু বোনার নালা কেটে ফেলেছিল । অলদ্রিন আর ব্রাসিকল এনে রেখেছে । তারপরই বজ্রপাতের মতন সর্বনাশা খবর । আলুর মড়কে বীজ নষ্ট । দিন দশের মধ্যে না পাতলে ফলন হবে না ।

দুজনেরই করোনারি থ্রমবোসিস, আলুপচা রোগে, বললে সদর হাসপাতালের ডাক্তার ।

মুটিয়া মজুর সর্দারদের ভাগ্য আর কমিশন থেকে কাটমানির নিষ্পত্তি না হওয়ায় বীজের আলু বাইরেই পড়েছিল টানা পনেরো দিন । বীজ আলু হল চাঁপা ফুলের পাপড়ি । অযত্ন ওদের সহ্য হয় না । তিন নম্বর চেম্বারে তিরিশ হাজার প্যাকেট বীজ আলু নষ্ট হল । এক চাষির বীজ অন্যকে দিয়ে যদ্দিন চলে চালিয়েছে । দিতে-দিতে ফুরিয়ে গিসলো । আলুর অদেষ্ট, চাষির অদেষ্ট ।

কিন্তু আলুর গপ্পো নিয়ে তুই কী করবি রে ? বলল খুশিরানি মণ্ডল ।

ভবেশকা  অ্যাতো সম্পত্তি আর টাকা নিয়ে কী করবে, বলো তুমি, অ্যাঁ ? সেই ভবেশকার এমন ভুঁড়িটুড়ি, ঠাকুরদেবতা, ঝাড়ফুঁক, দলাদলি, ওফ, আমি তো ভাবতেই পারি না । ট্র্যামের ভাড়া এক পয়সা বেড়েছিল বলে, আর আলু পাওয়া যাচ্ছিল না বলে, কী-ই না করেছিল ভবেশকা । ভবেশকাকে দেখছি আর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে । গেরুয়া, বাবরিচুল, সত্য সাঁইবাবা, মাদুলি, গোমেদের আঁটি । আধুনিক লোকটার তো দফারফা । কেন, অ্যাঁ, কেন ?

যিশু জানে খুশিদি অবোধ, নিষ্পাপ, অজ্ঞান, তাই নির্বাক ।

তোমার জন্মের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভবেশকা তোমায় একটা ভারি কালো লোহার শেকলে আষ্টেপৃষ্টে আগলে রেখেছে, রুমালে চোখ বেঁধে । কত চাষির আলু নিশ্চিন্তে পচিয়ে ফেললে ভবেশকা । পঞ্চায়েতের যে পঁচাত্তর শতাংশ বন্ড তা-ও গোলমাল হয়েছে, কালোবাজার হয়েছে, আর মালিকদের কুড়ি শতাংশ তো সোজা বেচে দিয়েছে পাকাবাজারে । এমনকী চাষির বন্ডেও ভবেশকার সই না থাকলে হিমঘরে তোলা যাবে না । সেই ভবেশকা, ভাবতে পারো তুমি ! বুকের মধ্যে চব্বিশঘন্টা বারোভুতের মেলা চলছে ভবেশকার ।

জানি । খুশিদির চোখের পাতা কাঁপে ।

খুশিদি কেঁদে ফেলবে । যিশুর হৃৎপিণ্ডের কপাটক ফরফর শব্দ করে নিঃশব্দে । ভবেশকার প্রসঙ্গ পালটায় । বুঝলে, বীরভূমে ষাটপলসা হিমঘর চালানো নিয়ে সে কী খেওখেয়ি । হিমঘর সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ দাশ আর বাদবাকি সদস্য রেবতী ভট্টাচার্য, অম্বিকা দত্ত, জনার শেখ এরা হল ফরোয়ার্ড ব্লকের, কিন্তু আরেক সদস্য মিনতি ঘোষ, যিনি পঞ্চায়েত প্রধান, তিনি সিপিয়েমের । সমবায়ের পাঁচ লাখ টাকার হিসেব মিলছে না অভিযোগ তুলে বিশ্বনাথ দাশ বরখাস্ত করলে সহকারি ম্যানেজার শিশির ঘোষ আর ক্যাশিয়ার বৈদ্যনাথ মণ্ডলকে । ব্যাস, আর দ্যাখে কে ; বেঁধে গেল দু-দলের কাজিয়া । ময়ূরেশ্বরের সিপিয়েম সভাপতি ত্রিপুরেশ্বর মণ্ডল দখল নিলে চেয়ারম্যানের কুরসি । আদালতের হুকুমে বিশ্বনাথ দাশ ফিরে পেয়েছে চেয়ার । এই আলুমন্হনের বিষের ভাগটা চাষিদের ।

জানি, এখানেও সিপিয়েম, তৃণমূল, কংরেস আর বিজেপি হয়েচে । সবাই মিলে একটা নাম নিলেই তো হয় । চাপা কান্নায় খুশিদির অন্যমনস্ক কন্থস্বরে ভাঙন ।

গল্পের রেশ থামলে খুশিদির আপ্রাণ ধরে রাখা অশ্রুবিন্দু টপ করে ঝরে পড়বে আর যিশু চেতনায় ঘটে যাবে বিস্ফোরণ । কথা বলা বজায় রাখে ও, যিশু । পুরশুড়ার হরপার্বতী হিমঘরে কী হয়েছে জানো না ? দেড় কোটি টাকার আলু পচিয়ে, বিদ্যুৎ পর্ষদের কয়েক লক্ষ টাকার বিল না মিটিয়ে, পুরোনো মালিকরা নতুন এক ব্যাবসাদারকে চুপচাপ হিমঘর বেচে দিয়ে পালিয়েছে । চাষিদের ক্ষতিপূরণ যে কে দেবে বা আদৌ দেবে কিনা, কেউ জানে না । নতুন মালিক পচা আলু বাইরে বের করে পোড়াচ্ছিল । সেই তেল-চিটচিটে ধোঁয়ায় গোলাপজাম আর জামরুল ওব্দি পাকা জামের মতন কালো হয়ে গেছে । পুরশুড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পতিতপাবন জানা শেষে গিয়ে আলু পোড়ানো বন্ধ করলে ।

খুশিদির ম্লান মুখাবয়বে তবু পরিবর্তন নেই ।

যিশু বলল, এবছর মোহনবাটির হিমঘরে অ্যামোনিয়ার ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে সোমথ্থ পাটগাছগুলো অজ্ঞান হয়ে গিসলো । খুশিদির ভাব পাল্টাচ্ছে না দেখে যিশু দুবাহু ধরে চোখে চোখ মেলে জানায়, মিছেই এসব গল্প করছি । তুমি কি কিছু বলবে ? খুশিদি ? বলবে কিছু ?

Leave a comment